হাবাশার বাদশা নাজাশী ও জা‘ফর ইবনু তালিবের মাঝে ঐতিহাসিক কথোপকথন

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 924 বার পঠিত

[রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী জীবনে কুরাইশদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করে। সেখানে বাদশা নাজাশী এবং ছাহাবী জা‘ফর ইবনু তালিবের মধ্যে যে ঐতিহাসিক আলাপচারিতা হয়েছিল, তাতে তাওহীদ ও শিরক এবং ইসলাম ও কুফরের স্বরূপ অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। অথচ শত আফসোস! যে ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জন্য মুসলমানরা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে; আপন বাপদাদা, ভাইবোনকে পরিত্যাগ করেছে; জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও শিরকী মূর্তিপূজাকে বির্সজন দিয়েছে; সেই মুসলমানের আজ কি ধরণের পদস্খলন! আবার তারা শিরক, বিদ‘আত, মূর্তি ও মাজার পূজাকে নিজেদের আদর্শ ও ঐতিহ্য বলে গর্ব করছে। যে মূর্তি মুসলমান ভেঙ্গে চুরমার করেছে, আজকে তারা মূর্তি বানানোর শয়তানী ফাঁদে পা দিয়ে ঈমান ও আমল সর্বস্ব হারাচ্ছে এবং যাবতীয় অন্যায় ও অপকর্মে হাবুডুবু খাচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাদশা নাজাশী ও জা‘ফর ইবনু আবী তালিবের সেই ঐতিহাসিক কথোপকথনটি পাঠক খেদমতে পেশ করা হ’ল]

কাহিনীর সূত্রপাত : আবিসিনিয়ায় যাতে মুসলমানগণ শান্তিতে থাকতে না পারে, সেজন্য কুরায়েশ নেতারা তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র করল। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা কুশাগ্রবুদ্ধি কুটনীতিবিদ আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে দায়িত্ব দিল। তারা মহামূল্য উপঢৌকনাদি নিয়ে হাবশা যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে প্রথমে খ্রিষ্টানদের নেতৃস্থানীয় ধর্মনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের ক্ষুরধার যুক্তি এবং মূল্যবান উপঢৌকনাদিতে ভুলে দরবারের পাদ্রী নেতারা একমত হয়ে যান। পরের দিন আমর ইবনুল ‘আছ উপঢৌকনাদি নিয়ে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তারা বললেন, হে বাদশাহ! আপনার দেশে আমাদের কিছু অজ্ঞ-মূর্খ ছেলে-ছোকরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যারা তাদের কওমের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে এবং তারা আপনাদের ধর্মেও প্রবেশ করেনি। তারা এমন এক নতুন দ্বীন নিয়ে এসেছে, যা আমরা কখনো শুনিনি বা আপনিও জানেন না। আমাদের কওমের নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে আপনার নিকটে পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি তাদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফেরৎ পাঠান। তাদের কথা শেষ হ’লে উপস্থিত পাদ্রীনেতাগণ কুরায়েশ দূতদ্বয়ের সমর্থনে মুহাজিরগণকে তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য বাদশাহকে অনুরোধ করেন। তখন বাদশাহ রাগতঃস্বরে বলেন, আল্লাহর কসম! এটা কখনোই হ’তে পারে না। তারা আমার দেশে এসেছে এবং অন্যদের চাইতে আমাকে পসন্দ করেছে। অতএব তাদের বক্তব্য না শুনে কোনরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।

মূল ঘটনা : 

নাজাশীর নির্দেশক্রমে জা‘ফর বিন আবু তালিবের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু সিজদা করলেন না। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা প্রথানুযায়ী আমাকে সিজদা করলে না কেন? যেমন ইতিপূর্বে তোমাদের কওমের প্রতিনিধিদ্বয় এসে করেছে? বাদশাহ আরও বললেন, বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে এমনকি আমাদের ধর্ম গ্রহণ না করে নতুন যে ধর্মে তোমরা দীক্ষা নিয়েছ, সেটা কী, আমাকে শোনাও!’

জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জা‘ফর বললেন, আমাদের মধ্যকারই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষনবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’। তিনি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হ’তে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি। এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন। সেকারণ বাধ্য হয়ে আমরা সবকিছু ফেলে আপনার রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছি আপনার সুশাসনের খবর শুনে। আমরা অন্যস্থান বাদ দিয়ে আপনাকে পসন্দ করেছি এবং আপনার এখানেই আমরা থাকতে চাই। আশা করি আমরা আপনার নিকটে অত্যাচারিত হব না’।

অতঃপর জাফর বললেন, হে বাদশাহ! অভিবাদন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের জানিয়েছেন যে, জান্নাত বাসীদের পরস্পরে অভিবাদন হ’ল ‘সালাম’ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে পরস্পরে ‘সালাম’ করার নির্দেশ দিয়েছেন’।

বাদশাহ বললেন, ঈসা ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও? উত্তরে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব সূরা মারিয়ামের শুরু থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতগুলি পাঠ করে শুনান। যেখানে হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আঃ)-এর বিবরণ,  মারিয়ামের প্রতিপালন, ঈসার জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন, মাতৃক্রোড়ে কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। বাদশাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাওরাত-ইঞ্জীলে পন্ডিত ব্যক্তি। কুরআনের অপূর্ব বাকভঙ্গি, শব্দশৈলী ও  ভাষালংকার এবং ঘটনার সারবত্তা উপলব্ধি করে বাদশাহ অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলেন। সাথে উপস্থিত পাদ্রীগণও কাঁদতে লাগলেন। তাদের চোখের পানিতে তাদের হাতে ধরা ধর্মগ্রন্থগুলি ভিজে গেল। অতঃপর নাজাশী বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই এই কালাম এবং ঈসার নিকটে যা নাযিল হয়েছিল দু’টি একই আলোর উৎস থেকে নির্গত’। বলেই তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আল্লাহর কসম! আমি কখনোই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না’।

আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহ দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমর বললেন, কালকে এসে এমন কিছু কথা বাদশাহকে শুনাবো, যাতে এদের মূলোৎপাটন হয়ে যাবে এবং এরা ধ্বংস হবে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, না, না এমন নিষ্ঠুর কিছু করবেন না। ওরা আমাদের স্বগোত্রীয় এবং নিকটাত্মীয়। কিন্তু আমর ওসব কথায় কর্ণপাত করলেন না।

পরের দিন বাদশাহর দরবারে এসে তিনি বললেন, ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে ভয়ংকর সব কথা বলে থাকে’। একথা শুনে বাদশাহ মুসলমানদের ডাকালেন। মুসলমানেরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা নাছারারা ঈসাকে উপাস্য মানে। কিন্তু মুসলমানরা তাকে ‘আল্লাহর বান্দা’ (عَبْدُ الله) বলে থাকে। যাই হোক কোনরূপ দ্বৈততার আশ্রয় না নিয়ে তারা সত্য বলার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করে দিয়ে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন,هُوَ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ وَرُوحُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إلَى مَرْيَمَ الْعَذْرَاءِ الْبَتُولِ ولم يَمَسُّها بَشَرٌ ‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত রূহ এবং তাঁর নির্দেশ। যা তিনি মহীয়সী কুমারী মাতা মারিয়ামের উপরে ফুঁকে দিয়েছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাকে স্পর্শ করেনি’। তখন নাজাশী মাটি থেকে একটা কাঠের টুকরা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি যা বলেছ, ঈসা ইবনে মারিয়াম তার চাইতে এই কাষ্ঠখন্ড পরিমাণও বেশী ছিলেন না’। তিনি জাফর ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যাও! তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দিবে, তার জরিমানা হবে (৩বার)। তোমাদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে যদি কেউ আমাকে স্বর্ণের পাহাড় এনে দেয়, আমি তা পসন্দ করব না’। অতঃপর তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ফেরৎ দানের নির্দেশ দিলেন।

ঘটনার বর্ণনাদানকারিণী প্রত্যক্ষ সাক্ষী হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) (পরবর্তীকালে উম্মুল মুমেনীন) বলেন, ‘অতঃপর ঐ দু’জন ব্যক্তি চরম বেইযযতির সাথে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল... এবং আমরা উত্তম প্রতিবেশীর সাথে উত্তম গৃহবাসীরূপে বসবাস করতে থাকলাম’ (ইবনু হিশাম ১/৩৩৩-৩৮; আহমাদ হা/১৭৪০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১১৫, সনদ ছহীহ)। ফালিল্লাহিল হাম্দ



আরও