সন্তানদের প্রতি উম্মে হাকীমাহর উপদেশমালা

মুখতারুল ইসলাম 1183 বার পঠিত

১ম উপদেশ : সাবধান, হে আমার বৎস! মানুষ ও কোন জিনিসের ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত না হয়ে কোন ধরনের অপ্রীতিকর মন্তব্য করতে যেও না। প্রতিটি আনীত খবরের খুঁটিনাটি যাচাই বাছাই কর এবং মুখরোচক কথার উপর ভিত্তি করে তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নিও না। ব্যক্ত করা প্রতিটি কথা এবং অর্ধেক দেখা কোন বিষয়কে বিশ্বাস করতে নেই। আল্লাহ যখন তোমাকে কোন শত্রুর মোকাবেলায় পেশ করে, তখন তুমি তাকে ইহসানের অস্ত্র ছুঁড়ে মার। মন্দকে সুন্দর আদর্শ দিয়ে প্রতিহত কর। আমি আল্লাহর কসম কেটে বলতে পারি, তুমি চিন্তাই করতে পারবে না যে, কিভাবে শত্রুতা অসম্ভব রকমের ভালবাসায় পরিণত হয়!

যদি তুমি কোন বন্ধুর ভালবাসার সত্যতা যাচাই করতে চাও, তবে তুমি তার সাথে সফরে বেরিয়ে পড়। তাহলেই তোমাদের মাঝে ভালবাসার হাকীকত সম্পর্কে জানতে পারবে। কেননা সফর প্রকৃতার্থে মানুষের বাহ্যিক বন্ধুত্বের খোলস ছিন্ন করে এবং প্রকৃত মন্যুষত্ব অর্থাৎ বন্ধুত্ব খাঁটি না মেকী তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

২য় উপদেশ :  তুমি যদি কোন বিষয়ে সত্যবাদী হও আর মানুষেরা তোমার উপরে সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করে; তোমাকে নিয়ে কটু কথা বলে, তবে তাতে তোমার কোন যায় আসেনা। তুমি তা হাসি মুখে বরণ করে নাও। যখন এই মানুষগুলো প্রকৃত সত্য বুঝতে পারবে, তখন তারাই তোমাকে সফলকাম ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে মেনে নিবে। কেননা মৃত কুকুর কখনও লাথি দিতে পারে না। আর এটাই সত্য যে, ফলদার বৃক্ষেই মানুষেরা ঢিল ছুঁড়ে।

তুমি যখন কারো সমালোচনায় প্রবৃত্ত হও, তখন মৌমাছির দৃষ্টিতে মৌচাক অবলোকন করবে। মানুষের চোখে মৌচাক অবলোকন করতে যেও না। নইলে দূর্গন্ধময় যমীনে পতিত হবে।

৩য় উপদেশ : রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাও। কেননা সকালে রিযিকে বরকত প্রদান করা হয়। আমার ভয় হয় রাতভর জেগে থাকার ফলে তুমি রহমানের প্রদত্ত বরকত থেকে  বঞ্চিত হয়ে যাবে।

৪র্থ উপদেশ : আজ আমি তোমার কাছে একটি বকরী ও নেকড়ের গল্প শুনাব। যে তোমার সাথে শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়, তাকে বিশ্বাস করো না।

আর যদি কেউ তোমার উপর আস্থা রাখতে চায়, তবে তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ো; সাবধান কখনও তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।

সিংহের গুহায় চল তোমাকে কিছু শিখাই। দেখ, বৎস! সিংহ জঙ্গলে তর্জন-গর্জন করে বলেই তাকে জঙ্গলের রাজা বলা হয় না। বরং তার আত্মমর্যাদাবোধই তাকে এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। কেননা যখন সে ক্ষুধার্ত হয়, ভীষণ ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে। তবুও সে অন্যের শিকারের উপরে হামলে পড়ে না।

তুমি খবরদার কারো পরিশ্রমলব্ধ কোন কিছু চুরি করে নিবেনা। নইলে পরে তুমিই সবচেয়ে বড় যালেমে পরিণত হবে।

৫ম উপদেশ : চল হে বৎস! তোমাকে এবার কুশলী গিরগিটি দেখিয়ে নিয়ে আসি। তুমি নিজে চোখেই দেখবে যে, সে কিভাবে অবস্থাভেদে তার রং পাল্টায়। মানুষের মধ্যেও অনেকেই বর্ণচোরা রয়েছে যারা সময়মত তাদের রং বদলায়। সমাজে অনেককে মুনাফিক দেখবে; প্রয়োজনমত নিজের লেবাস পরিবর্তন করে; নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজেকে রং ও লেবাসের আবরণে ঢেকে ফেলে।

হে  প্রিয় বৎস! শুকরিয়া আদায়ের অভ্যাস গড়ে তোল। তুমি চলতে পার; শুনতে পাও; দেখতে পাও; মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয়? তুমি আল্লাহর বেশী বেশী শুকরিয়া আদায় কর। কেননা তার প্রতি কৃতজ্ঞ বান্দাদের আল্লাহ বহুগুণে বাড়িয়ে দেন।

মানুষের প্রতিও তুমি কৃতজ্ঞ হও; তাদের জন্য খরচ কর। দেখবে তাদের নিকট তোমার মানমর্যাদা ও ভালোবাসা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

৬ষ্ঠ উপদেশ : হে প্রিয় বৎস! আমি আমার জীবনে আবিস্কার করেছি যে, জীবন চলার পাথেয় হিসাবে সততা একটি মহৎ গুণ। অনেক সময় মিথ্যা বলে পার পাওয়া যায়। কিন্তু তদস্থলে সত্যকে আবিস্কারই করাই তোমার জন্য অতি উত্তম ও কল্যাণকর। 

৭ম উপদেশ : হে বৎস! প্রতিটি বিষয়ে তোমার বিকল্প কিছুর করার চিন্তা থাকতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে পূর্ণ প্রস্ত্ততি থাকতে হবে। বিষয়টা যেন এমন না হয় যে, কাউকে সে বিষয়ে অনুরোধ করতে গিয়ে অপমানিত ও লাঞ্চিত হতে হয়।

জীবনে প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাও। আজকে সহজভাবে যে সুযোগ পেয়েছ, পরবর্তীতে সেটা নাও পেতে পার। মনে রাখবে, সুযোগ জীবনে বার বার আসে না।

৮ম উপদেশ : জীবনে অভিযোগ এবং বিড়ম্বনায় পড়ে যেওনা। আমি চাই তুমি আশাবাদী হয়ে জীবনকে এগিয়ে নাও। হতাশাবাদী ও ব্যর্থ লোকদের সঙ্গ ত্যাগ কর। সর্বোতভাবে কুসংস্কারচ্ছন্ন ব্যক্তি থেকে সাবধান।

৯ম উপদেশ : কোন ব্যক্তির বিপদে খুশী হয়োনা। কোন লোকের চেহারা আকৃতি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে নেই। কেননা কোন ব্যক্তিই নিজের সৃষ্টিকর্তা নয়। যদি তুমি হাসি ঠাট্টা করেই থাক, প্রকৃতপক্ষে তোমার তামাশা তার সত্তার উপরই বর্তায়, যে সত্তা তাকে আকৃতি দিয়েছেন; সৃষ্টি করেছেন; রং ঢং দিয়ে পরিপাটী করেছেন।

১০ম উপদেশ : কোন মানুষের দোষক্রটি নিয়ে সমালোচনা করা ঠিক নয়। নয়তো পাছে মহান আল্লাহ তোমার আবাসস্থলেই দোষক্রটি উন্মোচন করবেন। মনে রেখ, আল্লাহ দোষক্রটি গোপনকারী। দোষক্রটি গোপনকারীকে আল্লাহ ভালবাসেন এবং তিনি কারো প্রতি সামান্যতম যুলুম করেন না। যদি তোমার দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়, মনে রেখ, মহান আল্লাহ সবার উপরে ক্ষমতাবান।

১১তম উপদেশ : যখন তুমি কারো সাথে আচরণে কঠোরতা অনুভব কর, তখন তুমি ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও। তুমি চমকিত হবে কিভাবে এমন হস্ত স্পর্শে হৃদয়ের কঠোরতা ছুয়ে যায় এবং তা হৃদয় থেকে দূরীভূত হয়।

তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাগ কর। কেননা তর্কবিতর্কে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি মনে হয় যে, বাহাছে আমরা হেরে গেছি, তবে মনে রাখতে হবে, মূলতঃ আমরা আমাদের অহংকারকেই কবর দিয়েছি। আর যদি জিতে যাই, তবে অন্য ভাইয়ের ক্ষতির কারণ হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কেননা একপক্ষ ভাবে, বিজয় লাভ করেছি এবং অপরপক্ষ ভাবে, পরাস্ত হয়েছি।

১২তম উপদেশ : একাকী সব বিষয়ে মতামত প্রদানকারী হয়ো না। বরং কাউকে প্রভাবিত করা এবং প্রভাবিত হওয়ার মধ্যে সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে। তুমি যদি কোন বিষয়ে সত্যবাদী  হও, অন্যের মতের তোয়াক্কা করো না। প্রভাবিত না হয়ে, নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অটল থাক।

হে আমার বৎস! যাদু বা প্রতারণার আচরণে নয়, বরং মধুময় শব্দ চয়ন এবং মুচকি হাসির ঝলকে মানুষের অজান্তেই তাদের অন্তরে জায়গা করার অদম্য শক্তি তোমায় অর্জন করতে হবে। যাতে করে তাদের উপর তুমি বিশেষ প্রভাব বলয় তৈরী করতে পার। মহান আল্লাহ পবিত্র যিনি মুচকি হাসিকে আমাদের ধর্মে ইবাদত হিসাবে গণ্য করেছেন এবং এর পুরস্কারও নির্ধারণ করেছেন। চীন দেশে দোকান মালিকদের মুচকি হাসি বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। নচেৎ তাদের দোকান চালানোর অনুমতিই মিলবে না। তোমার সামনে যদি কোন ব্যক্তি মুচকি হাসি না দেয়, তবুও তুমি তার সামনে মুচকি হাসি দিবে। মুচকি হাসিতে যখন তোমার মুখটা হাসিময় হয়ে উঠবে, তখনই ব্যক্তিটির অন্তর বিগলিত হবে এবং তুমি তোমার হাসির প্রতিচ্ছবি তার চেহারায় দেখতে পাবে।      

যখন তোমার ব্যাপারে মানুষের মাঝে সন্দেহের দানা বেঁধে উঠবে, তখন তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর এবং নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সকল সন্দেহের উর্ধ্বে নিজের অবস্থান পরিস্কার করবে। অনধিকারচর্চা করতে গিয়ে সব বিষয়ে নাক গলাতে যেওনা। সমাজের মানুষ যেভাবে জীবনের ছন্দ মিলায় সেভাবে ছন্দ মিলাও। হে আমার বৎস! এসব অসহিষ্ণু ও আমার অপসন্দনীয় কর্মকান্ড পরিহার করে উন্নত জীবন গঠন কর।

১৩তম উপদেশ : হে আমার বৎস! ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। মনে রেখ মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিই করেছেন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এবং তিনি দেখে নিতে চান কে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ছবরকারী। তবুও কি আমরা ছবর করব না? জীবনের কষ্টগুলো সহজভাবে নাও, হতাশায় মুষড়ে পড়ো না। মনে রেখ, কষ্টের পরবর্তী স্বস্তির জীবন খুবই নিকটবর্তী। কেননা প্রকান্ড মেঘের ঘনঘটার পরই প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।

১৪তম উপদেশ : অতীতের জন্য দুঃখ করো না। অতীতে যা হওয়ার যথেষ্ট হয়েছে; অতীত তো অতীত। অতীতের ছেলেমানুষী নিয়ে পড়ে না থেকে ভবিষ্যতের বীজ বপন করি।

১৫তম উপদেশ : ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হও, নিজেকে প্রস্ত্তত কর, ভবিষ্যত বিনির্মাণে জামার হাতা গুটিয়ে নাও। নিজের জীবনের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে উঠ। নিজেকে  গৌরবময় মঞ্চে উপস্থাপন কর। অন্যরা তোমাকে সেভাবেই দেখবে। সাবধান! হীনমন্য ও  ছোট ভেবে নিজের জীবনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না। তুমি বড় স্বপ্ন দেখলে তবেই তো তুমি বড় হবে। তুমি তাদের মত হয়ো না যারা ছোট স্বপ্নের পেছনে পড়ে থাকে এবং অবশেষে জীবনে ছোটই থেকে যায়।

তুমি যদি পুরো দুনিয়ার সংস্কার চাও। আমি তোমাকে বলব যে, আমি তোমার কাছ থেকে এমন আশা করিনি। আর আমি এও আশা করিনি যে, সমস্ত অন্যায়, অপকর্ম থেকে আমরা সকলে মুক্তি পাব। তুমি চিন্তা করে দেখ, ধোঁকাবাজ ও মিথ্যুকদের অভয়ারণ্যে এ দুনিয়াতে মহৎ ব্যক্তিবর্গ কিভাবে বেঁচে আছে? আমরা কোত্থেকে রিযিক পাচ্ছি? কিভাবে আমরা অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে দুনিয়ায় বসবাস করতে পারছি?

১৬তম উপদেশ : হে আমার বৎস! তুমি যখন আমার পেটে ছিলে, তখন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, তোমাকে আমি প্রতিপালন করে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত করব। আর তুমি আমাকে বলছ, আম্মু আপনি আমার ব্যাপারে এত তাড়াহুড়া করছেন (আমি তো বড়ই হয়নি) কেন? ঠিক আছে ব্যাটা, তুমি এটাও স্মরণ রাখ যে, মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে অলৌকিকভাবে কোন কিছু পেয়ে যায় না। বরং কর্ম দিয়েই নিজের বড়ত্ব অর্জন করে নিতে হয়।

[অনুবাদক : কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]



বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
আরও