পরহেযগারিতা (২য় কিস্তি)

মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান 1478 বার পঠিত

পর্ব ১। 

প্রকাশ্যে ও গোপনে পরহেযগারিতা অর্জন করা :

পরহেযগারিতা নামক এই মহৎ গুণটি সর্বাবস্থায় রাখতে হবে। যেমনটি হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তার সাথীদের নিয়ে একদিন মদীনার অদূরে কোন এক প্রান্তে মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বের হন। স্থানীয় লোকেরা তাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে এবং তাদের জন্য খাওয়ার দস্তরখান বিছিয়ে দেয়। তারা সকলেই খাওয়ার দস্তরখানে বসল। এমতাবস্থায় একজন ছাগলের রাখাল তাদের সালাম দিল। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) রাখালকে বলল, হে রাখাল! তুমি আস, আমাদের সাথে খাওয়াতে শরিক হও। সে বলল, না আমি খাব না; আমি ছিয়াম রত অবস্থায় আছি। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) রাখালকে বলল, তুমি এ প্রচন্ড গরমের দিনে ছিয়াম রাখছ এবং ছিয়াম অবস্থায় এ পাহাড়ের পাদদেশে ছাগল চরাচ্ছ? আব্দুল্লাহ ইবনু ওমরের কথার উত্তরে সে বলল, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি সেদিনের জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছি যেদিন আমাদের খালি হাতে একত্র হ’তে হবে। একমাত্র আমল ব্যতীত আমাদের আর কিছুই থাকবে না। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) তাকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বললেন, তুমি আমাদের নিকট তোমার এ ছাগলগুলো হ’তে একটি ছাগল বিক্রি করবে? যদি বিক্রি কর, আমরা তোমাকে ছাগলের মূল্য দিব এবং যবেহ করে তোমার জন্য গোশত দিব, যাতে তুমি গোশত দিয়ে ইফতার করতে পার। তখন সে বলল, এখানে যে ছাগলগুলো দেখছেন, তার একটিও আমার ছাগল নয়, এগুলো সব আমার মনিবের। ইবনু ওমর (রাঃ) রাখালকে বললেন, যখন তুমি একটি ছাগল হারিয়ে ফেল, তখন তোমার মনিবের আর কিছুই করার থাকবে না। তুমি বলবে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে। এ কথা শুনে রাখালটি আকাশের দিকে হাত উঁচু করে এ কথা বলতে বলতে দৌড় দিল, আল্লাহ কোথায়? আল্লাহ কোথায়? অতঃপর ইবনু ওমর (রাঃ) রাখালের কথাটি বলতেন এবং স্বরণ করতেন। তিনি যখন মদীনায় ফিরে আসেন তখন তার (রাখালের) মনিবকে ডেকে পাঠালেন এবং তার থেকে তার ছাগলগুলো এবং রাখালকে কিনে নিলেন, তারপর রাখালকে মুক্ত করে দিলেন এবং তাকে ছাগলগুলো দিয়ে দিলেন’।[1]

মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারির পরিবর্তন হয়। মানুষের অবস্থার প্রেক্ষাপটে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারির সংজ্ঞা ও অবস্থার পরিবর্তন হয়। একজন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, মান-মর্যাদা ও বয়স ইত্যাদি ভেদাভেদের কারণে পরহেযগারিতার ভেদাভেদ বা পার্থক্য হয়।

যারা বয়সে ছোট তাদের পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী হ’ল, বড়দের কর্মকান্ড নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তাদের কোন বিষয়ে তারা কোন মতামত দিবে না। আর যারা বড়, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তাদের পরহেযগারিতা হ’ল, চুপ করে না থাকা। তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করবে এবং যারা দায়িত্বশীল তাদের সঠিক পরামর্শ দিবে। যাতে তারা কোন ভুল সিদ্ধান্ত জাতির উপর চাপিয়ে দিতে না পারে।

অনুরূপভাবে একজন জাহেল (মূর্খ) ও আলেমের পরহেযগারিতা এক হ’তে পারে না। আল্লামা হুবাতুল্লাহিল মুক্বরী (রহঃ) বলেন, مِنْ وَرْعِ الْعَالِمِ أَنْ يَّتَكَلَمَ وَمِنْ وَرْعِ الْجٰاهِلِ أَنْ يَّسْكُتَ ‘একজন আলেমের পরহেযগারিতা হ’ল, প্রয়োজনের সময় কথা বলা। আর একজন জাহেলের (মূর্খের) পরহেযগারিতা হ’ল, চুপ থাকা’।[2] 

আল্লামা ইবনু ও‘আইনা (রহঃ)-কে পরহেযগারিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, উত্তরে তিনি বলেন, اَلْوَرْعُ طَلَبُ الْعِلْمِ الذَّيْ يَعْرِفُ بِهِ اَلْوَرْعَ وَهُوَ عِنْدَ قَوْمُ طُوْلُ الصَّمْتِ وَقِلَّةِ الْكَلَامِ وَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِنِ الْمُتَكَلِّمُ الْعَالِمِ أَفْضَلُ عِنْدِيْ وَأَوْرَعَ مِنَ الْجَاهِلِ الصَّامِتِ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, যে ইলম বা জ্ঞান দ্বারা দ্বীনদারিকে জানা যায়, সে ইলমের অনুসন্ধান করা। আর তা হ’ল, কারো কারো মতে অধিক চুপ থাকা এবং কথা কম বলা। অনুরূপভাবে তিনি আরো বলেন, একজন জ্ঞানী যে কথা বলে, সে আমার নিকট একজন জাহেল বা মূর্খের থেকে উত্তম যে কথা না বলে চুপ থাকে।[3] 

ইলম ও পরহেযগারিতা :

পরহেযগারিতা এটি নিঃসন্দেহে অন্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল বা মহান কর্ম। যারা পরহেযগার তাদের মর্যাদা অধিক। তবে ইলম ব্যতীত কখনোই পরহেযগারিতা অর্জন করা যায় না।

আল্লামা আবু মাসঊদ (রহঃ) বলেন, إِنَّ التَّوَرَّعَ عَنْ مَحَارِمِهِ سُبْحَانَهُ مَوْقُوْفٌ عَلٰى مَعْرِفَةِ الْحَلَالِ وَالْحَرَامِ اَلْمَنُوْطُ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ ‘আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকাটা নির্ভর করছে হালাল-হারাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকার উপর। কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম তা জানতে না পারলে হালাল-হারাম বেঁচে চলা সম্ভব নয়। আর হালাল-হারাম সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ’।[4] 

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, পরহেযগারিতার পূর্ণতা হ’ল, একজন মানুষ ভালোর ভালোত্বকে জানা এবং খারাপের খারাপিকে জানা। আর এ কথা অবশ্যই জানা থাকতে হবে, ইসলামী শরী‘আতের ভিত্তি হ’ল, কল্যাণ লাভকে নিশ্চিত করা এবং কল্যাণকে পূর্ণতায় পৌঁছানো এবং সব ধরনের ক্ষতিকে প্রতিহত করা এবং যথাসম্ভব তা দমিয়ে রাখা। অন্যথায় যে লোক কাজ করা ও না করার মধ্যে ভালো-মন্দ তারতম্য করতে পারে না এবং কোনটির মধ্যে ইসলামী শরী‘আতে কল্যাণ রেখেছে আর কোনটির মধ্যে ইসলামী শরী‘আত অকল্যাণ বা ক্ষতি রেখেছে তার বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে না, তার অবস্থা এমন হবে সে কোনো সময় যা করা ওয়াজিব তা ছেড়ে দিবে আর যা করা হারাম বা নিষিদ্ধ তা করে বসবে। আবার কোনো সময় কোন কাজকে সে তাক্বওয়া মনে করবে কিন্তু বাস্তবে তা তাক্বওয়া নয়, বরং ইসলামী শরী‘আতের পরিপন্থী। যেমন অনেক লোকে দেখা যায় তারা যালিম বা অত্যাচারী শাসকের সাথে একত্র হয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয়, তারা মনে করে এটা পরহেযগারি বা বুজুর্গি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, যেমন- কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থায় কতিপয় মুসলিম সৈন্য তাদের আমীরের বা শাসকের নিকট এসে দেখতে পেল সে কোন শরী‘আত বিরোধী কাজে লিপ্ত, তখন তারা তার অবস্থা দেখে বলল, আমরা এ ফাসেক বা পাপাচারীর সাথে থেকে যুদ্ধ করতে রাযী না। এই বলে তারা যদি যুদ্ধ করা হ’তে বিরত থাকে তাহলে কি লাভ হবে? এ ধরনের ভ্রান্ত তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতার কারণে দুশমনরা এসে শহরকে দখল করে নিবে এবং মুসলিমদের বিপর্যয় নেমে আসবে! অর্থাৎ যার পরিণতি কারোর জন্যই শুভকর হবে না। পরহেযগারিতা অবলম্বন করার জন্য সময় সুযোগ বুঝতে হবে। আর এসব বুঝার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও দক্ষতা।

ইলম বা জ্ঞানহীন পরহেযগারির বা দ্বীনদারের আরেক দৃষ্টান্ত হ’ল, একজন ব্যক্তির পিতা মারা যাওয়ার পর তার কিছু সন্দেহযুক্ত সম্পদ রয়েছে; অর্থাৎ যেগুলো তার পিতা দুনিয়াতে রেখে গেছে। সাথে সাথে তার এমন কতিপয় পাওনাদার রয়েছে, যারা তার নিকট টাকা পাবে। তারপর লোকেরা যখন তার ছেলের নিকট এসে তাদের পাওনা দাবি করে, তখন সে বলে, আমি সন্দেহযুক্ত সম্পদ হ’তে আমার পিতার দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হ’তে বিরত থাকতে চাই।

এ ধরনের পরহেযগারিতা ফাসেদ বা ভ্রান্ত এবং যারা এ ধরনের পরহেযগারিতা অবলম্বন করে তারা জাহেল বা মূর্খ। কেননা সে তার পিতার সম্পদে সন্দেহ রয়েছে এ কথা বলে মানুষের অধিকার বা পাওনা পরিশোধ করা ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ মানুষের পাওনা পরিশোধ করা তার উপর ওয়াজিব।

জ্ঞান না থাকা মানুষকে অনেক ভালো কাজ হ’তে বঞ্চিত করে। কারণ, তারা মনে করে, এ ধরনের কাজ না করাটাই পরহেযগারিতা। অতঃপর ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, وَيَدَعُ الْجُمْعَةَ وَالْجَمَاعَةَ خَلْفَ الْأَئِمَّةِ الَّذِينَ فِيهِمْ بِدْعَةٌ أَوْ فُجُورٌ وَيَرَى ذَلِكَ مِنْ الْوَرَعِ وَيَمْتَنِعُ عَنْ قَبُولِ شَهَادَةِ الصَّادِقِ وَأَخْذِ عِلْمِ الْعَالِمِ لِمَا فِي صَاحِبِهِ مِنْ بِدْعَةٍ خَفِيَّةٍ وَيَرَى تَرْكَ قَبُولِ سَمَاعِ هَذَا الْحَقِّ الَّذِي يَجِبُ سَمَاعُهُ مِنْ الْوَرَعِ . ‘অনেক লোককে দেখা যায়, তারা যেসব ইমামদের মধ্যে কোন প্রকার বিদ‘আত বা অন্যায় দেখতে পায়, তাদের পিছনে জামা‘আতে ছালাত ও জুম‘আর ছালাত আদায় করা ছেড়ে দেয়। তারা মনে করে তাদের পিছনে ছালাত আদায় করার চেয়ে একা ছালাত আদায় করা পরহেযগারিতা। কিন্তু তাদের এ ধরনের ধারণা কুরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিপরীত। অনুরূপভাবে যখন কোন আলেমের মধ্যে কোন গোপন বিদ‘আত পরিলক্ষিত হয় বা কোন সঠিক সাক্ষ্যদাতা তার মধ্যে কোন ত্রুটি দেখা যায়, তখন তাদের থেকে ইলম অর্জন করা ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হ’তে বিরত থাকে। তারা মনে করে তাদের থেকে হক কথা শুনে গ্রহণ করা ছেড়ে দেয়া হ’ল পরহেযগারিতা। অথচ হক কথা শুনেও তা গ্রহণ করা ওয়াজিব।[5]

সালাফে ছালেহীনদের পরহেযগারিতার কতিপয় দৃষ্টান্ত :

নবী করীম (ছাঃ)-এর পরহেযগারিতা :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ أَخَذَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ فَجَعَلَهَا فِي فِيهِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كِخْ كِخْ لِيَطْرَحَهَا ثُمَّ قَالَ أَمَا شَعَرْتَ أَنَّا لَا نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসান ইবনু আলী (রাঃ) ছাদাক্বার একটি খেজুর নিয়ে মুখে দিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তা ফেলে দেয়ার জন্য ‘ওয়াক’ ‘ওয়াক’ (বমির পূর্বে আওয়াযের মত) বললেন। অতঃপর বললেন, তুমি কি জান না যে, আমরা ছাদাক্বাহ ভক্ষণ করি না।[6] 

তিনি তাঁর নাতিকে যে খেজুর খাওয়া বৈধ না তা ধরতে নিষেধ করতেন। অথচ সে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও ছোট ছেলে, শরী‘আত মানতে বাধ্য নয়।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنِّي لَأَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِي فَأَجِدُ التَّمْرَةَ سَاقِطَةً عَلَى فِرَاشِي فَأَرْفَعُهَا لِآكُلَهَا ثُمَّ أَخْشَى أَنْ تَكُونَ صَدَقَةً فَأُلْقِيهَا আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, আমি আমার ঘরে ফিরে যাই, আমার বিছানায় খেজুর পড়ে থাকতে দেখি। খাওয়ার জন্য আমি তা তুলে নেই। পরে আমার ভয় হয় যে, হয়ত তা ছাদাক্বার খেজুর হবে তাই আমি তা রেখে দেই’।[7]

আমাদের সালাফে ছালেহীনদের মধ্যে অনেকেই পরহেযগারিতার গুণে গুণান্বিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কখনোই নিজেদের পরহেযগার হিসাবে দাবি করতেন না, বরং তারা তাদের থেকে এ ধরনের কোন গুণকে প্রত্যাখ্যান করতেন। কেননা তারা জানতেন পরহেযগার হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ; পরহেযগার হ’তে হলে অনেক সাধনা বা অনেক কষ্ট করতে হয়।

আল্লামা শা‘বী (রহঃ) বলতেন, يَا مَعْشَرَ الْعُلَمَاءِ يَا مَعْشَرَ الْفُقَهَاءِ لَسْنَا بِفُقَهَاءِ وَلَا عُلَمَاءِ وَلَكِنَّا قَوْمَ قَدْ سَمِعْنَا حَدِيْثًا فَنَحْنُ نُحَدِّثُكُمْ بِمَا سَمِعْنِا إِنَّمَا الْفَقِيْهُ مَنْ وَرَعَ عَنْ مَحَارِمِ اللهِ وَالْعَالِمُ مَنْ خَافَ اللهَ ‘হে আলেম সম্প্রদায়! হে ফকীহ সম্প্রদায়! তোমরা মনে রাখবে, আমরা আলেম কিংবা ফকীহ কোনটিই নই, বরং আমরা হলাম এমন সম্প্রদায়ের লোক, যারা একটি হাদীছ শুনেছি তারপর আমরা যা শুনলাম তা তোমাদের নিকট বর্ণনা করলাম। ফকীহ তো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ তা‘আলা যা নিষেধ করেছেন, তা হ’তে বিরত থাকে। আর আলেম তো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে’।[8] 

নিমেণ সালাফে ছালেহীনদের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতার কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اشْتَرَى رَجُلٌ مِنْ رَجُلٍ عَقَارًا لَهُ فَوَجَدَ الرَّجُلُ الَّذِي اشْتَرَى الْعَقَارَ فِي عَقَارِهِ جَرَّةً فِيهَا ذَهَبٌ فَقَالَ لَهُ الَّذِي اشْتَرَى الْعَقَارَ خُذْ ذَهَبَكَ مِنِّي إِنَّمَا اشْتَرَيْتُ مِنْكَ الْأَرْضَ وَلَمْ أَبْتَعْ مِنْكَ الذَّهَبَ فَقَالَ الَّذِى شَرَى الأَرْضَ إِنَّمَا بِعْتُكَ الْأَرْضَ وَمَا فِيهَا (فكل منهما تورع عن أخذ الذهب) قَالَ فَتَحَاكَمَا إِلَى رَجُلٍ فَقَالَ الَّذِي تَحَاكَمَا إِلَيْهِ أَلَكُمَا وَلَدٌ؟ فَقَالَ أَحَدُهُمَا لِي غُلَامٌ وَقَالَ الْآخَرُ لِي جَارِيَةٌ قَالَ أَنْكِحُوا الْغُلَامَ الْجَارِيَةَ وَأَنْفِقُوا عَلَى أَنْفُسِهِمَا مِنْهُ وَتَصَدَّقَا আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির নিকট থেকে এক খন্ড জমি ক্রয় করে। যে ব্যক্তি জমি ক্রয় করেছিল সে তার কেনা সম্পত্তিতে একটি কলসি পেল। তাতে স্বর্ণ ছিল। যে ব্যক্তি জমি ক্রয় করেছিল সে বিক্রেতাকে বলল, তুমি আমার নিকট থেকে তোমার স্বর্ণ বুঝে নাও। আমি তো তোমার নিকট থেকে জমি ক্রয় করেছি, স্বর্ণ ক্রয় করিনি। তখন যে ব্যক্তি সম্পত্তি বিক্রি করেছিল সে বলল, আমি তো তোমার নিকট জমি এবং জমির মধ্যে যা কিছু আছে সবই বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়েই এক ব্যক্তির নিকট গিয়ে ফায়ছালা চাইল। তখন সে বলল, তোমাদের কি কোন সন্তান আছে? তাদের একজন বলল যে, আমার একটি ছেলে আছে এবং অপর জন বলল, আমার একটি মেয়ে আছে। তখন তিনি বললেন, তোমার ছেলেটিকে (তার) মেয়েটির সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দাও এবং এ উপলক্ষে তোমরা তোমাদের উপর তা ব্যয় কর এবং এ থেকে ছাদাক্বাহ কর’।[9]

ছাহাবায়ে কেরামের পরহেযগারিতা

আবু বকর (রাঃ)-এর পরহেযগারিতা :

আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতার স্থান আকাশচুম্বী। তার তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা একেবারে চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছিল। নবী ও রাসূলদের পর তাঁর স্থান সকল মানুষের শীর্ষে। তাঁর সমকক্ষ আর কেউ হ’তে পারবে না।

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلَامٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلَامُ أَتَدْرِي مَا هَذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ؟ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ إِلَّا أَنِّي خَدَعْتُهُ فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذَلِكَ فَهَذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنِهِ আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ)-এর একজন ক্রীতদাস ছিল। সে প্রতিদিন তার উপর ধার্য কর আদায় করত। আর আবু বকর (রাঃ) তার দেওয়া কর হ’তে আহার করতেন। একদিন সে কিছু খাবার জিনিস এনে দিল। তা হ’তে তিনি আহার করলেন। তারপর ক্রীতদাস বলল, আপনি জানেন কি ওটা কিভাবে উপার্জন করা হয়েছে যা আপনি খেয়েছেন? তিনি বললেন, বলত, কিভাবে? ক্রীতদাস উত্তরে বলল, আমি জাহেলী যুগে এক ব্যক্তির ভবিষ্যৎ গণনা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ভবিষ্যৎ গণনা আমার ভালভাবে জানা ছিল না। তথাপি প্রতারণা করে তা করেছিলাম। আমার সাথে তার দেখা হলে গণনার বিনিময়ে এ দ্রব্যাদি সে আমাকে হাদিয়া দিল যা হ’তে আপনি আহার করলেন। আবু বকর (রাঃ) এটা শুধুমাত্র মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং পেটের ভিতর যা কিছু ছিল সবই বমি করে দিলেন’।[10]

ওমর ফারুক (রাঃ)-এর তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা :

عن ابن عمر رضي الله عنها عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ فَرَضَ لِلْمُهَاجِرِينَ الْأَوَّلِينَ أَرْبَعَةَ آلَافٍ فِي أَرْبَعَةٍ وَفَرَضَ لِابْنِ عُمَرَ ثَلَاثَةَ آلَافٍ وَخَمْسَ مِائَةٍ فَقِيلَ لَهُ هُوَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ فَلِمَ نَقَصْتَهُ مِنْ أَرْبَعَةِ آلَافٍ فَقَالَ إِنَّمَا هَاجَرَ بِهِ أَبَوَاهُ يَقُولُ لَيْسَ هُوَ كَمَنْ هَاجَرَ بِنَفْسِهِ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্নিত, তিনি তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তিনি প্রাথমিক পর্যায়ের মুহাজিরদের জন্য চার কিস্তিতে বাৎসরিক চার হাজার দিরহাম (টাকা) ধার্য করলেন এবং ইবনে ওমরের জন্য নির্বাচন করলেন তিন হাজার পাঁচশ। তাঁকে বলা হ’ল, তিনিও তো মুহাজিরদের। তাঁর জন্য চার হাজার হ’তে কম কেন করলেন? তিনি বললেন, সে তো তার পিতা-মাতার সাথে হিজরত করেছে। কাজেই সে ঐ লোকদের সমান হ’তে পারে না যে লোক একাকী হিজরত করেছে’।[11]

কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) ছোট ছিলেন। তাই তাকে তার মাতা-পিতা উভয়ে হিজরত করান। এ কারণে তাকে যারা ইসলামের প্রথম যুগে হিজরত করেছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন নি।

