কোন কোন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়তর (২য় কিস্তি)

মিনারুল ইসলাম 1519 বার পঠিত

(৩) আল্লাহর উপর ভরসাকারী

তাওয়াক্কুল শব্দের আভিধানিক অর্থ হ’ল ভরসা করা, নির্ভরশীল হওয়া। পারিভাষিক অর্থ হ’ল যারা অক্ষমতার সময় আল্লাহর উপর ভরসা করে ও তার উপর নির্ভরশীল হয় এবং তাদের সমস্ত বিষয় তাঁর দিকেই সঁপে দেয়।

মহান আল্লাহ্ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِين ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। আল্লাহর উপর ভরসা করা মুমিনের একটি বিশেষ গুণ। কর্মের সাথে তার উপরই ভরসা রাখতে হবে, কারণ আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُو حَسْبُهُ ‘যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট’ (তালাক্ব ৬৫/৩)

আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে চলে আসে সুবর্ণ সফলতা। তবে আল্লাহর উপর ভরসা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধু শুধুই ঘরে বসে থেকে দো‘আ করাকেই কি ভরসা বুঝায়? পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করাকেই কি ভরসা বলে; গভীর রাতে আল্লাহর যিকির, তাসবীহ-তাহলীল ও তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করাকেই কী ভরসা বুঝায়? না তা নয়, ভরসা হ’ল কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তাওয়াক্কুলের সাথে সাথে কর্মের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا. ‘যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথাযথভাবে তাওয়াক্কুল কর, অবশ্যই তোমাদেরকে রিযিক দান করা হবে, যেভাবে পাখিদেরকে রিযিক দান করা হয়। তারা প্রত্যুষে খালি পেটে নীড় থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে নীড়ে ফিরে আসে’।[1]

এই হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর উপর যথাযথভাবে ভরসা করতে হবে, যার মধ্যে কোন প্রকারের সন্দেহ ও দুর্বলতার প্রকাশ না পায়। আর অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ) নীড়ে বসে থাকা পাখির উপমা দেননি, বরং তিনি উপমা দিয়েছেন ঐ পাখির যে পাখি আহার অন্বেষণের জন্য নীড় থেকে বেরিয়ে গেছে। অতএব অযথা বসে না থেকে কাংখিত লক্ষ্যে পেঁŠছার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপের ইতিহাস, যখন তাঁকে মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়, ঠিক এই কঠিন মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি সর্বোত্তম কর্ম বিধায়ক। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, يَانَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের উপর ঠন্ডা ও শান্তিময় হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। যে আগুন সব কিছুকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় সেই আগুন ইবরাহীমের উপর ঠান্ডা ও শান্তিময় হয়ে যায়।

স্মরণ করুন মূসা (আঃ)-এর সেই ঘটনাকে, যখন ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে ধাওয়া করে। মূসা (আঃ) ও তার অনুসারীরা সামনে দৌড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা সাগরের সম্মুখীন হয়ে যায়, সামনে সাগর পিছনে শত্রু পালানোর কোন উপায় নেই। এই কঠিন সময় তাঁর অনুসারীরা দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আমরা তো আজ যালেমদের হাতে বন্দি হয়ে গেলাম। মূসা বলল কখনোই নয়, আল্লাহ আমার সাথে রয়েছে এবং আমাকে পথ দেখাবেন। তখন আল্লাহ মূসার প্রতি অহি করলেন,فَلَمَّا تَرَاءَى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ قَالَ كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانْفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ ‘অতঃপর যখন দু’দল পরস্পরকে দেখলো তখন মূসা (আঃ)-এর সঙ্গীরা বললো, আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম। মূসা (আঃ) বললেন কিছুতেই নয়! আমার সাথে আমার প্রতিপালক আছেন, সত্বর তিনি আমাকে পথ-নির্দেশ করবেন। অতঃপর আমি মূসা (আঃ)-এর প্রতি অহী করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর, ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বত সদৃশ হয়ে গেল’ (শুআ’রা ৬১-৬৩)

অত্র আয়াত ও হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ সব কিছুর ক্ষমতার অধিকারী, তাই সর্বাবস্থায় ও সকল বিষয়ে তাঁর উপর ভরসা রাখতে হবে। যার ফলে চলে আসবে তাঁর পক্ষ হ’তে অকল্পনীয় সাহায্য ও সফলতা। 

আল্লাহর উপর ভরসাকারীর বৈশিষ্ট্য

এই মর্মে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘নিশ্চয়ই মু’মিনরা এরূপই হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়, আর তারা নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)

আল্লাহর উপর ভরসা করা মু’মিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা তিনি ছাড়া আর কারো কাছে কোনকিছু আশাই করে না। আশ্রয়দাতা তাঁকেই মনে করে থাকে। কিছু চাইলে তাঁর কাছেই চেয়ে থাকে। প্রতিটি কাজে তাঁর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। তারা জানে যে, তিনি (আল্লাহ) যা ইচ্ছা করবেন তাই হবে এবং যা ইচ্ছা করবেন না তা হবে না। তিনি একক। তাঁর কোন অংশীদার নেই। সব কিছুরই মালিক একমাত্র তিনিই। তাঁর সিদ্ধান্তের পর আর কারও সিদ্ধান্ত চলতে পারে না। তিনি সত্বর হিসাব গ্রহণকারী। প্রকৃতার্থে আল্লাহর উপর ভরসা হচ্ছে ঈমানের বন্ধন।

(৪) ধৈর্যশীল ব্যক্তি

মহান আল্লাহ বলে, وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ ‘আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৬)। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্বীয় বান্দাগণকে অবশ্যই পরীক্ষা করে থাকেন কখনও পরীক্ষা করেন উন্নতি ও মঙ্গলের দ্বারা, আবার কখনও পরীক্ষা করেন অবনতি ও অমঙ্গল দ্বারা। তিনি বলেন, فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ ‘তিনি (আল্লাহ) তাদেরকে ক্ষুধা ও ভয়ের স্বাদ গ্রহণ করিয়েছেন’ (নাহল ১৬/১১২)। আল্লাহ আরো বলেন,وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ ‘নিশ্চই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষাকরতঃ কারা আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী এবং কারা ধৈর্যশীলগণ তা জেনে নেব’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩১)

এই ছবরের মূলভাব এই যে, সামান্য ভয়-ভীতি, কিছু ক্ষুধা, কিছু ধন-মালের ঘাটতি, কিছু প্রাণের হ্রাস অর্থাৎ নিজের ও অপরের, আত্নীয়-স্বজনের এবং বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যু, কখনও ফল এবং উৎপাদিত শস্যের ক্ষতি ইত্যাদি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাগণকে পরীক্ষা করে থাকেন। এতে ধৈর্যধারণকারীদের তিনি উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকেন। যেমন আল্লাহ বলেন,وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيرًا مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا ‘আর তাদের ছবরের পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোষাক দান করবেন’। ‘তারা সেখানে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে’ (দাহর ৭৬/১২,১৩)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ‘মু’মিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মু’মিন ব্যতীত আর কারুর জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। আর এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। আর এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়’। [2]

অতএব আমাদেরকে যে কোন বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং সেই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর নিকট পানাহ চাইতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)

ছবর তিন প্রকার : (১) নিষিদ্ধ ও পাপের কাজ থেকে ছবর করা (২) আল্লাহর আনুগত্য ও নেক আমলের উপর ছবর করা (৩) বিপদ ও দুঃখের সময় ছবর করা।

তাফসীর ইবনে কাছীরের একটি বর্ণনাতে পাওয়া যায় যে, ক্বিয়ামতের দিন একজন আহবানকারী আহবান করে বলবে, হে ধৈর্যশীলগণ তোমরা কোথায়? তোমরা উঠ ও বিনা হিসাবে জান্নাত প্রবেশ কর’। একথা শুনে কিছু লোক দাঁড়িয়ে যাবে এবং জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে। ফেরেশতাগণ তাদেরকে দেখে জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ? তারা বলবে জান্নাতে’। ফেরেশতাগণ বলবে, এখনও তো হিসাব দেয়া হয়নি। তারা বলবে হ্যাঁ, হিসাব দেয়ার পূর্বেই। ফেরেশতাগণ তখন জিজ্ঞেস করবে, ‘তাহলে তোমরা কি প্রকৃতির লোক? উত্তরে তারা বলবে, আমরা ধৈর্যশীল লোক। আমরা সদা আল্লাহর নির্দেশ পালনে লেগে ছিলাম, তার অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণ হ’তে বেঁচে থাকতাম। মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এর উপর ধৈর্যধারণ করেছি এবং অটল থেকেছি। তখন ফেরেশতাগণ বলবে, ঠিক আছে। অবশ্যই এটা তোমাদের প্রতিদান এবং তোমরা এরই যোগ্য। জান্নাতে গিয়ে আনন্দ উপভোগ কর। কুরআন মাজীদে একথাই ঘোষিত হচ্ছে, يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিদান বেহিসাবে দেয়া হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ কক্ষ অর্জনের তাওফীক দান করুন- আমীন।

হাদীছে এসেছে, عَنْ حَمَّادِ بْنِ سَلَمَةَ عَنْ أَبِى سِنَانٍ قَالَ دَفَنْتُ ابْنِى سِنَانًا وَأَبُو طَلْحَةَ الْخَوْلاَنِىُّ جَالِسٌ عَلَى شَفِيرِ الْقَبْرِ فَلَمَّا أَرَدْتُ الْخُرُوجَ أَخَذَ بِيَدِى فَقَالَ أَلاَ أُبَشِّرُكَ يَا أَبَا سِنَانٍ. قُلْتُ بَلَى. فَقَالَ حَدَّثَنِى الضَّحَّاكُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَرْزَبٍ عَنْ أَبِى مُوسَى الأَشْعَرِىِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا مَاتَ وَلَدُ الْعَبْدِ قَالَ اللَّهُ لِمَلاَئِكَتِهِ قَبَضْتُمْ وَلَدَ عَبْدِى. فَيَقُولُونَ نَعَمْ. فَيَقُولُ قَبَضْتُمْ ثَمَرَةَ فُؤَادِهِ. فَيَقُولُونَ نَعَمْ. فَيَقُولُ مَاذَا قَالَ عَبْدِى فَيَقُولُونَ حَمِدَكَ وَاسْتَرْجَعَ. فَيَقُولُ اللَّهُ ابْنُوا لِعَبْدِى بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ وَسَمُّوهُ بَيْتَ الْحَمْدِ. হযরত আবু সিনান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আমার একটি শিশুকে সমাধিস্থ করি। আমি তার কবরেই ছিলাম এমন সময় হযরত আবু তালহা খাওলানী (রাঃ) আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে নেন এবং বলেন, আমি কি আপনাকে একটি সুসংবাদ দেবো না? আমি বললাম হ্যাঁ, বলেন, তিনি বলেন হযরত আবু মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মালাকুল মাউত! তুমি আমার বান্দার ছেলে, তার চক্ষুর জ্যোতি এবং কলিজার টুকরোকে ছিনিয়ে নিয়েছো? ফেরেশতা বলেন, হ্যাঁ। ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তখন আমার বান্দা কি বলেছে? ফেরেশতা বলেন, ‘সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেছে। তখন ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার জন্যে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি কর এবং তার নামে ‘বায়তুল হামদ’ বা প্রশংসার ঘর রেখে দাও।[3]

সম্মানিত পাঠক! বান্দা যখন বিপদে পড়ে আল্লাহর প্রশংসা ও ইন্নালিল্লাহ পাঠ করে, আল্লাহ খুশি হয়ে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, أُولَئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيهَا تَحِيَّةً وَسَلَامًا خَالِدِينَ فِيهَا حَسُنَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا- ‘তাদেরকে প্রতিদানস্বরূপ দেওয়া হবে জান্নাতের সর্বোচ্চ কক্ষ এজন্য যে, তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা দেওয়া হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আশ্রয়স্থল ও আবাসস্থল হিসাবে কতইনা উৎকৃষ্ট! (ফুরকান ২৫/৭৫-৭৬)। আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ কক্ষ গ্রহণের তাওফীক দান করুন- আমীন।

ধৈর্যশীল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য :

‘ছবর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হ’ল ধৈর্যধারণ করা। পারিভাষিক অর্থে ধৈর্যশীল হ’ল যারা তাদের দ্বীনের উপর অটুট থাকে, যাতে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। আর তা হ’ল ইসলাম। সুতরাং তারা সুখে-দুঃখে, কষ্টে-শান্তিতে সর্বাবস্থায় আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকে না, এমনকি তারা মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

‘ছবর’-এর অর্থ হচ্ছে যে, আল্লাহর দানকে স্বীকার করা, বিপদের প্রতিদান আল্লাহ তা‘আলার নিকট পাওয়ার বিশ^াস রেখে তার জন্যে পুণ্যের প্রার্থনা করা; প্রত্যেক ভয়, উদ্বেগ এবং কাঠিন্যের স্থলে ধৈর্য ধারণ করা এবং পুণ্যের আশায় তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা।

আরো সহজ ভাবে বলা যায়, যে কাজে আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং যা করা উচিৎ নয়, এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ‘ছবর’ মানুষের মহৎ একটি গুণ যা যে কোন ধর্মের মানুষের মধ্যে তা থাকতে পারে, তবে মু‘মিনের গুণসমূহের অন্যতম গুণ হ’ল ‘ছবর’। যে গুণ মু‘মিন বান্দার জান্নাতের সর্বোচ্চ কক্ষ লাভের কারণ হয়। কিন্তু কিছু লোক নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বিচলিত ও ধৈর্যহারা হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা আছরে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য চারটি গুণ বর্ণনা করেছেন, যা ইহকালে ও পরকালে কল্যাণের জন্য অর্জন করা প্রত্যেকের অপরিহার্য। চারটি গুণ হ’ল, (১) যারা (জেনে বুঝে) ঈমান এনেছে (২) সৎকর্ম সম্পাদন করেছে (৩) পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও (৪) পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে। যার কোন একটি গুণের কমতি থাকলে কেউ পূণাঙ্গ মুমিন হ’তে পারবে না এবং ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতেও পারবে না।

একটি যরূরী বিষয় এই যে, এখানে আল্লাহ ‘হক’ ও ‘ছবর’ দু’টিকে পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন। এর হিকমত এই যে, ‘হক্ব’-এর দাওয়াত দেওয়ার সাথে সাথে ধৈর্যেরও উপদেশ দিতে হবে। কারণ ‘হক্ব’-এর উপর অটল থাকতে গেলে, আমরা চার জায়গা থেকে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারি, (১) পরিবার (২) সমাজ (৩) ধর্মীয় নেতা ও (৪) রাষ্ট্রযন্ত্র। এমনকি দেশ থেকে বিতাড়িত ও ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হতে পারে। এই সময় বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও ধৈর্যধারণ করতে হবে। হাদীছে এসেছে, ‘রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা হ’ল, ‘সর্বোত্তম ঈমান কী? তিনি বললেন, উত্তম চরিত্র, ছবর ও উদারতা’।[4] (ক্রমশ)

[লেখক : সহকারী শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ]


[1]. তিরমিযী হা/২৩৪৪

[2]. মুসলিম হা/২৯৯৯।

[3]. তিরমিযী হা/১০২১; ছহীহাহ হা/১৪০৮।

[4]. ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৯৫।



বিষয়সমূহ: আমল
আরও