প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 594 বার পঠিত

 [‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে’র এই সৃনতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর পক্ষ থেকে মুযাফ্ফর বিন মুহসিননূরুল ইসলাম]   

আমীরে জামা‘আত : ০৩.০১.১৯৮৯ইং সকালের ফ্লাইটে আমি লাহোর থেকে দিল্লী আসি। সম্ভবতঃ আধা ঘণ্টা সময়ও লাগেনি। এক দেশ থেকে আরেক দেশের রাজধানীতে এত স্বল্প সময়ে এসে পড়ব ভাবতে পারিনি। একাকী সফরে এয়ারপোর্টে লাগেজ টানা যে কত বিড়ম্বনা, ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন। তার ওপর আমার হ’ল বইয়ের বোঝা। বিশাল দিল্লী শহর। অজানা ঠিকানা ৪১১৬ উর্দূ বাজার জামে মসজিদ দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ট্যাক্সি নিয়ে অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ একাকী মুসাফির। ড্রাইভারকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে, আমি একজন বাঙ্গালী এবং নবাগত। কেননা তাতে সে সুযোগ নিতে পারে। পুঁজি কয়েকটা ডলার ও ক্যামেরা নিয়ে নিলেই আমি শেষ। খাতির জমিয়ে ফেললাম। রাস্তায় দু’পাশে আমার নযর। বেরসিক ভারত সরকারের হুকুমে সাইন বোর্ডগুলো লেখা হয়েছে সব হিন্দী ভাষায়। হিন্দী আমি পড়তে পারি না। আমার নযর উর্দূ ও ইংরেজীর দিকে। মাঝে-মাঝে ভয় হচ্ছে। এত সময় লাগছে কেন? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে ভাববে আমি চিনি না। তাই মুখে যতই চোটপাট, ভিতরে ততই ভয়। পথিমধ্যে নযর পড়ল ‘ছদর বাজার রোড’। পরিষ্কার উর্দূ ভাষায় লেখা। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অফিসের সামনে গলিপথের দু’পাশে কেবলই বইয়ের দোকান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা, তা দেখলেই বুঝা যায়। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করলাম। ঘড়িটা ভারতের টাইমের সাথে মিলিয়ে নিলাম। হিসাব করে দেখলাম লাহোর থেকে দিল্লী আসতে যা সময় লেগেছে, দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লী আসতে তার চেয়ে প্রায় চারগুণ সময় লেগেছে। মোগলদের সময় লাহোর-দিল্লী একই দেশভুক্ত ছিল। কাছাকাছি দু’টি শহর হলেও রাষ্ট্র বিভক্তির কারণে এখন বহু দূর মনে হয়। বইয়ের বোঝা এক দোকানদারের যিম্মায় রেখে আমি ভিতরে চলে গেলাম ও অফিস খুঁজে বের করলাম। অফিস সম্পাদককে নিজের পরিচয় ও আগমনের উদ্দেশ্য বললে তিনি খুব খুশী হলেন। সঙ্গে সঙ্গে সহ-সম্পাদক আমানুল্লাহকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিলেন। সাথে আরও দু’জন। অতঃপর বইয়ের লাগেজ নিয়ে অফিসে এলাম। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। গোসল-নাশতা সেরে জমঈয়ত অফিসে গেলাম। বইয়ের তালিকা নিলাম। পসন্দমত বই কিনলাম। সম্ভবতঃ মূল্য পড়ল ৯২৩/= রূপী। এছাড়াও কিছু পেলাম হাদিয়া। হয়ে গেল আরেকটি বড় বোঝা। এটা হ’ল ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীছ হিন্দ’-এর কেন্দ্রীয় অফিস। নাম ‘আহলেহাদীছ মনযিল’। পাক্ষিক মুখপত্রের নাম ‘তর্জুমান’। সারা দেশ থেকে দৈনিক বহু আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা ও সুধীজনেরা এখানে আসেন। এতে আমার থিসিসের তথ্য সংগ্রহের বড় সুযোগ হয়ে গেল। একদিন পেয়ে গেলাম জমঈয়তের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী আব্দুল ওয়াহহাব খালজীকে। তার কাছ থেকে সারা ভারতের আহলেহাদীছদের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী চাইলাম। তিনি ৫.৭.১৯৮৯ইং তারিখে স্বাক্ষরিত পত্রে বিস্তারিত আমার ঠিকানায় রাজশাহী পাঠিয়ে দিলেন। একদিন পেলাম আব্দুল হক সুল্লামীকে। ইনি কেরালার ‘সালাফী সমাজকল্যাণ সংস্থা’র সেক্রেটারী। তার কাছে কেরালায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের তথ্যাবলী চাইলাম। তিনি ১৪.৫.১৯৮৯ইং তারিখে স্বাক্ষরিত পত্রে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন। আহলেহাদীছ মনযিল-এর দোতলায় পূর্বপাশের একটি কক্ষে হরিয়ানার খ্যাতনামা আলেম হাকীম আজমল খাঁকে পেলাম। উনি ওখানে বসে উর্দূ ভাষায় মাসিক ‘মাজাল্লা আহলেহাদীছ’ পত্রিকা চালান। আমি আগে থেকেই তার পাঠক। জানতাম না যে, উনি এখানে থাকেন। প্রতিভাবান বর্ষিয়ান আলেম। নীরবে কাজ করে চলেছেন। তাঁর লেখনী গবেষণাধর্মী এবং উচ্চ মানের। জমঈয়ত মুখপত্র ‘তর্জুমানে’র চাইতে অনেক উন্নত। দু’জনের সাক্ষাৎকার খুবই ফলপ্রসু হ’ল। অনেক বিষয়ে আমার জানা হ’ল। লাহোরে ইসহাক ভাট্টি এবং এখানে  ইনি আমাকে আহলেহাদীছ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিক সম্পর্কে ধারণা অনেকটা স্পষ্ট করে দেন। জামায়াতে ইসলামী ও তাবলীগ জামা‘আতের ফিৎনা সম্পর্কে হাকীম খানের জ্ঞান অনেক বেশী।

জমঈয়ত অফিস থেকে তর্জুমানের সহ-সম্পাদক আমানুল্লাহকে নিয়ে এবার দিল্লী শহরের আহলেহাদীছ মাদরাসা ও মারকাযগুলি পরিদর্শনে বের হলাম। সঙ্গে ডায়েরী, ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার। উদ্দেশ্য, নেতাদের কাছ থেকে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আমার থিসিসের উপাত্ত লেখা ও স্বাক্ষর নেওয়া। আর ব্যস্ত নেতাদের বক্তব্য টেপ করা এবং প্রয়োজনীয় ছবিসমূহ ক্যামেরাবন্দী করা। প্রথমেই গেলাম ঐতিহাসিক দিল্লী জামে মসজিদে ছালাত আদায় করতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বারবার মনে পড়ছিল সেই ৯ জন আহলেহাদীছের কথা, যারা নিঃসঙ্গ শাহ অলিউল্লাহ দেহলবীকে বাঁচানোর জন্য সিঁড়িতে সারিবদ্ধভাবে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গুন্ডাদের সামনে বুক পেতে সর্বশক্তি দিয়ে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়েছিল। আর তাতেই গুন্ডাদের হাতের তরবারি পড়ে গিয়েছিল। নিঃশব্দ বিস্ময়ে হতবাক গুন্ডাদের সামনে দিয়ে সেদিন শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী মাত্র এই ক’জন আহলেহাদীছ সাথীকে নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যান সিঁড়ি বেয়ে। বাকী সব মুছল্লী তাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তার অপরাধ ছিল একটাই যে, তিনি কুরআনের ফার্সী তরজমা করেছিলেন। বিরোধী আলেমরা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, তিনি কুরআনের পরিবর্তন করেছেন। মনে পড়ে গেল সেই দু’শো নিরস্ত্র আহলেহাদীছের কথা। যেদিন ইংরেজ ও শিখেরা মিলে মসজিদটিকে উড়িয়ে দেবার জন্য কামান তাক করেছিল। আর সব মুছল্লী পালিয়ে গেলেও এই দু’শ জন আহলেহাদীছ শুয়ে পড়েছিল মসজিদের সিঁড়িতে আর কেঁদে কেঁদে বলেছিল, হে আল্লাহ! আমরা মযলূম। তুমি তোমার মসজিদকে রক্ষা কর। এই মসজিদের সাথেই আমাদের জীবন। মসজিদ শহীদ হয়ে গেলে আমরাও শহীদ হব, কিন্তু তোমার আশ্রয় ছেড়ে আর কোথাও যাব না। আল্লাহ তাদের দো‘আ কবুল করেছিলেন। শত চেষ্টায়ও কামানের গোলা সেদিন ফুটেনি। মনে পড়ে গেল ১৩ বছরের সেই তরুণ বালকটির কথা, এই জামে মসজিদে জামা‘আত চলাকালে সরবে ‘আমীন’ বলার অপরাধে (?) তাকে আলেমরা ধরে নিয়ে যায় বিচারের জন্য ভারতগুরুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আব্দুল আযীযের কাছে। তিনি আলেমদের ধমক দিয়ে বলেন, তোমরা কি হাদীছ পড়োনি? পরে সবাই জানল, ঐ ছেলেটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ভারত গুরু পৌত্র শাহ ইসমাঈল বিন আব্দুল গণী। মনে পড়ে গেল সেই ঘটনা, যখন এই মসজিদে ছালাত আদায় করতে গিয়ে সরবে ‘আমীন’ ও রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করে ধরা পড়ে যান আল্লামা ফাখের যায়ের এলাহাবাদী। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শাহ অলিউল্লাহ দেহলভীর কাছে। শাহ ছাহেব ঐসব আলেমদের বুঝিয়ে বিদায় করেন। অতঃপর আল্লামা ফাখের তাঁকে বলেন, অলিউল্লাহ! কতদিন আপনি এভাবে লুকিয়ে থাকবেন? অলিউল্লাহ বললেন, ফাখের! যদি নিজেকে লুকিয়ে না রাখতাম, তাহলে এইসব গুন্ডা আলেমদের হাত থেকে আজ আপনাকে বাঁচাতো কে?

হাঁ, ইতিমধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম উপরে মসজিদের মূল আঙ্গিনায়। প্রবেশ করলাম ভিতরে। প্রাণভরে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করলাম ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। দো‘আ করলাম, হে আল্লাহ! এই মসজিদকে তুমি চিরদিন বাঁচিয়ে রাখো। বের হবার আগে চারপাশ ঘুরে দেখলাম। অতঃপর পূর্ব গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার গেলাম ‘মাদরাসা রহমানিয়া’ দেখতে। আমাদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ আফতাব আহমাদ রহমানী, উস্তাদ মাওলানা হাবীবুল্লাহ খান রহমানী, আহমাদুল্লাহ রহমানী, শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুন্তাছির আহমাদ রহমানী প্রমুখ আলেমগণ যে মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়েছেন, এমনকি এখানে শিক্ষকতাও করেছেন, সেখানে যাওয়ার আগ্রহ আমার সবচেয়ে বেশী। যেয়ে দেখলাম বিল্ডিং আছে। কিন্তু নাম পরিবর্তন হয়েছে ‘রিয়াযুল উলূম’। আতাউর রহমানরা দুই ভাই মিলে ‘মাদরাসা রহমানিয়া’ চালাতেন। তাঁদের মৃত্যুর পরে কমিটি পরিবর্তন হয়েছে। ফলে কেবল নামই পরিবর্তন হয়নি, নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে সুনামও হারিয়ে গেছে। সে যুগের পরিচ্ছন্ন দিল্লী এ যুগে এক ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে। তাই মাদরাসার চেহারা দেখে মনটা বিগড়ে গেল। তবুও পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঢুকে পড়লাম। শিক্ষক কাউকে পেলাম না। তবে ছাত্রদের সঙ্গে বসলাম ও অনেক কথা জানলাম। এখানে সাতক্ষীরার সোনাবাড়িয়ার আবুল হাসানকে পেলাম। রাজশাহী রাণীবাজারের ছাত্র জামালপুরের হাড়গিলার আবু সাঈদের সাথেও এখানে দেখা হ’ল। সে চমৎকার একটা তথ্য দিল যে, স্যার! দিল্লীতে সব পাগলের বাস। আমার মত একটা পাগলকে এরা বড় হুযূর বলে। চারদিক থেকে লোক আসে আমার কাছ থেকে পানি পড়া ও তাবীয নেবার জন্য। আবার গাড়ীতে করে আমাকে নিয়ে যায়। আর পকেট ভরে টাকা দেয়। বললাম, তোমরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে বুঝিয়ে বললেই তো পার। বলল, স্যার! তাহ’লে দিল্লীর মত শহরে চলব কি করে? মুচকি হেসে বললাম, আল্লাহ সকলের রূযির মালিক। পরে ৮.১.৮৯ইং দিল্লী থেকে বেনারস যাবার দিন ট্রেনে ওঠার সময় কিতাবের ভারি বোঝা ঘাড়ে করে নিয়ে সে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা দান করুন! সম্ভবতঃ সে এখন সাভারে একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করে। আর আবুল হাসান বর্তমানে আমাদের দারুল হাদীছ আহমাদিয়াহ সালাফিইয়াহ (বাঁকাল, সাতক্ষীরা)-এর শিক্ষক।

অতঃপর সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মাওলানা আব্দুল হামীদ রহমানী প্রতিষ্ঠিত ‘মারকায আবুল কালাম আযাদ’ (৪, জোগাবাঈ, নয়াদিল্লী-২৫) দেখতে। বছরের অধিকাংশ সময় বিদেশ সফরে থাকা মানুষটিকে ভাগ্যক্রমে ঐদিন পেয়ে গেলাম। এর আগে ১৯৮৫-তে ঢাকার জমঈয়ত কনফারেন্সে হোটেল শেরাটনে বসে তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপের সুযোগ হয়েছিল। সেই সুবাদে তিনি আমাকে খুব সমাদর করলেন। আমার থিসিসের বিষয়বস্ত্ত শুনে খুবই প্রীত হলেন। অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে একটা কক্ষে আমাকে নিয়ে বসলেন। তাঁর ব্যস্ততা বুঝে বললাম আমি আপনাকে প্রশ্ন করি। আপনি জবাব দিন। সেগুলি আমি টেপ করে নিই। তাতে উনি খুব খুশী হলেন। অতঃপর তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করে নিলাম। পরে ওনার প্রতিষ্ঠান সব ঘুরে ঘুরে দেখালেন। মাসিক ‘আত-তাওঈয়াহ’ পত্রিকা দিলেন এবং আমার নামে ফ্রি জারি করে দিলেন। পরে গ্রাহক সংগ্রহের জন্য ওনার একজন প্রতিনিধি ইয়ার মুহাম্মাদ বাংলাদেশে আসেন এবং আমার সাথে সাতক্ষীরা সফর করেন। ১৯৯৩ সালের ২৭-৩১ শে আগষ্টে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ১ম এশীয় ইসলামিক কনফারেন্স থেকে আমরা একই ফ্লাইটে দিল্লী ফিরি এবং তাঁর বাড়ীতে মেহমান হিসাবে থাকি। অতঃপর একই দিনে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসা ওছমান বিন আফফান’ দেখতে যাই। যা ৯নং যমুনা সেতুর নিকটবর্তী ১০০ বিঘা জমির উপর অবস্থিত (২০ শতকে বিঘা)। এখানে ভবিষ্যতে জামে‘আ (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করা হবে শুনলাম।

পরদিন আমানুল্লাহকে নিয়ে হামদর্দ-এর হেড অফিস ও প্রধান কারখানা, যা নাকি ৬০ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত, সেখানে গেলাম। সেখানে বড় লাইব্রেরী আছে শুনলাম। কিন্তু তেমন কিছু পেলাম না। পরদিন ৬.১.৮৯ইং শাহ অলিউল্লাহ দেহলভীর মাদরাসায় গেলাম। যা এখন জামে‘আ রহীমিয়াহ নামে পরিচিত। লাইব্রেরী আছে। তবে পাওয়ার মত কিছু নেই। পাশেই মসজিদ ও তাঁর পারিবারিক গোরস্থান। তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কবরের সামনে পাথরে খোদাই করা নেমপ্লেট। যেয়ারত করলাম। সবার কবর আছে। নেই কেবল মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর কবর। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই মনীষী বেঁচে আছেন উপমহাদেশের কোটি কোটি মুমিনের হৃদয়ের মণিকোঠায় অতীব সম্মানে, অতুলনীয় শ্রদ্ধায়।

সেখান থেকে গেলাম পরবর্তীতে অলিউল্লাহর মসনদে আসীন মিয়াঁ নযীর হুসায়েন দেহলভী (রহঃ)-এর মাদরাসায়। যা ছদর বাযারের ফাটক হাবাশ খাঁ-তে অবস্থিত। এখানে গিয়ে স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। কেননা এখানে বসেই ইলম ও আমলের শতায়ু মহীরুহ দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে দ্বীনের তা‘লীম দিয়েছেন। প্রায় সোয়া লক্ষ ছাত্রের সেই বিশ্বখ্যাত শিক্ষক আজ নেই। বিশ্বব্যাপী আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিস্তৃতিতে যাঁর কোন তুলনা নেই, সেই মহান শিক্ষকের শিক্ষালয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ শিক্ষক নেই। আছে কেবল তাঁর স্মৃতি। বিদ‘আতী আলেমরা তাকে দাওয়াত দিয়ে বিষ মাখানো রান্না গোশত খাইয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে মক্কার শাসককে ভুল বুঝিয়ে হজ্জের মৌসুমে তাঁকে গ্রেফতার করিয়েছিল। সেখানেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ইংরেজ সরকারকে দিয়ে রাওয়ালপিন্ডির কারাগারে একবছর বন্দী রাখতে সমর্থ হয়েছিল। তাতেও তাদের মনের ঝাল মেটেনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসাভরা কবিতা লিখে সারা দিল্লীতে লিফলেট ছড়িয়ে ছিল। সেদিন তিনি হাসতে হাসতে ভক্তদের বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে কিছু দিয়েছে, নেয়নিতো কিছু’। হাঁ এখানে বসেই তিনি ফৎওয়া দিতেন। যা এখন বিরাট খন্ডাকারে ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বসেই শিক্ষাগ্রহণ করেছেন উপমহাদেশের ইলমী জগতের দিকপাল আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, শামসুল হক আযীমাবাদী, আব্দুল আযীয রহীমাবাদী, আব্দুল্লাহ গাযীপুরী, মুহাম্মাদ হুসায়েন বাটালভী, আব্দুল্লাহ গযনভী, ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটি, মুহাম্মাদ শাহজাহানপুরী, ওয়াহীদুযযামান লাক্ষ্ণৌবী প্রমুখ বিদ্বানগণ। তাঁর মাদরাসা ও মসজিদ জাঁকজমকপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু লাইব্রেরী কোথায়?

এরপর গেলাম মিয়াঁ ছাহেবের বিখ্যাত ছাত্র ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছে’র প্রতিষ্ঠাতা আমীর মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব দেহলভীর মাদরাসা, মসজিদ ও পাক্ষিক ‘ছহীফায়ে আহলেহাদীছ’-এর অফিস দেখতে। বেশ বড়সড় ভৌতকাঠামো। কিন্তু অন্যগুলির মত এখানেও জ্বরাগ্রস্ত অবস্থা। মূল নেতার অবর্তমানে সবই যেন বেহাল দশা। এই মাদরাসা ১৩০০ হিঃ/১৮৮২ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত।

পরদিন জমঈয়ত অফিসে প্রায় সারা দিন নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম। তার পরের দিন সকালে আমানুল্লাহকে নিয়ে চললাম যমুনা পারে। উদ্দেশ্য ঐ স্থানটি দেখা, যেখানে শাহ ইসমাঈল (রহঃ) প্রচন্ড শীতের দিনে ফজর বাদ যমুনায় নেমে সাঁতার কাটতেন আর ছাত্ররা কিতাব নিয়ে নদীর পারে বসে থাকত। তারা পড়ত। আর তিনি সাঁতরে কিছুক্ষণ পাঠদান শেষে আবার সাঁতার কাটতেন। তারপর ফিরে এলাম শহরে এবং যোহরের ছালাত পড়তে গেলাম সম্রাট আকবরের স্মৃতি ধন্য ফতেহপুর সিক্রি জামে মসজিদ। উদ্দেশ্য এর বিশাল খোলা চত্বর দেখা। যার উপরে ভর দুপুরের প্রচন্ড দাবদাহে স্ফূলিঙ্গ সদৃশ পাথরের উপরে আল্লামা ইসমাঈল খালি পায়ে হাটতেন ধীরগতিতে। এই অবস্থায় একা পেয়ে একদিন বিদ‘আতী আলেমদের পাঠানো মুছল্লীবেশী এক গুন্ডা ছোরা হাতে তাকে খুন করতে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেই ক্ষমা চেয়ে বিদায় হয়। ছাত্ররা তাকে এত কষ্ট করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, দেখ সমাজ সংস্কারের যে কঠিন আন্দোলনে আমরা নেমেছি, তাতে জীবনে কখন কোন অবস্থায় পড়তে হবে, তার ঠিক নেই। তাই শরীরকে সকল অবস্থায় খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্ত্তত করে নিচ্ছি। হাঁ, পরবর্তীতে তিনি জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং বালাকোট যুদ্ধে ইংরেজ ও শিখবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এখানেও ভূমিকা ছিল মুসলমান নামধারী কিছু মুনাফিকের। যারা তার লাশটা পর্যন্ত কবর না দিয়ে টুকরা টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

