পাপ পুণ্য

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 783 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। প্রাচীনকালে এক বৃদ্ধ জ্ঞানী মুসলমান বুখারা শহরে বসবাস করতো। তাকে খাজা বুখারী বলা হত। একদিন খাজা তার ধন সম্পদ হিসাব করে দেখল তার হজ্জ্ব ফরজ হয়ে গেছে। অতঃপর সে হজ্জ্বের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রস্ত্তত করে হজ্জ্ব কাফেলার সাথে মক্কার পথে রওনা হয়।

খাজার ভ্রমণ সামগ্রী কাফেলার অন্য সকলের থেকে বেশী ছিল। খাজা বুঝতে পেরেছিল সে অন্যদের থেকে বেশী ধনী। তার দেখাশোনার জন্য কয়েকজন কর্মচারী ছিল। একশ’রও বেশী উট জিনিসপত্র বহন করছিল। অন্যদের উট, পালকি ও হাওদার চেয়ে খাজা বুখারীর সবকিছু ভাল ছিল। কর্মচারী ও উটের রশি ধরে যারা পথ চলছিল তারা সকলেই খাজাকে সম্মান করছিল। প্রথমতঃ এইজন্য যে, খাজা জ্ঞানী ও খ্যাতিমান ছিল এবং দ্বিতীয়তঃ সকলের জন্য অনেক টাকা-পয়সা খরচ করছিল। যেখানেই তাবু স্থাপন করছিল সেখানেই নিজের খাবার টেবিলে কাফেলার সকল কর্মচারীদের রাতের ও সকালের খাবার দিচ্ছিল। এসব দেখে খাজা যে সম্মানীয় সেটা সকলেই বুঝেছিল। ঐ কাফেলায় কয়েকজন কম খরচে হজ্জ্বে যাচ্ছিল। দরবেশের মত অল্পে সন্তুষ্ট ছিল এবং তারা ও তাদের কর্মচারীরা পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল।

সে সময়ে আরবের শুষ্ক বা ঘাসযুক্ত সমভূমি পাড়ি দেওয়ার জন্য উট ছাড়া কোন যানবহন ছিল না। হজ্জ্ব সফর এক বছরের দীর্ঘ পথ ছিল। এই দরবেশ হজ্জ্বযাত্রীরা যখন হেজাজের কাছাকাছি পৌছালো তখন দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে, অর্থ সংকটে ও অল্প খাওয়ার দরুণ তাদের শারীরিক সক্ষমতা অবশিষ্ট থাকলো না। এভাবেই একদিন হাজীগণ আরাফাতের মাঠে পৌঁছায়। বাতাস খুব গরম ছিল। দরবেশ হাজীগণের মধ্যে একজন যে খাজা বুখারীর টাকা-পয়সা বেশী সেটা দেখেছিল। সে কষ্ট সহ্য করতে করতে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। পায়ে হেঁটে এতদূর আসার ফলে তার আর হাঁটার শক্তি ছিল না, তৃষ্ণায় ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, বুক ধড়ফড় করছিল। কাতর হৃদয়ে সে খাজা বুখারীর কাছে এসে বলল : ‘আমরা একসাথে হজ্জ্বে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি এত সম্পদ নিয়ে যাচ্ছেন আর আমরা কষ্ট করে আল্লাহর ঘরের কাছে যাচ্ছি। লক্ষ্য করেন আপনার আর আমাদের ছওয়াব কী সমান হবে?’

খাজা উওর দিলেন : ‘না, আমি সেটা দেখতে চাই না যে, আল্লাহর কাছে আমাদের ছওয়াব সমান হোক। যদি সেটা চিন্তা করতাম তাহলে এই গরমে এতদূর কষ্ট করে আসতাম না।’

দরবেশ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো : ‘কেন? তাহলে নিজেকে আমাদের থেকে উওম মনে করেন ?’

খাজা বললেন : ‘হ্যাঁ, কারণ আমি আল্লাহর আদেশ ও কোরআন অনুযায়ী আমল করি আর তুমি আদেশের বিপরীত আচরণ করছো। আমাকে হজ্জ্বের আদেশ দেওয়া হয়েছে আর তোমাকে দেওয়া হয় নি। আমি অনুগত্য করছি আর তুমি আনুগত্য করছো না।’

দরবেশ বললো : ‘আজব কথা শুনছি ?

খাজা বললেন : ‘আসলে ঠিক কথাই শুনছো। হজ্জ্ব সফর ছালাত নয় যে ধনী-গরীব সবার জন্যই ফরয হবে। হজ্জ্ব সফরের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা শর্ত। আমার পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল বিধায় আমার উপর ফরয ছিল। তোমার পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না তাই এই কষ্ট করে ছওয়াব পাবেনা।’

দরবেশ বললেন : ‘এখন তাহলে আমাকে সাহায্য না করে কথা দিয়ে যখম করবেন?’

খাজা বললেন : ‘না এটা যখম করা নয়, এটাই সত্য। আমি তোমাকে তোমার দেশে ফেরত পাঠাতে টাকা খরচ করতে প্রস্ত্তত। কিন্তু ধর্মের আদেশ তা-ই, যেটা বললাম। প্রত্যেক কাজের শর্ত আছে এবং প্রত্যেক আদেশ ব্যক্তিবিশেষকে দেওয়া হয়েছে। ইসলামে জিহাদ ফরজ, কিন্তু অসুস্থ ও মহিলাদের জন্য ফরজ নয়। ছিয়াম ফরজ, কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ফরজ নয়। দান করা ছওয়াবের কাজ, কিন্তু যদি এতে নিজের জীবন সংকটে পড়ে তাহলে গুনাহ হবে। মৃত জীব-জন্তুর গোশত খাওয়া হারাম কিন্তু কেউ ক্ষুধার্ত অবস্থায় মুমূর্ষ হলে সে গোশত ছাড়া আর কোন গোশত না থাকলে হারাম নয়। পিতা-মাতার আনুগত্য করা প্রতিটি সন্তানের জন্য কর্তব্য, কিন্তু হারাম ও গুনাহের কাজে তাদের আনুগত্য হারাম। প্রত্যেক আদেশ নির্দিষ্ট জায়গার জন্য দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেকের জন্য সকল অবস্থার কর্তব্য জানানো হয়েছে।’

দরবেশ বললো : ঠিকই বলেছেন। তাহলে এখন আমি কী করবো ?

খাজা বললো : ‘এখন আমি তোমাকে তোমার দেশে পাঠাবো কিন্তু এরপরে ইসলামের হুকুম সেভাবেই আমল করো, যেভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে। নিজের বুদ্ধি ও খেয়াল খুশিমত নয়। আমরা কিছু আদেশ গ্রহণ করবো আর কিছু আদেশ নিজেদের খেয়াল খুশিমত পরিবর্তন করবো এটা ইসলাম নয়। পড়, জিজ্ঞাসা করো, মুখস্থ করো তারপর আমল করো। যাতে তোমার কাজে মাথা উঁচু হওয়ার জায়গায় লজ্জায় পড়তে না হয়।’      

শিক্ষা : প্রতিটি ইবাদত আল্লাহ ও রাসূল (ছা:)-এর নির্দেশে ও দেখানো পদ্ধতিতে করলেই ছওয়াব পাওয়া যায়। নিজের খেয়াল খুশিমত আমল করে শত পরিশ্রম করে কোনই ফায়দা পাওয়া যাবে না।

অনুবাদ (ফার্সী থেকে)

আব্দুর রঊফ

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও