ইতিহাস কথা বলে : পর্ব-৩
মেহেদী আরীফ
যহুরুল ইসলাম 2403 বার পঠিত
আমরা দিন দিন যত আধুনিক হচ্ছি, আমাদের ভিতর থেকে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির চেতনাবোধ ততোটাই হারিয়ে যাচ্ছে। অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে বাঁচা বড় দায় হয়ে গিয়েছে। শারঈ বিধান এবং ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চেয়েও আমাদের নিকট স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বস্তাপচা সংস্কৃতি। আমাদের জীবনে অন্যতম মূল্যায়নযোগ্য বিষয় হ’ল সময় তথা দিন-তারিখ ও বছর গণনা।
কারণ, সময়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ইসলামী ঐতিহ্য, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসব এবং আমাদের মূল্যবান ইবাদত বন্দেগী। এজন্য প্রত্যেক মুসলমান ভাইয়ের লক্ষ্য করা উচিত, যেন এই মূল্যবান সময়ের গণনা একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর সম্মানিত রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় হয়। কিন্তু বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমান দিন-তারিখ গণনার ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন হয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় বুঁদ হয়ে আছে। সেকারণ, মুসলিম জীবনে দিন-তারিখ গণনায় ইসলামী পদ্ধতি কী এবং এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
মুসলমানদের জীবনে দিন-তারিখ ও বছর গণনা হবে চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী :
মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তা‘আলা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, নিশ্চয় আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাসসমূহের গণনা হ’ল বারোটি। যার মধ্যে চারটি মাস হ’ল ‘হারাম’ (মহাসম্মানিত)। এটিই হ’ল প্রতিষ্ঠিত বিধান। অতএব এ মাসগুলিতে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। আর তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সঙ্গে থাকেন’ (তাওবা ৯/ ৩৬)। তদুপরি মহান আল্লাহই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে আমরা এই বারোটি মাসের গণনা করবো।
মহান আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি সূর্যকে করেছেন কিরণময় ও চন্দ্রকে করেছেন জ্যোতির্ময় এবং ওর গতির জন্য মনযিল সমূহ নির্ধারণ করেছেন। যাতে তোমরা বছরের গণনা ও সময়ের হিসাব করতে পার। আল্লাহ এগুলিকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিদর্শন সমূহ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য’ (ইউনুস ১০/৫)।
তাফসীরে আল্লামা ইমাম বাগাভী (রহঃ) তাঁর গ্রন্থ তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করেছেন, বারো মাস হ’ল- মুহাররম, ছফর, রবীঊল আউয়াল, রবীঊল আখের, জমাদিউল উলা, জমাদিউল আখেরাহ, রজব, শা‘বান, রামাযান, শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হ’ল- মুহররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ।[1]
মুহাররম : মুহাররম-এর অর্থ হ’ল পবিত্র, সম্মানিত। যেহেতু এটি হারাম মাসের একটি। তাই একে মুহাররম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
ছফর : ছফর শব্দের অর্থ খালি হওয়া। কেননা হারাম মাস মুহাররমের পরে সবাই ঘর ছেড়ে যুদ্ধে বের হত, তাই একে ছফর বা খালি নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রবীঊল আউয়াল, রবীঊল আখের : এ দুই মাস নামকরণের সময় রবী‘ তথা বসন্তকালে এসেছে। তাই এ দুই মাসকে প্রথম বসন্ত ও শেষ বসন্ত অর্থাৎ রবীঊল আউয়াল ও রবীঊল আখের বলা হয়।
জমাদিউল উলা, জমাদিউল আখেরাহ: জমদ শব্দের অর্থ হ’ল, বরফ জমাট বাধা। যেহেতু এ দুইমাসে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া হওয়ার কারণে বরফ জমাট বাধে, তাই মাস দ্বয়কে জমাদিউল উলা ও জমাদিউল আখেরাহ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
রজব : রজব শব্দের অর্থ সম্মান করা। এ মাসকে সম্মান করে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকা হয়, তাই এ মাসকে রজব নামে নামকরণ করা হয়েছে।
শা‘বান : এর অর্থ হ’ল বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়া। যেহেতু হারাম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকার পর আরবরা শা‘বান মাসে আবার তাদের আক্রমণের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হত, তাই একে শা‘বান নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রামাযান : রময শব্দের অর্থ-দগ্ধ হওয়া। রামাযান মাসে গরমের প্রচন্ডতার কারণে এ মাসকে রামাযান নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ মাসের নাম মহাগ্রন্থ আল কুরআনে উল্লেখ আছে।
শাওয়াল : শাওয়াল শব্দের অর্থ কমে যাওয়া। যেহেতু সে সময়ে আরবদের উটের দুধ নানা কারণে কমে যেত। তাই এ মাসকে শাওয়াল নামে নামকরণ করা হয়েছে।
যিলক্বদ: ক্বা‘দা শব্দের অর্থ বসে থাকা। সম্মানিত ও হারাম মাস হওয়ার কারণে আরবরা যুদ্ধ বিগ্রহে না গিয়ে বসে থাকত। তাই একে যিলক্বদ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
যিলহজ্জ: যিলহজ্জ শব্দের অর্থ হজওয়ালা। যেহেতু এ মাস হজ্জের মাস। তাই একে যিলহজ্জ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, চন্দ্র মাস গণনা তথা হিজরী সন গণনা করা শারঈ বিধান ও মুসলিম ঐতিহ্য অনুসরণ।
চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী গণনা হওয়ার যৌক্তিকতা :
ইসলামের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দিন-তারিখগুলোকে খৃষ্টীয় সন-তারিখে রূপান্তরিত করে পালন করা বা স্মরণ করার মধ্যে কোন যৌক্তিকতা বা উপকারিতা নেই।
কারণ এসব ঘটনা যেসব মাস বা দিনে হয়েছে সেগুলোর আলাদা তাৎপর্য আছে। যেমন বদর যুদ্ধের দিনের কথা বলতে পারেন। যুদ্ধটি হয়েছে রামাযান মাসে। কুরআন নাযিলের মাসে। এখন এ যুদ্ধদিনের তারিখকে খৃষ্টীয় সনে অনুসরণ করে স্মরণ করলে একসময় দেখা যাবে দিনটি আর রামাযান মাসে নেই। তখন এ যুদ্ধের ইতিহাসের যে আবেদন রয়েছে, তা কিছুটা হারিয়ে যাবে। তাই এ জাতীয় ঘটনা ও দিবসকে হিজরী সন ও তারিখ দিয়েই গণনা করা উচিত। তবে হিজরী সন ঠিক রেখে কেউ যদি এর সঙ্গে খৃষ্টীয় সনকে মিলিত করে উল্লেখ করেন, সেটা দোষণীয় নয়।
আসলে ইসলাম হচ্ছে দ্বীনুল ফিতরাহ বা স্বভাব-অনুকূল ধর্ম। ইসলামের বিধিবিধান এমনভাবে দেয়া হয়েছে যে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহুরে-গ্রাম্য, সমতলবাসী বা পাহাড়ী, তথ্য ও প্রযুক্তির সুবিধাপ্রাপ্ত ও বঞ্চিত-সবাই যেন স্বাচ্ছন্দে আল্লাহর বিধিবিধানগুলো পালন করতে পারে। চাঁদের মাস ও বছরের হিসাবেই খুব সহজে সম্ভব। জোতির্বিদ্যা বা আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য যাদের কাছে থাকে না তারাও চাঁদ দেখে স্বাচ্ছন্দ্যে এ বিধানগুলো পালন করতে পারে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, চন্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী হওয়ায় একটি ইবাদত বিভিন্ন মৌসুমে পালনের সুযোগ মুসলমানরা পান। কখনও ছিয়াম ছোট দিনের হয়, কখনও দীর্ঘ দিনের। কখনও ঈদ ও হজ্ব হয় শীতকালে, কখনও গ্রীষ্মকালে। মৌসুমের এই বৈচিত্র্যের কারণে মুসলমানরা একটি ইবাদত বা উৎসব আল্লাহর দেওয়া সবক’টি মৌসুমেই পালন করতে পারেন।
চন্দ্রবর্ষ বা হিজরী সন সূচনার ইতিহাস :
ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক চন্দ্রবর্ষটি বিক্ষিপ্ত ভাবে গণনা শুরু হয় স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে।
তখন আরবে সুনির্দিষ্ট কোনো সাল প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হত। যেমন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হস্তীর বছর, আমুল হুযন অর্থাৎ দুঃখের বছর ইত্যদি। তবে সুশৃঙ্খল ও কাঠামোগত অবয়বপ্রাপ্ত হয় রাসূল (ছাঃ) এর ওফাতের সাত বছর পর, ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে। ১৭ হিজরী মোতাবেক ৫৩৮ মতান্তরে ৫৩৯ খৃষ্টাব্দে। তৎকালীন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) যখন খলীফা হন, তখন অনেক নতুন ভূখন্ড ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হত। তখন এর গুরুত্ব বোঝার পর হিজরী সন গণনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষাপট ছিল হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসত। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা হত। কিন্তু সনের নাম থাকত না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হত। তখন পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সন নির্ধারণ ও গণনার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন উপলক্ষ থেকে সন গণনার মতামত আসলেও শেষ পর্যন্ত হিজরতের ঘটনা থেকে সন গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঐতিহাসিক আলবিরুনির বিবরণী থেকে জানা যায়, হযরত আবু মুসা আশ‘আরী (রাঃ) একটি পত্রে উমর (রাঃ)-কে অবহিত করেন, সরকারী চিঠিপত্রে সন-তারিখ না থাকায় আমাদের অসুবিধা হয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে হযরত ওমর (রাঃ) একটি সাল চালু করেন।
আল্লামা শিবলি নোমানী (রাঃ) হিজরী সালের প্রচলন সম্পর্কে ‘আল-ফারূক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরী সালের শা‘বান মাসে খলীফা ওমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সালের উল্লেখ ছিল না। খলীফা জিজ্ঞাসা করলেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে এটি কোন সালে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হযরত ওমর (রাঃ) ছাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীকে নিয়ে আলোচনা করে মহানবী (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের বছর থেকে সাল গণনা করার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। হিজরতের বছর থেকে সাল গণনার পরামর্শ দেন হযরত আলী (রাঃ)। পবিত্র মুহাররম মাস থেকে ইসলামী বর্ষ হিজরী সালের শুরু করার ও যিলহজ্জ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসাবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হযরত ওছমান (রাঃ)।
হিজরতের বছর থেকেই সন গণনার তাৎপর্য :
রবিঊল আউয়াল মাসই হিজরী সালের প্রথম মাস হওয়া উচিত ছিল। কেননা এ মাসেই রাসূল (ছাঃ) মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন; কিন্তু রবিঊল আওয়ালের পরিবর্তে মুহাররম মাসকে প্রথম মাস এজন্যে করা হয় যে রাসূল (ছাঃ) মুহাররম মাস থেকেই হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। মদীনার আনছারগণ দশই যিলহজ্জ তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন এবং যিলহজ্জের শেষ তারিখে তাঁরা মদীনা মুনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তাদের প্রত্যাবর্তনের কয়েক দিন পরেই হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেন এবং ছাহাবায়ে কিরামকে মদীনায় হিজরতের অনুমতি দেন। এ কারণে মুহাররমকে হিজরী সনের প্রথম মাস করা হয়েছে। এছাড়া ওছমান এবং আলী (রাঃ) পরামর্শ দেন যে হিজরী সনের সূচনা মুহাররাম মাস থেকেই হওয়া উচিত। কেউ কেউ বললেন, রামাযানুল মুবারক থেকেই বছরের সূচনা হওয়া উচিত। ওমর (রাঃ) বললেন, মুহাররম মাসই উপযুক্ত মাস। কারণ হজ্জ থেকে মানুষ মুহাররম মাসেই প্রত্যাবর্তন করে। এর ওপরই সবাই একমত হন’।[2]
আবার কোন কোন ইতিহাসবেত্তা বলেন, সন গণনার আলোচনার সময় প্রস্তাব উঠেছিল, ঈসায়ী সনের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে নবীজীর জন্মের সন থেকে ইসলামী সনের শুরু হোক। এ রকম আরও কিছু কিছু উপলক্ষের কথাও আলোচিত হয়। কিন্তু হিজরতের সন থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হল, হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় ‘আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী বিষয় হিসাবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ-গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। প্রকাশ্যে আযান, ছালাত, জুম‘আ, দুই ঈদ সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
মুসলিম জীবনে হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সভ্যতা-সংস্কৃতিতে হিজরী সালের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে মুসলিম জীবনে হিজরী সনের গুরুত্ব ও তার কারণ আলোকপাত করা হ’ল।
ক. যেসব ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষ বা হিজরী সনের প্রভাব :
এই চন্দ্রবর্ষের ও চান্দ্রমাসের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, ক্ষণ ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরী সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হিজরী সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য যরূরী। যেমন রামাযানের ছিয়াম, দুই ঈদ, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ক্ষেত্র গুলোতে চন্দ্রবর্ষ বা হিজরী সন ধরেই আমল করতে হয়। ছিয়াম রাখতে হয় চাঁদ দেখে, ঈদ করতে হয় চাঁদ দেখে।
এভাবে অন্যান্য আমলও। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলাদের ইদ্দতের ক্ষেত্রগুলোতেও চন্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী গণনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ মুসলমানদের ধর্মীয় কতগুলো দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোতে চাঁদের হিসাবে দিন, তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করা আবশ্যকীয়।
খ. হিজরী সন বা ইসলামী সনকে স্মরণ রাখা ও অনুশীলন করার প্রয়োজনীয়তা :
শুধু হিজরী সন নয়, হিজরী সনের মাসগুলোর তারিখ ব্যবহারে ও চর্চায় রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কর্তব্য। মুসলমানদের হিসাব-নিকাশগুলো হিজরী তারিখ উল্লেখ করেই করা উচিত। অন্য সনের হিসাব অনুগামী হিসাবে আসতে পারে।
মনে রাখতে হবে, ইসলামী তারিখ বা চান্দ্রবর্ষের হিসাব রক্ষা করা মুসলমানদের জন্য ফরযে কেফায়া। একথা মনে করার কোনোই অবকাশ নেই যে, হিজরী সনটি আসলে আরবী বা কেবল আরবদের একটি সন; বরং এটি মুসলমানদের সন এবং ইসলামী সন। এক্ষেত্রে শুধু একটা চাঁদ দেখা কমিটি করে একটি মুসলিম-রাষ্ট্রের দায়িত্ব পুরোপুরি পালিত হয় না। বরং সব মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের উচিত, তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ইসলামী বা হিজরী সনকে প্রাধান্য দেওয়া।
মুসলিম জীবনে হিজরী সনের গুরুত্ব :
ক. আল্লাহর আদেশ : হিজরী সন হ’ল চন্দ্র মাস। আর আল্লাহ তা‘আলা চন্দ্রকে সময় নির্ধারণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশের প্রতি সম্মানার্থে হিজরী সন গণনা করা অপরিহার্য্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী, লোকেরা আপনাকে নবচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা হ’ল মানুষের এবং হজ্জ্বের জন্য সময় নির্ধারণকারী। (বাক্বারাহ ২/১৮৯) এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে পঞ্জিকাস্বরূপ চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য চন্দ্র মাস তথা হিজরী সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
খ. আল্লাহর নিদর্শন : মহান আল্লাহ চন্দ্র মাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেন, আমি রাত ও দিনকে করেছি দৃষ্টি নিদর্শন, রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকজ্জ্বল করেছি যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে সক্ষম হও এবং রাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যাও হিসাব করতে পার এবং আমি সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করছি। এ আয়াত থেকে উপলব্ধি করা যায় যে আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ স্বরূপ তাঁর বান্দাদের সাল গণনা ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশের জন্য দিন-রাতকে সৃষ্টি করেছেন।
গ. রাসূল (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ)-এর অনন্য স্মৃতিচারণ :
হিজরী সাল গণনা করা হয় রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ফলে হিজরী সন ব্যবহার ও গণনার ফলে রাসূল (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) সেই হিজরতের ঘটনা মুসলিম হৃদয়ে বার বার দোলা দেয়।
আবার স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) তাঁর উম্মতদের নির্দেশ দিয়ে বলছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ এবং চাঁদ দেখে ইফতার কর’।[3]
ঘ. ইবাদত-বন্দেগী আদায় :
ইসলামের অধিকাংশ ইবাদত-বন্দেগী যেমন: ছিয়াম, হজ্জ, কুরবানী, শবে-কদর, আশুরা ইত্যাদি ইবাদত হিজরী সনের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। ফলে হিজরী সনের ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক সময়ে ইবাদত করা সম্ভব হয়। এজন্য তাফসীরে মা‘আরেফুল কুরআনে, হিজরী সন তথা চন্দ্রমাস গণনাকে ফরযে কেফায়া হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ঙ. খোলাফায়ে রাশেদার অনুকরণ :
হিজরী সন হ’ল ওমর (রাঃ)-এর শাসন আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্নাত। আর রাসূল (ছাঃ) তাঁর এবং তাঁর খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার জন্য আদেশ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের উচিত আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’।[4]
চ. মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকরণ :
হিজরী সন গণনা ইসলামী সংস্কৃতির অনুসরণ। এজন্য চন্দ্র মাস হিসাবে হিজরী সন গণনা করা মুসলমানদের জন্য কর্তব্য। হিজরী সন ইসলামী ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা। যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়।
উপসংহার : মুসলিম হিসাবে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হ’ল, আল্লাহর দেওয়া এই বারোটি মাস সম্পর্কে যত্মশীল হওয়া। নিজেদের বক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবনসহ রাষ্ট্রীয় জীবনে এর যথাসাধ্য প্রয়োগ করা। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।
[লেখক : ছাত্র, ছানাবিয়াহ ২য় বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]
[1]. তাফসীরে বাগাভী ৪/৪৪ পৃ.।
[2]. বাবুত তারীখ, ফাৎহুল বারী, ৭/২০৯, তারীখে তাবারী, ২/২৫২, যারকানী, ১/৩৫২, উমদাতুল কারী, ৮/১২৮।
[3].মুসনাদে আহমদ হা/৯৫৫৬; বুখারী হা/১৯০৯; মুসলিম হা/১০৮৯।
[4].মুশকিলুল আছার লিত তাহাবী হা/৯৯৮।