মাশহুর বিন হাসান বিন মাহমূদ আলে সালমান
মুখতারুল ইসলাম
আব্দুল হাকীম 2399 বার পঠিত
বহুমুখী
জ্ঞানের অধিকারী হিসাবে এক অনবদ্য বিদ্বান হলেন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ
রাসলান হাফিযাহুল্লাহ। মিশরে যারা সালাফী আক্বীদা ও মানহাজকে প্রচার ও
প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি তাদের অন্যতম। নিম্নে তাঁর
সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম উপস্থাপন করা হলো।
নাম ও জন্ম : ফযীলাতুশ শায়খ মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ ইবনু আহমদ রাসলান আল মাকানী। তিনি ১৯৫৫ সালের ২৩ নভেম্বর মিশরের কায়রো নিকটবর্তী মুনুফিয়্যাহ অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষাজীবন : শায়খ রাসলান আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন এবং সার্জারির উপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। সাথে সাথে তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আওতাধীন আরবী ভাষা- সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলমুল হাদীছে মুমতায ফলাফলের সাথে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার মাষ্টার্স গবেষণা কর্মের শিরোনাম ছিল ضوابط الرواية عند المحدثين। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও সম্পন্ন করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল الرواة المبدعون من رجال الكتب الستة।
আক্বীদা : নবী করীম (ছাঃ), তাঁর ছাহাবী, তাবেঈ এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর অনুসৃত ব্যক্তিবর্গের আক্বীদা তথা সালাফে ছালেহীনের অনুসরণে অনড় এক ব্যক্তিত্ব হলেন শায়খ মুহাম্মদ ইবনু সাঈদ রাসলান। তিনি আক্বীদার ক্ষেত্রে সালাফদের আক্বীদার অনুসরণে এক শক্তিশালী পাহাড়ের ন্যায় সুদৃঢ়। প্রত্যেক যুগে যেমন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর অনুসৃত ব্যক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহে দুনিয়ায় থাকেন তিনিও বর্তমানে তাদের মতই এক ব্যক্তিত্ব। নিম্নে তার সংস্কারমূলক দাওয়াতী কার্যক্রমের কিছু প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরা হ’ল :
ক. রাফেযীদের পদস্খলন এবং গোমরাহী নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং মুসলিমদের সাথে যুদ্ধের সময় রাফেযীরা যে ইহুদীদের পক্ষ নিয়েছে তিনি তার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছেন।
খ. সালাফদের পরবর্তী সময় থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত যারা আক্বীদায় বিভ্রান্ত তিনি তাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা العلمانية ও উদারতাবাদ الليبرالية -এর আলোচনায় বাহাইয়্যাহ ((البهائية ও বাবিয়্যাহ ((البابية দের বিভ্রান্তি তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি গণতন্ত্র ((الديمقراطية ও হিযবিয়্যাহ ((الحزبية -এর প্রতিরোধ করেছেন বিশুদ্ধ আক্বীদার মাধ্যমে। বিশেষতঃ তিনি শী‘আ ও রাফেযীদের প্রকৃত চেহারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এর আক্বীদার মাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন। যাতে করে জনগনের নিকটে তাদের বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয় এবং সালাফদের আক্বীদা তাদের গ্রহণ করতে সহজ হয়।
মানহাজ : শায়খ মুহাম্মদ ইবনু সাঈদ রাসলান সালাফী মানহাজের একজন সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ও একজন নির্ভরযোগ্য দাঈ। তাঁর বক্তব্য, লেখনী এবং দারসের বদৌলতে সারাবিশ্বে অনলাইনের মাধ্যমে সালাফী দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার এক অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি সাইয়েদ কুতুব এবং তাঁর বইসমুহ, তাঁর মতবাদ খন্ডন করে অনেক বই লিখেছেন এবং সাইয়েদ কুতুবের মতবাদকে দলীল ভিত্তিক বাতিল প্রমাণ করেছেন। তাঁর সালাফী মানহাজের দাওয়াহ সম্পর্কে ফযীলাতুশ শায়খ সুহায়মী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, ‘মহান আল্লাহর প্রশংসা আমি তাঁকে চিনি। তাঁর দ্বারা সালাফী দাওয়াতের বিশাল খেদমত মহান আল্লাহ কবুল করেছেন। তাঁর দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো আল কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। আমি জানি দূর দুরান্তের অনেকেই তাকে চেনে না। কেননা তিনি সাদাসিধে জীবন যাপনকেই পসন্দ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দূরদৃষ্টি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এজন্য যখনই তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর নামে যেখানেই বিভ্রান্তি দেখতে পান তিনি উত্তম পন্থায় তার খন্ডন করেন। আর এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তাঁর গণতন্ত্রী এবং হিযবীদের খন্ডন। মোটকথা - তিনি আল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল ভিত্তিক জারহ ওয়া তা‘দীল এবং ইলম ও আদবের সমন্বয়ে খন্ডন করেন।
উল্লেখযোগ্য কর্মসমূহ : শায়খ রাসলান বক্তব্য এবং দারসের প্রতি বেশী মনোযোগ দিয়ে থাকেন। তাঁর অনেক মৌলিক কিতাবের দারস রয়েছে। তিনি একাধারে তাফসীর, উসূলে তাফসীর, হাদীছ, উসূলে হাদীছ, ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ, আক্বীদা, মানহাজ, ফারায়েয, সীরাত প্রভৃতি বিষয়ে দারস দিয়েছেন। এসব বিষয় সামনে রেখেই তিনি প্রায় দেড় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রদত্ত হ’ল :
১. ফাযলুল ইলমী ওয়া আদাবু তলাবাতিহি ওয়া তুরুকু তাহসীলিহি ওয়া জামঈহি (فَضْلُ الْعِلْمِ وَآدَابُ طَلَبَتِهِ وَطُرُقُ تَحْصِيلِهِ وَجَمْعِهِ) ।
২. দাআইমু মিনহাজিন নুবুওওয়্যাহ (دَعَائِمُ مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ)।
৩. যওয়াবিতুর রিওয়ায়াতি ইন্দাল মুহাদ্দিছীন (ضَوَابِطُ الرِّوَايَةِ عِنْدَ الْمُحَدِّثِينَ) এটা তিন খন্ডে প্রকাশিত মাষ্টার্স থিসিস।
৪. আর রুওয়াতুল মুবাদ্দিঊনা মিন রিজালিল কুতুবিস সিত্তাহ (الرُّوَاةُ الْمُبَدَّعُونَ مِنَ رِجَالِ الْكُتُبِ السِّتَّةِ) এটা তার পিএইচডি থিসিস। যা চার খন্ডে প্রকাশিত।
৫. ফাযলুল আরাবিয়্যাহ ওয়া উজুবু তাআল্লুমিহা আলাল মুসলিমীন (فَضْلُ الْعَرَبِيَّةِ وَوُجُوبُ تَعَلُّمِهَا عَلَىالْمُسْلِمِينَ)।
৬. শারহু উসূলিস সুন্নাহ লিল ইমাম আহমাদ (شَرْحُ أُصُولِ السُّنَّةِ لِلْإِمَامِ أَحْمَدَ)। দুই খন্ড।
৭. শারহু কিতাবিল আদাবিল মুফরাদ (شَرْحُ كِتَابِ الْأَدَبِ الْمُفْرَدِ)
৮. শারহু তাতহীরিল ই‘তিকাদ লিস সন‘আনী।
৯. শারহু মুযাক্কিরাতিত তাওহীদ লিল আল্লামাহ আব্দুর রাজ্জাক আফীফী।
১০. আল ওয়াযঊ ফিল হাদীস ওয়া জুহুদুল ওলামাই ফী মুওয়াজাহাতিহ (الْوَضْعُ فِي الْحَدِيثِ وَجُهُودُ الْعُلَمَاءِ فِي مُوَاجَهَتِهِ)।
১১. যওয়াবিতুল কিতাবাহ ইন্দাল মুহাদ্দিছীন।
১২. আদাবু ত্বলিবিল ইলম (آدَابُ طَالِبِ الْعِلْمِ)।
১৩. যাম্মুল জাহলি ওয়া বায়ানু ক্ববীহি আছারিহ (ذَمُّ الْجَهْلِ وَبَيَانُ قَبِيحِ أَثَرِهِ)।
১৪. আত তারহীব মিনার রিবা (التَّرْهِيبُ مِنَ الرِّبَا)।
১৫. তাহযীবু শারহি আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ লি ইবনি ঊছাইমীন।
১৬. মাওকিফুস ছাহাবাহ মিন রিওয়ায়াতিল হাদীছ।
১৭. আহাম্মুল মুছান্নাফাত ফী ইলমির রিওয়ায়াহ।
১৮. শারহুল কাওয়াইদিল আরবা‘ (شَرْحُ الْقَوَاعِدِ الْأَرْبَعِ)
১৯. শুরূতু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া নাওয়াকিযুল ইসলাম।
২০. কিরাআতুন ওয়া তা‘লীকুন ওয়া তাখরীজুন লিরিসালাতি শায়খিল ইসলাম ইবনি তাইমিয়্যাহ আল ঊবূদিয়্যাহ।
২১. কিরাআতুন ওয়া তা‘লীকুন ওয়া তাখরীজুন লিরিসালাতি শায়খিল ইসলাম ইবনি তাইমিয়্যাহ আল আমরু বিল মারূফ ওয়ান নাহয় আনিল মুনকার।
২২. তামামুল মিন্নাহ ফিত তা‘লীকী আলা শারহিল উসূলিস সুন্নাহ লি ইবনি ঊছায়মীন।
বিনয় ও নম্রতা : শায়খ মুহাম্মদ ইবনু সাঈদ রাসলান চাল চলন ও আচার-আচরণে এক অনুপম ব্যক্তিত্ব। তাঁর নম্রতা ও ভদ্রতা সবার জন্য অনুপম দৃষ্টান্ত। সালাফদের যেমন যুহদ বা দুনিয়াবিমুখতা ছিল, তেমনই যুহদ তার মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যখনই ছাত্রদের সাথে মিলিত হন তিনি নিজেই সালাম প্রদান করেন ছাত্র যত ছোটই হৌক না কেন। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ইলমী ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও এখনো তালেবুল ইলমদের ন্যায় চলাচল করতে পসন্দ করেন। প্রশংসার জোয়ারে ভাসতে কিংবা বড়ত্ব ও আমিত্ব কোথাও যেন পরিলক্ষিত না হয় এজন্য তিনি সদা সচেষ্ট থাকেন। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হ’ল তিনি বক্তব্য ও দারসের সময় ক্বিয়ামত ও আখেরাতের ভীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে অনেক কান্না করেন। যেমন তার জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী (بين الحياة والممات) এবং নির্জনে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অন্তরকে সুরক্ষা প্রদান (رقابة السر ورعاية الضمير) বক্তব্যটি একারণে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
শায়খ সম্পর্কে বিদ্বানদের মন্তব্য : শায়খ রাসলান সম্পর্কে বর্তমান সময়ের নির্ভরযোগ্য অনেক বিদ্বান গ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেছেন। যার মাধ্যমে শায়খের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। যেমন :
ক. আল্লামা হাসান ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, মিশরে যারা সালাফী দাওয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, তাঁরা হলেন শায়খ ‘আলী হাশীশ, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ রাসলান (হাফিঃ)।
খ. শায়খ ড. ফালাহ ইবনু ইসমাঈ মান্দাকার (রাহিঃ) বলেন, ‘আমি শায়খের সান্নিধ্যে থাকা, তাঁর দারস শ্রবণ করা এবং তাঁর থেকে ফায়দা গ্রহণ করার নছিহত করছি। আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে দেখেছি যে, তিনি সুন্নাহ, সালাফিয়্যাহ ও শারঈ শিষ্টাচারের ব্যাপারে প্রবল আগ্রহী। আমি তাঁকে দেখেছি যে, তিনি একজন দুনিয়াবিমুখ পরহেযগার মানুষ। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে ও তাঁকে দ্বীনের উপর সুদৃঢ় রাখেন এবং আমাদেরকে ও তাঁকে (সৎকর্মের) তাওফীক্ব দান করেন’।
তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের জন্য আকাবির তথা বড়দের আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। আল্লাহর রহমতে মিশরে তোমাদের কাছে আছেন শায়খ হাসান ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব আল-বান্না এবং শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ রাসলান। তোমাদের জন্য এই বড়দের আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। তাঁদের কাছে ভাইদের একত্রিত করো এবং তোমাদের সমস্যাগুলো এই বড়দের কাছে উপস্থাপন করো। বড়দের দিকে ফিরে যাওয়ার মধ্যে বিরাট কল্যাণ এবং মহান উপকারিতা রয়েছে’।
গ. ফযীলাতুশ শায়খ সুলাইমান ইবনু সালীমুল্লাহ আর-রুহাইলী (হাফিঃ)-কে মিশরের কোন শায়খের দারসে উপস্থিত হওয়া যাবে মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি শায়খ রাসলানের দারসে বসায় উদ্বুদ্ধ করেন এবং বলেন, ‘আমি শায়খ রাসলানকে চিনি তাঁর বক্তব্য শোনার মাধ্যমে। তিনি স্বীয় আক্বীদাহ ও মানহাজে শক্তিশালী ব্যক্তি’।
এছাড়া শায়খ মুহাম্মদ ইবনু রাবী ইবনু হাদী আল মাদখালী, শায়খ আহমাদ ইবনু ওমর বাযমুল, শায়খ সা‘দ আল হুসাইন, শায়খ আহমাদ সালিম সহ প্রমুখ সালাফী বিদ্বান তাঁর সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করি তিনি যেন শায়খ রাসলানকে হায়াতে তায়্যিবাহ দান করেন। বিশুদ্ধ আক্বীদা ও সালাফী মানহাজের একজন একনিষ্ঠ রাহবার হিসাবে কবুল করেন- আমীন!
[লেখক : শিক্ষার্থী, হাদীছ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ]