শিশুদের নিরাপত্তাবিধানে ইসলাম
বযলুর রহমান
আব্দুর রহীম 977 বার পঠিত
পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮।
দুনিয়ার প্রতি উছমান (রাঃ)-এর অনীহা :
ইসলামের তৃতীয় খলীফা, রাসূল (ছাঃ)-এর দুই মেয়ের জামাতা, দুই নূরের অধিকারী নামে খ্যাত উছমান বিন আফফান (রাঃ) দুনিয়ার প্রতি কোন মূল্য দিতেন না। তিনি যেমন ধন-সম্পদকে কোন গুরুত্ব দিতেন না তেমনি তিনি পোষাক-পরিচ্ছদকে গুরুত্ব প্রদান করতেন না। এমনকি তিনি নিজের জীবনের প্রতিও সামান্য গুরুত্ব দিতেন না। যখন লোকেরা তাকে হত্যার জন্য তার বাড়ি অবরোধ করে রেখেছিল তখনও তিনি নিজের জীবনের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে পরকালকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি আদমের শান্তিপ্রিয় সন্তান হাবীলের অবস্থান গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় শৃংখলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি সম্পদশালী হয়েও কখনো অহংকার করেননি। তিনি ক্ষমতাবান হয়েও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। সেজন্য তিনি দুনিয়াতে যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় পাত্র ছিলেন আখোতেও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে অবস্থান করবেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর রোগশয্যায় বলেন, ‘আমি আশা করি যে, এ সময় আমার কোন ছাহাবী আমার নিকট উপস্থিত থাকুক। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার কাছে আবুবকরকে ডেকে আনব? তিনি নীরব থাকলেন। আমরা বললাম, আমরা কি আপনার কাছে ওমরকে ডেকে আনব? তিনি এবারও নীরব থাকলেন। আমরা বললাম, আমরা কি আপনার নিকট উছমানকে ডেকে আনব? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতঃপর উছমান এলেন। তিনি তার সাথে একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। উছমান (রাঃ)-এর চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ক্বায়েস (রহঃ) বলেন, আমার নিকট উছমানের মুক্ত দাস আবু সাহলাহ (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, উছমান ইবনু আফফান নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ থাকাকালে বললেন, রাসূল (ছাঃ) আমার থেকে একটি অঙ্গীকার নিয়েছেন, আমি তাতে ধৈর্যধারণ করব। আলী ইবনু মুহাম্মাদ (রহঃ) তার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, উছমান বলেছেন, আমি তাতে ধৈর্যধারণ করব। ক্বায়েস (রহঃ) বলেন, ছাহাবীদের মতে, রাসূলুল্লাহ -এর সঙ্গে এটাই ছিল তাঁর একান্ত আলাপ’।[1]
সম্পদের প্রতি অনীহা :
ধন-সম্পদ তারাই অকাতরে দান করতে পারে যাদের সম্পদের প্রতি কোন লোভ লালসা নেই। উছমান (রাঃ) পরকালের জন্য মূল্যহীন এই সম্পদকে মোটেই গুরুত্ব দেননি। যখনই রাসূল (ছাঃ) দানের কথা বলতেন তখনই তিনি তার মূল্যবান সম্পদগুলো দান করে দিতেন। এভাবেই তিনি দুনিয়ার প্রতি তাঁর অনীহা প্রদর্শন করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, আহনাফ ইবনু কায়স (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা (বাড়ি হ’তে) হজ্জ করার জন্য (বের হয়ে) মদীনায় পৌঁছলাম। আমরা আমাদের মনযিলে পৌঁছে আমাদের মাল-সামান যখন নামিয়ে রাখছিলাম, তখন এক ব্যক্তি এসে বললেন, লোকজন মসজিদে একত্রিত হয়েছে এবং তারা ভীত-সন্ত্রস্ত। এরপর আমরা গিয়ে দেখলাম যে, মসজিদের মাঝখানে কয়েকজনকে ঘিরে কিছু লোক একত্রিত রয়েছে এবং এদের মধ্যে আছেন আলী, যুবায়ের, তালহা এবং সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ)। আমরা তাদের সঙ্গে বসলাম। এমতাবস্থায় উছমান ইবনু আফফান (রাঃ) উপস্থিত হলেন এবং তাঁর গায়ে একখানা হলুদ রংয়ের চাদর ছিল, যা দিয়ে তিনি তাঁর মাথা ঢেকে রেখেছিলেন। এরপর তিনি বললেন, এখানে কি আলী (রাঃ) আছেন, এখানে কি তালহা (রাঃ) আছেন, এখানে কি যুবায়ের (রাঃ) আছেন, এখানে কি সা‘দ (রাঃ) আছেন? তারা বললেন, হ্যাঁ, (আমরা এখানে উপস্থিত আছি)।
উছমান (রাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে ঐ আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, তোমরা কি জান যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, অমুক গোত্রের (উটের) বাথান যে ক্রয় করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি ঐ স্থানটি বিশ হাজার বা পঁচিশ হাজার (দিরহাম) দিয়ে ক্রয় করি। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ খবর দেই। তখন তিনি বললেন, তুমি তা আমাদের মসজিদের জন্য (ওয়াকফ করে) দিয়ে দাও। এর ছওয়াব তুমি পাবে। তারা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহ সাক্ষী। উছমান (রাঃ) আবার বললেন, আমি তোমাদেরকে ঐ আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি-যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই তোমরা কি জান যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘রূমা’ কূপ যে ক্রয় করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। তখন আমি তা এত এত মূল্যে ক্রয় করি এবং আমি নবী (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলি, আমি তা এত এত মূল্যে ক্রয় করি। তিনি বললেন, তুমি তা মুসলমানদের পানি পান করার জন্য (ওয়াকফ্ করে) দিয়ে দাও, আর এর ছওয়াব তুমি পাবে। তখন তারা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহ সাক্ষী। তিনি আবার বললেন, আমি তোমাদেরকে ঐ আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি- যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই। তোমরা কি জান, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যে এদের যুদ্ধের সামান অর্থাৎ অনটনগ্রস্ত (তাবুক) বাহিনীর ব্যবস্থা করে দেবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। তখন আমি তাদের জন্য এমন সামানের ব্যবস্থা করলাম যে, তারা একটি রশি বা লাগামের অভাব অনুভব করল না। তারা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহ সাক্ষী! তিনি বললেন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন! আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন’।[2]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ছুমামা বিন হাযন আল কুশাইরী হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, উছমান (রাঃ) যখন অবরুদ্ধ, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি প্রাসাদ থেকে নিচের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ঐ দু’জন ব্যক্তিকে ডাকো যারা আমার উপর ক্ষেপে আছে। তাদেরকে ডাকা হলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমরা কি জান না যখন রাসূল (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে আসলেন তখন মসজিদের জায়গায় মুছল্লীদের জন্য সংকুলান হচ্ছিল না তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে তার খাঁটি সম্পদ দ্বারা এই স্থানটি ক্রয় করে দিবে এবং সেখানে অন্যান্য মুসলমানদের মত তার অধিকার থাকবে। আর এর বিনিময়ে সে পরকালে জান্নাতে এর থেকে উত্তম স্থান পাবে? তখন আমি সেটি ক্রয় করে সকল মুসলিমের জন্য উন্মুক্ত করে দেই। আর আজকে তোমরা আমাকে সেখানে দুই রাক‘আত ছালাত আদায়ে বাধা দিচ্ছ?। তিনি আরো বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমরা কি জান রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন সেখানে রূমা কুপ ছাড়া কোন মিষ্টি পানির ব্যবস্থা ছিলনা। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমাদের কে আছে যে এই কুপটি তার খাঁটি সম্পদ দ্বারা ক্রয় করবে। অতঃপর সেখানে তার বালতি প্রবেশের অধিকার থাকবে যেমন অন্যান্য মুসলামানেরও থাকবে। আর এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে উত্তম কিছু থাকবে’। তখন আমি আমার খাঁটি সম্পদ দ্বারা ক্রয় করে দান করে দেই। আর আজকে তোমরা আমাকে সেখান থেকে পানি পানে বাধা দিচ্ছ? এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি জান আমি কঠিন সময়ের তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তারা বলল, আল্লাহর কসম, হ্যাঁ’।[3]
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, উছমানের মুক্ত গোলাম আবু ছালেহ বলেন, আমি মীনায় উছমানকে বলতে শুনেছি, হে জনতা, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিকট থেকে একটি হাদীছ শুনেছি, সেটি তোমাদেরকে শুনাচ্ছি। তিনি বলেন, আল্লাহর পথে একদিন পাহারা দেয়া অন্য ক্ষেত্রে এক হাজার দিন পাহারা দেয়ার চেয়ে উত্তম। অতএব, প্রত্যেক মানুষের যেভাবে ইচ্ছা পাহারা দেয়া উচিত। আমি কথাটা পৌছে দিয়েছি তো? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। উছমান বিন আফফান (রাঃ) উবায়দুল্লাহ বিন আদী ইবনুল খিয়ারকে বললেন, হে ভাতিজা, তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে জীবিত পেয়েছ? সে বলল, না, তবে তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাস আমার নিকট এমন নির্ভেজাল ও খাঁটিভাবে পৌছেছে, যেমন খাঁটি ও নির্ভেজাল থাকে কুমারীর কুমারীত্ব তার নির্জন কক্ষে। এরপর উছমান (রাঃ) কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। তারপর বললেন, এখন তোমরা শোন, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, আমি (সেই সত্যকে গ্রহণের জন্য) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দাওয়াত গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছি, এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিকট যে বাণী এসেছে তার প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। তারপর উভয় হিজরতে (হাবশায় ও মদীনায়) শরীক হয়েছি যেমন আগে বলেছি। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জামাতাও হয়েছি এবং তাঁর নিকট বায়আতও করেছি। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাঁকে যেদিন তুলে নিয়েছেন, সেদিন পর্যন্ত আমি কখনো তাঁর নির্দেশ অমান্যও করিনি এবং তাকে ধোঁকাও দিইনি।[4]
আবু সালামা বিন আবদুর রহমান বলেন, উছমান (রাঃ) যখন অবরুদ্ধ, তখন প্রাসাদ থেকে নিচের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করি, হেরার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কে ছিল, যখন পাহাড় কেঁপে উঠেছিল? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে পা দিয়ে লাথি মারলেন, তারপর বললেন, থামো হেরা, তোমার ওপরে একজন নবী, একজন ছিদ্দীক ও একজন শহীদ ছাড়া আর কেউ নেই। তখন আমি তার সাথেই ছিলাম। উছমানের এ কথায় অনেকেই কসম খেয়ে সমর্থন জানালো। উছমান (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, বাইয়াতুর রিযওয়ানের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাথে কে ছিল? যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে মক্কার মুশরিকদের নিকট পাঠালেন। তিনি বললেন, এটা আমার হাত, আর এটা উছমানের হাত। এভাবে আমার জন্য বায়‘আত নিলেন। এ কথার পক্ষেও সমবেত লোকদের অনেকে সায় দিল। উছমান (রাঃ) বললেন, সেই সময়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কে ছিল যখন তিনি বললেন, এই বাড়িটি কিনে দিয়ে কে মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করিয়ে দেবে? এর বিনিময়ে সে জান্নাতে একটা বাড়ি পাবে। তখন আমি নিজের টাকা দিয়ে বাড়িটি কিনে দিলাম এবং তা দ্বারা মসজিদের সম্প্রসারণ করলাম। অনেকেই তার এ কথার পক্ষে সাক্ষ্য দিল। উছমান (রাঃ) পুনরায় বললেন, মুছীবতের বাহিনীর দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কে ছিল? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আজকে কে এমন দান করবে, যা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গেছে? আমি তৎক্ষণাৎ অর্ধেক বাহিনীকে নিজের টাকায় যাবতীয় প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করলাম। আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি সেই জলাশয়টির কাছে কে ছিল, যার পানি পথিকের নিকট বিক্রি করা হত? আমি নিজের টাকা দিয়ে সেটি কিনে দিয়েছি। এভাবে মুসাফিরের জন্য সেই জলাশয়কে অবাধ করে দিয়েছি (যার ফলে এখন সে জলাশয় থেকে বিনা মূল্যে পানি পাওয়া যায়)। এ সময়ও বহু লোক তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিল। [5]
রাত জেগে ইবাদত :
উছমান বিন আফফান (রাঃ) দানশীলতার মাধ্যমে যেমন দুনিয়ার সম্পদের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করেছেন তেমনি পরকালীন কল্যাণ লাভের জন্য রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত ও ছালাত আদায়ে রত থেকেছেন। এমনকি তিনি এক রাক‘আত বিতরে কুরআন খতম করেছেন। তিনি নিয়মিত ছালাতুল লায়ল বা তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করতেন। যেমন বিভিন্ন আছারে এসেছে-
عَنِ ابْنِ سِيرِينَ قَالَ : قَالَتِ امْرَأَةُ عُثْمَانَ حِينَ قُتِلَ : لَقَدْ قَتَلْتُمُوهُ وَإِنَّهُ لَيُحْيِي اللَّيْلَ كُلَّهُ بِالْقُرْآنِ فِي رَكْعَةٍ-
ইবনু সীরীন বলেন, উছমান (রাঃ)-এর স্ত্রী তার হত্যাকালীন বলেছিলেন, তোমরা তাকে হত্যা করলে? অথচ তিনি এক রাক‘আতে পুরো কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করতেন। [6]
আব্দুর রহমান তায়মী হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আজকে রাত জাগরণে আমার উপর কেউ বিজয়ী হ’তে পারবেনা। আমি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় শুরু করলাম। হঠাৎ করে আমি পিছন থেকে কোন ব্যক্তির উপস্থিতি অনুভব করলাম। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি উছমান বিন আফফান (রাঃ)। আমি তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিলাম। তিনি ছালাত শুরু করলেন এবং কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শেষ করলেন। অতঃপর রুকু সিজদাহ করে তিনি ছালাত শেষ করলেন। আমি বললাম, এই বৃদ্ধ হয়ত সন্দেহে পড়েছেন। ছালাত শেষে আমি বললাম, হে আমীরুল মুমেনীন, আপনি তো এক রাক‘আত আদায় করলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ এইটা আমার বিতরের ছালাত’।[7]
عَنِ الزُّبَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ، حَدَّثَنَا جَدِّي ، أَنَّ عُثْمَانَ بْنَ عَفَّانَ ، رَحِمَهُ اللَّهُ مَا كَانَ يُوقِظُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِهِ مِنَ اللَّيْلِ إِلَّا أَنْ يَجِدَهُ يَقْظَانَ فَيَدَعُوهُ فَيُنَاوِلُهُ وُضُوءَهُ وَكَانَ يَصُومُ الدَّهْرَ-
যুবায়ের ইবনু আব্দিল্লাহ তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, উছমান (রাঃ) রাতে তার পরিবারের যাকেই ঘুম থেকে জাগ্রত করতেন সে-ই উছমান (রাঃ)-কে জাগ্রত অবস্থায় পেত। তিনি তাকে উঠাতেন এবং ওযূর পানি ধরাতেন। আর তিনি নিয়মিত ছিয়াম পালন করতেন (প্রতি মাসে আইয়ামে বিযের ছিয়াম পালন করতেন)। [8]
আব্দুল্লাহ বিন রূমী বলেন,
كَانَ عُثْمَانُ رَحِمَهُ اللَّهُ إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ يَأْخُذُ وَضُوءَهُ قَالَ :فَقَالَ لَهُ أَهْلُهُ : أَلَا تَأْمُرُ الْخَدَمَ يُعْطُونَكَ وَضُوءَكَ ؟ قَالَ : لَا إِنَّ النَّوْمَ لَهُمْ يَسْتَرِيحُونَ فِيهِ-
উছমান (রাঃ) যখন রাতের ছালাতের জন্য জাগ্রত হতেন তখন ওযূর পানি নিতেন। তার পরিবারের কোন একজন বলল, আপনি খাদেমকে নির্দেশ দিলেন না কেন যে আপনাকে ওযূর পানি দিত? তিনি বললেন, না। তারাও ঘুমের মধ্যে বিশ্রাম করে থাকে’। [9]
আমরা বিনতে কায়েস বলেন, আমি ওছমানের শাহাদাতের বছর আয়েশার সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মদীনা অতিক্রম করার সময় ঐ কুরআন খানা দেখলাম যেটা কোলে থাকা অবস্থায় উছমান (রাঃ)-কে হত্যা করা হয়। তাকে তরবারী দ্বারা আঘাত করার সময় প্রথম যে রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল তা নিম্নের আয়াতটির উপর فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ আমরাহ বলেন, তাদের মধ্যে একজন লোকও ছহীহ সালামতে মৃত্যুবরণ করেনি।[10]
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ওছমান (রাঃ)-কে চল্লিশ রাত অবরোধ করে রাখা হয়। তিনি আমাকে বললেন, সাহরীর সময় আমাকে রাতে জাগিয়ে দিবে। আমি তার বাসায় আসলাম। সাহরীর সময় হলে আমি বললাম, হে আমীরুল মুমেনীন আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন সাহরীর সময় হয়েছে। তখন তিনি এভাবে কপাল মাসাহ করে বললেন, সুবহানাল্লাহ হে আবু হুরায়রা ! তুমি আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে দিলে যাতে আমি রাসূল (ছাঃ) কে দেখছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি আগামীকাল আমাদের সাথে ইফতার করবে। সেদিনই তাকে হত্যা করা হয়’। [11] সুফিয়ান ইবনু ঊয়াইনা বলেন, ওছমান (রাঃ) বলেছেন, لَوْ طَهُرَتْ قُلُوبُكُمْ مَا شَبِعْتُمْ مِنْ كَلَامِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلٌ ‘তোমাদের অন্তর পরিচ্ছন্ন হলে তোমরা কখনো আল্লাহর কালাম পাঠ করে পরিতৃপ্ত হতেনা।[12] সুফিয়ান ইবনু ঊয়াইনা বলেন, উছমান (রাঃ) বলেছেন, وَمَا أُحِبُّ أَنْ يَأْتِيَ عَلَيَّ يَوْمٌ وَلَا لَيْلَةٌ إِلَّا أَنْظُرُ فِي اللَّهِ يَعْنِي الْقِرَاءَةَ فِي الْمُصْحَفِ ‘আমার নিকট প্রিয় কাজ হ’ল যে এমমন কোন দিন বা রাত অতিক্রম করবে না যেখানে আমি কুরআন থেকে তেলাওয়াত করব না’।[13]
সাধারণ জীবন-যাপন :
উছমান (রাঃ) নিরহংকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের খলীফা হয়েও কখনো নিজেকে বড় মনে করতেন না। বরং সর্বদা সবার সাথে মিশতেন। তার কোন রাজপ্রাসাদ ছিলনা। সেজন্য দেখা যায় তিনি মসজিদে শুয়ে বিশ্রাম করতেন। এশার ছালাত জামা‘আতে আদায় করার জন্য মাগরিবের পর থেকে মসজিদে বসে থাকতেন। এমনকি তিনি গাধার উপর আরোহন করতেন এবং তার পিছনে তার দাসকে বসাতেন। যেমন বিভিন্ন আছারে বর্ণিত হয়েছে।
হাসান বছরী (রহঃ) হামাদানীর সূত্রে বর্ণনা করেন, আমি উছমান (রাঃ)-কে চাদর পরিহিত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি। তার পাশে কেউ ছিল না। অথচ তখন তিনি আমীরুল মুমিনীন (মুসলমানদের নেতা)।[14]
মায়মূন বিন মেহরান বলেন, হামদানী উছমান বিন আফফান (রাঃ)-কে দেখেন যে, তিনি একটি গাধার উপর আরোহন করে আছেন আর পিছনে বসে আছে তার অনুগ্রহ প্রাপ্ত দাস। তখন তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের খলীফা। [15]
ইউনুস বিন ওবায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘মসজিদে কায়লুলা করা সর্ম্পকে হাসানকে জিজ্ঞেস করা হ’ল। তিনি বললেন, আমি ওছমান বিন আফফান (রাঃ)-কে মসজিদে কায়লূলা করতে দেখেছি। তখন তিনি খলীফা ছিলেন। তিনি যখন দাঁড়াতেন তার পিঠে কঙ্করের দাগ পড়ে থাকত। বলা হত এইতো আমীরুল মুমেনীন, এইতো আমীরুল মুমেনীন।[16]
দামী খাদ্যের প্রতি অনীহা :
উছমান (রাঃ) দুনিয়ার মূল্যহীনতা বুঝাতে সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ খাবার গ্রহণ করতেন। তিনি প্রজাদের মূল্যবান খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেও নিজে স্বল্প মূল্যের খাবার গ্রহণ করতেন। এমনকি তিনি দাওয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কোন খাবার অহংকার প্রদর্শন বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রস্ত্তত করা হলে সেটা তিনি বর্জন করতেন। যেমন শুরাহবীল বিন মুসলিম হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ওছমান (রাঃ) লোকদের রাজকীয় খাবার খাওয়াতেন। আর তিনি বাড়িতে প্রবেশ করে তেল ও সিরকা খেতেন’।[17]
হুমাইদ বিন নুআঈম বলেন, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে একটি দাওয়াতে আহবান করা হ’ল। রাস্তায় বের হওয়ার পর উছমান (রাঃ) ওমর (রাঃ) কে বললেন, আমার এমন একটি দাওয়াতে হাযির হলাম যাতে উপস্থিত না হওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল। ওমর (রাঃ) বললেন, কেন? তিনি বললেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই খাবার গর্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে’।[18]
হানী (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, উছমান (ছাঃ) যখন কোন কবরের সামনে দাঁড়াতেন তখন খুবই কাঁদতেন এমন কি তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে বলা হ’ল, আপনার কাছে জান্নাত-জাহান্নামের কথা আলোচনা করা হলে আপনি কাঁদেন না অথচ এই ক্ষেত্রে এত কাঁদেন কেন? তখন তিনি বললেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আখিরাতের মানযিলসমূহের প্রথম মানযিল হ’ল কবর। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পেয়ে যাবে তার জন্য পরবর্তী মানযিলসমূহ আরো সহজ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে না তার জন্য পরবর্তী মানযিলসমূহ আরো কঠিন হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি এমন কোন দৃশ্য কখনো দেখিনি যার থেকে কবর ত্রাসজনক নয়।[19]
عَنْ أَبِي عُثْمَانَ ، أَنَّ غُلَامَ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ ، تَزَوَّجَ فَأَرْسَلَ إِلَى عُثْمَانَ وَهُوَ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ ، فَلَمَّا جَاءَ قَالَ : أَمَا إِنِّي صَائِمٌ غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُ أَنْ أُجِيبَ الدَّعْوَةَ ، وَأَدْعُو بِالْبَرَكَةِ-
আবু উছমান (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, মুগীরা বিন শু‘বার দাস বিবাহ করলে উছমান (রাঃ)-এর নিকট দাওয়াত পাঠানো হল তখন তিনি ছিলেন বিশ্বজাহানের খলীফা। তার নিকট আসলে তিনি বললেন, আমি তো ছায়েম, তবে আমি দাওয়াত কবুল করা ও নবদম্পত্তির জন্য দো‘আ করাকে পসন্দ করি।[20]
দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আবাস। যারা এই মূল্যহীন পৃথিবীকে সঠিকভাবে বুঝতে পারে তারা কখনো কোন ক্ষেত্রে দুনিয়ার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেনা। কারণ তারা বিশ্বাস করে যেকোন মুহূর্তেই রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে পরপারে। সেজন্য দেখা যায় আবুবকর, ওমর, উছমান, আলীসহ অন্যান্য ছাহাবীগণ এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে মোটেও মূল্য দিতেন না। তারা দুনিয়াকে মুসাফিরখানা ধরে পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করতেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের আদর্শকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফীক দান করুন-আমীন! (ক্রমশঃ)
[লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ]
[1]. ইবনু মাজাহ হা/১১৩; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৯১৮; আহমাদ হা/২৫৮৩৯।
[2]. নাসাঈ হা/৩১৮২; আহমাদ হা/৫১১; ইবনু হিববান হা/৬৯২০।
[3]. দারাকুৎনী হা/৪৪৩৯; আহমাদ হা/৫৫৫,সনদ হাসান।
[4]. বুখারী হা/৩৬৯৬; আহমাদ হা/৪৮০; মাজামা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৫৩৬৩।
[5]. আহমাদ হা/৪২০, ৫৫৫, ৫১১; নাসাঈ হা/৩৬০৯, সনদ ছহীহ।
[6]. সুনানু সাঈদ ইবনু মানছূর ২/৪৬৯; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৭; ইবনুল মুবারক হা/১২৭৭, রিজাল ছহীহ, তবে এক রাতে কুরআন খতমের বিষয়টি হাদীছ বিরোধী হওয়ায় কেউ কেউ মতন নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ইমাম নববী বলেন, কুরআন খতমের সর্বনিম্ন সময়ের সীমা নেই। এটি ব্যক্তির অনুধাবন শক্তির উপর নির্ভরশীল (ফাৎহুল বারী ৯/৯৭)।
[7]. শারহু মা‘আনিল আছার হা/১৬১৯; ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ হা/১২৭৬; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৪৫৬১; দারাকুৎনী হা/১৫।
[8]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৬; ফাযায়েলুছ ছাহাবা হা/৭৪২;আর রিয়াযুন নাযরা ফী মানাকিবিল আ‘শরা ৩/৪৬।
[9]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৭, রেজাল ছহীহ।
[10]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৮; ফাযায়েলুছ ছাহাবা হা/৮১৭; আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, ফাযায়েলু উছমান হা/১৪১।
[11]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৮।
[12]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৮; ফাযায়েলুছ ছাহাবা হা/৭৭৫; আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, ফাযায়েলু উছমান হা/৬৬।
[13]. আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, ফাযায়েলু উছমান হা/৬৬।
[14]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, ফাযায়েলুছ ছাহাবা হা/৮০০; হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৫৯; আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, ফাযায়েলে উছমান হা/৯১।
[15]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৭; হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৬০।
[16]. বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৪১৩৮; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৭।
[17]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৯; আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুহসিন, আয-যাকাত ৩৪ পৃ.।
[18]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৬; আহাদীছু আফফান বিন মুসলিম হা/ ১৯২; ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ হা/২০১, রেজাল ছহীহ।
[19]. তিরমিযী হা/২৩০৮; আহমাদ হা/৪৫৪; মিশকাত হা/১৩২।
[20]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহুদ ১/১২৯; ইবনু শুবাহ, তারীখুল মাদীনা ৩/১০১৯।