সিপাহী জিহাদউত্তর মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমি [শেষ কিস্তি]
অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 1160 বার পঠিত
[মুফতী ফয়যুল্লাহ ফয়যী (৮৬) বাংলাদেশে হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ একজন আলেম। এদেশের হানাফীগণ তাকে তাদের আকাবীর হিসাবে সম্মান দিয়ে থাকেন। তিনি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত মেখল গ্রামে পিতা মুন্সি হেদায়েত আলী চৌধুরী ও মাতা রহিমুন্নেসার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন। ফয়যুল্লাহ দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর শিক্ষা সমাপন করেন। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর হাটহাজারী মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। শেষ বয়সে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারীর মেখলস্থ ‘হামিউস সুন্নাহ মাদরাসা’য় আমরণ পাঠদানে নিয়োজিত থাকেন। তিনি ছোট-বড় প্রায় ২০০টি গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে ২১টি ফারসী ভাষায় এবং অবশিষ্টগুলো বাংলা, উর্দু ও আরবী ভাষায় রচিত। তাকে মুফতী-এ-আযম (শ্রেষ্ঠ মুফতী) উপাধীতে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৭৬ সনের ৭ই অক্টোবর ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মুফতী ফয়যুল্লাহ হানাফী সমাজে প্রচলিত অনেক বিদ‘আতের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। শিরক ও বিদআ‘তের বিরুদ্ধে তাঁর এই আপোষহীন অবস্থান বর্তমান সময়ের হানাফী আলেমদের মধ্যে দেখা যায় না বললেই চলে। তিনি প্রচলিত সূফীবাদী যিকিরের বিরুদ্ধে ফার্সী ভাষায় ‘আল ক্বওলুস সাদীদ ফী হুকমিল আহ্ওয়ালি ওয়াল মাওয়াজিদ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। যেটা তাঁর ‘মাজমুয়ায়ে রাসায়েলে ফাইযিয়া’ নামক প্রবন্ধ সংগ্রহ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। প্রবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ ‘প্রচলিত বিদআতী যিকির : একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে পত্রস্থ করছি। ফার্সী থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রঊফ।- নির্বাহী সম্পাদক]
হামদ ও ছানার পর জেনে রাখা উচিত যে, এই ফিতনার যুগে অধিকাংশ যিকিরকারী এবং সূফী সাধকদের মধ্যে একটি তরীক্বার প্রচলন ও প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। আর তা হ’ল- ওয়াযের মাহফিল এবং অন্যান্য মজলিসে যখন আবেগপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করা হয় অথবা ইশকের কবিতা পড়া হয়; তখন আবেগতাড়িত হয়ে অনেকেই চিৎকার করে, কেউ কেউ যমীনে আছড়ে পড়ে ঘুরতে থাকে, হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে; এমনকি অনেকে বেহুশ হয়ে যায়। এগুলো নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও সুন্নাত পরিপন্থী। ছাহাবী-তাবেয়ী, আইম্মায়ে মুজতাহেদীন এবং সালাফে সালেহীনদের রীতিবিরোধী। স্বেচ্ছায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে এরকম ভান করা হারাম। এ ধরণের মন্দ কাজ যারা করে তারা নিঃসন্দেহে গুণাহ্গার। রাসূল (ছা:)- এর পাক পবিত্র মজলিসে এরূপ কিছুই ছিল না। শামায়েলে তিরমিযীর ২৪ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, و کان مجلسه مجلس علم و حیاء و صبر و امانته لا ترفع فیها لاصوات ‘রাসূল (ছা:)-এর বৈঠক ছিল ইলম (জ্ঞান), হায়া (লজ্জা), ছবর (ধৈর্য) ও আমানতের (বিশ্বস্ততার) বৈঠক। সেখানে কোন উচ্চবাচ্য বা আওয়াজ হ’ত না।’ একই গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায় রয়েছে- ‘আর যখন তিনি বক্তব্য দিতেন তখন সকলেই তাঁর কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন। দেখে মনে হ’ত যেন তাঁদের মাথায় পাখি বসে আছে।’ যেমনটি মিশকাতে বারা ইবনু আযেব (রা.) হ’তে বর্ণিত আছে, ‘নবী (ছা:) বসলেন, আমরাও তাঁর চারপাশে বসলাম। মনে হ’ল আমাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে।’[1]
হ্যঁা, অন্তর নরম করা বিষয়গুলো বর্ণনা করার সময় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া, কান্না করা এবং অন্তর থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয় ও নেকীর কাজ, যা সালাফে ছালেহীনদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। কুরআন ও সুন্নাহ তার দলীল বহন করে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছেন। যা পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পুন:পুন: পঠিত। এতে তাদের দেহ চর্ম ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর তাদের দেহ মন আল্লাহর স্মরণে বিনীত হয়।’[2]
ইরবাজ ইবনু সারিয়া (রা:) হ’তে বর্ণনায় এসেছে, ‘তিনি (ছা.) আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ওয়ায করলেন। তাতে আমাদের চক্ষু হ’তে অশ্রু প্রবাহিত হ’ল এবং অন্তরসমূহ ভীত হ’ল।’[3]
আয়াতে কারীমা থেকে দেহ ও মনে ভীতির সঞ্চার হওয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু ছুটাছুটি করা, চিৎকার করা, মাটিতে পড়ে আছড়ানো প্রমাণ হয় না। ইমাম শাত্বেবী (রহ.) আল ই‘তিছাম গ্রন্থে লিখেছেন-
والذي يظهر في التواجد ما كان يبدو على جملة من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ، وهو البكاء واقشعرار الجلد التابع للخوف الآخذ بجامع القلوب الیٰ ان قال فليس في ذلك صعق ولا صياح ولا شطح ولا تغاش مستعمل ولا شيء من ذلك الیٰ ان قال مر ابن عمر برجل من أهل العراق ساقط والناس حوله، فقال: ما هذا؟ فقالوا: إذا قرئ عليه القرآن أو سمع اللَّه يذكر؛ خر من خشية اللَّه قال ابن عمر: واللَّه إنا لنخشى اللَّه ولا نسقط! وهذا إنكار-
অন্তরে বিমোহিত ভাব সৃষ্টির অর্থ যেটা কিছু ছাহাবীর আচরণ থেকে বোঝা যায় তা হ’ল, কান্না, অন্তঃপ্রাণজুড়ে আল্লাহভীতি জনিত কারণে শরীর প্রকম্পিত হওয়া। এতে বেহুশ হয়ে যাওয়া, চিৎকার করা, লাফালাফি করা বা তথাকথিত হাল হওয়া ইত্যাদি কিছুই ছিল না। তিনি আরো বলেন, একবার ইবনু উমার এক ইরাকী ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন যে মাটিতে পড়ে ছিল। লোকেরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। ইবনু উমার জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি? লোকেরা বলল, যখন তার সামনে কুরআন পড়া হয় বা আল্লাহর যিকির করা হয়, তখন সে আল্লাহর ভয়ে পড়ে যায়। তখন ইবনু উমার বললেন, আল্লাহর কসম আমরা অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করতাম, কিন্তু এভাবে উল্টে পড়তাম না। এটা ছিল তাঁর পক্ষ থেকে এই কাজের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, আনাস ইবনু মালেক (রা.) হ’তে বর্ণিত-أنه سئل عن القوم يقرأ عليهم القرآن فيصعقون.فقال ذلك فعل الخوارج! ‘তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হ’ল এমন এক জাতি সম্পর্কে যাদের সামনে কুরআন পাঠ করা হলে বেহুশ হয়ে যেত। তিনি বললেন এগুলো খারেজীদের কাজ।’[4]
অতঃপর তিনি উলেলখ করেন যে, ‘যেমন ওয়ায-নছীহতের সময় অধিকাংশ অশিক্ষিত লোকেরা চিৎকার করে, হর্ষধ্বনি করে এবং বেহুশ হয়ে যায়। এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে হয় এবং শয়তান তাদের সাথে খেলা করে। এসব বিদ‘আত ও পথভ্রষ্টতা।’[5]
হালওয়ানী বলেন, ‘আমাদের যুগের ছূফীদের কথা শোনা ও লাফালাফি করা হারাম। সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছা করা যাবে না এবং সেখানে বসাও যাবে না। এগুলো গান-বাজনা এবং শয়তানের বাঁশী।’[6]
‘কুরআন তেলাওয়াতের সময় বেহুশ হয়ে যাওয়া মাকরুহ। কেননা এটি রিয়ার অন্তর্ভুক্ত এবং শয়তানের কাজ। এ ব্যাপারে ছাহাবী, তাবেয়ী ও সালাফে সালেহীনগণ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।’[7]
‘আমাদের যামানার ছূফীরা যা করে তা হারাম। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা বা বসাও জায়েয নয়। এরূপ তাদের পূর্ববর্তীরাও করেননি।’[8]
এই সমস্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এ বিষয়গুলো বিদ‘আত, বাতিল এবং ভ্রষ্টতা। হক্বপন্থী সালাফে ছালেহীন তাঁদের যামানায় এ ধরণের পাপ কাজে লিপ্ত হননি। বরং তা খারেজী এবং বিদ‘আতীরা করতো। ঐ যে আসমা (রা.)-এর হাদীছ যেটা বুখারী ও মিশকাতে এসেছে যে, একবার রাসূল (ছা.) ফিতনা ও ক্ববরের আযাব সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন; ঐ সময় ছাহাবায়ে কেরাম ভীত-সন্ত্রন্তের চুড়ান্ত অবস্থায় উচ্চস্বরে আওয়াজ (কান্না) করতে লাগলেন। সে হাদীছ এ যামানায় এসে এ ধরণের নোংরা আমল ও কদর্য কাজ জায়েয হওয়ার দলীল বহন করে না। কেননা এই বিষয়টি হঠাৎ ঘটেছিল এবং সেই যামানায় চালু থাকা কোন অভ্যাসগত আমল ছিল না। তারপরেও সেটি রাসূল (ছা.)- এর হাদীছ ও ক্ববরের আযাবের কথা শুনে ঘটেছিল। কোন মধুর সুরে গাওয়া কবিতা শুনে নয়। সুতরাং ঐ আমলটির সাথে বর্তমান সময়ের কোন সম্পর্ক নেই। কবি বলেন,
ببین تفاوت ره کز کجاست تا به کجا
چراغ مرده کجا شمع آفتاب کجا
দেখ, পথের দূরত্ব কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়!
কোথায় মৃত প্রদীপ আর কোথায় উজ্জ্বল রবি!
যদি ছূফীদের মধ্য থেকে এ ধরণের বিষয় প্রকাশিত হয় অথবা তাদের কেউ মাহফিল ও মজলিসে এমন আমল নিয়ে আসে তবে সেটিও দলীল হয়ে যায় না। ছূফীদের আমল কোন কিছুকে জায়েয করার দলীল নয়। আমরা তাদের অনুসরণ করি না বরং নবী কারীম (ছা.), ছাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করি। কেননা হাদীছে এসেছে, ‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে।’
অন্য হাদীছে এসেছে, ‘সর্বোত্তম যুগ হ’ল আমার যুগ, অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী, অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী, অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী।’[9]
এ হাদীছগুলো উপরোক্ত কথার দলীল বহন করে। হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ.) তাঁর মাকতুবাত কিতাবের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ছূফীদের আমল হালাল-হারামের সনদ নয়। এখানে আবু হানীফা (রহ.), আবু ইউসুফ (রহ.) এবং মুহাম্মাদ (রহ:)-এর কথা ও কর্ম নির্ভরযোগ্য। আবু বকর শিবলী ও আবুল হাসান নূরীর কথাও নয়।’[10]
অন্য জায়গায় লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ের ছূফীরা যদি সুবিচার করে ইসলামের দূর্বলতার দিকে লক্ষ্য রাখতো এবং মিথ্যা প্রসারিত হওয়ার দিকে লক্ষ্য করত তাহলে কখনো সুন্নাতের বিপরীতে তাদের পীরদের তাক্বলীদ করত না এবং শায়খদের আমলের বাহানায় নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ে অভ্যস্ত হত না। সুন্নাতের অনুসরণ অবশ্যই নাজাতের মাধ্যম, ফলপ্রসূ, কল্যাণকর এবং বরকতময়। অপরদিকে সুন্নাতের বিপরীতে তাক্বলীদ ভয়াবহ এবং ধ্বংসের কারণ।’[11] ‘সৌভাগ্যবান তো সেই ব্যক্তি যে, এই যামানায় পরিত্যক্ত সুন্নাতকে জীবিত করে এবং প্রচলিত বিদ‘আতকে ধ্বংস করে।’
‘মা লা বুদ্দামিনহু’ কিতাবের ৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘কারও কথা ও কর্ম যদি রাসূল (ছা:)-এর কথা ও কর্মের চুল পরিমাণ বিরোধী হয়, তবে তা অবশ্যই বর্জন করা উচিত। যদিও এগুলো মানুষকে বিশেষত: অসচেতন মূর্খদের পথভ্রষ্টতার অতল তলে এবং হাবিয়া জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। কারণ তারা এই বিষয়কে মুখ্য উদ্দেশ্য এবং পূর্ণতা ও সম্মান লাভের বড় মাধ্যম হিসেবে ধারণা করে (অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হবে বলে মনে করে)। বরং সাধারণ মানুষ এর থেকে দূরে রয়েছে। অনেক বিশেষ ব্যক্তিরাও এগুলোকে (আল্লাহর কাছে) উচ্চ মর্যাদা লাভের মাধ্যম ধারণা করে। সুন্নাতের অনুকরণ ও শরীআ‘তের অনুসরণ যে প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করে, আসলে সে বিষয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীত বিষয়কে কাঙ্খিত মাকছাদ অর্জনের মাধ্যম মনে করা এবং প্রকৃত মাকছাদ সম্পর্কে না জানা যে কত বড় পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহী তা ছোট-বড় কারও কাছেই গোপন নয়। তাদের বিশ্বাস রাখা উচিত যে, শরীআতের আনুগত্য ও সুন্নাতের অনুসরণই প্রকৃত মর্যাদা ও মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যম (আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম)। ইবাদতে ইখলাছ অর্জন করা, দুনিয়া ও তার মধ্যস্থ সবকিছু থেকে বিমুখ হওয়া এবং পরকালীন চিন্তায় বিভোর হওয়ার গুঢ় অর্থ যদি কেউ হাছিল করতে পারে, তবে সে-ই বড় কামেল, যদিও তার কাছ থেকে কোন প্রকার কাশফ-কারামত প্রকাশ না পায়। আর যদি কেউ এই গুঢ় অর্থ হাছিল করতে না পারে তবে সে কখনো কামেল ও বুযুর্গ নয়, যদিও তার থেকে হাযারটা কাশফ-কারামত প্রকাশ পায়। বরং মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রহ.) এটাকে কল্পনা ও খেয়াল খুশির অনুসরণ বলেছেন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও মারেফত ছূফীদেরকে কিছু সময়ের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ দেখায় বটে; কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে দেয় না। বরং এসব খেয়াল ও কল্পনা তরীকতের প্রাথমিক অবস্থার উপর প্রশিক্ষণ দেয় যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।’ এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, তারা তরীকতের প্রাথমিক অবস্থায় থাকে, পূর্ণতার স্তরে পৌঁছায় না। কিছু বুযুর্গানে দ্বীন ও তরীকতের আকাবির মনছূর হাল্লাজের ব্যাপারে বলেছেন যে, মনছূর তরিকতের এক ফোঁটা পানি খেয়েছে মাত্র; কিন্তু হজম করতে পারেনি। এখানে মারেফাত অর্জনে অনেক বড় ব্যক্তি রয়েছেন যারা পুরা দরিয়ার পানি পর্যন্ত পান করে ফেলেন, কিন্তু ঢেকুর তোলেন না।
যাদের দূরদর্শিতা কম তারা প্রাথমিক অবস্থাকেই প্রধান ও মোক্ষ বলে মনে করে এবং মারেফতের মুশাহাদা ও তাজাল্লিয়াতকেও আসল উদ্দেশ্য ভাবে। এই কারণে তারা কল্পনা ও খেয়ালের জেলখানায় বন্দি হয়ে যায় এবং শরীআতের পূর্ণতা লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে। অন্য জায়গায় লিখেছেন যে, ‘প্রাথমিক স্তরে ও মধ্যবর্তী স্তরে ইশক ও মোহাববতের অর্থ আল্লাহ পাকের সত্ত্বা ব্যতীত আর সবকিছুর সাথে যাবতীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা। এখানে ইশক ও মোহাববতই মূল উদ্দেশ্য বা গন্তব্য নয়।
শত আফসোস এই যামানার মানুষদের অবস্থার উপর, যারা তাদের পীর ও শায়েখদের উদ্ভাবিত আমলের প্রতি আকৃষ্ট ও মোহিত হয়ে আছে এবং নবী (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও শিক্ষা এবং হাদীছে বর্ণিত দোয়া থেকে বিমুখ। তারা যে পরিমাণ বিদআতী বা নব উদ্ভাবিত বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে, তার দশ ভাগের এক ভাগও নাবী (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সুন্নাতের প্রতি করে না। এসব কাজের যুক্তদের অধিকাংশ অনুসারীদের দেখা যায় যে, তারা শরীআ‘তের অনুকরণ, সুন্নাতের অনুসরণ, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। অথচ এই জিনিসগুলোই প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের বড় মাধ্যম। কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন ও আত্মীক পরিশুদ্ধিতা যা দুনিয়া বিমুখতার দ্বারা আখিরাতের পথে ধাবিত করে, ইবাদতের স্বাদ আস্বাদন, আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের আনুগত্য, ইহসানের স্তরে পৌছানো ইত্যাতি বিষয় কখনো এই নতুন উদ্ভাবিত বিদআ‘তী আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়; বরং সুন্নাতের আনুসরণ এবং হাদীছে বর্ণিত দো‘আ ও অযীফার উপরে কায়েম থাকার মাধ্যমেই এইসব জিনিস অর্জিত হয়। কেননা সালাফে ছালেহীন এবং ফকীহ ও মুজতাহীদগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই সফলতা অর্জন করেছিলেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, হাদীছে বর্ণিত পথটি নির্ভেজাল এবং মযবুত, যে পথের অনুসারীদের বিদআ‘ত ও গোমরাহীতে পতিত হওয়ার আশংকা থাকে না। পক্ষান্তরে নব আবিষ্কৃত বিদআ‘তী পথগুলোতে ভয় ও বিপদে পড়ার আশংকা থাকে। কারণ এসব পথের অনুসরণ মানুষকে গোমরাহীর গর্তে নিক্ষেপ করে। বর্তমান যুগটি বিভিন্ন ধরণের বিদআ‘ত ও ইসলাম বিরোধী আচার-আচরণ প্রকাশের যুগ। কেননা বিদআ‘ত এবং গোমরাহী সারা বিশ্বকে বেষ্টন করে ফেলেছে। ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ সম্পাদনের সময় এই বিদআ‘তী কাজগুলো সম্পাদন করায় বিদআ‘তকে আরো সম্প্রসারণ করা হয় এবং বিদআতীদের সমর্থন যোগায়। তখন হক্বপন্থীগণ অবশ্যই দুর্বল হয়ে যায়। বরং হক্ব ও হক্বপন্থীদের মরে যাওয়া ও গোপন হয়ে যাওয়া প্রকাশ পায়। কিন্তু কাঙ্খিত মাকছাদে পৌঁছা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন নিঃসন্দেহে নবী (ছা.) থেকে বর্ণিত বিষয়ের মাধ্যমেই সাধিত হয়। এজন্য সেগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করা এবং তার উপরে সদাসর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখা যরূরী। যেমন- প্রথমত : মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ এবং মুরাকাবা। দ্বিতীয়ত : সম্মানের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করা অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব এবং কুরআন মাজীদকে অন্তরস্থল থেকে তেলাওয়াত করা। কেননা হাদীছে এসেছে ‘তোমরা বেশী বেশী আনন্দ ধ্বংসকারী জিনিসটাকে স্মরণ করো আর তা হ’ল মৃত্যু।’[12]
হাদীছে এসেছে- ‘নিশ্চয় এই অন্তর মরীচীকাযুক্ত হয় যেমন মরীচীকা লাগে লোহায় যখন তাকে পানি স্পর্শ করে। বলা হ’ল, কী দিয়ে সে মরীচীকা দূর হবে হে আল্লাহর রাসূল (ছা.)? তিনি বললেন, অধিক পরিমাণে মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা।’[13] এই হাদীছটি উপরোক্ত কথার দলীল বহন করে। এছাড়াও কবর যিয়ারত করা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সম্পর্কে অপর একটি হাদীছে এসেছে- ‘তোমরা কবর যিয়ারত কর, কেননা তা মানুষকে দুনিয়া বিমুখ করে এবং আখিরাতকে স্মরণ করায়।’[14]তৃতীয়ত : আল্লাহর যিকির । যেমন হাদীছে এরশাদ হচ্ছে- لکل شئ صقالته وصقالة القلوب ذکر الله অর্থাৎ ‘প্রত্যেক জিনিসকে পরিষ্কার করার বস্ত্ত আছে এবং অন্তর পরিষ্কার করার বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর যিকির।’[15]
এখানে যিকির বলতে উদ্দেশ্য হ’ল কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত বিশুদ্ধ যিকিরসমূহ। প্রচলিত কোন বিদ’আতী যিকির নয়। যেমন বুখারীর হাশিয়ায় আল্লাহর যিকির অধ্যায়ে যিকিরের উদ্দেশ্য বলতে বোঝানো হয়েছে- ‘ঐ সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করা যেগুলোতে তার প্রতি উৎসাহ দান এবং বেশী বেশী বলা বোঝায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর যিকির থেকে উদ্দেশ্য হয় সে সব আমলগুলো সর্বদা করা যেগুলো আল্লাহ ওয়াজিব করেছেন অথবা সেদিকে আহবান করেছেন। যেমন কুরআন তেলাওয়াত, হাদীছ পাঠ, ইলম চর্চা এবং নফল ছালাত আদায় করা।’[16]
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রহ.) তাঁর মাকতুবাত কিতাবে লিখেছেন, ‘প্রত্যেক আমল শরীআ‘তের বিধান অনুযায়ী করলে সেটিও যিকিরের অর্ন্তভুক্ত যদিও সেটা কেনা-বেচা সম্পর্কিত হয়। সুতরাং প্রতিটি বিষয়ে শরীআ‘তের হুকুম-আহকামের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমল করা উচিত, তাহলেই সেটি যিকিরের অর্ন্তভুক্ত হবে। কেননা যিকিরের উদ্দেশ্য হ’ল উদাসীনতা পরিহার করা। আর যখন সকল আদেশ ও নিষেধের প্রতি লক্ষ্য রেখে সমস্ত কাজ করা হবে, তখন আদেশ ও নিষেধ মান্যকারী উদাসীনতা থেকে পরিত্রাণ পাবে এবং আল্লাহ তা‘আলার যিকিরে লিপ্ত থাকবে।[17] পীর-মাশায়েখদের সিলসিলায় চালু থাকা যিকিরগুলো সবই তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত। এগুলো সালাফে-ছালেহীন থেকে বর্ণিত নয়। এগুলো উদ্দেশ্যে পেঁŠছানোর বস্ত্ত নয়। এগুলোকে মুখ্য উদ্দেশ্য মনে করা বিদআ‘ত ও গোমরাহী। এই সমস্ত বর্ণিত যিকিরের অধিকাংশই নিতান্ত দুর্বল। এই সমস্ত যিকির- আযকার শরীআ‘তের সাথে মিল আছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং শরীআ‘তের খেলাফ হ’লে তা থেকে দূরে থাকা যরূরী। নতুবা লাভের জায়গায় ক্ষতি হবে। যেমন মাকতুবাতে বর্ণিত আছে, মাছলাহাতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা সম্পাদন করা এবং মাকরুহ থেকে বিরত থাকা। যদিও মাকরুহটি তানযীহী হয় তবুও তার থেকে বেঁচে থাকা ভাল। আর মাকরূহে তাহরীমী হ’লে ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। এগুলো পীরদের মুরাকাবা ও তাদের যিকির-ফিকিরের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার থেকে উত্তম। যে ব্যক্তি ভালোর প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং মাকরূহ থেকে বিরত থাকতে সক্ষম, সে ব্যক্তি মহা সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। অন্যথায় সে বিপদের সম্মুখীন হবে।[18]
হাযারো আফসোস এই যুগের সালেকীন ও যাকেরীনদের প্রতি যারা ঐ ধরণের যিকির অবলম্বনে শরীআ‘তের প্রতি লক্ষ্য করে না এবং এই সমস্ত কাজে শরীআ‘ত থেকে বেশী গুরুত্বারোপ করে। নিঃসন্দেহে এমনটি করা গোমরাহী এবং মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার নামান্তর।
চতুর্থত : কামেল এবং সম্মানীত ব্যক্তিগণের সাহচর্য লাভ করা। এই চারটি জিনিসের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তার প্রতি সদা সর্বদা কায়েম থাকা নিঃসন্দেহে মানুষকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পেঁŠছায় এবং এইসব কাজে বিদআ‘ত ও গোমরাহীতে পতিত হওয়ার আশংকা থাকে না। ধর্মীয় কিতাবাদি অধ্যয়ন করা এবং তাতেই ব্যস্ত থাকা এবং খালেছ নিয়তে ইলমে দ্বীন চর্চা আত্মিক পরিশুদ্ধিতা অর্জনের মহাশক্তি দান করে এবং কল্যাণ সাধন করে, যা কল্যাণকামী এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে গোপন নয়। সারকথা এই যে, ফিৎনায় ভরপুর যামানায় বিদআ‘তী কাজগুলো থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা যরূরী। এতেই দ্বীন ও ঈমানের নিরাপত্তা সাধিত হয় এবং বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকা যরূরী। কেননা এগুলো ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। নাসাঈ শরীফে হাদীছ বর্ণিত আছে যে, قال رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وإياكم والغلو فى الدين فإنما أهلك من كان قبلكم الغلو فى الدين অর্থাৎ ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাক। কেননা আল্লাহ তোমাদের পূর্বপুরুষদের দ্বীনে বাড়াবাড়ি করার জন্য ধ্বংস করেছেন।’[19]
- মূল (ফার্সী): মুফতী ফয়যুল্লাহ ফয়যী
বাংলাদেশে হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ একজন আলেম
বঙ্গানুবাদ : আব্দুর রঊফ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী বিভাগের শিক্ষার্থী
[1]. আহমাদ, মিশকাত হা/ ১৬৩০
[2]. সূরা যুমার-২৩
[3].আবু দাঊদ হা/ ৪৬০৭, আহমাদ হা/ ১৭১৮৫
৪. ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাহ, হা/১৫৩।
৪. আশ-শাত্বেবী, আল-ইতিছাম, ১/৩৫২।
৫. আলমগীরী, কিতাবুল কারাহাত, চতুর্থ খন্ড, পৃ. ১১০।
৬. আলমগীরী,পঞ্চম খন্ড, পৃ. ৯১।
৭. শামী, পঞ্চম খন্ড, পৃ. ৩০৬।
৮. দিওয়ানে হাফিয, গজল-২।
৯. মুসলিম হা/২৫৩৩।
১০. মাকতূবাত, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩৫।
১১. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৮।
১২. তিরমিযী হা/২৩২৭।
১৩.ইবনু মাজাহ হা/১৫৭১।
১৪.বায়হাকী, শুআবুল ঈমান হা/৫১৯।
১৫.২য় খন্ড, পৃ: ৯৪৮।
১৬. ২য় খন্ড, পৃ: ৪২।
১৭. ১ম খ- ৩৬ পৃ:।
১৮. সুনান নাসাঈ হা/ ৩০৭০।