কুরআন শিক্ষা : ফযীলত ও প্রয়োজনীয়তা
হোসাইন আল-মাহমূদ
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম 2372 বার পঠিত
জীবনে সৌভাগ্য ও সফলতা কে না পেতে চায়? কিন্তু সেই সৌভাগ্য ও সফলতা তো আর এমনিতেই পাওয়া সম্ভব নয়। এ পথ কন্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এর জন্য করতে হবে নিরন্তর কোশেশ, অবিশ্রান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামই হ’ল জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘ইহসান’ করা। ইহসান অর্থ দয়া, অনুগ্রহ, দান, পরোপকার, সদ্ব্যব্যবহার ইত্যাদি। তবে ব্যাপক অর্থে সুন্দর আমল করা। কেননা ইহসান আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর দান ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের কারণ। আর এটিই অন্তরে পরিতৃপ্তি, আত্মার প্রশান্তি, হৃদয়ের আনন্দ এবং সৃষ্টি জগতের ভালোবাসা লাভের মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ-الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ- ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (ইমরান ৩/১৩৩-১৩৪)।
যখন বান্দা ইহসান করে এবং নিয়ত, আমল ও কথা-বার্তায় বিশুদ্ধতা অবলম্বন করে তখন আল্লাহ তাকে ভালোবাসে। আর আল্লাহ যখন কাউকে ভালোবাসেন তখন তার চাওয়াকে পূরণ করেন। কারণ এই দুনিয়ায় আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হ’ল ইহসান তথা সুন্দর কর্ম করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ-الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সকল রাজত্ব এবং তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে। আর তিনি মহা পরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭/১-২)।
সুতরাং ইহসান হ’ল প্রতিটি কর্ম সুন্দর হওয়া, ভালো হওয়া পরোপকারী হওয়া। সেটি কথা-বার্তায়, আমলে ও নিয়তে হতে হবে এবং ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন হবে আল্লাহ ও পরকালের জন্য। ইবাদতের ক্ষেত্রে ইহসান হবে এমন যে, তার কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হবে। অনুরূপ চরিত্রে, আদব-কায়দায়, মানুষের সাথে লেনদেনে, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের প্রতি ইহসান করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নিজ কর্মকে সুন্দর করতে হবে যাতে লোকেরা উপকৃত হয়। সমাজের অসহায় মানুষের প্রতি দান করার মাধ্যমে ইহসান করতে হবে। অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা বা তাদের দেখতে যাওয়ার মাধ্যমে ইহসান করতে হবে। এমনকি কবরবাসীদের কবর যিয়ারত ও তাদের জন্য দো‘আ করার মাধ্যমে ইহসান করতে হবে। নিজের প্রতি ইহসান করার মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে হবে ও পাপাচার থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি কেউ এমন আমল করে তাহলে সার্বিক পরিস্থিতিতে ও সর্ব দিক থেকে আল্লাহর ইহসান লাভ করা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত হতে পারে কি?’ (রহমান ৫৫/৬০)।
অতএব যে ব্যক্তি ইহসান করবে আল্লাহ তার প্রতি ইহসান করবেন ও তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং বান্দার পক্ষ থেকে ইসানের বিনিময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ইহসান লাভ করা। এই ইহসান অল্প হলেও আল্লাহ এর প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ- وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ ‘কোন কিছু দান করাকে তুচ্ছ জ্ঞান করো না, এমনকি (অপারগতায়) তোমার ভাইয়ের সাখে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাকেও’।[1]
অন্যত্র এসেছে, لاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئاً وَلَوْ أَنْ تُعْطِىَ صِلَةَ الْحَبْلِ وَلَوْ أَنَ تُعْطِىَ شِسْعَ النَّعْلِ وَلَوْ أَنْ تُفْرِغَ مِنْ دَلْوِكَ فِى إِنَاءِ الْمُسْتَسْقِى وَلَوْ أَنْ تُنَحِّىَ الشَّىْءَ مِنْ طَرِيقِ النَّاسِ يُؤْذِيهِمْ وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ وَوَجْهُكَ إِلَيْهِ مُنْطَلِقٌ وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ فَتُسَلِّمَ عَلَيْهِ ‘কোন ভালো কাজ করাকে তুচ্ছ জ্ঞান করো না, যদিও তা দড়ির বন্ধন দিয়ে হয়, যদিও তা জুতার ফিতা দান করা হয়, যদি তা পানি পার্থীর পাত্রে নিজ বালতি থেকে পানি ঢেলে দেওয়া হয়, যদিও তা মানুষের জন্য কষ্টদায়ক বস্ত্ত রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলে হয়, যদিও মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করা হয় বা যদিও মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতকালে সালাম প্রদানের মাধ্যমে হয়’।[2]
মুসলিম প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহসান করার ব্যাপারে আদিষ্ট। এমনকি একটি পশু যবেহ করার সময়েও। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে; আর যখন যবেহ করবে তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যাবাহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে’।[3]
কারো প্রতি ইহসান করলে আল্লাহ বিনিময়ে উত্তম কিছু দান করেন। যেমন মূসা (আঃ) শু‘আয়েব (আঃ)-এর মেয়েদ্বয়ের প্রতি ইহসান করলেন এবং তাদের দুম্বাগুলোকে পানি পান করালেন। অতঃপর আল্লাহর নিকট এর প্রতিদান প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি ইহসান করলেন। আল্লাহ তাকে স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, কর্মক্ষেত্র বাড়ি ও নিরাপত্তা দানের মাধ্যমে ইহসান করেছিলেন। কারণ তিনি সৎকর্মশীল বা ইহসানকারীদের পসন্দ করেন (ইমরান ২/১৩৪)।
ইহসানের গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হ’ল নিজের প্রতি ইহসান করা। আর সেটি হ’ল পাপাচারে লিপ্ত হয়ে নিজের প্রতি যুলুম করা। কারণ কোন ব্যক্তি পাপাচার থেকে বাঁচতে কোন কিছু পরিহার করলে আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে উত্তম কিছু প্রদান করেন। যেমন হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا لِلَّهِ إِلَّا بَدَّلَكَ اللهُ بِهِ مَا هُوَ خَيْرٌ لَكَ مِنْهُ ‘নিশ্চয় তুমি যা কিছুই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের কারণে পরিত্যাগ করবে, তার চেয়েও উত্তম বস্ত্ত তিনি তোমাকে প্রদান করবেন’।[4]
এই হাদীছের বাস্তবতার পক্ষে বহু উদাহরণ রয়েছে। যেমন সোলায়মান (আঃ) ঘোড়া লালন-পালন করা খুব পসন্দ করতেন। তিনি একদিন ঘোড়ার সেবা করতে গিয়ে আছরের ছালাত পরিত্যাগ করে ফেলেন। সূর্য ডুবে যায়। এতে অনুতপ্ত হয়ে তিনি ঘোড়ার পায়ে ও গর্দানে ওয়াকফের আলামত লাগিয়ে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৭/৬৪)। এর বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য বাতাসকে অনুগত করে দেন। যার উপর আরোহন করে তিনি সকালে এক মাসের ও বিকালে আরেক মাসের পথ অতিক্রম করতেন। তিনি ঘোড়ার প্রতি ইহসান না করলে তিনি হয়ত এই নে‘মত লাভ করতে পারতেন না’(সাবা ৩৪/১২; ছোয়াদ ৩৮/৩৬)।
ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরে আযীয কিতফীরের বাসায় দাস হিসাবে অবস্থান করছিলেন। আযীযের স্ত্রী তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি সরাসরি প্রত্যাখান করেছিলেন আল্লাহর ভয়ে। তিনি সেদিন আল্লাহর ভয়ে কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করলে তিনি পরবর্তীতে মিসরের আযীয বা বাদশা হতে পারতেন না (সূরা ইউসুফের তাফসীর দ্রষ্টব্য)।
মক্কার মুহাজির ছাহাবীগণ যখন নিজ বাড়ি-ঘর, সম্পদ ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে রিক্ত হস্তে মদীনায় চলে গেলেন। তারা সাময়িক ভাবে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু এর বিনিময়ে আল্লাহ যেমন মদীনাবাসীর হৃদয়ে তাদের স্থান করে দিয়েছিলেন তেমনি তারা মদীনাসহ অর্ধ পৃথিবীকে শাসন করার সুয়োগ পেয়েছিলেন। সাথে সাথে পুরোপুরি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছিলেন (বাইয়েনাহ ৯৮/০৮)।
আব্দুল্লাহ বিন মুবারক, যিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তার মাধ্যমে হাদীছ শাস্ত্রের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়। কিন্তু তার এতো বড় আলেম হওয়ার পিছনের কাহিনী আমরা অনেকে জানিনা। এটা ছিল তার পিতার পাপ কাজ বর্জনের ফল। আল্লাহর ভয়ে যিনি বাগানের কর্মচারী হয়েও কোন দিনে মালিকের অনুমোদন না থাকায় একটি বেদানাও ছিঁড়ে খাননি। মুবারক একটি বেদানা বাগানে কাজ করতেন। একদিন বাগানের মালিক এসে বললেন, মুবারক একটি মিষ্টি বেদানা ছিঁড়ে নিয়ে এসো। তিনি কোন একটি গাছ থেকে বেদানা ছিঁড়ে এনে দিলেন। মালিক বেদানা ভেঙ্গে দেখলেন তা অত্যন্ত টক। মালিক রেগে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, আমি তোমাকে মিষ্টি বেদানা নিয়ে আসতে বললাম। আর তুমি টক নিয়ে আসলে? যাও মিষ্টি বেদানা নিয়ে এসো। তিনি অন্য একটি গাছ থেকে আরেকটি বেদানা কেটে নিয়ে মালিকের হাতে তুলে দিলেন। মালিক কেটে দেখলেন এটি টক। তিনি আবারো ধমক দিয়ে মিষ্টি বেদানা আনার নির্দেশ দিলেন। মুবারক আরেকটি গাছ থেকে বেদানা ছিঁড়ে এনে দিলেন। মালিক চেঁখে দেখলেন এটিও টক। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, তুমি টক ও মিষ্টি বেদানা চিননা? মুবারক বললেন, না। তিনি বললেন, তুমি এতো এতো বছর থেকে বাগানে কাছ কর আর তুমি কোনটি মিষ্টি ও কোনটি টক আলাদা করতে পারো না? মুবারক উত্তরে বললেন, আমি কোনো দিন একটি দানাও খাইনি যে, বুঝতে পারব কোনটি টক ও কোনটি মিষ্টি। তিনি বললেন, কেন খাওনি? মুবারক বললেন, কারণ আপনি আমার জন্য খাওয়ার অনুমতি রাখেননি। বাগানের মালিক বিষ্মিত হলেন। তিনি তদন্ত করে তার সত্যতা পেলেন। তার নিকটে মুবারকের মর্যাদা বেড়ে গেল। তিনি তার প্রতি খুশি হলেন। তার পরমা সুন্দরী একজন মেয়ে ছিল। যার বহু জায়গা থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসছিল। তিনি বললেন, হে মুবারক! এই মেয়ের সাথে বিবাহের জন্য কাকে তুমি যোগ্য মনে কর। তিনি বললেন, তিনি বললেন, জাহেলী যুগের লোকেরা বংশ মর্যাদা দেখে বিবাহ দিত, ইহুদীরা সম্পদ দেখে, খৃষ্টানেরা সৌন্দর্য দেখে এবং এই উম্মত দ্বীন বা ধর্ম দেখে। তার বুদ্ধিমত্তায় বাগানের মালিক খুব খুশি হলেন। এরপরেই তিনি তার মেয়ের বিবাহ মুবারকের সাথে দিয়ে দিলেন। তারই ওরশে জন্ম গ্রহণ করেন বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিছ আব্দুল্লাহ বিন মুবারক। তিনি বিশ্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি নিজের ব্যাপারে বলেন, আমি চার হাজার শায়খ থেকে ইলম অর্জন করেছি। এটা ছিল আল্লাহ ভয়ের বিনিময়। এটি ছিল পাপ বর্জনের পুরুষ্কার। এটি ছিল ইহ্সানের প্রতিদান’। [5]
তিন ব্যক্তির ঘটনা, যারা প্রচন্ড ঝড়ের সময় নিজেদের রক্ষার জন্য পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকে এক সময় অন্যায় পরিত্যাগ করেছিল এবং অন্যের প্রতি ইহসান করেছিল। একজন আল্লাহর ভয়ে যেনা বা ব্যভিচার পরিত্যাগ করেছিল। আরেকজন আল্লাহর ভয়ে বহু বছর পরেও শ্রমিকের মজুরী অনেক গুণ বেশী প্রদান করেছিল। আর অন্য জন যে আল্লাহর ভয়ে নিজ সন্তানের উপর মায়ের ক্ষুধার্ত দূর করাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এরা তিনজনই যখন এমন এক বিপদে পড়েছিল যেখান থেকে নাজাত পাওয়া অসম্ভব। সেখানে তারা নিজেদের পাপ পরিত্যাগ ও মানুষের প্রতি ইহসান করার বিনিময়ে নাজাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন’। [6]
রাসূল (ছাঃ)-এর ছেলে সন্তানেরা ছোটকালে মারা যায়। রাসূল (ছাঃ)-এর বিনিময় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে তাকে হাউযে কাওছার দান করেন। তিনি কিয়ামতের দিন তার কোটি কোটি সন্তানতুল্য উম্মতকে সেই হাউয থেকে পানি পান করাবেন (সূরা কাউছারের তাফসীর দ্রষ্টব্য)।
ইহসান করার বিনিময় কখনো অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যমে হয়। জনৈক দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আপনি দুনিয়া পরিত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে কী প্রদান করেছেন? তিনি বললেন, আমি যে অবস্থার উপর আছি তাতে সন্তুষ্টি থাকা। আর অল্পে তুষ্ট থাকা এমন একটি নে‘মত যা তুলনাহীন’।[7] কেননা এটি প্রতিটি মূহুর্তে সৌভাগ্যবান রাখে। এটি ধন-সম্পদ দ্বারা কেনা যায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى ‘নিশ্চয়ই পরকাল তোমার জন্য ইহকালের চাইতে শ্রেয়। তোমার পালনকর্তা সত্বর তোমাকে দান করবেন। অতঃপর তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে’ (যোহা ৯৩-৪-৫)। বান্দা যতদিন আল্লাহ নিষিদ্ধ কাজ আল্লাহকে খুশি করার জন্য পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তারা এর যথেষ্ট বিনিময় দান করবেন। এটি আল্লাহর ওয়া‘দা। আর আল্লাহ তার ওয়া‘দা ভঙ্গ করেন না।
উপসংহার : প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহসানের পন্থা আবলম্বন করা মুমিনের অন্যতম কর্তব্য। কারণ ইহসানের বিনিময় সর্বদা কলাণময় হয়। আমাদের সালাফগণ ইহসানের পন্থা অবলম্বন করতেন। বিনিময়ে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম ইহসান লাভ করেছেন। আমরা যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ও সর্বদা ইহসানের নীতি অবলম্বন করি আল্লাহ আমাদেরও উত্তম প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করূন।
[লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]
[1]. মুসলিম হা/২৬২৬; মিশকাত হা/১৮৯৪।
[2]. আহমাদ হা/১৫৯৯৭; ছহীহাহ হা/১৩৫২, সনদ ছহীহ।
[3]. মুসলিম হা/১৯৫৫; মিশকাত হা/৪০৭৩।
[4]. আহমাদ হা/২৩১২৪; যইফাহ হা/০৫-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, সনদ ছহীহ।
[5]. ইবনু খাল্লিকান, ওয়াফিয়াতুল আইয়ান ৩/৩২; আয়দারূস, আন-নূরুস সাফের আন আখবারিল কারনিল আশের ১/২২৯৮; হিলইয়াতুল আওলিয়া ৮/১৬২।
[6]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত হা/৪৯৩৮।
[7]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ৩/১৮৫।