চোখশোক
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব
২৬শে
মার্চ ২০২১ শুক্রবার। আমাদের জীবনের উপর দিয়ে বইয়ে গেল এক অকল্পনীয়
সাইক্লোন। যার ছোবলে এক এক করে পরিবারের পাঁচজন স্বজনকে মাটি চাপা দিয়ে শেষ
বিদায় জানাতে হ’ল। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নেয়া যে কত কঠিন, কত
হৃদয়বিদারক, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু
সবকিছুর উপর আল্লাহ্ তা‘আলার অলংঘনীয় ফরমান বলে সমস্ত শোককে পাথর চাপা
দিয়ে রাখি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন।
আগের দিন ২৫শে মার্চ আমি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কেন্দ্রীয় আয়োজনে তিনদিন ব্যাপী বার্ষিক শিক্ষা সফর (সুন্দরবন) শেষে ফজরের সময় ট্রেনযোগে সৈয়দপুর এসে পেঁŠছালাম। বড্ড ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় সেখান থেকে রংপুর যেলার পীরগঞ্জস্থ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে আমার ভগ্নিপতি মুহাম্মাদ ছালাহুদ্দীন ভাইকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। বললাম ভাই কোথায়? সে বলল, একটু পরিবার নিয়ে রাজশাহী যাচ্ছি ঘুরে দেখার জন্য। সাথে আছে আরো তিন/চারটি পরিবার। সকাল ৯ টার দিকে বাড়ি পেঁŠছলাম। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি লাঘবের জন্য বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা। কিন্তু দাওয়াতী কাজে জুম‘আর খুৎবা থাকায় আর বিশ্রাম নেওয়া হলো না। কাকতালীয়ভাবে আমার জুম‘আর খুৎবার বিষয় ছিল- মৃত্যু পরবর্তী জীবন।
খুৎবা শেষে বাড়ি ফেরার পর পরই অপরিচিত এক নম্বর থেকে ফোন আসল। আপনার ছালাহুদ্দীন ভাই কোথায়? বললাম, কেন কি হয়েছে? তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। আমি তখনও বুঝতে পারছিনা কী সংবাদ অপেক্ষা করছে? এরপর বললেন, গাড়িটিতে আগুন লেগে গেছে। আমি বললাম, খুলে বলেন ভাই! তাদের কী হয়েছে? বললেন, সবাই পুড়ে মারা গেছে! আমি আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না। বোধশক্তিও ছিল না। কি মর্মান্তিক! এও কী সম্ভব! পরিবারের এতগুলো সদস্য নিমিষেই শেষ হয়ে গেল! ইন্নালিল্লাহ.....!!
গাড়িতে ছিল আমার আদরের ছোট বোন, ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভগ্নিপতি এবং আমার বড় বোন কামারুন্নাহার (৩৮)। তিনি ছিলেন বিধবা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। একটি মাত্র ছেলেকে আঁকড়ে ধরে তিনি আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ের অনেক সম্বন্ধও এসেছিলো। কিন্তু তার ধারণা বিয়ে জীবনে একবারই হয়। সবসময় বলতেন, আমি জান্নাতে আমার স্বামীকে পেতে চাই। এভাবেই তার ২১ বছর কেটে গেছে আমাদের বাড়িতে। আমার বড় বোনের স্বামী ছিলেন আবার ছোট বোনের স্বামীরই সহোদর ভাই। তিনিও ২০০০ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। আমি যখন শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্যে বের হই, তখন আমার বড় বোন বলেছিলেন, তুই আমার জন্য খুলনা থেকে গামছা আনবি। আমি তার জন্য গামছা এনেছিলাম। কিন্তু আমরা গামছার মালিককে হারিয়ে ফেলেছি।
গত ৬ মাস আগে আমার দ্বিতীয় মেয়ে জন্ম হওয়ায় স্ত্রীর ব্যাপক রক্তপাতের কারণে বুকের দুধ বাচ্চা বেশী পেত না। তাই আমার ছোট বোন শামসুন্নাহার (৩২) রোজ ৩ কিলোমিটার দূর থেকে এসে আমার মেয়েকে দুধ পান করাতো। দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকতো। মাঝেমধ্যে সে আমাদের বাড়িতে থেকে যেত। বোনটা আসতেই আমি আমার মেয়েকে বলতাম, মা তোমার দুধ মা হালীমা এসেছে অনেক কষ্ট করে। আমার মেয়েকে সে দুধ পান করিয়েছে গত ২৫ শে মার্চেও। আমার মাত্র দুই বছরের ছোট পরম আদরের বোন। গত কয়েকদিন পূর্বে দু’বোন মিলে বায়না ধরেছে আমার কাছে দু’টি ভালো কম্বল নিবে। আমি বলেছিলাম ইনশাআল্লাহ দেব। হায়! আল্লাহ, এখন আমি কাকে দিব.......!! তাদের আব্দার কীভাবে পূরণ করব!
আমার ছোট ভাগ্নে সাজীদ। বয়স ৯ বছর হয়নি। স্বপ্ন ছিল তাকে বড় আলেম বানাবো। তাই তাকে হাফেয বানানোর জন্য হেফযখানায় দেই। পরিকল্পনা ছিল ২০২২-এ তাকে রাজশাহী নওদাপাড়া ভর্তি করব। ওকে বড় আলেম বানিয়ে আমার বড় মেয়ের জামাই বানাবো। ও অনেক মেধাবী ছিল। শুনে শুনেই সব মুখস্থ করে ফেলত। অল্প কয়েক দিনেই সে প্রায় ৩০টির মত সূরা মুখস্থ করেছিল এবং সব সময় সঙ্গীতের মত তার মুখে কুরআনের তেলাওয়াত লেগেই থাকত। তার মত মিষ্টি বাচ্চা আমি আর দেখিনি। আমার সেই স্বপ্নের জামাইকে আমি এখন কোথায় পাবো....?
আমার একমাত্র ভাগ্নী সাফা। বয়স মাত্র দেড় বছর (১৮ মাস)। মাত্র ৮ মাস বয়স থেকে কথা বলা শুরু করে। আমাকে বলত মামা তুতুত (বিস্কুট) দাও, মামা মিতি (মিষ্টি) আনো। আমি ওকে আমার নিজের মেয়েই মনে করতাম। ওর ভাগের দুধ আমার ছোট মেয়ে পান করেছে। আল্লাহর কি ইচ্ছা সাফা, ওর মায়ের একটি দুধ সে খেত আর একটিতে মুখ দিত না। দুধের ওই কচি বাচ্চা বলত, মামনি আপু তাবে (খাবে)। ওর মতো মধুর মামা ডাক পৃথিবীতে আমাকে আর কে ডাকবে.....? আল্লাহুম্মা আজিরনী ফী মুছীবাতী ওয়াখলুফলী খাইরাম মিনহা।
ছালাহুদ্দীন আমার তাওয়াতো ভাই এবং ভগ্নিপতি। আমরা কামিল, অনার্স ও মাস্টার্স একসাথে করেছি। ও ছিল আমার দুই বছরের বড়। একসাথে ব্যবসা করতাম। প্রায় ১৫ বছর আমাদের এক সাথে কেটেছে। ওর মত ভদ্র, শান্ত ও নীতিবান ছেলে বর্তমান সময়ে খুব কমই পাওয়া যাবে।
আমরা জন্মগতভাবে হানাফী মাযহাবের ছিলাম। আমি ২০১০ সালে আহলেহাদীছ হই আলহামদুলিল্লাহ। পরে আমার পুরো পরিবার আহলেহাদীছ হয়ে যায়। সে গত সেশনে পীরগঞ্জ উপজেলা যুবসংঘে’র অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে। ও আমাকে প্রায়ই বলতো ভাই দুনিয়া কয় দিনের। আল্লাহ যেন জান্নাতে দেন। এটাই শুধু চাওয়া। ও ছিলো আমার ভগ্নিপতি, ভাই ও বন্ধু। এগুলো কথা মনে পড়লে বুকটা ফেটে যায়।
আরো অবাক করা ব্যাপার যে, আমার আববাও সেই দিন জুমআ‘র খুৎবা দেন। তারও খুৎবার বিষয়বস্ত্ত ছিল ধৈর্য ধারণের উপর। মুহূর্তের মধ্যেই যে আমাদেরকে ধৈর্যের এই মহাপরীক্ষা দিতে হবে, তা কে জানত!
আমার পিতা আমাকে প্রায়ই বলত। মতীউর! আমরা তো আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে মসজিদ থেকে বিতাড়িত। আমাদের জানাযায় লোক কোথায় পাবো রে...? কারণ আমাদেরকে সমাজ মেনে নেয় না। আমি তখন তাকে বলতাম। আল্লাহ যেন আমাদের সামাজিক একটা গ্রহণযোগ্যতায় এনে তারপর পরিবারের কারোর মৃত্যু ঘটান। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তা কবুল করলেন। প্রায় দশটি যেলা থেকে ‘যুবসংঘ’-এর দ্বীনী ভাইয়েরা জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাত ১২টার জানাযা হ’ল। কিন্তু তারপরও মানুষের মাঝে কোন তাড়া নেই। রাজশাহী থেকে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ভাই ও মাসিক আত-তাহরীক সহকারী সম্পাদক ড. কাবীরুল ইসলাম ভাইসহ কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের অনেকেই এসেছিলেন। আসলে মহান আল্লাহর ইচ্ছা এভাবেই বাস্তবায়িত হয়।
আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার ফোন দিয়ে আববাকে সান্ত্বনা দিলেন। আমাকে বললেন, ‘আল্লাহ তাদের কবুল করুন, তোমরা ধৈর্য ধারণ করো’। আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাতী হিসাবে কবুল করে নেন এবং আমরা যেন ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর দৃঢ় থাকতে পারি, দ্বীনী ভাইদের কাছে এই দো‘আই কামনা করি-আমীন!
-মতীউর রহমান
সহ-সভাপতি, আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রংপুর যেলা