قَالَ ثَعْلَبَةُ بْنُ أَبِي مَالِكٍ إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَسَمَ مُرُوطًا بَيْنَ نِسَاءٍ مِنْ نِسَاءِ الْمَدِينَةِ فَبَقِيَ مِرْطٌ جَيِّدٌ فَقَالَ لَهُ بَعْضُ مَنْ عِنْدَهُ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ أَعْطِ هَذَا ابْنَةَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّتِي عِنْدَكَ يُرِيدُونَ أُمَّ كُلْثُومٍ بِنْتَ عَلِيٍّ فَقَالَ عُمَرُ أُمُّ سَلِيطٍ أَحَقُّ وَأُمُّ سَلِيطٍ مِنْ نِسَاءِ الْأَنْصَارِ مِمَّنْ بَايَعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ عُمَرُ فَإِنَّهَا كَانَتْ تَزْفِرُ لَنَا الْقِرَبَ يَوْمَ أُحُدٍ সা‘লাবা ইবনু আবী মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) মদীনার কিছু সংখক মহিলার মধ্যে কয়েকখানা (রেশমী) চাদর বন্টন করেন। অতঃপর একটি ভাল চাদর রয়ে গেল। তাঁর নিকট উপস্থিত একজন তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এ চাদরটি আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নাতনী উম্মু কুলসুম বিনতে আলী (রাঃ) যিনি আপনার নিকট আছেন, তাকে দিয়ে দিন। ওমর (রাঃ) বললেন, উম্মু সালীত (রাঃ) এই চাদরটির অধিক হকদার। উম্মু সালীত (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আতকারিণী আনছার মহিলাদের একজন। ওমর (রাঃ) বলেন, কেননা উম্মু সালীত (রাঃ) ওহুদের যুদ্ধে আমাদের নিকট মশক বহন করে নিয়ে আসতেন’।[12] ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন,‘تزفر’ অর্থ তিনি সেলাই করতেন।

ওমর (রাঃ) কাপড়টি তাঁর স্ত্রীকে দান করতে অস্বীকার করেন। অথচ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নাতনী। কারণ তার স্থান উম্মু কুলসুমের নিচে।

যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর পরহেযগারিতা :

আয়েশা (রাঃ) ইফকের (অপবাদের) ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলা যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে তার পরহেযগারিতার কারণে হেফাযত করেন। মুনাফিকরা যখন আয়েশা (রাঃ)-এর ব্যাপারে বিপথগামী হলেন এবং তাদের সাথে অন্যান্য লোকেরাও তাদের কথার আলোচনা করতে আরম্ভ করেন, তখন যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর সতীন হওয়া এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আয়েশা (রাঃ)-এর উপর নিজের বড়ত্ব প্রকাশ ও আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি তার বৈপরিত্য থাকা স্বত্বেও আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে কোন খারাপ মন্তব্য করেননি। যখন তাকে আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, তখন তিনি বললেন, আমি তার সম্পর্কে ভাল জানি। তার মধ্যে আমি কখনো কোন খারাপী দেখিনি। তিনি এ ঘটনায় নিজেকে জড়ানো হ’তে সম্পূর্ণ বিরত থাকেন।

আয়েশা (রাঃ) নিজেই যয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُ زَيْنَبَ بِنْتَ جَحْشٍ عَنْ أَمْرِي فَقَالَ يَا زَيْنَبُ مَا عَلِمْتِ مَا رَأَيْتِ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ أَحْمِي سَمْعِي وَبَصَرِي وَاللهِ مَا عَلِمْتُ عَلَيْهَا إِلَّا خَيْرًا قَالَتْ وَهِيَ الَّتِي كَانَتْ تُسَامِينِي فَعَصَمَهَا اللهُ بِالْوَرَعِ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি বললেন, হে যয়নব! তুমি কী জান? তুমি কী দেখেছ? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি আমার কান, আমি আমার চোখের হেফাযত করতে চাই। আল্লাহর কসম! তার সম্পর্কে ভালো ব্যতীত অন্য কিছু আমি জানি না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অথচ তিনিই আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। কিন্তু পরহেযগারীর কারণে আল্লাহ তার হেফাযত করেছেন’।[13]

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর পরহেযগারিতা :

عَنْ نَافِعٍ قَالَ سَمِعَ ابْنُ عُمَرَ مِزْمَارًا قَالَ فَوَضَعَ أُصْبُعَيْهِ عَلَى أُذُنَيْهِ وَنَأَى عَنِ الطَّرِيقِ وَقَالَ لِى يَا نَافِعُ هَلْ تَسْمَعُ شَيْئًا؟ قَالَ فَقُلْتُ لاَ. قَالَ فَرَفَعَ أُصْبُعَيْهِ مِنْ أُذُنَيْهِ নাফে‘ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা ইবনে ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেয়ে উভয় কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হ’তে সরে গিয়ে আমাকে বললেন, হে নাফে‘! তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছ? আমি বললাম না। অতঃপর তিনি কান হ’তে হাত বের করলেন।[14] অথচ আজকের সমাজে গান, বাদ্যযন্ত্র খুবই সস্তা খোরাকে পরিণত হয়েছে যা খুবই দুঃখজনক।

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْقَاحَةِ وَمِنَّا الْمُحْرِمُ وَمِنَّا غَيْرُ الْمُحْرِمِ فَرَأَيْتُ أَصْحَابِي يَتَرَاءَوْنَ شَيْئًا فَنَظَرْتُ فَإِذَا حِمَارُ وَحْشٍ يَعْنِي وَقَعَ سَوْطُهُ فَقَالُوا لَا نُعِينُكَ عَلَيْهِ بِشَيْءٍ إِنَّا مُحْرِمُونَ فَتَنَاوَلْتُهُ فَأَخَذْتُهُ ثُمَّ أَتَيْتُ الْحِمَارَ مِنْ وَرَاءِ أَكَمَةٍ فَعَقَرْتُهُ فَأَتَيْتُ بِهِ أَصْحَابِي فَقَالَ بَعْضُهُمْ كُلُوا وَقَالَ بَعْضُهُمْ لَا تَأْكُلُوا فَأَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ أَمَامَنَا فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ كُلُوهُ حَلَالٌ আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদীনা হ’তে তিন মারহালা দূরে অবস্থিত ‘কাহা’ নামক স্থানে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। নবী করীম (ছাঃ) ও আমাদের কেউ ইহরামধারী ছিলেন আর কেউ ছিলেন ইহরামবিহীন। এ সময় আমি আমার সাথীদেরকে (ছাহাবীদেরকে) দেখলাম তাঁরা একে অপরকে কিছু দেখাচ্ছেন। আমি তাকাতেই একটি বন্য গাধা দেখতে পেলাম। (রাবী বলেন) এ সময় তার চাবুকটি পড়ে গেল। (তিনি উঠিয়ে দেয়ার কথা বললেন) সকলেই বললেন, আমরা মুহরিম। তাই এ কাজে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। অবশেষে আমি নিজেই তা উঠিয়ে নিলাম এরপর ঢিলার পিছন দিক হ’তে গাধাটির কাছে এসে তা শিকার করে ছাহাবীদের কাছে নিয়ে আসলাম। তাদের কেউ বললেন, খাও, আবার কেউ বললেন, খেয়ো না। সুতরাং গাধাটি আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। তিনি আমাদের সকলের আগে ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, খাও, এতো হালাল বা বৈধ’।[15]

অর্থাৎ, আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ)-এর লাঠি মাটিতে পড়ে গেলে তিনি তার নিজের লাঠি নিজেই মাটি থেকে উঠালেন। কোন ছাহাবী তার লাঠিটা তার হাতে তুলে দেননি। কেননা, তারা আশঙ্কা করছিল যদি আমরা তার লাঠি তুলে দেই, তাহলে মুহরিম অবস্থায় তাকে শিকার করার জন্য সহযোগিতা করা হ’ল। কেননা ছাহাবীগণ তখন মুহরিম ছিল আর ক্বাতাদাহ (রাঃ) গায়রে মুহরিম বা হালাল। অতঃপর ছাহাবীগণ আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) কর্তৃক শিকার করা গাধার গোশত খেতে ও সংকোচ বোধ করেন। কেননা তারা চিন্তা করছিল আবু ক্বাতাদাহ শিকার করার প্রতি মনোযোগী হত না যদি তারা তার প্রতি দেখাদেখি না করত। তারা যখন দেখাদেখি করলেন তখন আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) গাধাটিকে শিকার করতে উদ্বুদ্ধ হ’ল। এ কারণে তারা গোশত খেতে চাইছিল না। তারা ধারণা করছিল মুহরিম অবস্থায় শিকারির গোশত খাওয়া যাবে না।

তাবেঈনে এযামের পরহেযগারিতা :

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ عُثْمَانَ قَالَ : كُنَّا مَعَ طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ وَنَحْنُ حُرُمٌ، فَأَهْدَي لَنَا طَائِرٌ، فَمِنَّا مَنْ أَكَلَ، وَمِنَّا مَنْ تَوَرَّعَ فَلَمْ يَأْكُلْ. فَلَمَّا اِسْتَيْقَظَ طَلْحَةُ وَفَّقَ مَنْ أَكَلَ وَقَالَ: أَكَلْنَاهُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. আব্দুর রহমান ইবনে ওছমান (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা ইহরাম অবস্থায় ত্বালহা ইবনু ওবাইদুল্লাহ (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম, তখন আমাদের জন্য একটি পাখি হাদিয়া স্বরূপ প্রেরণ করা হ’ল। আমাদের মধ্য হ’তে কেউ কেউ তা হ’তে খেল, আবার কেউ কেউ না খেয়ে থাকল এবং পরহেযগারিতা অবলম্বন করল। অর্থাৎ অনেকেই তা থেকে একটুও খেল না। তারপর যখন ত্বালহা (রাঃ) ঘুম থেকে উঠল, তখন তিনি যারা খেয়েছে তাদের সাথে একমত হন এবং তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এ ধরনের পাখির গোশত খেয়েছি।[16]

আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (রহঃ)-এর পরহেযগারিতা :

حَكَىٰ الْحَسَنُ بْنَ عَرَفَةَ عَنْهُ مِنْ دَقِيْقِ اَلْوَرْعِ أَنَّهُ اِسْتَعَارَ قَلَمًا مِنْ رَجُلٍ بِالشَّامِ وَحَمَلَهُ إِلٰى خُرَاسَانَ نَاسِيًا فَلَمَّا وَجَدَهُ مَعَهُ بِهَا رَجَعَ إِلٰى الشَّامِ حَتَّى أَعْطَاهُ لِصَاحِبِهِ-

হাসান ইবনে ‘আরাফাহ (রহঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের সূক্ষ্ম বিষয়ে যে পরহেযগারিতা অবলম্বন করতেন, তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তিনি একদিন শামের এক ব্যক্তির নিকট থেকে একটি কলম ধার নেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ভুলে গিয়ে তা খোরাসানে নিয়ে আসেন। অতঃপর যখন সে কলমটি হাতে পান, সাথে সাথে সে পুনরায় শামে চলে আসেন এবং কলমটিকে তার প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেন।[17]

এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেগুলো বর্ণনা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহতে ভরপুর। তবে যারা জ্ঞানী তাদের জন্য দু-একটি ঘটনাই উপদেশ গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট। কেননা প্রবাদে রয়েছে, ‘জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।

(চলবে)

[লেখক : শিক্ষক, ইক্বরা ইসলামিয়া মডেল মাদরাসা, বি-বাড়িয়া]।


[1]. শু‘আবুল ঈমান হা/৫২৯১

[2]. আল্লামা মুরক্বী, আন-নাসেখ ওয়াল মানসুখ ১/৩৮ পৃ.

[3]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/২৯৯ পৃ.

[4]. তাফসীরে আবী সা‘ঊদ ২/১৩০ পৃ.

[5]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ১০/৫১২ পৃ.

[6]. বুখারী হা/১৪৯১; মুসলিম হা/১০৬৯

[7]. বুখারী হা/২৪৩২; মুসলিম হা/১০৭০

[8]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৪/৩১১পৃ.

[9]. বুখারী হা/৩৪৭২; মুসলিম হা/১৭২১; (ইঃ ফাঃ হা/৪৩৪৮; ইঃ সেঃ ৪৩৪৮

[10]. বুখারী হা/৩৮৪২

[11]. বুখারী হা/৩৯১২

[12]. বুখারী হা/২৮৮১

[13]. বুখারী হা/২৬৬১

[14]. আবু দাউদ হা/৪৯২৬; আহমাদ হা/৪৫৩৫, আলবানী (রহঃ) হাদীছটিকে হাসান বলেছেন

[15]. বুখারী হা/১৮২৩

[16]. তাফসীরে ত্বাবারী ৫/৬৪ [১১/৮৫, হা/১২৭৭২

[17]. তাহযীবুত তাহযীব ৫/৩৩৭ [২০/৩৫৬



বিষয়সমূহ: আমল
আরও