মানব সমাজে শিরক প্রসারের কারণ
ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 379 বার পঠিত
দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত উপ-মহাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে আরব বণিকদের মাধ্যমে, এসব এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আরব মুসলিমদের মাধ্যমে, খিলাফতে রাশিদার সময় হ’তে ক্রমাগত রাজনৈতিক অভিযান সমূহের মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে আগত ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈ বিদ্বানদের নিরন্তর দা‘ওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে। সেই হ’তে আজ পর্যন্ত উপমহাদেশে মুসলমানের বসবাস রয়েছে এবং বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও তাদের আকীদা ও আমলে এসেছে বহু পরিবর্তন, কুরআন ও সুন্নাহ্র স্বচ্ছ সলিলে ঘটেছে বহু মতের সংমিশ্রণ।
একথা অনস্বীকার্য যে, ছাহাবায়ে কেরামই ছিলেন ইসলামের বাস্তব নমুনা। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী তাঁদের সার্বিক জীবন পরিচালিত হ’ত। পরবর্তী যুগে সৃষ্ট মাযহাবী দলাদলি হ’তে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। উদ্ভূত কোন সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁরা কুরআন ও হাদীছ থেকে সিদ্ধান্ত তালাশ করতেন। না পেলে ছাহাবীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত (ইজমা) অনুসন্ধান করতেন। সেখানেও না পাওয়া গেলে কুরআন ও সুন্নাহ্র মূলনীতির আলোকে ‘ইজতিহাদ’ করতেন। পরবর্তীতে কোন ছহীহ হাদীছ অবগত হ’লে ইতিপূর্বেকার গৃহীত ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করতেন। কোনরূপ ব্যক্তিগত বা দলীয় যিদ ও অহমিকা তাঁদেরকে হাদীছের অনুসরণ হ’তে বিরত রাখতে পারতনা। তাঁরা ছিলেন সুন্নাতের হেফাযতকারী, হাদীছের প্রচারক ও নিরপেক্ষ অনুসারী। তাঁরা হাদীছের প্রচলিত ও প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করতেন। কোনরূপ দূরতম সম্ভাবনা ব্যক্ত করে ‘তাবীল’-এর আশ্রয় নিতেন না। মোটকথা জীবন সমস্যার সমাধান সরাসরি কুরআন ও হাদীছ হ’তে গ্রহণের ব্যাপারে তাঁরা সদা সচেষ্ট থাকতেন। আর এজন্য তাঁরা যথার্থভাবেই নিজেদেরকে ‘আহ্লুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করতেন এবং প্রথম শতাব্দী হিজরীর শেষার্ধে সৃষ্ট খারেজী, শী‘আ, মুর্জিয়া, জাব্রিয়া, ক্বাদারিয়া প্রভৃতি বিদ‘আতী ফের্কাসমূহ হ’তে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতেন। তাবে-তাবেঈগণও এই তরীকার অনুসারী ছিলেন। রাসূলুলাহ (ছাঃ)-এর বাণী এ ব্যাপারে স্মরণযোগ্য- ‘শ্রেষ্ঠ যুগ আমার যুগ, তারপর পরবর্তীদের, তারপর তাদের পরবর্তীদের...।’-ছাহাবীদের যুগ ১০০ বা ১১০ হিজরী, তাবেঈদের যুগ ১৮০, তাবে-তাবেঈদের যুগ ছিল ২২০ হিজরী পর্যন্ত।
একথা বলা চলে যে, ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের স্বর্ণযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের হাতে বিজিত এলাকা সমূহের মুসলিমগণ তাঁদের ন্যায় ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন। পরবর্তীতে বহু রাজনৈতিক চাপ ও উত্থান-পতন সত্ত্বেও পঞ্চম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর ও এলাকা সমূহে ‘আহলুল হাদীছ’ নামেই তাদের বসবাস যে উল্লেখযোগ্য হারে ছিল তা মাকদেসীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ও আবদুল কাহির বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯/১০৩৭ খৃঃ)-এর বক্তব্যে বিবৃত হয়েছে।
ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম ও তাঁদের অনুসারী মুহাদ্দিছ উলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমেই পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার ন্যায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ইসলাম প্রচারিত হয়। তাঁদের হাতে ইসলাম ছিল তার নিজস্ব রূপে দীপ্যমান। সেই সময়ে আরবীয় বণিকদের মাধ্যমে যে ইসলাম দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে ও ব্যবসা কেন্দ্রে প্রচারিত হয়, তাও ছিল নির্ভেজাল এবং ছাহাবা ও তাবেঈ বিদ্বানদের আদর্শপ্লুত। কুরআন ব্যতীত তাঁদের সম্মুখে আর কোন গ্রন্থ ছিল না। রাসূল ও ছাহাবীদের আদর্শ ব্যতীত তাঁদের নিকটে আর কোন আদর্শ ছিল না। তাঁদের মাধ্যমে এদেশে কুরআন ও হাদীছের প্রচার ও প্রসার ঘঠেছে। তাঁদের হাতেই ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়েছে। তাঁদের ব্যাপক দা‘ওয়াত ও তাবলীগের ফলে মাত্র ৭০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ৯৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম (৬৬-৯৬ হিঃ) যখন সিন্ধু আসেন, তখন মুসলিম জনগণের নিরাপত্তার জন্য কেবল মুলতানেই পঞ্চাশ হাযার সৈন্যের একটি বহর নিয়োগ করতে হয়। এতদ্ব্যতীত মানছূরা, আলোর প্রভৃতি শহরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী সামরিক কেন্দ্র ছিল। এইভাবে মানছূরা, মুলতান, সিন্দান, কুছদার (বেলুচিস্তান), কান্দাবীল প্রভৃতি স্থানগুলি কেবলমাত্র আরব বসতি কেন্দ্র ছিলনা বরং কুরআন ও হাদীছের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবেও মর্যাদাপূর্ণ ছিল।
প্রাসংগিকভাবে উল্লেখ্য যে, ইল্মে হাদীছের প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে আহলেহাদীছ আন্দোলন প্রত্যক্ষ বা সরাসরিভাবে যুক্ত। সেকারণে উপমহাদেশে হাদীছ চর্চার যুগগুলিকে আমরা আহলেহাদীছ আন্দোলনের যুগ হিসাবে চিহৃিত করতে পারি। এখানে উপমহাদেশকেই আমরা প্রধান ভূমিকায় রাখব। কারণ মুসলিম রাজনৈতিক উত্থান-পতন এখানেই সবচেয়ে বেশী হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের প্রচারকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আহলেহাদীছ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যদিও মুসলিম-অমুসলিম কোন কোন পন্ডিতের দৃষ্টিতে তারা ‘শাফেঈ’ বলে অভিহিত হয়েছেন। মাকদেসী (মৃঃ ৪২৯/১০৩৭), মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) ‘শাফেঈ’ মাযহাবকে ‘আহলেহাদীছ’ হিসাবে গণ্য করেছেন। এটি প্রযোজ্য হ’তে পারে যদি হাদীছের উপরে ‘রায়’-এর প্রাধান্য না থাকে।
তিনটি যুগ :
উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে আমরা তিনটি প্রধান যুগে চিহৃিত করতে পারি।
১. প্রাথমিক যুগঃ ২৩-৩৭৫/৬৪৪-৯৮৪ খৃঃ, (অন্যূন সাড়ে তিনশত বছর)।
২. অবক্ষয় যুগঃ ৩৭৫-১১১৪/৯৮৪-১৭০৩ খৃঃ, (অন্যূন ৭৩৯ বছর)।
৩. আধুনিক যুগঃ ১১১৪-১১৭৬/১৭০৩-১৭৬২) থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
৩৭৫ হিজরী থেকে অলিউল্লাহ যুগ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসর সময়কালকে আমরা উপমহাদেশীয় বিচারে ‘অবক্ষয় যুগ’ বলেছি। কারণ ‘গযনবী যুগে’ (৩৮৮-৪৪৩/৯৯৭-১০৩০ খৃঃ) ক্ষমতাহারা শী‘আদের গোপন দৌরাত্ম্য খুবই বেশী থাকায় সিন্ধুতে হাদীছ চর্চা ও আহলেহাদীছ আন্দোলন পুনরায় জোরদার হ’তে পারেনি। বাহমনী (৭৮০-৮৮৬/১৩৭৮-১৪৭২ খৃঃ) ও মুযাফ্ফরশাহী যুগে (৮৬৩-৯৮০/১৪৫৮-১৫৭২ খৃঃ) আহলেহাদীছ আন্দোলন কেবল দক্ষিণ ভারতেই জোরদার ছিল। কিন্তুু রাজধানী দিল্লী হ’তে বাংলাদেশ পর্যন্ত উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিশাল এলাকায় আহ্লুর রায়দের হুকুমত, সুবিধাভোগী আলেমদের চক্রান্ত ও ব্যাপক সামাজিক অনুদারতার ফলে আহলেহাদীছ আন্দেলন একেবারে নিবু নিবু পর্যায়ে চলে এসেছিল। অতঃপর আওরঙ্গযেব (১০৬৮-১১১৮/১৬৫৮-১৭০৭ খৃঃ)-এর পরবর্তী ভোগলিপ্সু শাসকদের আমলে দিল্লীর মাদরাসা রহীমিয়ার মাধ্যমে অলিউল্লাহ পরিবারের উত্থান আহলেহাদীছ আন্দোলনে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। শাহ ইসমাঈল (১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১খৃঃ)-এর জিহাদ আন্দোলনের সময়ে যা দ্রুতগতিতে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। মাদরাসা রহীমিয়ারই পরবর্তী বিহারী শিক্ষক শায়খুল কুল ফিল কুল মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর (১২২০-১৩২০/১৮০৫-১৯০২ খৃঃ) বিপুল ছাত্রবাহিনীর মাধ্যমেই প্রধানতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলন সর্বভারতীয় রূপ ধারণ করে এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও বিস্তার লাভ করে।
প্রাথমিক যুগ (২৩-৩৭৫ হিঃ/ ৬৪৪-৯৮৪ খৃঃ)
এই যুগের মহান নেতৃবৃন্দ ছিলেন ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও মুহাদ্দিছবৃন্দ। এই সময়ে হিন্দুস্থানে ১৮ জন মতান্তরে ২৫ জন ছাহাবীসহ উমাইয়া খেলাফতের শেষ (১৩২/৭৫০ খৃঃ) পর্যন্ত সর্বমোট ২৪৫ জন তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈর শুভাগমন ঘটে। তন্মধ্যে সর্বশেষ ছাহাবী ছিলেন সিনান বিন সালামাহ বিন মুহবিক আল-হুযালী। ইনি মক্কা বিজয়ের দিন জন্মগ্রহণ করেন এবং আল্লাহ্র নবী (ছাঃ) নিজে তার নাম রাখেন। আমীর মু‘আবিয়ার শাসনকালে (৪১-৬০ হিঃ) ৪২ ও ৪৮ হিজরীতে দু’দুবার তাঁকে হিন্দুস্থান বা সিন্ধু এলাকার গভর্ণর হিসাবে প্রেরণ করা হয়। তাঁর মৃত্যু ও মৃত্যুসন সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মতভেদ করেছেন। তবে বিভিন্ন তথ্য ও যুক্তির আলোকে ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক বলেন যে, তিনি ৫৩ হিজরী মোতাবেক ৬৭৩ খৃষ্টাব্দে বেলুচিস্তানের ‘খাযদার’ (خضدار) নামক স্থানে শাহাদত বরণ করেন।
ছাহাবা ও তাবেঈদের মাধ্যমে উপমহাদেশে ইল্মে হাদীছের বীজ বপিত হ’লেও হাদীছের প্রচার ও প্রসারে তাঁরা বিশেষ মনোযোগী হ’তে পারেননি। কারণ রাসূলের (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিমিত্ত ছাহাবা ও তাবেঈগণকেই সাধারণতঃ বিভিন্ন অভিযানে নেতৃত্বের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করা হ’ত। ফলে যুদ্ধের পরিবেশে ইল্মে হাদীছের প্রচার আশানুরূপ হয়নি। ২য়তঃ যুদ্ধাভিযান শেষে উপমহাদেশে তাঁদের অবস্থানকাল থাকত খুবই সংক্ষিপ্ত। ৩য়তঃ ইল্মে হাদীছের প্রচারের জন্য যে রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন ছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে অর্জিত হয়নি। তবুও ইসলামের সাবলীলতা এবং ছাহাবা ও তাবেঈ বিজ্ঞ জনের অনুপম চরিত্র মাধুর্যে উদ্ধুদ্ধ হ’য়ে এদেশের অগণিত মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরা ছাহাবা ও তাবেঈ বিদ্বানদের প্রভাবে শিরক ও বিদ‘আত থেকে মুক্ত ছিলেন বলে অনুমান করা যায়। এছাড়া মুহাম্মাদ বিন কাসিম (৬৬-৯৬ হিঃ) দেবল, মুলতান ও তৎসন্নিহিত এলাকাসমূহে মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে কয়েকটি শহর গড়ে তোলেন। গড়ে ওঠে বায়যা, মাহ্ফূযা, মানছূরা প্রভৃতি সমৃদ্ধ নগরীসমূহ। এসব এলাকায় মসজিদ সমূহ নির্মাণ করা হয়। নিয়োগ করা হয় পৃথকভাবে আমীর, খতীব ও কাযীবৃন্দ। মুসলমানগণ এইসব শহরে অত্যন্ত শান্তিতে ও নির্বিবাদে জীবন যাপন করতেন। আরব সেনাবাহিনীতে বিশেষভাবে এমন কিহর বিদ্বানকে পাঠানো হয়েছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৭৬-৯৬ হিঃ) যাদেরকে হিন্দুস্থান এলাকায় কুরআন-হাদীছ শিক্ষা দেওয়ার জন্যই নিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং কুরআন ওহাদীছের প্রচারে জীবন উৎসর্গ করেন। ফলে দেবাল, মুলতান, কুছদার (বেলুচিস্তান), লাহোর, মানছূরা (করাচী) প্রভৃতি শহরগুলি ইল্মে হাদীছের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারের জন্য আলিম ও মুহাদ্দিছ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। সেটি হ’ল, এইযুগে হিন্দুস্থান এলাকায় নিয়োজিত অধিকাংশ ওয়ালী ও কাযীগণ ছিলেন সততা, দ্বীনদারী এবং কুরআন ও হাদীছের ইল্মে সমৃদ্ধ উজ্জ্বল তারকাসদৃশ। তাঁদের প্রভাব ছিল প্রজাদের উপরে অসাধারণ। তাঁরা ছিলেন যুগের নমুনা ও সকলের জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যেমন উছমান গণী (রাঃ)-এর সময়ে (২৩-৩৫ হিঃ) সিন্ধু এলাকায় কাযী হুকাইম বিন জাবালাহ আবাদী, আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের যুগে (৬৫-৮৬) সাঈদ বিন আসলাম কিলাবী, মুজা‘আ বিন সি‘র, মুহাম্মাদ বিন হারূন বিন যিরা‘ আল-নুমাইরী প্রমুখ কাযীবৃন্দ যেমন একদিকে ছিলেন অনন্যসাধারণ বিচারকমন্ডলী, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন কুরআন ও হাদীছে পারদর্শী অতুলনীয় পন্ডিত। কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ন্যায়বিচারের ফলে মানুষ কুরআন ও হাদীছের আলোকে জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ হয়, আহলেহাদীছ আন্দোলনের যা প্রধান দাবী। প্রাদেশিক আমীরদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম (৬৬-৯৬) ছিলেন অনন্য গুণসম্পন্ন নেতা। তাঁর সময় থেকেই সিন্ধু ইসলামী খেলাফতের স্থায়ী প্রদেশের মর্যাদা পায়। খ্যাতনাম ছাহাবী আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর সম্ভাব্য শিষ্য তাবেঈ বিদ্বান তরুণ সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম ২৭ বৎসর বয়সে ৯৩ হিজরীতে সিন্ধু আগমন করেন এবং ৯৬ হিজরীতে উচ্চমহলের রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হ’য়ে নিহত হন। মাত্র তিন বছরের স্বল্পকালীন সময়ে সমগ্র বিজিত এলাকায় তিনি ইসলামী শাসনের এমন সুবাতাস বইয়ে দেন যে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মুগ্ধ প্রজাসাধারণ তাঁর বিয়োগ ব্যথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল এবং অমুসলিমগণ ভক্তি শ্রদ্ধায় তাঁর মূর্তি গড়েছিল। তাঁর সময়ে চতুর্দিকে ইল্মে হাদীছের চর্চা হ’তে থাকে। আরব জগত হ’তে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী উলামা ও মুহাদ্দেছীন সিন্ধুতে আগমণ করতে থাকেন। সিন্ধুর বহু ছাত্র আরব দেশে গিয়ে ইলমে হাদীছের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পান। ফলে এই যুগে বহু হিন্দী উলামা মুহাদ্দিছ-এর জন্ম হয়। এই যুগের (২৩-৩৭৫) উলামা ও মুহাদ্দেছীনকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১ম-ঐ সকল ভারতীয় বংশোদ্ভূত উলামা, যাঁরা আরব ভূমিতে জীবন কাটিয়েছেন ও মৃত্যুবরণ করেছেন। যেমন খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম মাক্হূল বিন আব্দুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ১১৩ হিঃ) মূলতঃ কাবুলের মানুষ। কিন্তু সিরিয়াতে জীবন কাটান ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। অনুরূপভাবে তাবেঈ ইমাম আবদুর রহমান সিন্ধী, মূসা সিলানী (সিংহলী), আব্দুর রহমান বিন আবী যায়েদ বেলমানী (সিন্ধু ও গুজরাটের মধ্যবর্তী স্থান), হারেছ বেলমানী, তাবে-তাবেঈ মুহাম্মাদ বিনুল হারেছ বেলমানী, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বেলমানী, আবদুর রহমান বিন আমর সিন্ধী ওরফে ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হিঃ), আবু মা‘শার নাজীহ বিন আবদুর রহমান সিন্ধী, ক্বায়েস বিন বুস্র বিন সিন্ধী, ইয়াযীদ বিন আব্দুল্লাহ সিন্ধী প্রমুখ তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণ’। ২য়ঃ ঐসকল মুহাদ্দিছ যাঁরা এদেশেই জীবন কাটিয়েছেন এবং ইল্মে হাদীছের প্রসার ঘটিয়েছেন।
নিম্নে আমরা এই যুগের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ হাদীছ বিশারদের নাম উল্লেখ করব, যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ায় ও ভারত বর্ষে ইল্মে হাদীছের প্রচারে ও আহলেহাদীছ আন্দোলন প্রসারে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন।
১ম যুগের (২৩-৩৭৫) কয়েকজন সেরা মুহাদ্দিছঃ
১-মূসা বিন ইয়াকূব ছাক্বাফী :
আরবের ছাক্বাফী গোত্রের মশহুর মুহাদ্দিছ মূসা বিন ইয়াকূব ছাক্বাফীকে মুহাম্মাদ বিন কাসিম (৬৬-৯৬ হিঃ) আলোরের কাযী নিযুক্ত করেন। একই সাথে তাঁকে জুম‘আর খুৎবা প্রদান ও ধর্মীয় বিষয়ক কার্যাবলীর দায়িত্বভার এবং বিশেষভাবে জনগণের নৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি একনিষ্ঠভাবে সুন্নাতের পাবন্দ ছিলেন। তাঁর পরিবারে কুরআন ও হাদীছের চর্চা খুব বেশী ছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই বংশানুক্রমে আলোরের কাযীর পদ অলংকৃত ছিল। তিনি স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাস করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও বহুদিন পর্যন্ত তাঁর পরিবার ইল্মে হাদীছে এত প্রসিদ্ধ ছিল যে, ৬১৩ হিঃ/১২১৬ খৃষ্টাব্দেও এই পরিবারের অন্যতম বিখ্যাত পন্ডিত ইসমাঈল বিন আলী ছাক্বাফী সিন্ধী সমসাময়িক যুগে ইল্ম ও তাক্ওয়া এবং ভাষা ও সাহিত্যে অদ্বিতীয় হিসাবে গণ্য হতেন। তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর মধ্যভাগে তাঁর ঊর্ধতন কোন একজন পিতামহ ‘মিনহাজুদ্দীন’ নামে সিন্ধুতে মুসলিম বিজয়ের যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন, তার কিয়দংশ পরবর্তীকালে পাওয়া যায়। আলী বিন হামিদ কূফী তা সংকলন করেন। অতঃপর সেখানে থেকে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় পর্যন্ত ইতিহাস ফারসী ভাষায় ‘ফতহনামা’ বা ‘চাচনামা’ নামে ৬১৩ হিজরীতে প্রকাশিত হয়।
২-ইসরাঈল বিন মূসা বাছ্রী (মৃঃ ১৫৫/৭৭১ খৃঃ) :
ইনি মূলতঃ বছরার অধিবাসী হ’লেও সিন্ধুতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এজন্য তাঁকে ‘নাযীলুল হিন্দ’ বলা হয়। তিনি তাবে-তাবেঈ ছিলেন। তিনি হাদীছের একজন বিশ্বস্ত রাবী ছিলেন। ছহীহ বুখারীতে চার জায়গায় তাঁর বর্ণিত হাদীছ স্থান পেয়েছে। তিনি হাসান বাছরী (২১-১১০ হিঃ), আবু হাযেম আশজা‘ঈ (মৃঃ ১১৫ হিঃ), মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ), ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ (৩৪-১১৪) হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেন। তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন সুফিয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১), সুফিয়ান বিন উয়ায়না (১০৭-১৯৮), হুসাইন বিন আলী জু‘ফী (মৃঃ ২০৫), ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্ত্বান (১২০-১৯৮) প্রমুখ হাদীছশাস্ত্রের যুগশ্রষ্ঠা দিকপালগণ। এইসব মহা মনীষীদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হওয়াটাই হাদীছ বিশারদ হিসাবে তাঁর জন্য সর্বাপেক্ষা বড় গর্বের বিষয়। সুনানের কিতাব সমূহেও তাঁর বর্ণিত হাদীছসমূহ রয়েছে।
৩-আমর বিন মুসলিম বাহেলী (মৃঃ ১২৩/৭৪০ খৃঃ) :
ট্রান্স অক্রিয়ানার দিগ্বিজয়ী সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিমের ভাই আমর বিন মুসলিম খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয (৯৯-১০১/৭১৭-৭১৯ খৃঃ)-এর গবর্ণর হিসাবে সিন্ধুতে আগমন করেন। তাঁরই গবর্ণর থাকাকালীন সময়ে খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে দাহিরপুত্র জীসাহ সহ হিন্দুস্থানের কয়েকজন রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সময় খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয ইসলামী খেলাফতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদীছ সংকলনের নির্দেশ জারী করেন। তিনি তাঁর ফরমানে স্পষ্ট করে বলে দেন যে, আহলুস্সুন্নাহ বা হাদীছপন্থীদের কাছ থেকেই কেবল হাদীছ গ্রহণ করতে হবে, বিদ‘আত পন্থীদের কাছ থেকে নয়।’ খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয়ের সিন্ধুর প্রদেশিক আমীর আমর বিন মুসলিম আল-বাহেলী (মৃঃ ১২৩/৭৪০ খৃঃ) হাদীছপন্থী ছিলেন বলে ধারণা করা যায়। সিন্ধু এলাকায় ইল্মে হাদীছের প্রচার ও প্রসারে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ইয়ালা বিন ওবায়েদ হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং তার থেকে আবু তাহের হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীছ নাসাঈ ও আবুদাঊদে স্থান পেয়েছে।
৪-রবী‘ বিন হরবাইহ সা‘দী আল-বাছরী (মৃঃ ১৬০/৭৭৬ খৃঃ)
আববাসীয় খলীফা মাহ্দী-এর সময়ে (১৫৮-১৬৯/৭৭৪-৭৮৫ খৃঃ) সেনাপতি আবদুল মালিক বিন শিহাব মাসমাঈর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে যে নৌ-অভিযান প্রেরিত হয়, রবী‘ সেই সঙ্গে ভারতে আসেন। উক্ত বাহিনী দক্ষিণ ভারতের ভ্রুচ বন্দরের নিকটবর্তী ‘ভারভাট’ নামক সমৃদ্ধিশালী বন্দরনগরী জয় করে। কিন্তু এই সময় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক মহামারী ছড়িয়ে পড়লে দেশে ফেরার পথে আক্রান্ত হয়ে রবী‘ বিন হরবাইহ পথিমধ্যে ইন্তেকাল করেন। ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপে তাঁকে দাফন করা হয়। রবী‘ বিন হরবাইহ হাসান বাছরীর (২১-১১০ হিঃ) শিষ্য ছিলেন। তাঁর নিকট থেকে হাদীছ শোনা ছাড়াও তিনি হামীদ আত্-ত্বাবীল (মৃঃ ১৪২ হিঃ), ছাবিত আল-বুনানী (৪১-১২৭), মুজাহিদ বিন জাব্র (২১-১০৩) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ হাদীছজ্ঞ বিদ্বানগণের নিকট থেকেও হাদীছ শ্রবণ করেন। সমসাময়িক কালের রাবীদের মধ্যে তাঁর মর্যাদা এত উচ্চে ছিল যে, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (১১৮-১৮১), সুফিয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১), ওয়াকী (১২৯-১৯৮) ইমাম আবুদাঊদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৩), আব্দুর রহমান বিন মাহদী (১৩৫-১৯৮) প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত হাদীছবিশারদ পন্ডিতগণ সকলেই তাঁর ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে হাদীছ বর্ণনা করতেন। এতদ্ব্যতীত তিনি হাদীছশাস্ত্রের সেই ঝান্ডাবাহীদের অন্যতম ছিলেন, যারা দ্বিতীয় শতাব্দী হিজরীতে হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেউ কেউ তাঁকে ‘তাবেঈ’ হিসাবে গণ্য করেছেন।
[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গৃহীত]।
{আজ থেকে বহু বহু বছর পূর্বে মক্কা নগরীতে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আঃ) সর্বপ্রথম মনুষ্য জনপদ গড়ে তুলেছিলেন। সেই থেকে মক্কা হয়ে উঠে বিশ্বের ঈমানদার মানুষদের জন্য এক দুর্নিবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। হাযার হাযার বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ্র আবেগ-অনুভূতির সাথে একাকার হয়ে সগৌরবে দন্ডায়মান রয়েছে বায়তুল্লাহ কা‘বা মুশাররাফাহ। উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার উপর হজ্জ ফরয হয়েছিল ৯ম হিজরীতে। এতদিনে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ১৪২৪টি বছর। কিন্তু মক্কার প্রতি মুসলিম উম্মাহ্র সেই আবেগের জোয়ারে কখনই ভাটার টান পড়েনি। বরং তার প্রবল ঘূর্ণিস্রোতে প্লাবিত হয়ে পুণ্যভূমি মক্কা আজও মুসলিম উম্মাহ্র জন্য বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে সততঃ বিকাশমান। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজীর পদভারে প্রকম্পিত হয় বায়তুল্লাহ শরীফ। যে আকর্ষণকে কেন্দ্র করে এই মক্কা মুকাররামাহ এবং আজকের সঊদী আরবের বিখ্যাত হয়ে উঠা-সেই কা‘বা ও মসজিদুল হারামের ইতিহাস নিয়েই এবারের বিশেষ নিবন্ধটি- নির্বাহী সম্পাদক।}