ডা. ইদরীস আলী
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
[বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া (৬২), যিনি দেশে ও বিদেশে মোট এগারোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ বছর শিক্ষকতার অনবদ্য অভিজ্ঞতায় ভাস্বর। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে তাঁর রয়েছে গভীর মনীষা ও বিস্তর গবেষণা। সম্পতি আত-তাহরীক টিভির পক্ষ থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তাওহীদের ডাক সম্পাদক ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব। বিষয়বস্ত্তর গুরুত্ব বিবেচনায় এর ঈষৎ পরিবর্তিত অনুলিখিত রূপটি তাওহীদের ডাক পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।- নির্বাহী সম্পাদক ]
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার, আপনার জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ যেলা শহরে আমার জন্ম। আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। এক ভাই ছোট বেলায় মারা গেছে। আমার বড় ভাই আমেরিকার আরিজোনা স্টেটের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রান্সপোর্ট এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-য়ে অফিসার হিসাবে কর্মরত আছেন। তারপর আমি আর আমার পরে আরো দুই বোন আছে। তাঁরা বিবাহিতা। আর আমার পিতা ও মাতা উভয়েই মারা গেছেন। আমার পিতা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আর মা ছিলেন একজন শিক্ষিকা। আমার তিন মেয়ে। তারা সকলেই পড়াশোনার মধ্যে আছে। আমার বড় মেয়ে আমেরিকায় পিএইচ.ডি করছে।
আর শিক্ষাজীবনের কথা বলতে গেলে প্রথম জীবনে আমি জীবনের লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। জানতাম না যে, আমার জীবনের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিৎ। তাই ছাত্রজীবনও আমার বিক্ষিপ্ত অবস্থায় শুরু হয়েছিল। প্রথমে মিশনারী মরিয়াম স্কুল ও ময়মনসিংহ যেলা স্কুলে কিছুদিন পড়ি। সেখান থেকে ঢাকা মুহাম্মাদপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে হাইস্কুল জীবন শেষ করি। তারপর ঢাকা কলেজ অতঃপর ময়মনসিংহ কলেজ। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেও একবছর পড়েছি। তারপর আবার ছয় মাসের মত মেরিনে ছিলাম। পরিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইবিএ এবং এমবিএ শেষ করি। পরবর্তীতে আমেরিকায় বিজনেস রিলেটেড আরো উচ্চতর পড়াশোনা করার পর সর্বশেষ পিএইচ.ডি করেছি। এর মধ্যে ইসলামের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরী হলে ভার্জিয়ানার আমেরিকান ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করি।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : পেশাজীবন কখন শুরু করেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : ১৯৮৭-এর জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে আমেরিকায় এক্সপ্রেস ব্যাংকে দুই বছর
চাকুরি করলাম। তারপরে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএতে লেকচারার পদে প্রায় বছরখানেক অধ্যাপনা করি। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতেও কিছুদিন ছিলাম। পরে আবার আমেরিকা গেলাম। তারপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলাম। আলহামদুলিল্লাহ একাধারে নিজ দেশসহ ৭টি দেশের মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ হয়েছে আমার। এর মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়েস, টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি (১ বছর), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি (১০ বছর), নর্দার্ন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ডাকোটা (৩ বছর), ইউনিভার্সিটি অব স্ক্রানটন (১ বছর), সঊদী আরবের রিয়াদের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্ (৪ বছর), কাতারের কাতার বিশববিদ্যালয় (৩ বছর), ওমানের সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি (৩ বছর), কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটি (১ বছর)। এছাড়া বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছি।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : শিক্ষকতার জন্য এত দেশে পদচারণা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমার চাকুরী জীবন শুরু হয়েছিল আমেরিকায়। বিদেশে চাকুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় ভালো করে লক্ষ্য করতে হয়। একটি হ’ল একাডেমিক রিসার্চ তথা নিজের বিষয় বা ডিপার্টমেন্টাল বিষয়ে গবেষণার মানসিকতা এবং টিচিং পারফরমেন্স বা শিক্ষকতার দক্ষতা। এ দু’টি বিষয় ঠিক থাকলে বিদেশের মাটিতে চাকুরী পেতে বেগ পেতে হয় না।
আর এত জায়গায় চাকুরীর কারণ হ’ল, বিদেশে চাকুরী বাজারের দৃশ্যপট আমাদের দেশের মত নয়। আমাদের দেশের মানুষেরা একটা চাকুরী দিয়েই জীবন পার করে দেয়। কিন্তু বাইরে যে কোন সময় চাকুরীর ক্ষেত্র পরিবর্তন হ’তে পারে। যেমন আমি আমেরিকায় এক ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার দিলাম। সেখানে ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটির ডীন বসা ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমাদের ওখানে চলে আসো আর একটি সেমিনার দাও! পরে আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেমিনার দিলাম। জব অফারও হল। কিন্তু পরবর্তীতে আমার যাওয়া হয়নি। এগুলো বিদেশে খুব স্বাভাবিক বিষয়।
এছাড়াও আমার বিদেশে অনেক ইউনিভার্সিটিতে চাকুরীর অফার এসেছিল। যেমন জার্মানি, ইংল্যান্ড, লেবানন, সাউথ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলোতে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : এ পর্যন্ত আপনার কতটি গবেষণাপত্র বা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : একশ’র মত হবে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আপনি তো বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিভাবে দেখেন? এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু মানসম্পন্ন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : এ বিষয়ে আমি একটু অন্যভাবে বলব। প্রথমতঃ উচ্চতর জ্ঞানার্জন দুইভাবে হয়ে থাকে। (১) ডিসিমিনেশন অফ নলেজ বা জ্ঞানের প্রচার-প্রসার, যা গবেষণা এবং প্রায়োগিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর এর অন্যতম প্রক্রিয়া হ’ল টিচিং বা শিক্ষাদান। এর রূপরেখা হ’ল একজন শিক্ষকের নিজ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনার মাধ্যমে বিশেষ জ্ঞানার্জন করা এবং পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির অন্যান্য সকল বিষয়ে একটা দখল থাকা। জ্ঞানের প্রচার-প্রসারের এই প্রক্রিয়াটিকে দেখভাল করতে হয় ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হ’ল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে শিক্ষার সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা এবং বিকাশ ঘটানো; সাথে সাথে উচ্চশিক্ষার নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে মান নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং তদনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা। (২) ক্রিয়েটিং নিউ নলেজ বা নিত্য-নতুন জ্ঞানের পরিধিকে বাড়ানো এবং ডাইনামিক বা যুগের চাহিদানুযায়ী জ্ঞানকে শাণিত করা। এর রূপরেখা হ’ল প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষকের ক্লাস কম থাকবে এবং ক্লাস বিষয়ক গবেষণার জায়গা থাকবে বিস্তৃত। যাতে করে শিক্ষক যথাযথ জ্ঞার্নাজনের মাধ্যমে পরিশীলিত শিক্ষিত ছাত্রসমাজ গড়তে পারে। যারা জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।
শিক্ষার এ দু’টি দিকের সাথে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করলে দেখা যায়, প্রথম কাঠামোর সাথে আমাদের মিল থাকলেও ইউজিসির দুর্বলতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দুয়ারে নিক্ষেপ করেছে। আর দ্বিতীয়টির দিকে নযর দিলে দেখা যায় আমাদের দেশে শিক্ষকতার মান রক্ষার চেয়ে শিক্ষকদের ঘাড়ে ক্লাসের বোঝা বেশী চাপানো হয়। ফলে তারা ক্লাস কাতর শিক্ষকে পরিণত হয়ে যায়।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমি ইসলামাবাদে দেখেছি সেখানে এইচইসি নামে একটা সরকারী উচ্চতর কমিশন আছে, যারা কঠোরভাবে উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই কমিশন প্রতিনিয়ত শিক্ষার মানোন্নয়নে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখছে। আপনি কি ইউজিসির এমন কোন ভূমিকার কথা বলছেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : হ্যাঁ, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা কমিশনকে তেমন নতুন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক রেটিং-এ ভাল কোন অবস্থানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেই। এ ব্যাপারে ইউজিসির কোন তদারকি নেই। নতুন জ্ঞানের সৃষ্টিতে তাদের বিশেষ ভূমিকা নেই। আর বর্তমান পরিবেশে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনে কাজ করা শিক্ষকদের পক্ষে খুব সহজও নয়। যেমন আমি একটা উদাহরণ দেই। আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে প্রতি সেমিস্টার হয় ১৪ সপ্তাহে। বছরে ৩টি সেমিস্টারে মোট ক্লাস হয় ৪২টি সপ্তাহ। লুইজিয়ানায় আমার ক্লাস ছিল মোট ৩০ সপ্তাহ। বাকি যে ২২টি সপ্তাহ বা বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় আমি গবেষণা তথা নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনে কাটাতাম। আর আমাদের পাবলিকেশন্সের উপর আমাদের প্রমোশন বা বেতন বৃদ্ধি নির্ভর করত। এজন্য যথেষ্ট উৎসাহভাতা দেয়া হ’ত। আমার সারা বছরে মাত্র ৪টা কোর্স ছিল। আর আমাদের দেশের শিক্ষকদের প্রতি সেমিস্টারে ৪টা কোর্স বা বছরে প্রায় ১২টা কোর্স থাকে। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষকরা টিচিং-য়েই আটকে থাকছে। তারা গবেষণায় তেমন সময় দিতে পারছে না। ফলে কোয়ালিটি পাবলিকেশন্স এখানে খুব একটা হয় না। এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা কমিশন কতদূর ভাবে তা আমাদের জানা নেই।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাংকিং-য়ে এত পিছিয়ে থাকার কারণ কী?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : মূল কারণ হ’ল, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কাজ তথা একাডেমিক গবেষণা আমাদের দেশে অনেক কম।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : অর্থাৎ একাডেমিক রিসার্চ বাংলাদেশে সেভাবে হচ্ছে না?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমি বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। আর যেগুলো হয়, সেগুলোও কোয়ালিটিতে অনেক পিছিয়ে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : বাংলাদেশের প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মত কি? বাইরের দেশের তুলনায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা তুলনামূলক পিছিয়ে কেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : এক্ষেত্রে আমি বলব, এমনিতে স্বাভাবিক নিয়ম-কানূনের জায়গায় এদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোর মতই আছে। তবে এখানে শুধু সুন্দর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। পরিকল্পনা দুই প্রকার- দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী। প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হ’ল আমাদের পড়াশোনার দুর্বলতাগুলি খুঁজে বের করা এবং সে বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করে সুন্দর পরিকল্পনা উপস্থাপন করা। তারপরে তা বাস্তবায়নে নেমে পড়া। কিন্তু আমাদের প্রতিটি স্তরে গলদগুলো রয়ে গেছে। ফলে ভাল কোন ফলাফল আমরা পাচ্ছিনা। ভাল কিছু পেতে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা দরকার, যে কাজটি উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে। প্ল্যান বেইজড এ্যাকশন তথা পরিকল্পনা মাফিক কাজের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট দুর্বলতা আছে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমাদের দেশে একটা ছাত্র একেবারে প্রাথমিক ক্লাস থেকে ইংরেজী শিক্ষা শুরু করে। কিন্তু অনার্স শেষ করেও সে ভালো ইংরেজি বুঝেনা। এর কারণ কী?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : শিক্ষাটা আসলে ছাত্র- শিক্ষকের ব্যাপার। ছাত্রের ব্যাপারে বলব, তাকে সর্বপ্রথম লাইফ গোল সেটিং বা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আর শিক্ষকদের বলব পড়াশোনার পদ্ধতিগত উন্নতি করতে হবে। বিভিন্ন দেশে এসব বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক বছর একজন শিক্ষক তার পড়াশোনার কী কী ধাঁচ পরিবর্তন করেছে, নতুন বছর নতুনদের জন্য সে কী মেথড এ্যাপ্লাই করবে ইত্যাদি বিষয়ে রীতিমত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়। ইচ্ছামত পড়ানোর সুযোগ নেই। নইলে চাকুরী পর্যন্ত চলে যেতে পারে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে একঘেঁয়েভাবে একই পদ্ধতিতে ছাত্রদের পড়িয়ে আসছেন। ছাত্রদেরকে পড়াশোনায় ইন্টারেস্টেড করানো হচ্ছে না। মোটিভেশন করা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক উন্নয়নের জন্য কোন এ্যাডভাইজারী বোর্ড নেই, যারা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষামান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। ফলে ছাত্রদের শিক্ষামান উন্নয়নে ভাল কোন কিছু জাতি পাচ্ছে না। ছাত্ররা অদক্ষ হয়ে গড়ে উঠছে। আর একারণেই বহুদিন ধরে কোন বিষয় পড়ার পরও ছাত্ররা তাতে ভাল কোন ফল করতে পারছে না।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার, আপনি যে প্ল্যানিং-এর বিষয়ে বারবার বলছেন তা কেমন হওয়া উচিৎ? দেখা যায়, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে, তখনও বাংলা বা ইংলিশ ভাবসম্প্রসারণ করতে বললে তারা গাইড বই থেকে মুখস্থ করে পড়া দিচ্ছে। নিজে থেকে লিখতে পারছে না। এটা কি প্ল্যানিং-এর দুর্বলতা, নাকি এর জন্য শিক্ষক-ছাত্র উভয়ে দায়ী?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : মূল সমস্যা বোধ হয় কেবল প্ল্যানিং নয়; বরং প্ল্যানিং কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তার কোন ফলোআপ না থাকা। প্ল্যানড এ্যাপ্রোচ হ’ল প্ল্যানিং-এর সাথে সাথে ফলোআপ থাকা। নইলে তাকে পূর্ণ প্ল্যানিং বলা যায় না। প্ল্যানিং-এর কথা আমরা বারবার বলছি এই কারণে যে, কোন কাজে আমাদের রিসার্চ বা যথেষ্ট প্ল্যান নেই বলেই আমাদের দেশের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নাই। আমাদের কারো চাকুরী যায় না। আবার যারা একটু-আধটু প্ল্যান করেন, তারা আবার প্ল্যান বাস্তবায়ন হয় না বলে বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে যান। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের স্ট্রং হওয়া দরকার।
আর পরের যে বিষয়টি বললেন, সেক্ষেত্রে আমি বলব, শিক্ষকরা চাইলেই বাচ্চাদের দিয়ে এটা করিয়ে নিতে পারেন। কেননা প্রতিটি নতুন আবিষ্কারই তৃপ্তিদায়ক। ছাত্ররা নিজেরা পড়বে এবং নিজের মেধা খাটিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিবে। উন্নত বিশ্বে এইটার খুব চর্চা হয়। তাদের সামনে বই খুলে দিলেও তাতে তারা কিছুই খুঁজে পাবেনা। বরং নিজের মত করে উত্তর দিতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সুতরাং এখানে শিক্ষকদেরই দায়িত্ব বেশী।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমাদের দেশে একজন মেডিকেল ছাত্র, যে কিনা পরবর্তীতে ডাক্তার হবে, তাকে বিসিএস দিতে গেলে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক কিছু পড়া লাগছে যা তার ফিল্ডে আদৌ কোন কাজে লাগবে না। যেমন বাংলা, গণিত, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি তার কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়বে না। তবুও পড়তে হচ্ছে। এই বিষয়টি কিভাবে সমাধান করা যায়?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : বাহিরের দেশে এই ধরনের ফিল্ডে আলাদাভাবে পরীক্ষা হয়। মূল কথা হ’ল যে, যে বিষয় পরীক্ষা দিবে সে সেই বিষয়ে পড়বে। স্পেশাল বিষয়গুলোতে যেমন মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্যবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে ভিন্নতর পরীক্ষা সিস্টেম রাখতে হবে। কমন লার্নিং গোল-এর উপরই পরীক্ষা হওয়া উচিৎ। সঠিক ও গোছালো পরিকল্পনা না থাকার কারণেই আমাদের দেশে এই সমস্যাগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার, এবার আপনার কাছে জানতে চাইব যে, প্রাইমারী ও হাইস্কুল লেভেলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিভাবে আমরা আরো উন্নতি করতে পারি? এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের দায়িত্ব কী হবে?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : একাধিক বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমতঃ শিক্ষকদের উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেউ বলতে পারবে না যে, আমার টিচিং মেথড শতভাগ উপযুক্ত। এটা যদি কেউ বলে তাহলে সে ঠিক পথে নেই। সুতরাং শিক্ষকরা নতুন নতুন কী মেথড টিচিংয়ে আনতে পারছেন, তাদের দক্ষতা, কার্যকারিতা, পাঠদান প্রস্ত্ততি, কনটেন্ট আপডেট করার দক্ষতা, উদ্ভাবনী চিন্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠানকে খুব ভালভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানের একটা বাজেট থাকতে হবে এই কোয়ালিটি উন্নয়ন সেক্টরকে স্ট্রং করার জন্য। এই ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। বাহিরের দেশে একজন শিক্ষক লেকচার দেয়ার সময় তার কলিগরাও কখনো কখনো ক্লাসে এসে বসেন এবং তার টিচিং পারফরমেন্স পর্যবেক্ষণ করেন। শিক্ষকদের যাচাইয়ের জন্য তার আচার-আচরণ, শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে পূর্ব থেকেই ছাত্রদের কাছে অনেকগুলি প্রশ্ন দেয়া হয়। সেই মোতাবেক ছাত্ররাও কমেন্টস করে। পরে ছাত্রদের কমেন্টসগুলো আবার এ্যানালাইসিস করা হয়, শিক্ষকের সাথে শেয়ার করা হয়। ফলে একজন শিক্ষক জানতে পারছে যে তার দুর্বলতাটা কোথায়, উন্নতি কোথায় করতে হবে। এগুলো একজন শিক্ষককে খুব সহজভাবে নিতে হবে। ইগোকে দমন করতে হবে। কেননা যদি আমি ঠিকভাবে না পড়াই তবে আমার চাকরি চলে যেতে পারে। আমি একটা জবাবদিহিতার মধ্যে রয়েছি, যা ইচ্ছা তাই আমি করতে পারি না- এই অনুভূতি শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে। এই ধরনের চেক এ্যান্ড ব্যালান্সের পরিবেশ যেখানে থাকে, সেখানেই সহজে শিক্ষকদের কোয়ালিটি ডেভেলপ করে। শিক্ষার্থীরাও যা চায়, তাই পায়। তারাও দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়তঃ ছাত্রদেরকেও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে হবে। তারা লার্নিং গোল অনুযায়ী কি শিখল, কতটুকু শিখল, তা নির্ণয় করার জন্য উন্নত বিশ্বে তাদের এক্সিট ইন্টারভিউ পর্যন্ত নেয়া হয়। মূল কথা হ’ল, শিক্ষক-ছাত্র সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে হবে। আর তাদের বুঝাতে হবে যে, আমরা যেটা করছি সেটা তোমার লাইফ স্টাইল ভালো করবে। আমি যেটা পড়াচ্ছি সেটা কাজে লাগবে। দুঃখের বিষয় যে, আমাদের ছাত্ররা জানে না যে, সে তার লেখাপড়া দিয়ে কি করবে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু ভাল রেজাল্টের দিকে বেশী মনোনিবেশ করা হয়; কিন্তু কোয়ালিটির দিকে নযর থাকে না। ইনপুট এবং আউটপুটের দিকে প্রতিটি শিক্ষককে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সর্ম্পকে আপনার কোন অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমার অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না। দেশে এসে কিছু কিছু মাদ্রাসা পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে। আমি একটি নৈশ মাদ্রাসায় ক্লাসও করছি। সেখানে মিশকাত পড়ানো হয়, এসো আরবি শিখি বই পড়ানো হয় ইত্যাদি। এ বিষয়ে আমি এতটুকুই বলব, আমাদের দেশ মুসলিম দেশ। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলাম কিভাবে সাজানো? আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচারনীতি সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে পশ্চিমা নিয়মে। এখানে ইসলামের কোন উপস্থিতি নেই। কারণ যারা প্ল্যানিং-এর দায়িত্বে আছেন, তারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নন, বরং সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে তারা তাদের মত করে রাষ্ট্রের মূল জায়গাগুলো পরিচালনা করছেন। অপরদিকে যারা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের কোন অর্থনৈতিক দক্ষতা নেই, বিজনেস স্কিল নেই, ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা নেই, কোন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালানোর দক্ষতা নেই। কালচারাল ফিল্ডে কিছু করার নেই। লিগ্যাল ফিল্ডে কোন ভূমিকা নেই। কিন্তু এসব ফিল্ডে ইসলাম বাস্তবায়ন করতে গেলে সেই ধরনের লোক লাগবে যারা দ্বীন সম্পর্কে জানেন এবং অন্যান্য দক্ষতাও যাদের আছে। কিন্তু যারা ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করছে, তারা ঐ সকল ফিল্ডে যেতে পারছে না। ফলে কোন ভূমিকাও তারা রাখতে পারছে না।
আমাদের মাদ্রাসার ছাত্ররা দাওরা শেষ করছে ১৮/২০ বছর বয়সে তথা মাত্র ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে। অথচ সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে এরপর আরো ৪/৫ বছর বিভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে শিক্ষাদান করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্ররাও অনুরূপ কোন একটি বিষয় নিয়ে পড়ুক। তাহলে সে দ্বীন নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে, দ্বীনদার পুলিশ হতে পারবে, দ্বীনদার ডিসি হতে পারবে। এগুলো ছাড়া তো সমাজ চলবে না। অপরদিকে যারা বিভিন্ন সেক্টরে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদেরকে দ্বীন শেখাবে কে? আমাদের মাদ্রাসাগুলোর ত্রুটি হ’ল, তারা এই সেক্টরগুলোর মানুষদের জন্য দ্বীন শিক্ষার কোন পরিকল্পিত কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রাম রয়েছে, যেখানে সমাজের মানুষের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী, ১/২/৩ মাসের প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। ফলে ছাত্ররাই কেবল নয়, বরং বাইরের সাধারণ মানুষের কাছেও তারা জ্ঞানকে পৌঁছে দিতে পারছে। ফলে তাদের ওয়ার্কফোর্স কোয়ালিটি ওভারঅল বাড়ছে। কিন্তু আমাদের দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দিকটি অবহেলিত রয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি, আমি দ্বীন শিখতে চাইলে প্রফেশনালী কন্ডাকটেড কোন প্রোগ্রাম আমার জন্য রয়েছে মাদ্রাসাগুলোতে? নেই। এই ধরনের প্রোগ্রাম যদি আমাদের প্রতিটি মাদ্রাসায় থাকতো, তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের সাধারণ ইসলামী জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে পারত সহজেই। অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও মাদ্রাসাগুলো লাভবান হ’তে পারত! তাছাড়া দুঃখের বিষয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার মধ্যে পারস্পরিক কোন আদান-প্রদান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসাগুলোর কি কোন কিছুই নেওয়ার নেই? আবার মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুই নেওয়ার নেই? কেন এমনটা হ’ল? বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রং রিসার্চ মেথোডলজী আছে। এটা কি মাদ্রাসাগুলো নিতে পারে না? আবার মাদ্রাসাতে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের জন্য যে একাডেমিক অবজেক্টিভিটি আছে সেটা কি বিশ্ববিদ্যালয় নিতে পারে না? এই আদান-প্রদানগুলো না থাকার কারণে একটা ডাইকোটোমাস বা পরস্পরবিরোধী সমাজ তৈরী হচ্ছে। যেখানে জেনারেল শিক্ষিতরা ধর্মের কিছুই জানছে না। আবার যারা ধর্ম শিখছে তারা দুনিয়ার কিছু জানছে না।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার! বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় দুনিয়াবী জ্ঞান তো পরের কথা, দ্বীনী জ্ঞানই বা কতটুকু শিখতে পারছে শিক্ষার্থীরা সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা বছরের পর বছর ধরে একই সিলেবাসে পড়ছে। যেখানে আধুনিকায়ন খুব কমই হয়েছে। আবার আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে দ্বীন শিক্ষার সুযোগ দিন দিন সীমিত করা হচ্ছে। সেখান থেকে প্রকৃত আলেম তেমন কেউ বের হচ্ছে না। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার কোন উপায় আছে কী?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : মূলতঃ মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে নতুনভাবে রিসার্চ করা দরকার। এখান থেকে আমরা ধর্মীয় জ্ঞান কতটুকু অর্জন করতে পারছি। যারা আলেম হতে চায় তারা কতটুকু জানবে এবং যারা নির্দিষ্ট লেভেলের পর অন্যান্য পেশায় যাবে তারা কতটুকু দ্বীন শিখবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। মূলতঃ কারিকুলামের উপর নিয়মিত কাজ করা যরূরী। বাইরের দেশে প্রতি বছর সামাজিক গবেষণা ও বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেক হোল্ডার্সদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়। একদল গবেষক এটি নিয়ে সবসময় কাজ করে। সুতরাং সমকালীন চাহিদা ও প্রত্যাশিত জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় করে যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরী করা অতীব যরূরী।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী কেমন হওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আদর্শ শিক্ষকের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। প্রথমতঃ যখন একজন শিক্ষক এই পেশায় আসেন তখন এটাকে ভালোবাসতে হবে। তার আরো অনেক অপশন ছিল যেখানে না গিয়ে তিনি এখানে এসেছেন। নিশ্চয়ই তিনি এটাকে ভালোবাসেন। তার একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। বেসিক কোয়ালিফিকেশন আছে। তাঁর আচরণ এমন থাকা উচিৎ যে, আমাকে প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে হবে। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের কিছু দায়িত্ব রয়েছে আদর্শ শিক্ষক তৈরীর জন্য। বাইরের দেশে নতুন কোন শিক্ষক নিয়োগ করা হ’লে তার জন্য একজন সিনিয়র শিক্ষককে মেন্টর বা পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়, যিনি তাকে নিয়মিত গাইড করেন। দ্বিতীয়তঃ শিক্ষকদেরকে এমন হ’তে হবে যাতে ছাত্ররা তাদের সাথে সহজে মিশতে পারে। ছাত্ররা যেন তার ঐ ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য উদগ্রীব থাকে। তারা যেন মনে করে যে, আমি এখান থেকে কিছু অর্জন করতে পারছি, শিখতে পারছি। তৃতীয়তঃ টিচারকে অনেক স্টাডি করতে হবে। তার কন্টেন্ট অর্থাৎ পড়ানোর বিষয়গুলো নিয়মিত আপডেট করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোন শিক্ষক একটা নোট দিয়ে অনেক বছর ধরে পড়িয়ে যাচ্ছেন। এভাবে পড়ালে দেখা যাবে যে, সে একসময় ছাত্র হারিয়ে ফেলবে। আমি একটা মাদ্রাসা দেখলাম, যেখানে শুরুতে ২৫ জন ছাত্র ছিল। পরে ছাত্ররা চলে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আর মাত্র একজন ছাত্র আছে। কিন্তু এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কোন মাথা ব্যথা নেই। আমি বললাম যে, আপনাদের এটা কি ধরনের প্রতিষ্ঠান? তাদের কোন দায়িত্ববোধই নেই। যেন তাদের কোন দোষই না। সব দোষ ছাত্রদের। একজন বড় আলেমের ক্লাসের কথা শুনেছি যার ক্লাসে গড়ে ৮/৯শ ছাত্র বসে। কিন্তু ক্লাস শেষে দেখা যায় শ’খানেক ছাত্র অবশিষ্ট আছে, বাকীরা বরকতের জন্য এসে তারপর চলে গেছে। এটা কোন ক্লাস হ’ল? তিনি তাঁর বহু পুরোনো নোটগুলো ক্লাসে বের করে পড়ান। এটা তো শিক্ষকতা নয়। তার কোন আপডেট নেই, কোন উন্নতির চেষ্টা নেই। একজন আদর্শ শিক্ষককে অবশ্যই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করতে হবে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আপনি নিজে শিক্ষকতা করার সময় কিভাবে ক্লাসের প্রস্ত্ততি নিতেন এবং কি কি বিষয় অনুসরণ করতেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমি যে বিষয়ে লেকচার দেব, সে বিষয়ে প্রচুর সময় ব্যয় করতাম। সে বিষয়ে নতুন নতুন কী গবেষণা হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতাম। আর লেকচারের বিষয়টি সবসময় স্টুডেন্টদের জীবন অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। আমার প্রচেষ্টা থাকত ছাত্রদেরকে এটা বোঝানো যে, আমি যেটা পড়াচ্ছি সেটা তাদের কাজে লাগবে। শিক্ষকতার জন্য প্রচুর পড়াশোনার মধ্যে থাকা দরকার। নিজেকে আপডেট রাখার জন্য চেষ্টার দরকার। একটা হ’ল বিষয়ের আপডেট, আরেকটা হ’ল কিভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করব তার আপডেট। আর আজকের যুগের ছাত্রদের সাথে মিশতে গেলে একটা নেতৃত্ব বা লিডারশীপের ব্যাপার আছে। গুড লিডার কোন নেগেটিভ বিষয় উপস্থাপনের সময়ও অপরের মর্যাদাকে খাটো করে না। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে বড় জিনিস হ’ল তার সম্মান। সে জিনিসটাকে আঘাত করা যাবে না। কোন ছাত্রকে বোকা বলা বা তাকে দিয়ে কিছু হবে না- ইত্যাদি বলে যদি হীন করা হয়, তবে সেটা কখনই শিক্ষকদের জন্য সঠিক এ্যাপ্রোচ নয়। একটা ছাত্র যদি কোন কারণে ভালো ফলাফল না করতে পারে, তবে তাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। তার সম্মানহানি করা যাবে না। সবসময় মনে রাখতে হবে আমার নিজের যেমন আত্মমর্যাদাবোধ রয়েছে, তেমনি তারও রয়েছে। আমি যেমন অপমানিত হতে চাই না, সেও অপমানিত হতে চায় না। সুতরাং একজন আদর্শ শিক্ষক অবশ্যই ছাত্রদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন, শত্রুসুলভ নয়। আমি শিক্ষকতাকালীন সময়ে এ বিষয়গুলোই বেশী বেশী অনুসরণ করতাম।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার! আপনার জীবনের বিশেষ কোন স্মৃতি আছে কি না, যেটা এখানে উল্লেখ করার মত?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : নিজের জীবন তো অনেক এলোমেলো। কোনকিছুই প্ল্যানমাফিক হয়নি। যেমন আজ এই যে আমি রাজশাহীতে আসলাম। আমার অবাক লাগে। অনলাইনে দেখলাম যে, রাজশাহীতে একটা সম্মেলন হবে। ভাবলাম দেখে আসি। তারপর মাদ্রাসায় আসলাম। আমার যে আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ হবে- এমন কোন পরিকল্পনা মাথায় ছিল না। এত বড় মাপের মানুষ তিনি। তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হতে পারে- এমন কোন চিন্তাই মাথায় আসেনি। কেমন করে যেন উনার সাথে দেখা হয়ে গেল। কেমন করে আবার এখানে আসলাম। উনার বই পেলাম। থিসিস অনুবাদ করলাম। এসব কিছুই পরিকল্পনামাফিক ছিল না। তাকদীরই যে আমাকে এখানে টেনে এনেছে, তা এখান থেকে সুস্পষ্ট। আমার কন্ট্রোলে যেন কিছুই নেই। স্টুডেন্ট লাইফেও আমি জানতাম না আমি কি পড়ব। প্রথমে মেডিকেলের ছাত্র ছিলাম। ভাল লাগল না। তারপর মেরিনে গেলাম। সেখানেও তৃপ্তি পেলাম না। তারপর আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইবিএ-তে ফাইন্যান্সে পড়লাম। সেখানে আমি একটা হোস্টেলে থাকতাম, যার আশেপাশে মার্কেটিং-য়ে পিএইচ.ডি রত ছাত্ররা থাকত। আমি তাদের সাথে গল্পগুজব করতাম। সেখানে রাশিয়ান ছিল, সাউথ কোরিয়ান ছিল, নানান দেশের ছাত্ররা ছিল। তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তাদের সাথে ঘুরাফেরা করতে করতে তাদের সাথে তাদের ক্লাসেও গিয়েছি। সেসময় মনে হ’ল মার্কেটিং-ই তো ভাল। পরে এই বিষয়েই এমবিএ, পিএইচ.ডি করলাম। এইভাবে জীবনটা আমার অজান্তেই নানা পথে বাঁক নিয়েছে, যার কোন কন্ট্রোল আমার হাতে ছিল না।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আপনি তো পূর্ব থেকে আহলেহাদীছ বা সালাফী মানহাজের ছিলেন না। কিভাবে পরিচয় হল এই মানহাজের সাথে?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আহলেহাদীছ কী, এদের আক্বীদা কী- এই আলোচনাটাই আমার কাছে অবাক লাগে। আমি বিভিন্ন দেশে মুসলিম ভাইদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি। একেবারে নর্থ আফ্রিকার মৌরিতানিয়া থেকে শুরু করে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, সুদান, কাতার, সঊদী আরব, কুয়েত, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, আযারবাইজান, ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া; ওদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের মানুষদের সাথে আমার হরহামেশা চলাফেরা ছিল। তাদের সাথে নিয়মিত ছালাত আদায় করেছি। বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টারে গিয়েছি। সব জায়গাতে আমি দেখেছি ছালাতে জোরে আমীন, রাফঊল ইয়াদায়েন হচ্ছে। আবার জামা‘আতে ছালাতের পর মুনাজাত হচ্ছে না। জুমআ‘র খুৎবা হচ্ছে ইংরেজী ভাষায়। এটাই তো আমি নরমাল জেনে এসেছি। যখন দেশে ছিলাম তখন হয়ত হানাফী তরীকায় ছালাত আদায় করতাম। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর যখন দেখলাম এত দেশের মানুষ যখন এভাবে ছালাত আদায় করছে, তো আমিও এভাবে ছালাত করি। আমেরিকার অধিকাংশ স্টেটে আমি গিয়েছি, একই তরীকায় ছালাত সবজায়গায় দেখেছি। মেক্সিকোতে গেলাম, খুৎবা স্প্যানিশ ভাষায় হচ্ছে, সবই একই জিনিস। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মোটামুটি সব ঘুরেছি। সেখানেও ছালাত একই পেয়েছি। চীনের সাংহাইতে গিয়েছি, সেখানেও চাইনিজ ভাষায় খুৎবা হয়, জোরে আমীন বলে। সুতরাং এটাই আমাদের কাছে কমন প্রাকটিস মনে হয়েছে। ২০১৮ সালে আমি দেশে ফিরলাম। তাবলীগের ভাইদের সাথে সময় লাগালাম, এক পীরের দরবারেও গেলাম। তারপর বুঝতে পারলাম ছালাতের পার্থক্যটা এদেশে কত বড় সমালোচনার বস্ত্ত। এটা নিয়ে কত হুলুস্থুল কান্ড হয়। এই সমালোচনাগুলো আমার কাছে খুবই অপ্রিয় ও হতাশাজনক লাগল। এমনকি আমাদের বাড়ির পাশে একটা বড় মসজিদ আছে, আমি নাম বলছি না। সেখানে পাকিস্তান থেকে অনেক বড় বড় আলেম আসেন। সেখানে একজন বড় নাম করা আলেমের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, ‘এটা জোরে আমীন বলা মসজিদ না। যে জোরে আমীন বলে তাকে বের করে দাও’। আমি মনে মনে বললাম, এটা কিভাবে সম্ভব যে, দুনিয়ার সব মুসলমানদের তুমি মসজিদ থেকে বের করে দেবে! তাছাড়া বিদেশে আমরা জুম‘আর খুৎবা শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। নতুন কিছু শিখব এই আকাংখা নিয়ে যেতাম। কিন্তু দেশে এসে এসব কিছুই দেখি না। ফলে এটাই আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হ’ত। পরে তো আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের সন্ধান পেয়ে গেলাম। তবে বিদেশে আহলেহাদীছ শব্দটা আমি শুনিনি। বরং তারা নিজেদের সালাফী বলে। এরপর যখন আমীরে জামা‘আতের পিএইচ.ডি থিসিসটা পড়লাম, তখনই আমার আহলেহাদীছ সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণাটা আসল। তারপর এটার অনুবাদে হাত দিলাম। কেননা আহলেহাদীছ সম্পর্কে মানুষের বহু ভুল ধারণা আছে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ কিভাবে হ’ল?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : সম্ভবতঃ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১২/১৩ তারিখে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ছাহেবের উদ্যোগে আয়োজিত একটি সম্মেলনের পোস্টার আমি ইন্টারনেটে পেলাম। ভাবলাম ঘুরে আসি। তো রাজশাহীতে আসব বলে ইন্টারনেটে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ওয়েবসাইটে গেলাম, মাদ্রাসার ছবি দেখলাম। তখন ভাবলাম মাদ্রাসাটা দেখে আসি। কারিকুলাম সম্পর্কে জেনে আসি। তো রাজশাহীতে এসে আমি নওদাপাড়া মাদ্রাসার গেটে আসলাম। গেটম্যান আমাকে মাদ্রাসা অফিসের দিকে দেখিয়ে দিলো। সেখানে শামসুল আলম ছাহেবের সাথে দেখা হল। তারপর মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ড. নূরুল ইসলামের সাথে দেখা হল। আমাকে বললেন, চলেন আমীরে জামা‘আতের সাথে দেখা করে আসি। উনার সাথে আমার কখনও দেখা না হ’লেও ইন্টারনেটে অনেক লেকচার শুনেছি। উনার লেকচার খুব ভাল লাগত। আসলে উনি তো একজন বড় স্কলার। আমি তাদেরকে বললাম এত বড় একজন স্কলারের সাথে দেখা করবো? তিনি গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তাঁর ডিস্টার্ব হয় কি-না। তারপর তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি তখন খুব ব্যস্ত ছিলেন লেখালেখিতে। এর মধ্যেও তিনি আমাদের লাঞ্চ করালেন। খুব মহববতের একটা আতিথেয়তা পেলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এ কারণে যে, উনি আমাদের চেনেন না। একদম নতুন আগন্তুক আমরা। তিনি আমাকে অনেকগুলো বই গিফট করলেন। প্রায় ৩০টির মত। আমি তো অবাক হলাম। এতগুলো বই তিনি আমাকে দিলেন! এরপর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকা ফিরলাম। পরে তাবলীগী ইজতেমাতে এসে আরো মোটিভেটেড হলাম। তাঁর লেখা বইগুলো পড়তে থাকলাম। তাঁর থিসিসের উপর একটা বুক রিভিউ আমি লিখে ফেললাম। তাঁর নিকট পাঠালাম। তিনি পড়ার পর আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন। পরে তাঁর সাথে আমার মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হ’তে লাগল। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, আপনি আমার থিসিস ইংরেজীতে অনুবাদ করে দেন। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব। আমি ইতিপূর্বে কখনও অনুবাদের কাজ করিনি। পরে শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন কাজ প্রায় শেষের দিকে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, এই মাপের মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, একটা মহববতের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। আমি এজন্য আল্লাহর একান্ত শুকরিয়া আদায় করি। কেননা এটা আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল। এটা যেন এক আকস্মিক স্বপ্নবৎ বিষয়।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : থিসিসের ইংরেজী অনুবাদ করতে গিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছে?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : হ্যাঁ, আহলেহাদীছদের ইতিহাস, আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে এত সুস্পষ্ট আলোচনা এখানে করা হয়েছে যে এখানে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকছে না। যেসব দলীল-প্রমাণাদি, সুবিস্তৃত তথ্যাদি সেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো পড়ার পর আমাদের সঠিক আক্বীদা কী হওয়া উচিৎ তা যেমন স্পষ্ট হয়েছে, তেমনি আমাদের পথভ্রষ্টতার কারণগুলো নির্ণয় করে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা সম্ভব হয়েছে। আহলেহাদীছদের যারা উপমহাদেশীয় পথপ্রদর্শক তাদের কথা আমার জানা ছিল না। থিসিস আমার সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। এগুলো আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। নতুন কিছু জানার সুযোগ হচ্ছে। বিশেষ করে উনার উপস্থাপনা এত ক্লিয়ার এবং দলীলসমৃদ্ধ যে, কোন ব্যক্তি তা পাঠ করলে স্যাটিস্ফায়েড হয়ে যাবে। সুতরাং যদি এই গবেষণাটিকে আমরা আরো বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে আরো বেশী মানুষ এখান থেকে উপকৃত হতে পারে। আর আমরা যদি এটা বিদেশী ব্যক্তির কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারি তাহলে এটা অনেক ভালো কাজ হবে ইনশাআল্লাহ।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমরাও ধন্য বোধ করছি যে আপনি থিসিসের ইংরেজী অনুবাদের কাজটা হাতে নিয়েছেন। আমরা ইতিপূর্বে অনুবাদের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আপনি যে উচ্চমানসম্পন্ন অনুবাদ করেছেন, তা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর আপনার উপর রহম করুন। আমীন! স্যার! আপনি তো বাংলাদেশে একেবারে চলে এসেছেন, তো আপনার ভবিষ্যৎ প্ল্যান কী? আপনি কি কোথাও আর শিক্ষকতা করবেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : না। আমি আর সেক্যুলার ফিল্ডে মেহনত করতে চাচ্ছি না। যদি দ্বীনী ফিল্ডে সুযোগ থাকে, তাহলে আমি করব ইনশাআল্লাহ।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : এখন আপনি কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমি দ্বীনী শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছি। একটি নৈশ মাদ্রাসায় মিশকাত পড়ছি। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়টি ছিল কিতাবুল ইমারত বা প্রশাসন বিষয়ক। সেখানে ১২৬টি হাদীছ ছিল। এগুলো পড়ার পর মনে হ’ল আমাদের শিক্ষিত মহল তো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জানে না। তখন আমরা মনে হ’ল এই হাদীছগুলো বিষয়ভিত্তিকভাবে একত্রিত করে একটা সুন্দর ভূমিকা লিখে যদি শিক্ষিত মহলে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে তাদের জন্য অনেক উপকার হবে। এই লক্ষ্যে আমি ১২৬টি হাদীছ থেকে কেবল ছহীহ আর হাসান হাদীছ বের করলাম। এতে মোট ৮৮টি হাদীছ পাওয়া গেল। এই হাদীছগুলোকে আমি ১০টা ভাগে ভাগ করলাম এবং প্রতিটি অধ্যায়ের একটা সারসংক্ষেপ তৈরী করে সমসাময়িক পরিস্থিতির সাথে এর একটা মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি এগুলো সবার জানা দরকার। বিশেষ করে প্রশাসক, বিচারক এবং সাধারণ মানুষ সকলের জন্য হাদীছগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এরপর মিশকাতের কিতাবুল আদাব বা শিষ্টাচারের হাদীছগুলো নিয়েও আমার একই ধরনের কাজ করার আগ্রহ আছে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : জাযাকাল্লাহ খাইরান। আল্লাহ আপনার মেহনত কবুল করুন। আমীন! আমাদের যারা দর্শক বা শ্রোতা আছে, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কী?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : বক্তব্য এতটুকুই যে, আমাদেরকে সবসময় ভাবতে হবে যে, দুনিয়াতে আমরা এমনভাবে জীবন-যাপন করব, যাতে আমাদের আখেরাতটা সুন্দর হয়। আখেরাতটাই আমাদের মূল গন্তব্য। সেটাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়া যে কোন মুহূর্তে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। দুঃখজনক বিষয় হ’ল, পশ্চিমা দর্শন আমাদেরকে এমন বস্ত্তবাদী বানিয়ে দিয়েছে যে, দুনিয়ার বাইরে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা আমাদের মাথায় আসে না। আমি কেন দুনিয়াতে এসেছি, আমি কি দুনিয়ায় শুধু আনন্দ-ফূর্তি, আরাম-আয়েশ করতে এসেছি? তবে কি দুনিয়াতে বাড়ি, গাড়ি, টাকা-পয়সা এগুলোই আমাদের সব? এতেই কি সব সমস্যার সমাধান? না, দুনিয়া হ’ল পরীক্ষার স্থান। ফলাফল আখেরাতে। দুনিয়া এখন সর্বোচ্চ ভোগের দিকে ছুটছে। কিন্তু এর তো কোন সীমানা নেই। এর কোন নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ নেই। অর্জন করাও অসম্ভব। ফলে মানুষ হতাশায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থ মনে করছে। সুতরাং কুরআন ও হাদীছের দিকে ফিরে আসা, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা- এটাই একমাত্র সমাধান। এর বাইরে মুক্তি নেই।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার, আপনার এই সমৃদ্ধ টিচিং ক্যারিয়ার তো বহু মানুষের কাছে ঈর্ষণীয় এবং সোনার হরিণের মত। আমাদের শিক্ষিত সমাজে অনেকেই তো এমন ক্যারিয়ারেরই স্বপ্ন দেখেন। আপনি কেন এই ক্যারিয়ার থেকে ফিরে আসতে চাচ্ছেন? আর জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনি আমাদের ক্যারিয়ারের পেছনে ছোটা তরুণদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আমি তো বলছি না যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ কর। বরং হালাল পন্থায় উপভোগ কর। নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নাও। কিন্তু নিজেকে হারাম, অন্যায়, অপকর্ম ও দুর্নীতির মধ্যে ডুবিয়ে নয়। এখন আমি জীবন নিয়ে খুব ভাবি। প্রথম দিকে দুনিয়াবী নানা লক্ষ্য অর্জনই ছিল আমার প্রধান চিন্তা। এখন মনে হয়, যদি আমার প্রাথমিক জীবনে দ্বীনী জ্ঞানা অর্জন করতে পারতাম, তাহলে আমার জীবনটা কতইনা ভাল হত! অনেক পরে এসে আমি এটা বুঝেছি।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : কিন্তু আপনার আগের জীবনটা তো খারাপ ছিল না? বহু মানুষকে আপনি আপনার জ্ঞান দিয়ে উপকৃত করেছেন!
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ইসলামের সঠিক জ্ঞান না থাকায় শরী‘আতে সিদ্ধ নয়, এমন অনেক কাজ আমি করেছি প্রফেশনাল লাইফে। আমার টাকা-পয়সাগুলো অনর্থক খরচ করেছি। ভ্যাকেশনে সুইজারল্যান্ড, ইতালি, প্যারিস, লন্ডন ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে অনেক খরচ হয়েছে। এগুলো এখন আমার কাছে একদম অনর্থক মনে হচ্ছে।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : স্যার! আপনার কথা শুনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নাস্তিক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, আমাদের জীবনের সব চাওয়া যখন পাওয়া হয়ে যাবে তখন কী হবে? কেননা সব চাওয়া পূরণ হয়ে গেলে, তারপরে মানুষের আর কোন কিছু চাওয়ার থাকবে না। তাহলে সবশেষে আর কী বাকী থাকবে? নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও তার এই প্রশ্ন সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আসলে সমস্ত চাওয়াকে পাওয়া হতে হবে- এটাই তো ইলুশন, ধোঁকা। কেননা কমার্শিয়াল দুনিয়ায় মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নাই। কেননা কোন একটা চাওয়া যখন পূরণ হওয়ার পথে, তখন তার মনে নতুন নতুন চাওয়া তৈরী হচ্ছে। বর্তমানে মার্কেটিং-এর পলিসিই এমন যে, প্রতি মুহূর্তে তারা বেটার মডেলের জিনিস কাস্টমারের সামনে তুলে ধরছে, যেন সে কখনও পূর্ণ স্যাটিস্ফায়েড থাকতে না পারে। সবসময় তার মধ্যে একটা ডিম্যান্ড ক্রিয়েট করে রাখবে। ধরুন, আমি বাজারের সবচেয়ে আধুনিক একটা নতুন গাড়ি কিনে আনলাম। তারপরে কোম্পানী আমার গাড়ীর চেয়ে আরো অত্যাধুনিক গাড়ী বাজারজাত করল। ফলে অবেচতনভাবে কোম্পানী আমার মাথায় বেটার মডেলের গাড়ি কেনার কথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বস্ত্তবাদী দুনিয়া আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ধোঁকায় ফেলে দিচ্ছে। কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে আমাদের মনের প্রশান্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। সুতরাং এটাই চিরন্তন সত্য যে, দুনিয়ার চাহিদার পিছনে পড়ে থাকা অর্থহীন। এটা কখনও আমাদের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। বরং আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং আখেরাতের কামিয়াবী হাছিল করা।
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : আমাদেরকে এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহ খাইরান।
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া