সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের উপায়

অধ্যাপক মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন 3417 বার পঠিত

ভূমিকা :

কর্মীরা সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী ছাড়া যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় না। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন গতিশীল হয় না। আর সংগঠন গতিশীল না হলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। উলেলখ্য যে, সূর্যকে কেন্দ্র করেই সৌরজগত পরিচালিত হয়। অনুরূপভাবে যোগ্য নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে সংগঠনের কর্মীরা পরিচালিত হয়। এজন্য নেতার দায়িত্ব কর্মীদেরকে যোগ্য ও অভিজ্ঞ করে গড়ে তোলা। আর এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। এর নেই কোন শর্টকার্ট রাস্তা। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী কর্মসূচীর; সেই সাথে তা বাস্তবায়ন। এক্ষেত্রে কর্মীদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের কিছু উপায় আলোচনা করা হল :

১. সাংগঠনিক প্রজ্ঞা :

ইসলামের প্রথম বাণী হল, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড়ুন! আপনার প্রভুর নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ১/৯৬)। আল্লাহ বলেন, هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘হে নবী! আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি উভয়ই সমান’ (যুমার ৩৯/৯)। জগৎ বিখ্যাত হাদীছের পন্ডিত ইমাম বুখারী (রহঃ) অধ্যায় রচনা করেছেন, باب العلم قبل القول و العمل ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন করা’। অতএব সাংগঠনিক কাজের পূর্বেই সংগঠন সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

সংগঠনের মৌলিক উপাদান হল তিনটি। যথা- যোগ্য নেতৃত্ব, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী। এই তিনটির সমন্বিত নাম হল সংগঠন। একজন সংগঠক হিসাবে এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট থাকতে হবে। তাহলে সংগঠন গতিশীলতা লাভ করবে।

২. দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি :

দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যে কোন কাজের সফলতার মানদন্ড। অপরদিকে কাজে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি না থাকলে সফলতা লাভ করা যায় না। সর্বক্ষেত্রে সে ব্যর্থ হয়। তাই একজন কর্মীকে সংগঠক হওয়ার জন্য তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা ছাড়া যোগ্য সংগঠক হওয়া যায় না। ইংরেজীতে একটি কথা আছে Well begun is half done ‘কোন কাজ ভালভাবে আরম্ভ করা মানে অর্ধেকটা সম্পন্ন হয়ে যাওয়া। এতে কাজে সফলতা আসে।

৩. পরিকল্পিত কাজ :

যিনি দক্ষ সংগঠক হবেন তাকে পরিকল্পিত কাজ করতে হবে। বলা হয় যে, পরিকল্পনা হল কাজের অর্ধেক। Plan বা নকশা ছাড়া কাজ করলে সফলতা লাভ করা যায় না। পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে, অল্প অল্প করলেও বরকত হয়। লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া যায়।

৪. কর্মনীতি মূল্যায়ন :

জগত বিখ্যাত সংগঠকদের কর্মময় জীবন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করুন। তাদের সফলতার পিছনে কোন্ কোন্ বিষয়গুলো সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে তা চিহ্নিত করে সে আলোকে নিজেকে গড়ে তুলুন। যা নিজ দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাদের জন্য মডেল। তার কর্মময় সোনালী জীবনকে মূল্যায়ন করে আমাদেরকে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে হবে।

৫. সংগঠন বিষয়ে বইপত্র পাঠ :

সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে স্ব স্ব স্তরের নেতা ও কর্মীদেরকে নিয়মিত সংগঠন সম্পর্কিত বইপত্র পাঠ করতে হবে। অপরদিকে বিশিষ্ট সংগঠকদের বইপত্র সংগ্রহ ও পাঠের মাধ্যমে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার ঝুলিকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করতে হবে।

৬. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন :

একজন নেতা ও কর্মীকে চোখ কান খোলা রেখেই নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে। নিজ দেশ ও জাতি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এভাবে দূরদর্শী নেতা ও কর্মী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। এভাবে সংগঠন গতিশীল হবে।

৭. কর্মবণ্টন নীতি :

কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মবণ্টন করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেওয়া একজন যোগ্য নেতার প্রধান কাজ। এ কাজে নেতা যত তৎপর হবেন কর্মীরা তত কর্মচঞ্চল হবেন। দায়িত্বের পাশাপাশি জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। এতে কর্মীদের মাঝে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হবে এবং সংগঠনের কাজে গতি বৃদ্ধি পাবে।

৮. আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার :

দক্ষ সংগঠক শারঈ জ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তি জ্ঞানে অভিজ্ঞ হবেন এবং কর্মীদের সেভাবে গড়ে তুলবেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাওহীদ ও সুন্নাতের দাওয়াতকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিবেন। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ উজ্জ্বল হবে। সংগঠনের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে।

৯. সাংগঠনিক কাঠামো :

একজন দক্ষ সংগঠক সাংগঠনিক কাঠামোকে মযবুত করে গড়ে তুলবেন। সংগঠনের ভিত্তি মযবুত হলে কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে। সাংগঠনিক কাঠামোকে মযবুত করার জন্য সংঘবদ্ধ কর্মীদের মাঝে মধুর সু-সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। পক্ষপাতহীন কর্মঠ ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বানুভূতি সম্পন্ন কর্মীদের মধ্য হতে গঠনতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্বশীল পরিষদ গঠন করা এবং সকল বিষয়ে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করলে সাংগঠনিক কাঠামো মযবুত হবে।

১০. নেতা ও কর্মী সম্পর্ক :

নেতা ও কর্মীর সম্পর্ক হবে সু-মধুর ও টেকসই একটি পরিবারের মত। যেখানে থাকবে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালবাসা ও ভক্তি। জুনিয়র কর্মী সিনিয়র কর্মীরদের প্রতি হবে শ্রদ্ধাশীল আবার সিনিয়র কর্মী বা দায়িত্বশীল নেতা জুনিয়র কর্মীদের প্রতি হবেন সেণহ পরায়ণ এবং তাদের হক্ব আদায়ে হবেন সর্বদা সচেতন। এভাবে নেতা ও কর্মীদের মাঝে আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হলে সংগঠনের গতি বৃদ্ধি পাবে।

১১. ভুলত্রুটি সংশোধন :

আদম সন্তান হিসাবে কর্মীরা ভুল করবে। দূরদর্শী নেতা হিসাবে কর্মীদের ভুল শুধরিয়ে দিবেন। ভুল সংশোধনের সুযোগ দিবেন। যদি সংগঠনের নিয়ম-নীতি বহির্ভূত কোন কাজ নেতা-কর্মীর দ্বারা সংগঠিত হয় তাহলে গঠতান্ত্রিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরস্পরের দোষত্রুটি গোপন রেখে সংশোধনের জন্য সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এতে আল্লাহর রহমত নেমে আসবে সংগঠনের কাজে বরকত হবে।

১২. নেতৃত্ব ও আনুগত্য :

নেতা ছাড়া যেমন আন্দোলন হয় না। তেমনী কর্মী ছাড়া আন্দোলন সফল হয় না। তাই ইসলামে নেতৃত্ব ও আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তাকে খুব গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِى سَبِيلِ اللَّهِ ‘আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন, নেতার আদেশ শ্রবণ, নেতার আনুগত্য, হিজরত এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’ (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৬৯৪, সনদ ছহীহ)। অতএব আল্লাহর প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য এবং রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছাহাবীগণের আনুগত্যের মূল্যায়ন করে দায়িত্বশীলদের প্রতি গভীর আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। এতে সংগঠনের উপর আল্লাহর রহমত নেমে আসবে ও কাজকর্মে বরকত হবে।

১৩. প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা :

আল্লাহ বলেন, وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ ‘আর তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের শক্তি নিয়ে প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর’ (আনফাল ৮/৬০)। তাই বলা যায়, সাংগঠনিক জীবনের সকল স্তরে প্রশিক্ষণ দরকার। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনে কর্মীদের প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। এজন্য মাঝে মাঝে দক্ষ প্রশিক্ষকদের দ্বারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যরূরী। যাতে কর্মীরা আধুনিক নব্য জাহেলিয়াতের মোকাবেলায় ময়দানে যিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদ হিসাবে টিকে থাকতে পারে।

১৪. পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা :

বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার। এজন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা দরকার। মহান আল্লাহ আদম (আঃ) থেকে আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূলকে পরীক্ষা করে মানব জাতির নেতা হিসাবে সম্মানিত করেছেন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) তাঁর জীবনে বহুমুখী পরীক্ষার সম্মুখীন হন। অতঃপর তিনি মানব জাতির নেতা হন। আল্লাহ বলেন, وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا ‘যখন ইবরাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বলেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। পরীক্ষাতেই পুরস্কার। তাই পরীক্ষিত কর্মীকে সামনে নিয়ে আসা এবং দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা একজন দূরদর্শী যোগ্য নেতার প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে নেতা ভুল করলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সংগঠনের গতি ব্যাহত হবে।

অতএব পরিশেষে আমরা বলব যে, নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডবাহী এদেশের একক যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর নেতা ও কর্মীদেরকে সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনে আন্তরিক হতে হবে। আধুনিক এই নব্য জাহেলী সমাজ পরিবর্তনে নিজেকে যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। কথা, কলম ও সংগঠন জিহাদের এই ত্রিমুখী হাতিয়ার নিয়ে সমাজ সংস্কারের কণ্টাকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন-আমীন!!

অধ্যাপক মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন

[লেখক : কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও