অধ্যয়নের গুরুত্ব ও উপকারিতা

নাজমুন নাঈম 1219 বার পঠিত

ভূমিকা : ওমর খৈয়াম বলেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা- যদি তেমন বই হয়’। তাই ওমর খৈয়াম বই পড়ার নেশার ঘোরে কথাটি অতি সযন্তে ও বাস্তবতার নিরিখে বলতে চেয়েছেন। কেননা কোন কালে কোন আদর্শ এবং সভ্যতার বিকাশ সাধিত হতে পারে না বই অধ্যয়ন ব্যতীত। নিম্নে অধ্যয়নের গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।

গুরুত্ব : আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। যে জাতি যত জ্ঞান সমৃদ্ধ, সে জাতির মাথা তত উঁচুতে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হ’ল, জ্ঞান পৃথিবীর একমাত্র সম্পদ যা বিতরণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আর এই অমূল্য সম্পদ অর্জনের সবচেয়ে সহজ পথ হ’ল পাঠ করা বা পড়া, যা মানুষের সামনে বিস্তৃত জ্ঞানভান্ডারের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। সেখান থেকে যত খুশী গ্রহণ করা যায়; বিতরণ করা যায়; আমৃত্যু কেউ বাঁধা দেবে না। কিন্তু এর জন্য অনেক বেশী পড়তে হবে এবং জানতে হবে। তবেই যৎসামান্যই অর্জন করা যাবে। প্রবাদে আছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। দেহ সোজা ও সচল রাখার জন্য মেরুদন্ড যেমন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তেমনি শিক্ষা একটি জাতির গঠন ও উন্নয়নের প্রধান উপাদান। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশী উন্নত’। ব্যক্তিত্ব গঠনেও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কম নয়। কারণ আধুনিক বিশ্বে যে যত জ্ঞানী, সে তত সম্মানী। আর একজন জ্ঞানী বা শিক্ষিত হওয়া চেষ্টার ব্যাপার। এখানে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই বলা যায়, আধুনিক পৃথিবীতে যে যত অধ্যয়নে আগ্রহী, সে তত বেশী অগ্রগণ্য। প্রকৃতার্থে জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্খাই পাঠের গুরুত্ব বুঝানো সহায়ক, অন্যথায় নয়।

আমরা অধ্যয়নের গুরুত্বকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. ধর্মীয় ২. পার্থিব। অন্য কথায়, ইহকালীন ও পরকালীন। যেহেতু মানব জীবন এই দুই কালেই সীমাবদ্ধ, সেহেতু বিষয় ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পাঠের উপকারিতাও দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু বিষয় উভয় জীবনেই পরিলক্ষিত হয়।

ক. ধর্মীয় :

প্রত্যেক মুমিনের প্রধান লক্ষ্য জান্নাত লাভ। পরকালের তুলনায় ইহকালীন সৌন্দর্য তাঁর কাছে অতীব তুচ্ছ। সেকারণ আমরা ধর্মীয় গুরুত্বকে আলোচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা পাঠের গুরুত্বকে নিম্নোক্ত শ্রেণীতে বিশ্লেষণ করতে পারি।

১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন :

মানব সভ্যতা বিকাশে অধ্যয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বপ্রথম পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ-خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ-عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড হ’তে। পড়, আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)। এই আয়াতটি ছিল শেষ নবীর নিকট প্রেরিত আল্লাহর সর্বপ্রথম নির্দেশ। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কোনটাই এখানে বলা হয়নি। কারণ আল্লাহ চান মানুষ প্রথমে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করুক’।[1] অন্যদিকে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ وَوَاضِعُ الْعِلْمِ عِنْدَ غَيْرِ أَهْلِهِ كَمُقَلِّدِ الْخَنَازِيرِ الْجَوْهَرَ وَاللُّؤْلُؤَ وَالذَّهَبَ.‏ ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। অপাত্রে জ্ঞান দানকারী শুকরের গলায় মণিমুক্তা ও সোনার হার পরানো ব্যক্তির সমতুল্য’।[2] আর ইলম শিক্ষার প্রধান মাধ্যম পাঠ করা, যা প্রত্যেক আদম সন্তানের জন্য অপরিহার্য। মোদ্দাকথা হ’ল, জানতে হ’লে পাঠের কোন বিকল্প নেই।

২. সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন :

সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম পাঠের নির্দেশ দেওয়ার পরে বললেন, خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’ (আলাক্ব ৯৬/২)। এখান থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব পাঠের গুরুত্ব সহজে অনুধাবন করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন, هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ ‘নিশ্চয়ই ঐসবের মধ্যে বড় ধরনের শপথ রয়েছে জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য’ (ফজর ৮৯/৫)। এর ব্যাখ্যায় তানতাভী বলেন, ‘সেটা কেবল এটাই হ’তে পারে যে, এর দ্বারা কুরআনের পাঠক ও অনুসারীদেরকে আল্লাহর সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান গবেষণায় লিপ্ত হওয়ার প্রতি আহবান জানানো হয়েছে’।[3] কেননা আল্লাহ চান, মানুষ জেনে-বুঝে তাওহীদের ইবাদত করুক। আর এজন্য পাঠের বিকল্প নেই।

৩. অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন :

দৃশ্যমান কোন কিছু বিশ্বাস করা খুবই স্বাভাবিক ও সকলে তা সহজে বিশ্বাস করেন। আর অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাসের প্রশ্নেই আস্তিক ও নাস্তিকের পার্থক্য সূচিত হয়। একদিকে আল্লাহ, ফেরেশতা, তাক্বদীর, মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান, ক্বিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি মু’মিনের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। দুনিয়াবী জীবনে যেসবের দর্শন লাভ সম্ভব নয়। অন্যদিকে নগদ দর্শনে বিশ্বাসী নাস্তিকের জ্ঞানের উৎস হ’ল বিভ্রান্তিকর যুক্তি। যার অন্যতম কারণ অজ্ঞতা ও হঠকারিতা। তাই এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠের কোন বিকল্প নেই।

৪. আল্লাহর নিকট মর্যাদা লাভ :

মানব জাতির মর্যাদার অন্যতম কারণ হ’ল জ্ঞান। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পর জ্ঞান দান করেন এবং এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের নিকট তিনি মর্যাদার অধিকারী হন। মহান আল্লাহ বলেন, وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ- قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ ‘অনন্তর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর সেগুলিকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এগুলির নাম বলে দাও, যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি পবিত্র। সকল পবিত্রতা আপনার। আমাদের কোন জ্ঞান নেই, যা আপনি আমাদের শিখিয়েছেন তা ব্যতীত। নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’ (বাক্বারাহ ২/৩১,৩২)

আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوا فَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমাদের বলা হয় মজলিস প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা সেটি করে দাও। আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দিবেন। আর যখন বলা হয়, উঠে যাও, তখন উঠে যাও। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালভাবে খবর রাখেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ. ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ. ‘জ্ঞানের ফযীলত হ’ল তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তির তুলনায় আমার ফযীলতের ন্যায়। এরপর রাসূল (ছাঃ) আরো বললেন, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজে এবং তাঁর ফিরিশতাগণ, আসমান ও যমীনের সব অধিবাসী এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও (পানির) মাছ পর্যন্ত মানুষকে কল্যাণপ্রসূ শিক্ষকের (আলিমের) জন্য অবশ্যই দো‘আ করে থাকেন’।[4] এ মর্যাদা প্রাপ্তি নির্ভর করে কেবল পড়ার জন্য।

৫. আল্লাহ ভীতি ও ইবাদাতে মনোযোগ বৃদ্ধি

মানুষ তার জ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং যার জ্ঞানে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে যেমন ধারণা সে সেই অনুপাতে আমল করে। মহান আল্লাহ বলেন, أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ ‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সেজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে এবাদত করে, পরকালের আশংকা রাখে এবং তার পালনকর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে এরূপ করে না; বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান’ (যুমার ৩৯/৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। তাই আল্লাহর ভয় ও ইবাদাতের জন্য বেশী বেশী পাঠ করতে হবে।

৬. শরী‘আতের বিধান জানা

মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জীন সৃষ্টি করেছেন কেবলমাত্র তাঁর ইবাদাতের জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। আর এজন্য নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও প্রদান করেছেন। যেগুলো জানা ও সে অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। এজন্য طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ ‏‏‏‏‏‏‏‏‏ ‘এর ব্যাখ্যা হলো দ্বীনের মৌলিক বিশ্বাস, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ফরয’।[5]

৭. ছওয়াব লাভ

পাঠ একটি সর্বজনীন স্বীকৃত ভালো কাজ। ফলে পাঠের বিষয় ভালো হলে ছওয়াব অর্জন করা যায়। যেমন কুরআন তিলাওয়াত করলে প্রতি হরফে পাঠক দশ নেকী করে প্রাপ্ত হয়। তেমনি অন্যান্য ভালো বই বা প্রবন্ধ পাঠেও ছওয়াব অর্জিত হয়। শুধু তাই নয় পাঠাভ্যাস নফল ইবাদতের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ أَفْضَلُ مِنْ صَلَاةِ النَّافِلَةِ- ‘জ্ঞানার্জন করা নফল ছালাতের চেয়ে উত্তম’।[6] জ্ঞানের বাহনই হল পড়া।

৮. উত্তম চরিত্র গঠন

চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। চরিত্রবান ব্যক্তিরা উভয় জীবনে সম্মানিত হন। আল্লাহ বলেন,كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ ٱللَّه أُسْوَةٌ حَسَنَة ‘তোমাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। একবার মা আয়েশা (রাঃ) কে রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি বলেন, أَتَقْرَأُ الْقُرْآنَ؟ فَقُلْتُ: نَعَمْ، فَقَالَتْ: إِنَّ خُلُقَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقُرْآنُ ‘তুমি কুরআন পড় না? রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র ছিল ‘আল-কুরআন’।[7] সুতরাং উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য আমাদের বেশী বেশী কুরআন, হাদীছ ও সীরাত পাঠ করতে হবে।

৯. দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ

নবী-রাসূলগণ আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। তাদের অবর্তমানে সেই দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। রাসূল (ছাঃ) বলেন, بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً ، وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. ‘আমার কথা (অন্যদের নিকট) পৌঁছিয়ে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়। আর বনী ইসরাঈলের ঘটনাবলী বর্ণনা কর। এতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করল, সে যেন দোযখকেই তার ঠিকানা নির্ধারিত করে নিল’।[8] লক্ষ্যণীয় যে, জানা থাকাটা এখানে শর্ত। অর্থাৎ যে বেশি জানে সে এই খিদমতের সুযোগ বেশি পাবে। যাতে আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ জানতে পারি এবং নির্ভুলভাবে তা জনগণের দোরগড়ায় পোঁছে দিতে পারি।

১০. শত্রুদের প্রতিহত করা

সৃষ্টির শুরু থেকেই একদল লোক সর্বদা হক্বের বিরোধিতা করেছে। তারা আল্লাহ প্রেরিত মহা সত্যকে মুছে দেওয়ার জন্য চক্রান্ত করছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا- ‘এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়’ (আনআম ৬/১১২)। তাদের এই চক্রান্তের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের জ্ঞানার্জন করা যরূরী। কেননা, জ্ঞানের উপরে মূর্খতা বিজয় লাভ করতে পারে না।

জ্ঞাতব্য, পাঠ ও জ্ঞান কি এক? নিঃসন্দেহে দু’টি এক নয়। তবে পাঠ হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যম। দর্শন ও শ্রবণের মাধ্যমেও জ্ঞান লাভ করা যায়। তবে পাঠের তুলনায় তা নগণ্য। এছাড়া পাঠের মাধ্যমে সর্ব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা যায়, যা দর্শনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আর শ্রবণের জন্য অন্য কারো বলার প্রয়োজন হয়। আর বলার জন্য পাঠের বিকল্প নেই।

খ. পার্থিব

পড়ার ক্ষেত্রে আমরা ধর্মীয় দিকের চেয়ে পার্থিব সফলতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ এর ফলাফল দৃশ্যমান। এখানে আমরা এমন কিছু আলোচনা করব যা মুসলমানের মত সকল জাত পাতের সবার ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। সেগুলো হল :

১. জীবনে সফলতা অর্জন

 প্রত্যেকের জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। আর সে লক্ষ্যের চূড়ান্ত পর্যয়ে পৌঁছানোই সফলতা হিসাবে বিবেচিত হয়। যেহেতু প্রত্যেকের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন থাকে তাই সফলতা অর্জনের মাধ্যমও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু লক্ষ্য যেমনই হোক পাঠ সেখানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় সফলতার প্রধান মাধ্যম। তাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘একটি বাচ্চা যদি বই পড়ার আনন্দ শিখে যায় তাহলে তার বড় হওয়া নিয়ে আমাদের আর কখনোই দুর্ভাবনা করতে হয়না’।

২. মেধা শক্তি বৃদ্ধি

মানুষের মস্তিষ্ক পেশীর মতন। পেশী যেমন ব্যায়াম করলে বৃদ্ধি পায়, শক্তিশালী হয় তেমনি মস্তিষ্ক যত বেশি ব্যবহার করা হয়, তত বেশি শক্তিশালী ও কর্মক্ষম হয়। আটলান্টা জর্জিয়ার এমরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা পরামর্শ দেয় যে কথাসাহিত্যের একটি শক্তিশালী কাজ পড়া মানব মস্তিষ্কে স্নায়বিক পরিবর্তন করতে পারে। যার ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত হয়! পরিবর্তনগুলি মস্তিষ্কের বিশ্রামের রাজ্যে ঘটে এবং কয়েক দিন স্থায়ী হয়। গেইম অব থ্রনস সিরিজের একটি জনপ্রিয় চরিত্র টিরিয়ন ল্যানিস্টার। তার মতে, একটি তরবারিকে যেমন ধারালো রাখার জন্য শানপাথর দিয়ে শাণ দিতে হয়, তেমনি মস্তিষ্ককেও শাণ দিতে হয় বই পড়ার মাধ্যমে।

৩. পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ

ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় গুলো পুনরাবৃত্তি করা নিঃসন্দেহে জ্ঞানীর কাজ নয়। বরং জ্ঞানের কাজ হলো ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা অধ্যায়গুলো অনুসরণ করা। তাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। শায়খ ইয়াসির কাদি বলেন, ‘অন্যদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং সে রকম মানুষ হওয়া থেকে বিরত থাকুন’। মহান আল্লাহও আমাদের নিকট পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সতর্ক করেছেন। যেমন আল্লাহর বাণী, وَلَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ آيَاتٍ مُبَيِّنَاتٍ وَمَثَلًا مِنَ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ ‘আমি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের কিছু দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ ভীরুদের জন্যে দিয়েছি উপদেশ’ (নূর ২৪/৩৪)

৪. দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন

অভিজ্ঞতা হল বাস্তব প্রায়োগিক জ্ঞান। যা ঘরে বসে অর্জন করা যায় না। শুধু ধারণা লাভ করা যায়। আর তার উৎস হল বই। কেননা একটি বই, প্রবন্ধ বা আর্টিকেল লেখকের কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে পুঞ্জিভূত করে। যা সে সারা জীবনে অর্জন করেছে। তবে আমরা পাঠক হিসাবে কেবলমাত্র কয়েক ঘন্টা বা মুহূর্তে সেগুলি পড়তে পারি। যার ফলে যথেষ্ট কম সময়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। আর এগুলো জীবনে এখনও ঘটেনি এমন পরিস্থিতিতে সঠিক প্রতিক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।

৫. সৃজনশীলতা ও চিন্তা শক্তির বিকাশ

 মানুষের চিন্তাশক্তি তার জ্ঞান দ্বারা সীমাবদ্ধ। মানুষ তার মস্তিষ্কে সঞ্চিত তথ্যও ধারণার অনুরূপ চিন্তা করে। যে পাখি দেখেছে সে আকাশে ওড়ার কথা ভাবে। আর যে রকেটের ক্ষমতা সম্পর্কে জানে সে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এখানেই পার্থক্য প্রকাশিত হয়। আমরা যখন কোন বই পড়ি, তখন সেই বইয়ের কথার সাথে, চরিত্রগুলো আমাদের চিন্তা-চেতনা এবং কল্পনাশক্তিকে ট্রিগার করে। এছাড়া সৃজনশীলতার উপর এমন অনেকগুলি বই রয়েছে যা আমাদের সৃজনশীল চিন্তাকে বিশেষভাবে আকার দিতে ও বর্ধন করতে পারে।

৬. নিজেকে আবিষ্কার করা

নিজের অবস্থান যাচাই করা। আমরা যখন কোন বই পড়ি, আমরা কোনভাবে বইগুলির ঘটনা, আবেগ, অভিজ্ঞতা এবং চরিত্রগুলির সাথে নিজেকে তুলনা করার চেষ্টা করি। এটি কেবল আমাদেরকে বইটিতে জড়িত রাখে না, বরং জানিয়ে দেয় আমাদের শক্তিমত্তা আর দুর্বলতা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জীবনের ভুলগুলো আর তার সমাধান। আমরা যতই অধ্যয়ন করি ততই আমাদের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করি।

৭. প্রেরণার উৎস

মানুষের জীবন গতিময়। সব বাঁধা পেরিয়ে সময়ের সাথে বয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথ একে প্রবাহমান নদীর স্রোতের সাথে তুলনা করেছেন। এই গতিময় পথে আমরা কখনো খেয় হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের আশা এবং আগ্রহ হারিয়ে দিগ্বিদিক জীবনের মানে খুঁজে বেড়াই। এরকম সময়ে আমাদের প্রয়োজন হয় কিছুটা প্রেরণা, সঠিক দিকে একটু ধাক্কা। এসময় একটা ভালো বই, একটা প্রবন্ধ হতে পারে কান্ডারী। বই নিঃসন্দেহে প্রেরণার এক বিশাল উৎস। যা আমাদের চিন্তাভাবনা ইতিবাচক করতে পারে। দিতে পারে সঠিক পথের দিশা যা অর্জিত হয় পড়ার মাধ্যমে।

৮. অবসরের সঙ্গী

একজন ভালো পাঠককে একাকিত্ব কখনো বিরক্ত করতে পারে না। অবসরে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তার কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। শুধু হাতের কাছে ভালো বই থাকলেই চলে। বই এমন বন্ধু যা কখনো ছেড়ে যায় না। রাগ বা বকাবকি করে না। নিঃস্বার্থ সঙ্গ দিয়ে যায়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালাম বলেন, একটি ভালো বই একশটা বন্ধুর সমান, আর একটা ভালো বন্ধু একটা লাইব্রেরির সমান। বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় এমন বন্ধু মিলা দায়। তাই আপাতত বইই সান্ত্বনা। পড়তে পড়তে অবসর ভরে উঠবে পূর্ণতায়।

৯. ভালো ঘুম হতে সহায়তা করে

আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি অথবা অবসাদগ্রস্থ মনের জন্য যে মানসিক চাপ তৈরী হয় সেটির জন্য কর্টিসল নামক এক ধরনের হরমোন দায়ী। আর এই কর্টিসল হরমোনকে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে রাতে ঘুমানোর আগে কিছু সময়ের জন্য বই পড়া। The Sleep Council-এর মতে, প্রায় ৩৯ ভাগ মানুষ যারা রাতে ঘুমানোর পূর্বে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেন, তারা বছর শেষে প্রতিদিনই সুস্থ স্বাভাবিক ঘুম উপহার পেয়েছেন এবং বিভিন্ন রোগবালাই থেকেও মুক্তিলাভ করেছেন।

১০. বিনোদন গ্রহণ

একথা সত্য যে, পড়া কারো কারো জন্য হয় বিরক্তিকর ও কষ্টের কারণ। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের পসন্দ জানি এবং সে অনুযায়ী বই পড়তে পারি, তাহলে এটা আমাদের আনন্দ আর আনন্দ দেয়। তাই তো ক্রিস্টোফার মার্লি মনে করেন, নতুন জানার যেমন যন্ত্রণা আছে তেমনি আনন্দও আছে। আর রবীন্দ্রনাথ তো আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন মাত্র দুটি জিনিসের মধ্যে। যার একটি জ্ঞানার্জন বা বই পড়ার মধ্যে।

তবে মনে রাখতে হবে ভালোর বিপরীতে মন্দও আছে। বইয়ের বিষয় যেমন হয় সুন্দর ও মার্জিত, তেমনি হতে পারে নগ্ন, কুরুচিপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের গগনে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি, যৌনতা ও নাস্তিক্যবাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যা আমাদের মস্তিষ্ককে যে কোন দিকে পরিচালিত করতে পারে। সেটা নির্ভর করে আমরা কি পড়ছি তার উপরে। তাই সতর্কতার সাথে পাঠে মনোযোগী হতে হবে।

উপসংহার : বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মানুষের জীবনকে উন্নত করেছে। অনেক শ্রম লাঘব করেছে। কিন্তু তাতে পড়ালেখার গুরুত্ব একটুও কমেনি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের মধ্যে বিজ্ঞানীদের বহুদিনের পড়াশোনা ও পরিশ্রম লুকিয়ে আছে। একজন পাঠক সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো পথ অতল সমুদ্রে নেমেছে, কোনোটা আবার অনন্ত শিখরে উঠে গেছে। যে যে দিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। বোধ করি তাঁর সেই আহবান আমাদের কানে পৌঁছায় নাই। অথবা অলসতা আমাদের এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে, তা ছাড়াবার সাধ্য আমাদের নাই। তাই চারদিকে যখন জ্ঞানের জয়জয়কার, তখন আমাদের ভয় ঐতিহ্য হারাবার। তাই বিখ্যাত দার্শনিক সেনাকারের ভাষায়, পৃথিবীর ইতিহাসে দুর্ঘটনাক্রমে কেউ জ্ঞানী হননি। নিয়মিত পাঠে অভ্যস্ত ব্যক্তিই কেবল প্রকৃত জ্ঞানীর মর্যাদা লাভ করেন।


নাজমুন নাঈম

[লেখক : শিক্ষার্থী, কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ]


[1]. ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, ৩৭৮ পৃ.

[2]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; জামে‘ হা/৩৯১৩।

[3]. তাফসীরে তানতাভী ২৫/৫৫ পৃ.।

[4]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; তা‘লীকুর রাগীব ১/৬০; মিশকাত হা/২১৩।

[5]. তাফসীরুল কুরআন, ৩০ তম পারা, ৩৮২ পৃ.।

[6]. সিলসিলাতু আছারুছ ছহীহাহ হা/৩৪৮।

[7]. নাসাঈ হা/১৬০১; মুসতাদরাকে হাকেম হা/৩৮৪২।

[8]. বুখারী হা/৩৪৬১;মিশকাত হা/১৯৮।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও