নারী নির্যাতন প্রসঙ্গ : সমাধান কোথায়?
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1838 বার পঠিত
গত ২৬শে মার্চ
২০২১ আমাদের প্রিয় দ্বীনী ভাই বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রংপুর যেলার
সহ-সভাপতি মতীউর রহমান একই সাথে হারিয়েছেন দুই বোনসহ তাঁর পরিবারের পাঁচ
পাঁচ জন সদস্য। পরদিন ২৭শে মার্চ রাত ১২-টা নাগাদ পীরগঞ্জে অনুষ্ঠিত
জানাযায় শরীক হই। বেশ বড় বাড়ি মতীউর ভাইদের। একদিন আগেও ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে
ভরপুর। নাতি-নাতনিদের আদর ভরা মিষ্টি মিষ্টি বুলি নানা-নানী, মামা-মামীদের
হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিত। নিত্যদিন কত কাজ ছিল, কত পরিকল্পনা ছিল
তাদের। সন্তানদের লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার। আজ সেই ভরা বাড়িতে
কবরের নিস্তব্ধতা। হাহাকার শূন্যতা। জানাযায় উপস্থিত উঠোনভরা গণজমায়েত
ছাপিয়ে সেই বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে খাঁ খাঁ মরুর বিরান সুর এসে অন্তরে
শেলের মত বাঁধে। মৃত্যুর অমোঘ বাস্তবতাকে আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না।
মৃত্যুর চেয়ে সুনিশ্চিত আর কিছু নেই। কিন্তু তবুও সেই মৃত্যু যখন আপনজনের
চিরবিদায়ের বার্তা হয়ে নিষ্ঠুরভাবে ধরা দেয়, তখন সেই বাস্তবতাকে বড় অবাস্তব
বলে মনে হয়। মহান প্রভু ধৈর্যশক্তি নামক এক মহা নে‘মত না দিলে এই বিচ্ছেদ
বেদনা সওয়া অথৈ পারাবার পাড়ি দেয়ার চেয়ে দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। বাড়ির উঠোনেই
নতুন চারটি কবর। আমি বেদনাতুর মতীউর ভাইকে দেখি। তাঁর অব্যক্ত বেদনায় মুষড়ে
পড়া পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকাই। ভাবতে পারি না, কীভাবে পরিবারটি
প্রিয়জন হারানোর কষ্ট সইবে? কোথায় এই অন্তহীন ব্যথার উপশম খুঁজবে! প্রতিটি
সকাল যে হবে তাদের জন্য এক নতুন বেদনার উপাখ্যান! এই লেখা যখন লিখছি তখন
মাদারীপুরে এক স্পীড বোট দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই ২৬ জন জলজ্যান্ত মানুষ লাশে
পরিণত হ’ল। নয় বছরের শিশু মীম হারালো বাবা-মা আর ছোট দুই বোন। পরিবারে তার
আর কেউ রইল না। মৃত্যুর অমোঘ বাস্তবতার কাছে আমরা কি নিদারুণ অসহায়!
পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে ফিরে গত বছরের করোনা আবার দ্বিগুণ শক্তিতে ধেয়ে এসেছে পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়াতে। হররোজ সেখানে প্রায় চার হাযার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনে প্রায় চার লাখ। দিললীর শ্মশানঘাটগুলোতে লাশ সৎকারের জায়গা নেই। কবরস্থানে কর্মীদের বিরাম নেই। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও এখন অনুরূপই চিত্র। টিকার পর টিকা বাযারে আসছে। কিন্তু করোনার লাগাম সহসাই টানা যাবে কিনা কেউ বলতে পারছে না। প্রায় বছরখানেক হয়ে গেল, সমগ্র বিশ্ব এখনও অচলাবস্থা তেমন কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউ, তৃতীয় ঢেউ- একের পর এক করোনার ঢেউ আসছে। একটার চেয়ে আরেকটা আরো শক্তিশালী। কবে এই ঢেউয়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে সেই অপেক্ষায় গোটা বিশ্ববাসী।
প্রিয় পাঠক, মৃত্যুর এই বিভীষিকা প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়িয়ে ফিরছে- একথা জানার বাকি না থাকলেও আমরা কি নিজেদের অত্যাসন্ন মৃত্যু নিয়ে দু’দন্ড ভাববার অবকাশ পেয়েছি? নাকি যৌবনের তাযা রক্ত, অর্থ-বিত্ত কিংবা ক্ষমতার মোহে আরো বহুকাল কাটানোর রঙিন স্বপ্ন দেখছি! এই স্বপ্ন ফিঁকে হওয়ার সময় কি এখনও হয়নি! এই করোনাতেই কত রথি-মহারথি, বিত্তশালী, ক্ষমতাশালীদের অকস্মাৎ মৃত্যু আমরা দেখেছি। ধন-সম্পদ, পরিকল্পিত ডায়েট, সুরক্ষিত ঘরবাড়ি, পৃথিবীর সর্বোত্তম চিকিৎসাব্যবস্থাও তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। দুনিয়াতে অট্টালিকার পর অট্টালিকা যার হাতে গড়া, তিনি এখন নিঃসঙ্গ মাটির বিছানায় নিজের দেহাবশেষ রক্ষায় ব্যস্ত। কেউই মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায়নি। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই; যদিও তোমরা সুউচ্চ দুর্গে অবস্থান কর’ (সূরা নিসা ৭৮)।
তাছাড়া সময়ের হিসাব কষলে আমাদের যাপিত জীবনের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালই বা কতটুকু? আখেরাতের তুলনায় তা এতটাই গৌণ যে, কাল কেয়ামতের ময়দানে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমরা কতদিন ছিলে দুনিয়াতে? আমাদের জবাব হবে- একটি সকাল কিংবা একটি সন্ধ্যা (সূরা নাযি‘আত ৪৬)। এই তো আমাদের জীবন! এই সময়টুকু একজন পথচারী কিংবা একজন আগন্তুকের ক্ষণিক বিশ্রামের সময়টুকুও তো নয়। রাসূল (ছাঃ) এই অমোঘ বাস্তবতার প্রতিই যেন ইঙ্গিত করেছেন, ‘তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে কাটাও যেন তুমি একজন আগন্তুক কিংবা পথচারী’ (বুখারী হা/৬৪১৬)।
প্রিয় পাঠক, জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এই সময়টুকু মিলেই আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জীবন। অতীব সংক্ষিপ্ত হ’লেও এই জীবন আমাদের জন্য অতীব মূল্যবান। কেননা জীবনের এই ক্ষণকাল সময়টুকুতে যে যতটুকু পরকালীন প্রস্ত্ততি নিতে পেরেছে, তার উপরই যে নির্ভর করছে তার চিরস্থায়ী তথা পরকালীন জীবনের যাবতীয় সুখ-দুঃখ। প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যু আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে প্রবল গতিতে। সেই সাথে ফুরিয়ে আসছে আমাদের জীবনের ব্যাপ্তি। আমাদের অজান্তে, আমাদের অলক্ষ্যে বেজে চলেছে বেলা শেষের ঘণ্টাধ্বনি। পরীক্ষার হলে একজন ছাত্র যেমন শেষ ঘণ্টা বাজার আগে সবকিছু সাধ্যমত লিখে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়, আমাদের পার্থিব জীবনের বাস্তবতা ঠিক একই রূপ। মৃত্যুই এখানে শেষ ঘণ্টা। তারপর যাবতীয় কর্মযজ্ঞ শেষ। শুরু হবে কর্মফলের পালা। আর এর ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে আমাদের জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য।
অনেকে দুনিয়াবী দুঃখ-কষ্টে পতিত হলেই জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন। নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চান। অথচ তিনি যদি জীবনের প্রকৃত গুরুত্ব ও বাস্তবতা উপলব্ধি করতেন, তাহলে একমুহূর্তের জন্যও এই চিন্তা করতেন না। কেননা কাল কেয়ামতের ময়দানে মানুষ সবচেয়ে বেশী আফসোস করবে পার্থিব জীবনের এই মূল্যবান সময়টুকুর জন্যই। সে আফসোসে প্রাণপাত করে সেদিন বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি ছাদাকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম!’ (সূরা মুনাফিকূন ১০)।
প্রিয় পাঠক, পরকালীন সম্বল অর্জনে আমাদের আলস্য, দুর্বলতা ও অসচেতনতার সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল মৃত্যুর স্মরণ থেকে গাফেল থাকা এবং মৃত্যুপূর্ব জীবনের মূল্যটুকু সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারা। এজন্য আমরা হরহামেশা নিশ্চিন্ত মনে বলি, জীবনটা একভাবে কাটিয়ে দিলেই তো হ’ল। অথচ রাসূল (ছাঃ) জীবনটাকে একটা গণিমত উল্লেখ করে বলেছেন- ‘পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে তোমরা গণিমত মনে কর; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার স্বচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে, মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে’ (ছহীহুল জামে হা/১০৭৭)। মৃত্যু নামক পর্দা হঠাৎ উঠে যাওয়া মাত্রই সব কিছু সাঙ্গ হয়ে যাবে আর নতুন এক সীমাহীন জগৎ তার সামনে ধরা দেবে। সেদিন দুনিয়াবী জীবনের গাফিলতিকে স্মরণ করে সে প্রচন্ড আফসোস করবে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র লাভ হবে না। আল্লাহ বলেন, তুমি এই দিবস সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। অতঃপর আজ (বাস্তবতা দেখে) তোমার চক্ষু স্থির, প্রখর (ক্বাফ ২২)। একথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে একদিন জিব্রীল এসে রাসুল (ছাঃ)-কে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবন যাপন করুন, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার মৃত্যু অনিবার্য; প্রিয়জনকে যত খুশী ভালোবাসুন, কিন্তু মানে রাখবেন, একদিন তাকে আপনার ছাড়তে হবে; আপনি যা ইচ্ছা করুন, কিন্তু মনে রাখবেন একদিন আপনি প্রতিফল পাবেন। জেনে রাখুন হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা হ’ল রাত্রি জাগরণে এবং তার সম্মান হ’ল, মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার মধ্যে (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৩১)।
সুতরাং পাঠক! আমাদেরকে মৃত্যুর এই চিরন্তন বাস্তবতাকে সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে হবে। পার্থিব জীবনের সর্বশেষ সীমারেখা এই মৃত্যু। আজ হোক, কাল হোক এই সীমারেখা আমাদের অতিক্রম করতেই হবে। অতএব যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের মৃত্যুকে কেবল কান্না আর বেদনার উপলক্ষ্য নয়; বরং উপদেশ ও স্মারক হিসাবে গ্রহণ করে আমাদেরও প্রস্ত্তত হতে হবে সেই অমোঘ বাস্তবতার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার জন্য। প্রস্ত্ততি নিতে হবে নিজ নিজ আমলনামা সাধ্যমত ভরপুর করে চিরস্থায়ী জীবনে সফল হওয়ার জন্য। এমনভাবে- যেন সেই মহাবিচারের দিনে পরম প্রশান্তির সাথে সকলকে আমরা ডেকে ডেকে বলতে পারি- ‘নাও, আমার আমলনামা দেখ, আমার রেজাল্টশীট পড়ে দেখ; আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম আমাকে হিসাবের মুখোমুখি হতে হবে’ (সূরা হাক্কাহ ১৯-২০)। আর সেদিন আমাদের রব আমাদের আনন্দিত চেহারা দেখে খুশী হয়ে বলবেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর নিকটে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা ফজর ২৭-৩০)। সেই মহাদিবসে এই মহান সেŠভাগ্য লাভের জন্য আমরা প্রস্ত্ততি নিচ্ছি তো!