ফারূকদের গল্প

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 943 বার পঠিত

১.

ইশ! আরেকবার ওযূ করতে হবে।

ওযূ করে মসজিদে যাচ্ছিল ওছমান, হঠাৎ রাস্তায় পড়ে থাকা ময়লা পায়ে মেখে গেছে।

না, চাচা। পেছন থেকে বলল ফারূক, সেও ছালাত আদায় করতে যাচ্ছিল। পায়ে ময়লা লাগলে ওযূ নষ্ট হয় না, পা ধুয়ে ফেললেই হবে।

তাই, বাবা? কেবল পা ধুয়ে নিলেই হবে?

জী।

মসজিদের চাপকল থেকে পা ধুয়ে নিল ওছমান।

ফারূক মাদরাসার ছাত্র। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।

২.

আব্দুছ ছবূর ছাহেব গ্রামের মসজিদের ইমাম, বয়স ষাটের উপরে। কুরআনের হাফেয। গ্রামের বাচ্চাদেরকে পড়ান। এতদিন তিনিই ছিলেন গ্রামের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা ব্যক্তি। তাই দ্বীন সম্পর্কে যেকোন প্রশ্ন তাকেই করে মানুষ।

‘ফারূক’ ছেলেটার উপর বেশ ক্ষেপা তিনি। আগে গ্রামের মানুষ তাকে দিয়ে নানা রকম ‘খতম’ পড়াতো। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শিরনি দিত। সেগুলো ক্রমেই কমে আসছে। এগুলোর জন্য দায়ী ওই ফারূক। সেই মানুষের মাথা নষ্ট করছে।

ওছমান আর ফারূকের কথা শুনে ফেলেছেন তিনি। আজ একটা সুযোগ মিলেছে, ফারূককে দেখে নেবেন আজ।

৩.

‘মুসলিম ভাইয়েরা আমার!’ মাগরিবের ছালাতের পর দাঁড়িয়ে বললেন আব্দুছ ছবূর। 'আমরা কি আসলে মুসলমান?’

মুছল্লীরা প্রথমে থমকে গেল, তারপর একটা গুঞ্জন শুরু হ’ল মসজিদে।

একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হুযূর, বুঝলাম না ব্যাপারটা। একটু যদি খোলাসা করতেন।’

‘কেমন মুসলমান আমরা, মানুষের ঈমান আমল ধ্বংস করা হচ্ছে আর আমরা কিছুই করতে পারছি না?’

‘হুযূর, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?’ আরেকজন মুছল্লী বলল।

‘আমরা কেমন মুসলমান, যখন একজন পথভ্রষ্ট, ইয়াহুদীর এজেন্ট ফৎওয়া দিল, পায়ে নাপাক লাগলেও নাকি ওযূ নষ্ট হবে না, তখন প্রতিবাদ করতে পারলাম না?’

‘কে এই বদমাশ?’ মুছল্লীরা জানতে চাইল।

‘রহমত মুনশীর ছেলে ফারূক। ওছমান মিয়া সাক্ষী।’

মুছল্লীরা ক্ষেপে উঠল। কেউ বলল, 'ওকে গ্রামছাড়া করব’, কেউ বলল, ‘চামড়া তুলে নেব’, কেউ পিটিয়ে ঠ্যাং ভাঙতে চাইল, কেউ অন্য কিছু বলল। সবাই ক্ষিপ্ত, সবার ঈমানী (!) জযবা জেগে উঠেছে।

‘আমার একটা কথা আছে’, আবুল কাশেম নামের এক যুবক দাঁড়িয়ে বলল।

শোরগোল থেমে গেল, সবাই তার দিকে তাকালো। আবুল কাশেম আবার বলতে লাগলো, ‘ইসলামবিরোধী কোন বক্তব্য আমরা বরদাশত করব না কিছুতেই। কিন্তু এ ব্যাপারে ফারূককে একটু জিজ্ঞাসা করতে চাই, ও এমন কথা বলার কারণ কী। ও তো কুরআন-হাদীছের কথাই বলে’।

‘না, এটা হ’তে পারে না’, জোর গলায় বললেন ইমাম সাহেব। ‘ওর কথা শুনতে যাবেন না, তাহ’লে আপনাদেরকেও পথভ্রষ্ট করে ফেলবে। ওকে এলাকা থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করুন।’

‘আমরা একটু শুনে দেখি, কী বলে..’ আবুল কাশেম বলল।

‘না!...’ প্রতিবাদ করলেন ইমাম ছাহেব।

মুছল্লীরা দু’ভাগ হয়ে গেল। কেউ ইমাম ছাহেবের কথাকে সমর্থন করল, কেউ ফারূকের কথা শুনে দেখতে চাইল। বাক-বিতন্ডা চলল কিছুক্ষণ।

‘ইমাম ছাহেব!’ মাতববর গোছের একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু ফারূকের বক্তব্যও শুনে দেখতে চাই। সবার সামনেই ওকে জিজ্ঞেস করতে চাই।’

ইমাম ছাহেব আর প্রতিবাদ করতে পারলেন না। ফারূককে ডাকতে গেল একজন। ব্যস্ততার কারণে ছালাত শেষে আগে আগে চলে গিয়েছিল ফারূক।

৪.

‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’। সবাইকে সালাম দিয়ে কথা শুরু করল ফারূক।

তার ব্যাপারে যে অভিযোগ ছিল, মসজিদে পৌঁছার পর মুছল্লীরা তাকে জানিয়েছে। ইমাম ছাহেবের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলছে সে। ওদিকে ইমাম ছাহেবের চেহারা অন্ধকার।

‘আমার ভাইয়েরা ও শ্রদ্ধেয় মুরববীগণ, আমার কথা একটাই। আমি যা বলেছি তা যদি আমার পক্ষ থেকে বানিয়ে বলে থাকি তাহলে আমাকে যা খুশি করুন; আর যদি আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা বলে থাকি তাহলে কি আমার কথা গ্রহণ করবেন?’

মজলিসে গুঞ্জন উঠল।

‘তোমার কথা ঠিক হলে আমরা মানতে রাযী আছি’- একজন জোরে বলল। তার কথায় সায় দিল আরো অনেকে।

‘পায়ে নাপাক লাগলে ওযূ ভেঙ্গে যাবে- একথার কোন প্রমাণ কুরআনেও নেই হাদীছেও নেই। আমি কি ভুল বলেছি হুযূর?’ ইমাম ছাহেবকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ফারূক।

সবার চোখ ইমাম ছাহেবের দিকে ঘুরে গেল। ইমাম ছাহেব কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কথা আটকে গেল তাঁর।

‘ফারূক!’ এতক্ষণে কথা বলল মসজিদের খাদেম। ‘তুমি যা বলছ সেটা কুরআন-হাদীছ থেকে তোমার বুঝ। আর ইমাম সাহেব যা বলছেন সেটা কুরআন-হাদীছ থেকে তাঁর বুঝ। তুমিই বল আমরা কার বুঝ গ্রহণ করব? একজন প্রবীণ ইমামের, যিনি এত বছর আমাদেরকে ছালাত পড়া শিখিয়েছেন, নাকি তোমার মত একজন নব্য ফেৎনাবাজের?’

‘হুজুর, ইমাম ছাহেব যা বলছেন তা কিন্তু কুরআন-হাদীছের কোথাও নেই। তিনি দেখাতে পারলে তো আমি অবশ্যই মেনে নেব’। ফারূক জবাব দিল।

‘দেখ, এগুলো বাহ্যবাদ!’ সুযোগ পেয়ে আবার কথা শুরু করলেন ইমাম ছাহেব। ‘কুরআন-হাদীছের বাহ্যিক অর্থ দেখলেই হয় না। আহলে দিলের কাছ থেকে বাহ্যিক দৃষ্টির আড়ালে থাকা গোপন অর্থ বুঝতে হয়। কামেল মানুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হয়’।

‘হুযূর, বাহ্যিক অর্থের আড়ালে যদি ভিন্ন অর্থ থাকে তাহ’লে তার স্বপক্ষে তো প্রমাণ থাকতে হবে। নতুবা বাহ্যিক অর্থই ধরতে হবে। আরবী ভাষার বালাগাত শাস্ত্র ও উছূলুল ফিকহ তো এ কথাই বলে। তাছাড়া এটা তো সব ভাষারই স্বীকৃত নিয়ম’।

‘আমার পিতা আমার আগে একটানা পঞ্চাশ বছর এই মসজিদে ছালাত পড়িয়েছেন। তিনিই এলাকার মানুষকে ছালাত পড়তে শিখিয়েছেন। কুরআন পড়তে শিখিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন কামেল লোক।’

মরহূম ইমাম ছাহেবের কথা স্মরণ করে গ্রামবাসী আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। কারো কারো চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল।

ইমাম ছাহেব আবার বললেন, ‘তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন পায়ে নাপাকী লাগলে আবার ওযূ করতে হয়। তুমি কি কুরআন-হাদীছ তাঁর থেকে বেশি বোঝ ফারূক? কত বড় কামেল হয়েছ তুমি? বেয়াদব!’

‘হুযূর...’ বিপদে পড়ে গেল ফারূক। গ্রামবাসীর চোখেমুখে ক্রোধ ফুটে উঠেছে। তার বেয়াদবীতে তারা ক্রুদ্ধ।

‘আমি তাঁর অবদানকে অস্বীকার করি না। কিন্তু সালাফগণ তথা আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীগণ, তাবেঈগণ ও মুজতাহিদ ইমামগণ যারা কুরআন-হাদীছের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারাও কিন্তু একথা বলেননি।’

‘এটাও সালাফের বক্তব্য থেকে তোমার বুঝ। তিনি সালাফদের ব্যাপারে তোমার চেয়ে ভালো বুঝতেন। আমরাও সালাফের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। এটার নাম ‘মানহাজুস সালাফ আলা ফাহমি ফুলান’।

‘কিন্তু হুযূর, কোন নির্ভরযোগ্য কিতাবে তো এমন কোন কথা সালাফদের কারো থেকে বর্ণিত হয় নি।’

‘আবার যাহেরপুরুস্ত বাহ্যবাদীদের মত কথা বলছ! ইলম কিতাব থেকে নিলে তো এভাবেই গোমরাহ হবা। প্রকৃত ইলম কিতাবে থাকে না। থাকে আহলে দিলের সীনায়। ‘সীনা বা সীনা’ (বুক থেকে বুকে) আল্লাহর রাসূল থেকে এভাবেই আমাদের কাছে পৌঁছেছে। সেগুলো হুবহু নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় ‘আমল মুতাওয়ারাছ’। বলেন ঠিক কিনা?’

‘ঠি-ই-ক!!’ চিৎকার করে উঠল গ্রামবাসীদের বড় অংশ।

‘কিন্তু...’ কথা শেষ করার সুযোগ পেল না ফারূক।

‘আর একটা কথা বলবি না বেয়াদব!’ কয়েকজন তেড়ে আসল তার দিকে। ‘এতদিন আমরা যা করেছি ভুল? আমাদেরকে নতুন ইসলাম শিখাতে এসেছিস?’

উপস্থিত মুছল্লীদের কেউ কেউ ফারূককে সাপোর্ট দিতে চাইলেও উত্তেজিত গ্রামবাসীকে তারা সামলাতে পারছিল না। অবশেষে ইমাম ছাহেব নিজেই সবাইকে শান্ত করেন।

‘ফারূক, আজকের মত বেঁচে গেলা। লজ্জা থাকলে আর কোনদিন যেন মানুষকে তোমার মাসআলা শিখাতে যাবা না।’ মুয়াযযিন ছাহেব বললেন।

কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হ’ল ফারূক। মনে মনে বলল, ইনশাআল্লাহ সে এখানে এক সময় অহির আলো ছড়িয়ে দেবে। তখন মানুষ বের হয়ে আসবে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোতে।

মন্তব্যঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের স্পষ্ট বক্তব্যের সামনে ‘সামি‘না ওয়া আত্বা‘না’ এবং ‘আমান্না বিহী’ বলতে না পারা অজ্ঞ মানুষের সমাজে অনেক সময় এভাবেই ‘বাহাছে’ হারে ফারূকরা। এভাবেই চলছে এখন।

[উল্লেখ্য, আমার একজন প্রবীণ উস্তাযের মুখে শুনেছি, তিনি ইলম অর্জন করে গ্রামে এসে যখন বলেছিলেন পায়ে গোবর লাগলে ওযূ নষ্ট হয় না তখন তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন গ্রামের কোন হুযূর]

আবূ খুবায়েব, খুলনা



আরও