নারী প্রগতি না-কি নারী দুর্গতি?
লিলবর আল-বারাদী
মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত 1234 বার পঠিত
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট নযরে আসল। সেখানে বিয়ের একটি ছবিতে লেখা যে, ‘পরিচয়টা থাকুক আগে থেকে আর বিয়েটা হোক পারিবারিকভাবে’। এই কথাটা আগে কখনো শুনিনি, ইদানীং চালু হয়েছে। ব্যাপারটা নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো। সুদকে যেমন ইন্টারেস্ট বা প্রফিট নাম দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তেমনি ‘পূর্ব পরিচিতি’ শব্দটা ব্যবহার করা বিবাহ বর্হিভূত প্রেম-ভালোবাসার উপর বৈধতার নতুন ফ্লেভার বা প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা। আমরা ইতিপূর্বে প্রেম-ভালোবাসার কথা শুনেছি, শুনেছি মুক্তমনাদের কাছে ‘লিভ টুগেদার’, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড কালচার ইত্যাদি যে ব্যাপারে আমাদের যুবসমাজের একটা বড় অংশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আগের এই টার্মগুলো থাকতে নতুন এই ‘পূর্ব পরিচিতি’ টার্ম বা পরিভাষা কেন আমদানী করা হ’ল?
এর উত্তর হ’ল, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি (তথা যেনা-ব্যভিচার) মুসলিম সমাজে স্বাভাবিকীকরণ করার একটা বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ার। মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের এই সমাজে যদিও ধীরে ধীরে রক্ষণশীলতা কমতে শুরু করেছে, কিন্তু তবুও ‘প্রেম’ কিংবা ‘বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড’ শব্দটা এখনো পর্যন্ত নিজেদের সন্তানদের জন্য মেনে নিতে পারেন না মুসলিম অভিভাবকরা; এখনও এসবের দিকে মুরুববীরা বাঁকা চোখে তাকান। ফলত শাসনের মুখে পড়তে হয় অধিকাংশকেই। তাই কিছুটা অন্য নামে, অন্য রঙে, অন্য পোশাকে হাযির করা হয়েছে আগের সেই একই প্রডাক্ট। ব্যাপারটা মাথায় পরচুলা লাগানোর মতো। প্রেম-ভালবাসা কিংবা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড নাম দিয়ে সুবিধা করা যাচ্ছে না, তাহলে বলো ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’, এটাও না হ’লে অন্য কিছু দেখো। একটা গ্রহণযোগ্য না হ’লে আরেকটা নাম দাও। একটা না একটা সমাজ হালকাভাবে নিবেই। আর এরই ধারাবাহিকতায় এবার এসেছে ‘পূর্ব পরিচিতি’ নামের এই ছলনা। সবার কাছে সহজ বলেই মনে হবে। মনে হবে শুধু একটু পরিচয়-ই তো, সামান্য একটু ফোনে হয়তো কথা বলা বা ম্যাসেঞ্জারে কিছু চ্যাটিং কিংবা পার্ক বা কফিশপে একলা একটু-আধটু সাক্ষাৎ; সামান্য পরিচয় হওয়াতে তো কোনো সমস্যা দেখি না! উপরন্তু টিভি-সিরিয়াল, নাটক-সিনেমায় এসব অহরহ দেখানো হয়; বিশেষত ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে এবং সেই স্রোতের ধাক্কা অবধারিতভাবে আছাড় খায় বাংলাদেশী মিডিয়ায়। এরপর অভিভাবকরা আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলবেন। তারপর আস্তে আস্তে এই চোরাপথ প্রশস্ত হতে শুরু করবে, ছড়িয়ে পড়বে মহামারী আকারে। এভাবে একটা সময় এগুলো স্বাভাবিক হয়ে যাবে আমাদের সমাজে। অঘোষিতভাবে হয়ে যাবে আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। তারপর বিরোধিতা করা তো দূরের কথা আধুনিকতা, প্রগতি আর ব্যক্তি-স্বাধীনতার নামে একে একে এগুলোকে বৈধ জ্ঞান করা হবে, আওয়াজ উঠবে এগুলোর নৈতিক এবং সামাজিক স্বীকৃতির পক্ষে। একটা একটা ধাপ পেরিয়ে ঠিক যেভাবে পাশ্চাত্যে সমকামিতা বৈধতার দাবি তোলা হয়েছিল। পাকিস্তান বা তুরস্কে ভাস্কর্য থাকাটা যেমন বঙ্গদেশীয় সুশীলদের কাছে ভাস্কর্য তৈরীর বৈধতার প্রমাণ, ঠিক তেমনি একটা সময়ে গিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নখরের আঘাতে জর্জরিত অন্য কোনো এক মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে এসব সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকাকে হয়তো বৈধতার নতুন প্রমাণ হিসাবে আনা হবে। তারপর এটাও অসম্ভব নয় যে, হয়তো এই পূর্ব পরিচিতিতে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারবে না সে প্রজন্ম; হয়তো আরো একটু এগিয়ে গিয়ে ‘লিভ টুগেদার’ চর্চা শুরু হবে। প্রকাশ্যে চলবে পশ্চিমাদের মত যেনা, ব্যভিচার আর অশ্লীলতার জয়জয়কার।
নেপথ্যে কারা?
আগ্রাসী ক্রুসেড যুদ্ধ বহু পূর্বেই শেষ হলেও থেমে থাকেনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের নীল নকশা। অনেক দশক আগে থেকেই নতুন করে শুরু হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রুসেডের কাল। আর এর পেছনে রয়েছে মুসলিমদের জাত শত্রু ইহুদী ও খৃষ্টানরা। মুসলিমদের বাহুবলে দুর্বল করা সম্ভব না-এই সত্য অনুধাবন করার পর তারা সচেষ্ট হয়েছে মুসলিমদের আদর্শিকভাবে ভ্রষ্ট করে দেবার জন্য এবং এই পথে তারা সিংহভাগই সফল। আর এটা করতে তাদের মূল টার্গেট হ’ল মুসলিম জাতির প্রাণশক্তি যুবসমাজ। ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী বলেন, ‘কোন জাতিকে যদি যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করতে চাও, তাহলে তাদের তরুণদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দাও’।
উত্তরণের পথ
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা অশ্লীলতার কাছেও যেও না। কিন্তু আজকের দিনে এই বাস্তবতা অনুধাবন করা অত্যন্ত যরূরী যে, এখন কাউকে অশ্লীলতার কাছে যেতে হয় না বরং অশ্লীলতা এবং অপসংস্কৃতি নিজেই আপনার কাছে চলে আসে। টিভি, মোবাইল, পত্রিকা বা রাস্তাঘাটে সিনেমার পোষ্টারসহ আরো বহু মাধ্যম দিয়ে অশ্লীলতা আপনা থেকেই ধেয়ে আসছে। এমতাবস্থায় আমাদের মধ্যকার গুটিকতক মানুষ হয়তো ছবর করে এর থেকে দূরে থাকতে পারবে; কিন্তু সমাজের সিংহভাগই ভেসে যাবে স্রোতের অনুকূলে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য ইবনে খালদুনের ‘পরাজিত জাতি বিজয়ী জাতির অনুকরণ করে’ তত্ত্বটা আমাদের অনুধাবন করা যরূরী। আজকে আমাদের দৃষ্টিতে বিজয়ী জাতি হ’ল পশ্চিমা বিশ্ব, যারা যাবতীয় অশ্লীলতা এবং অপসংস্কৃতি প্রসারের জন্য অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মিডিয়াসহ সম্ভবপর সব দিক দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব কিংবা অন্ধ অনুকরণ করে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম যুবসমাজ। আমরা হয়তো এই ভয়াল স্রোতের বিপরীতে সাময়িকভাবে কিছু নছীহত করবো, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার কথা বলবো ফিতনাময় এই অবস্থায়। কিন্তু এটা বালির বাঁধ দেবার চেষ্টা বৈ কিছুই নয়। জেনে রাখা দরকার যে, বালির বাঁধ পতন রুখতে পারে না। পতন রুখতে হলে প্রয়োজন সেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উৎসমূল বন্ধ করে দেওয়া, যেখান থেকে এই নোংরা জল গড়িয়ে আসছে। সেই সাথে প্রয়োজন অশ্লীলতাকে ঘৃণা করতে শেখা এবং পাহাড়সম ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম কৌশল নির্ধারণ করে বাতিলের মোকাবিলা করা; পরিপূর্ণভাবে ইসলামী শরী‘আতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!
-মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত
[লেখক : ছাত্র, মান্দা, নওগাঁ ]