আধুনিক যুগের নতুন ফিৎনা
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1126 বার পঠিত
[বাংলার
কিংবদন্তী আহলেহাদীছ মনীষী মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী ১৯৬০
সালের ২৫মে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি তৈরী করছিলেন পাকিস্তান
শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রেরিত প্রশ্নে জওয়াব। সেই কাজ সমাপ্ত করার পূর্বেই
মৃত্যুর করাঘাত তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়। তাঁর সেই অন্তিম মুহূর্তের
সাক্ষী ছিলেন মাওলানা রাগেব আহসান। মওলানার মৃত্যুর পর তাঁর সেই মুহূর্তের
বর্ণনাটি মূল উর্দু থেকে অনুবাদ করেন মোঃ আব্দুর রহমান, যা তর্জুমানুল
হাদীছের ৯ম বর্ষ, ৮ম ও ৯ম সংখ্যা ১৯৬০-এ প্রকাশিত হয়। তাওহীদের ডাক পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রবন্ধটি পত্রস্থ হল- নির্বাহী সম্পাদক]।
এ বৎসর ৩রা জুন হজ্জে আকবর সুসম্পন্ন করার পর বিশ্ব মুসলিম পরবর্তী দিবস ৪ঠা জুন পবিত্র ধাম মক্কার সন্নিকট মীনাতে যখন ভেড়ী, বকরী এবং উষ্ট্রের কুরবানী দিতে রত ঠিক সেই দিবসেই আল্লাহর বান্দা মুজাহেদে ইসলাম আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেব ঢাকা নগরীতে মিল্লাতে ইসলামের খেদমতে নিজের জীবনকে কুরবানীর জন্য নিবেদিত করলেন। ১৯৬০ ঈসায়ীর ২৫শে মের রাত্রে যে প্রতিশ্রুতি তিনি প্রদান করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেখালেন।
খেলাফত আন্দোলন এবং আযাদী সংগ্রামের মুজাহেদে আ’যম, পূর্বপাক জমঈয়তে আহলে হাদীসের সভাপতি, ‘তর্জুমানুল হাদীস’ ও ‘আরাফাত’ সম্পাদক আল্লামা মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহেল কাফী সত্যই আল্লাহর পথে এক উৎকৃষ্ট প্রাণ মুজাহেদের জীবন অতিবাহিত করে গেলেন এবং খাঁটি শহীদে মিল্লতের শাহাদত বরণ করে ধন্য হলেন। দেশ জাতির সেবায় তাঁর ঈমানী জোশ ও অটল সঙ্কল্প, ত্যাগ ও কুরবানী এবং সত্যের উপর অবিচল নিষ্ঠার এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এক সঞ্জীবনী শক্তি ও প্রেরণার চির অম্লান উৎসরূপে বিরাজমান থাকবে।
১৯৬০ সালের ২৪শে মে আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেবের দুজন প্রতিনিধি (বংশালের রঈস হাজী মোহাম্মাদ আকীল এবং অধুনালুপ্ত দৈনিক নাজাতের প্রাক্তন সম্পাদক কাজী আবদুশ শহীদ) বক্ষমাণ প্রবন্ধের লেখকের ঢাকাস্থ গৃহে (২৫ নং মিঞা সাহেবের ময়দান) তশরিফ আনয়ন করেন। আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেবের সালাম এবং সংবাদ পৌঁছিয়ে তাঁরা বলেন, ‘তিনি পাকিস্তান শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রশ্নাবলী সম্পর্কে পরামর্শের উদ্দেশ্যে আপনার সাক্ষাতের জন্য অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত। কিন্তু পিত্তশূলের বেদনা এবং রোগের তীব্রতার কারণে তাঁর পক্ষে এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হয়ে উঠেনি’। আমি বললাম, ‘মওলানা সাহেবের অপারেশন এবং প্রতিকূল স্বাস্থ্যের সংবাদ আমি অবগত আছি। তার কষ্ট স্বীকার অনুচিত। ইনশাআল্লাহ আমিই আগামীকাল্য তাঁর খেদমতে হাযির হ’ব।’
প্রতিশ্রুতিমত পর দিবস ২৫শে মে বান্দা ‘আরাফাত’ দফতরে গিয়ে হাজির হ’ল। গিয়ে দেখতে পেলাম তিনি শক্তিহীন এবং অত্যন্ত দুর্বল। তিনি বললেন, ‘অপারেশন বিফল হয়েছে, পিত্তকোষে কোন পাথরের সন্ধান পাওয়া যায় নাই, বেদনা আগের চাইতেও বর্ধিত হয়েছে, দুর্বলতা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা আমাকে পানি থেকে তীরে নিক্ষিপ্ত অসহায় মৎসের ন্যায় বিচলিত করে তুলেছে। পাকিস্তানকে একটি সেক্যুলার স্টেটে পরিণত করার যে অপচেষ্টা শুরু হয়েছে, সে দৃশ্য অবলোকন করে আমি কিছুতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পাচ্ছিনা। এখন শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রশ্নমালার উত্তর দেওয়া একান্ত আবশ্যক, এ ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ এবং সাহায্য একান্তভাবে কামনা করি।’
আমি বললাম, বান্দা যেকোন খেদমতের জন্য প্রস্ত্তত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট আলেম এবং চিন্তাশীল সুধীবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত, বিশেষ করে যারা ১৯৫১ ও ৫৩ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেব বললেন, এ ধরণের বৈঠকে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ঢাকা শহরে অবস্থানরত চিন্তাবিদ ও আলেমগণের তরফ থেকে যদি প্রশ্নমালার উত্তর দেওয়া যায় তা হলেই যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। আমি পুনরায় আমার অভিমত পেশ করলে তিনি বললেন, আসল কথা আমি এবার ঈদে কুরবান আমার পিতৃভূমি দিনাজপুর জিলার নুরুল হুদায় উদযাপন করার ইচ্ছা পোষণ করছি। তাই অনুরোধ, মেহেরবানী করে একাজ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করুন।
আমি এর উত্তরে নিবেদন করলাম, হযরত, এটা মিল্লাতের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নাযুক কাজ। এজন্য আপনাকে তো ঈদে-কুরবানকে বলিদান করতে হবে।
কথায় কথায় অতর্কিত মুখ থেকে বড় কথাই বের হয়ে গেল, কিন্তু মনে বড়ই বেদনা বোধ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল একটা অসাধারণ কথা একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনের অদৃশ্য কোঠা থেকে অতর্কিত মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয়ে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ নীরব নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। আমি তখন পশ্চিম দিকে মুখ করে এক চেয়ারে উপবিষ্ট, আমার ডাইনে হাজী মোহাম্মদ আকীল সাহেব এবং বামে কাজী আব্দুশ শহীদ সাহেব-দুজন দুই চেয়ারে বসে। মওলানা মুস্তাছের আহমাদ রহমানী ফরশের উপর আর হযরত আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী সামনের রোগ শয্যায় উপবিষ্ট।
অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করলেন স্বয়ং হযরত আল্লামা। ঈমানের জোশ ও সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় অন্তরস্ফূর্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে উত্তর করলেন :
ইনশাআল্লাহ কুরবানীর জন্য আমি প্রস্ত্তত। এই মহান কাজের জন্য ঈদের কুরবানকেও বলিদান করতে আমি কুন্ঠিত হব না। এখন যেভাবেই হোক আপনি একাজের ব্যবস্থা করুন।
পূর্ব দিনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ঢাকার কতিপয় চিন্তাবিদ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ২৬শে মে মওলানা সাহেবের রোগ প্রকোষ্ঠে একত্রিত হলেন। রাত্র ১১ ঘটিকা পর্যন্ত শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন প্রশ্নের উপর দীর্ঘ আলোচনা চলল। মওলানা সাহেব অভিযোগ করলেন, এই ব্যাপারে কতিপয় স্থানে যাতায়াতের দৌড়ধাপে তিনি পুনরায় বেদনার ভাব অনুভব করছেন, জ্বরও এসে গিয়েছে, তবিয়ত তখন অনুকূল নয়- তাই তাঁর প্রস্তাব এবং সকলের সম্মতিক্রমে স্থির হ’ল মওলানা রাগেব আহসান সাহেব কমিশনের প্রশ্নাবলীর বিস্তৃত জওয়াব সহ একটি খসড়া প্রস্ত্তত করবেন। পরবর্তী ৩রা জুন ওলামা এবং সূধিবৃন্দের একটি বৈঠকের অধিবেশন হবে। মওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী সাহেব এই বৈঠকের দাওয়াত নামা প্রেরণ করবেন এবং আরাফাত অফিসেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমি সেই মজলিসে আমর মুসাবিদা পেশ করব। মওলানা সাহেব আমাকে বারবার এইকথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র, দেশ ও মিল্লত এই উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রামাণিক ও যুক্তিসিদ্ধ জওয়াব লিখতে হবে। আমি এ দায়িত্ব স্বীকার করে নিলাম। রাত্র সাড়ে এগারটায় অন্য সকলে বিদায় নেওয়ার পর মওলানা সাহেব আমাকে এগিয়ে দিতে স্বীয় কামরার দরওয়াজা পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। বিদায় মুসাফাহা কালে আমি মওলানা সাহেবকে বিশেষভাবে অনুরোধ করলাম, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনিও যেন তাঁর লিখনী ধারণ করেন। তিনি তাঁর অসুস্থতার ওযর অবশ্য পেশ করলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন।
২৮শে মে মওলানা সাহেব বললেন, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মওলানা আকরম খানের সঙ্গে পরামর্শের জন্য তিনি তাঁর নিকট এবং আরও কয়েক জায়গায় ঘুরাফেরা করেছিলেন। ফলে তিনি জ্বরে আক্রান্ত এবং তাঁর পিত্তপ্রদাহ ও পিত্তশূল বর্ধিত হয়েছে। চিকিৎসকগণের নিষেধ অগ্রহ্য করেই তিনি একাজ করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম আর পাকিস্তানের কোন সমস্যা যখন গুরুতর আকারে দেখা দেয় তখন নিজের স্বাস্থ্য আর জানের সম্বন্ধে একদম বেপরওয়া হয়েই তিনি কাজে নেমে পড়েন। কারণ সবকিছুর উর্ধ্বে মিল্লতের স্থান। প্রকৃত প্রস্তাবে হৃদয়ের এই অনুভূতির দ্বারাই তিনি পরিচালিত।
বেদনার প্রতিযোগিতা : পিত্তশূল বনাম কওমী দরদ
আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী বছরের পর বছর পিত্তশূলের আক্রমণে দুঃসহ কষ্ট ভোগ করে আসছিলেন। পশ্চিম বাঙ্গলার বর্তমান মুখমন্ত্রী ডাক্তার বি.পি. রায়ের তত্ত্ববধানে একবার কোলকাতায় তাঁর পেটে অপারেশন করা হয়। কিন্তু পূর্ণ নিরাময় লাভ ঘটে উঠে নাই। এদিকে জীবনের সায়াহ্নে হৃৎপিন্ডের দুর্বলতা, রক্তের চাপ, বহুমূত্র, দৃষ্টিহীনতা প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হলেন। কিন্তু এই সব জটিল রোগের পৌনপুনিক আক্রমণ তাঁর মানসিক শক্তিকে বিন্দুমাত্রও দুর্বল করে তুলতে পারেনি। ইতিহাস, ইসলাম এবং জ্ঞানগর্ভ যেকোন বিষয়ের আলোচনায় তাঁর মস্তিষ্ক পুরাপুরি সতেজ ও সক্রিয় হয়ে উঠত। এভাবেই এলমী খেদমতের কাজ দস্ত্তরমত তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ডাক্তার শামসুদ্দীন এবং ডাক্তার আসিরুদ্দীন সাহেবান কয়েকবার এক্সরে এবং বিভিন্নরূপী পরীক্ষার পর এই অভিমত প্রকাশ করলেন যে, মওলানা সাহেবের পিত্তকোষে পাথর হয়েছে এবং অপারেশন ছাড়া এর চিকিৎসার অন্য কোন উপায় নেই। মওলানা সাহেব অস্ত্রোপাচারে রাজি হলেন এবং ডাক্তার আসিরুদ্দীন অপারেশন করলেন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয় অপারেশন করেও কোন পাথরের সন্ধান পাওয়া গেলনা। মওলানা সাহেব মেডিক্যাল কলেজের বিশেষ ক্যাবিনে কয়েক মাস পর্যন্ত জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দোদুল্যমান হয়ে রইলেন। প্রতিদিন প্রায় ৫০ টাকা করে খরচ হতে লাগল। কয়েক মাস পর অস্ত্রোপাচারের জখম কিছুটা শুকানোর পর বাসায় (আরাফাত অফিসে) প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখানে আসার পর বেদনার শুধু পুনরাক্রমণই ঘটলনা বরং পূর্বাপেক্ষা তীব্রতর আক্রমণ ঘন ঘন হতে লাগল। আর কষ্টও এত অসহনীয়ভাবে বর্ধিত হত যে, অনেক সময় বেহুশীর ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিত। কিন্তু ধন্য তাঁর এবং সামাজিক কর্মতৎপরতার এতটুকুও ভাটা পড়লনা। সাপ্তাহিক আরাফাত ও মাসিক তর্জুমানুল হাদীসের সম্পাদনা, প্রবন্ধাদির রচনা, ইসলামী গ্রন্থরাজির প্রণয়ন, ঢাকাস্থ মাদ্রাসাতুল হাদীসের তত্ত্বাবধান এবং সর্বোপরি পূর্বপাক জমঈয়তে আহলেহাদীসের সভাপতিত্বের ন্যস্ত দায়িত্ব শেষ নিঃশ্বাস পরিত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে স্বীয় স্কন্ধে বহন করে গেলেন।
এত সব কাজের উপর পাকিস্তান শাসনতন্ত্র কমিশনের সম্মুখে পূর্ব পাকিস্তানের আলেম, ফাযেল একং ইসলামপন্থীগনের একটি শাসনতান্ত্রিক সুফারিশ প্রস্ত্তত এবং পেশ করার কাজ একান্ত জরুরী হয়ে দেখা দিল। আর শেষ এই মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই মওলানা আবদুল্লাহেল কাফীর জীবনবিনাস ঘটিয়ে দিল। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর আলেম, ফাযেল এবং চিন্তাবিদের একত্রিত করা এবং আলোচনা ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁদের বিশ্বাস ও অভিমতসমূহের মধ্যে সমন্বয় বিধান কত্ত বড় কঠিন এবং সমস্যাঙ্কুল কাজ তা সহজেই অনুমেয়। এর জন্য যে অপরিমেয় ধৈর্য এবং সাধনার অনুশীলন প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। প্রকাশ্যতঃ আর কেউ যখন এগিয়ে এলেন না, মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী তখন কিছুতেই স্থির থাকতে পারলেন না, নিজের স্বাস্থ্য এবং জীবন পণ রেখে এই কঠিন কাজের বোঝা স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিলেন। বেহুশ হয়ে পড়ার মাত্র দুদিন পূর্বে মওলানা সাহেব আমার নিকট থেকে এক পত্র বাহকের মারফত শর্ষিনার পীর মওলানা আবুজাফর সালেহ এবং মাদ্রাসা আলীয়া দারুস সুন্নতের সেক্রেটারীর টেলিগ্রাম ঠিকানা সংগ্রহ করে নিলেন। তাঁদের নিকট টেলিগ্রামে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দিলে তিনি তাঁর স্বাস্থের সঙ্কটজনক অবস্থার ভিতরেই মজলিসে শূরার সমুদয় বন্দোবস্ত করতে লাগলেন।
অতঃপর আমার নিবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি নিজেও প্রশ্নমালার উত্তর লিখতে বসে গেলেন, যদিও তাঁর পিত্তশূল ক্রমে বেড়ে চলেছিল। কিন্তু দেখা গেল মওলানা সাহেব তাঁর শয্যার সঙ্গে সংযুক্ত একটি ক্ষুদ্র টেবিলে কেতাবপত্র সংস্থাপন করে লিখে চলেছেন ডাইন হাতে অবিরাম গতিতে কলম চলছে, বাম হাতে বক্ষদেশে বেদনাস্থল চেপে রেখেছেন, মাঝে মাঝে বেদনার অনুভূতি যখন সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন হাত দিয়ে ডলা শুরু করছেন। এইভাবে দুই বেদনার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল একদিকে শরীর অভ্যন্তরে পিত্ত বেদনা অন্যদিকে মিল্লতের জন্য তাঁর অন্তর বেদনা। দুই বেদনার তুমুল সংগ্রাম। আল্লাহর মনোনীত বান্দা আবদুল্লাহেল কাফীর অটল সংকল্প : তিনি তাঁর আরম্ভ কাজ সমাপ্ত করবেন, তবে উঠবেন। মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন।।
পয়লা জুন, ১৯৬০। জমঈয়তের অফিস সেক্রেটারী মৌলবী মীযানুর রহমান বি.এ বি টি সাহেব উপরে এলে মওলানা সাহেবকে উপরোক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আরয করলেন, হযরত নিজের শরীরের উপর রহম করুন, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে একটু খেয়াল করুন, ডাক্তারের কড়া নির্দেশ; শরীরকে আরাম দিতে হবে।
মওলানা সাহেব উত্তর করলেন, আপনাদের মুখে ঐ এক কথা : স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য। কিন্তু আমি স্বাস্থ্যের দিকে কি নযর দিব-এখন আমার জানেরও কোন পরওয়া নেই, সমস্তই পাকিস্তান ও ইসলামের জন্য উৎসৃষ্ট। এখন আপনি যান, নিচে গিয়ে দফতরের কাজ দেখুন, আমাকে আমার কাজ শেষ করতে দিন। এই বলে পূর্ববৎ বাম হস্তে বক্ষস্থলে জোরে চেপে ধরে অশেষ কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় কাজ করে চললেন। কমিশনের ৪০টি প্রশ্নের ৩৮টি জওয়াব পর একদম অবশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। বেদনার তীব্রতার অনুভূতিহীন ও শক্তিহারা অবস্থায় মেঝের উপর স্থাপিত পালঙে নিপতিত হলেন আর এই পড়াই তাঁর শেষ পড়া আর উঠতে সক্ষম হননি। ব্যাস! এই ছিল দুনিয়ায় তাঁর শেষ কাজ-অন্তিম কর্তব্য। ২রা জুন বেদনা তীব্রতর আকারে দেখা দিল, একেবারে বরদাশত সীমার বাইরে চলে গেল, দুর্বলতাও ক্রমে বর্ধিত হয়ে চলল। ডাক্তারগণ হৃৎপিন্ডকে অবসাদমুক্ত ও সবল রাখার জন্য শরীরে রক্ত দিতে শুরু করলেন। কিন্তু ফল কিছুই হলনা। সংজ্ঞাহীনতা গভীরতার দিকেই এগিয়ে চলল।
৩রা জুন, শুক্রবার। আজ হজ্বে আকবর! আরাফাতের ময়দানে বিশ্ব মুসলিমের সম্মেলন দিবস! ঠিক এই দিবসেই মওলানা সাহেব কর্তৃক পরামর্শ সভার বৈঠকে আহুত। মওলানা সাহেবের মুদ্রিত দাওয়াতনামা পেয়ে বাঙ্গলার বিশিষ্ট আলেম, ফাযেল এবং চিন্তাবিদগণ রোগ প্রকোষ্ঠের সংলগ্ন নব সংস্কৃতি বৃহত্তর প্রকোষ্ঠে সমবেত। আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ সকলেই মওলানার পার্শ্বদেশে সমবেত। কিন্তু হায়! আমন্ত্রণকারী এবং মজলিসের প্রাণ স্বয়ং মওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় শয্যায় শায়িত-জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দীর্ঘ নিঃশ্বাস তিনি টেনে চলেছেন। ডাক্তারগণ, উলামা, ফুযালা, বন্ধুবর্গ, ছাত্রবৃন্দ সকলেই তাঁকে ঘিরে আছেন। ডাক্তাররা জওয়াব দিয়ে বলে দিলেন, ব্যাস, মাত্র দু এক ঘন্টার মেহমান তিনি। সকলে সমস্বরে জার জার হয়ে কাঁদতে লাগলেন। এমন মর্মবিদারক করুণ দৃশ্য জীবনে আর কখনও দেখিনি।
কিন্তু তবু সেই মহান কাজ সমাধা করতে হবে, যে কাজের দায়িত্ব মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী নিজ ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। আমার প্রস্তাবক্রমে মওলানা আকরম খান পরামর্শ সভার সভাপতি নির্বাচিত হলেন। আমি মওলানা সাহেবের আহবান, মজলিসে শূরার সূচনা আর আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করলাম। আর সর্বশেষ একটি সাব কমিটি গঠন করে তার উপর আনুষ্ঠানিক কাজের দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাব উত্থাপন করলাম এবং সর্বসম্মতিক্রমে মঞ্জুর হ’ল। হাজী মোহাম্মাদ আকীল সাহেব মওলানা সাহেবের হৃদয়ের শেষ রক্তবিন্দুর বিনিময়ে লিখিত কমিশনের প্রশ্নাবলীর জওয়াবের মুসাবিদা পেশ করলেন। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব মন্তব্য করলেন, এই মহান স্মৃতি বিজড়িত এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বে মহীয়ান মুসাবিদা সযত্নে সুরক্ষিত রাখার যোগ্য। আমি তখন বললাম, এই খসড়া রায়ীসুল আহরার মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহরের সেই ঐতিহাসিক সুদীর্ঘ চরমপত্রের সঙ্গে তুলনীয়, যা তিনি তাঁর রোগশয্যায় বসে ভয়ঙ্কর ও সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় ডাক্তারগণের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে ২রা জানুয়ারী লন্ডনের হাইড পার্ক হোটেল থেকে হিন্দুস্তান এবং মিল্লতে ইসলামিয়ার আযাদীর উদ্দেশ্যে বৃটেনের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের নাম লিখেছিলেন। সেই মেহনতের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ৩রা জানুয়ারী মূচ্ছিত হয়ে পড়েন। ৪ঠা জানুয়ারী ছুবহে সাদেকের সময় শাহাদৎ বরণ করেন। আজ এই সময় আল্লামা আবদুল্লাহেল কাফীর বেলাতেও ঠিক সেই একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মওলানা আকরম খান এবং অন্যান্য সকলেই এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হলেন।
এই প্রবন্ধ লেখকের প্রস্তাব ক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হ’ল যে পরামর্শ সভার পরবর্তী বৈঠক ঈদে কুরবানের পর ১০ই জুন আহবান করা হোক এবং সেই মজলিসের সম্মুখে লেখকের বিস্তৃত শাসনতান্ত্রিক চিত্র এবং মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী সাহেবের তত্ত্বমূলক প্রস্তাবনা উভয়ই পেশ করা হোক।
অতঃপর সকলেই বেদনা বিধুর অন্তরে আল্লামা আবদুল্লাহেল কাফী সাহেবের জন্য মোনাজাত করলেন। বৈঠকের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ সাহেব আবেগ বিহবল অন্তরে মন্তব্য করলেন ‘এ এক পরম বাঞ্ছিত মৃত্যু! ইসলামের এবম্বিধ আযিমুশশান খেদমতে স্বীয় শক্তি এবং দেহের শেষ রক্ত বিন্দু ব্যয় করতে করতে নিজের আহূত সভার সম্মুখে জীবন দানের এমন অনুপম তওফীক অর্জন ক‘জনের ভাগ্যে জুটে! দেখুন, ওর রক্তের সর্বশেষ কাতরাটিও ইসলামের খেদমতে নিবেদিত হচ্ছে।
আমরা এ ধরণের আলোচনায় রত এমনি সময় মওলানা সাহেবের শয়ন কক্ষে হঠাৎ জোর ক্রন্দনরোল উত্থিত হ’ল। সকলেই বৈঠক ছেড়ে মওলানা সাহেবের কামরার দিকে ধাবিত হলেন, গিয়ে দেখলেন তাঁর চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত, কন্ঠ নালিতে গোঁ গোঁ শব্দের কাতরানি এবং তিনি সম্পূর্ণ মুচ্ছিত! একবার মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত নিঃসৃত হয়েছে। এর আগে আর কোন সময় রক্ত নির্গত হয়নি। ডাক্তার বলেছিলেন এ আর কিছু নয়, অভ্যান্তরীন রক্ত প্রবাহ। অন্যদের ধারণা অপারেশনের স্থানে সেলাই ছিড়ে গিয়েছে এবং সম্ভবতঃ সেখান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে সকলেই নিরাশ হয়ে গেল। মজলিস তখন তখনই ভেঙ্গে গেল। সেদিন ছিল জুমার দিবস। আসরের ওয়াক্ত। শুক্রবার এভাবেই অতিক্রান্ত হ’ল। শনিবারের রাতও প্রায় শেষ হ’ল ইয়াওমুনন্নাহার (কুরবানীর দিবস) শনিবার ৪ঠা জুন, ১৯৬০ খৃ: ভোর ৪টা ২৫মিনিটে যখন মসজিদে মসজিদে আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে গেছে, জামাত খাড়া হবে, এমন শুভ মুহূর্তে আল্লামা আবদুল্লাহেল কাফী আল্লাহর আহবানে সাড়া দিলেন। তাঁর দাওয়াতে কবুল করে লাববায়েক বললেন। বাঙ্গালা তার প্রদীপ হারাল, পাকিস্তান আলোকশূন্য হ’ল। এলম ও দীনের মজলিস ভেঙ্গে গেল। ইসলাম জগত আজ এমন এক আলেম বাআমল, সত্য ও স্বাধীনতার জন্য উৎসৃষ্ট প্রাণ মুজাহেদ, সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক, প্রথিতযশা মুহাদ্দেস, মহামান্য মুফাসসের, অতুলনীয় তত্ত্ববিধ, ইসলামী শাসনতন্ত্র শাস্ত্রের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ঐন্দ্রজালিক বাগ্মিশ্রেষ্ঠ, আপদমস্তক দরদে ভরপুর দেশপ্রেমিক, মিল্লতের বেলালী রূহ ও বজ্রগম্ভীর ব্যক্তিত্ব হতে চিরতরে বঞ্চিত হল। যিনি সারা জীবন লক্ষ লক্ষ অসাড় দেহে জীবনবহ্নি প্রজ্জ্বলিত করেছেন, সহস্র সহস্র আড়ষ্ট মস্তিস্ককে রওশনদীপ্ত ও বুদ্ধি সচেতন করে তুলেছেন এবং সংখ্যাতীত নওজোয়ানকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেঊন)।
ঢাকাস্থ বংশাল জামে মসজিদে মওলানা কবীরুদ্দীন রহমানী সাহেব জানাযায় ইমামতি করলেন। জানাযায় বহু ব্যক্তি অংশ গ্রহণ করেন। যোগদানকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রাক্তন গবর্ণর জেনারেল খাওয়াজা নাজিমুদ্দীন, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক উযিরে আলা মি: নূরুল আমীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মওলানা মরহুমের অছিয়ত মুতাবেক শবদেহ বৈকালিক ট্রেনে দিনাজপুর জিলাস্থ নূরুল হুদা গ্রামে প্রেরিত হ’ল। ময়মনসিংহ, জামালপুর, বাহাদুরপুর, বোনারপাড়া গাইবান্ধা, রংপুর প্রভৃতি স্টেশন হতে শত শত লোক জানাযার সঙ্গে সঙ্গে নূরুলহুদা অভিমুখে রওয়ানা হল। ৫ই জুন, ১৯৬০ খৃ: রবিবার অপরাহ্নে শবদেহ নূরুল হুদা পৌঁছল। সহস্র সহস্র লোক পুনঃ জানাযায় অংশগ্রহণ করল। লোকাধিক্য ও ভীড়ের দরুণ নূরুলহুদায় দু’ দুবার জানাযার নামাযের ব্যবস্থা করতে হ’ল। সূর্য পশ্চিম দিক চক্রবালে ঢলে পড়ার প্রাকমুহূর্তে ইলম ও জিহাদের এই আলোক-উজ্জ্বল সূর্যকে তাঁহার মহামান্য পিতা ও মাতার পাদদেশে সমাধিস্থ করা হ’ল। ইছলামী শাসনতন্ত্রের জন্য এবার ঈদে কুরবানের আনন্দকে বিসর্জন দেওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প এবং ঈদের কুরবানের পূর্বেই নূরুল হুদায় পৌঁছার প্রবল আকাঙ্খা দুই-ই এরূপ আশ্চর্যজনক ভাবে পূর্ণ ও বাস্তবায়িত হ’ল।
মাওলানা রাগেব আহসান