দিল্লীতে কাজ শেষ করে ৮.১.৮৯ইং তারিখে ট্রেন যোগে উত্তর প্রদেশের বানারস রওয়ানা হলাম। ভারতীয় ট্রেন বাংলাদেশের চাইতে অপ্রশস্ত। মনে হল ন্যারো গেজ লাইন। ভিতর দিয়ে চলাফেরা খুবই সমস্যা। তার উপরে বাহির থেকে বগি চেনা যায় না। ফলে আমি তড়িঘড়ি করে একটা বগিতে উঠে পড়ি। আমার সীট কয়েক বগি পরে। কিন্তু কিতাবের বোঝা নিয়ে কিভাবে যাব? শেষে একজন যাত্রী দয়াপরবশ হয়ে সীট ছেড়ে আমার সীটে চলে গেলেন। বানারস পৌঁছলাম। মনীরুদ্দীন (কিষাণগঞ্জ) ও বেলাল হোসায়েন (রসূলপুর, নওগাঁ) স্টেশনে আসার কথা। কিন্তু কাউকে পেলাম না। অবশেষে কুলি নিলাম। গেইট পাস করার সময় পুলিশে আটকালো। বুঝলাম মতলব খারাব। মাথায় খুন চেপে গেল। বুদ্ধি করে ইংরেজীতে কড়া ধমক দিলাম। সে ভয় পেয়ে ক্ষমা চাইল। ভাবল আমি রড় কোন রাজনৈতিক নেতা বা অফিসার হব। বাইরে গিয়ে ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে মাদরাসায় চলে গেলাম। ওরা দু’জন আমার পিছে পিছে এসে পৌঁছল এবং আমাকে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। এই মাদরাসা হ’ল ভারতে আহলেহাদীছদের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলূম আস-সালাফিইয়াহ’ (প্রতিষ্ঠা : ১৩৮৩ হিঃ/১৯৬৩ খৃঃ)। পাশেই হিন্দু ইউনিভাসিটি। অন্য পাশে হিন্দুদের তীর্থভূমি গয়া-কাশি। সেখানেও একটা মসজিদ এবং নিয়মিত ছালাত হয়। সামনে ইউনিভার্সিটির প্রাচীর ঘেঁষে শত শত মূর্তি খাড়া করা। বিক্রির জন্য। হতভাগারা এগুলো কিনে সেখানে ফুল দিবে। শ্রদ্ধা দেখাবে। মনের কামনা পেশ করবে। মানুষ যে কতবড় মূর্খ হয়, স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

মাদরাসার প্রধান ফটক পেরিয়ে ভিতরে গেলাম। শায়খুল জামে‘আহর সাথে সাক্ষাৎ হল। ভাল মানুষ। থাকা-খাওয়া ব্যবস্থা হয়ে গেল। রঈসুল জামে‘আহ ডঃ মুকতাদা হাসান আযহারীর সঙ্গে পরদিন দেখা হ’ল। তিনি অবাধে লাইব্রেরী ওয়ার্ক করার ও বই ফটো করার অনুমতি দিলেন। অনেক দুর্লভ বই পেলাম। জীর্ণ-শীর্ণ এসব বই ফটো করা মুশকিল। তবুও লাইব্রেরী সহকারী যুবকটি খুবই আন্তরিকতার সাথে বাহির থেকে ফটো করে এনে দিল। নওয়াব ছাহেবের অনেক বই যা একেবারেই দুর্লভ। সেগুলি নিতে পেরে স্বস্তিবোধ করলাম। পরদিন জুম‘আ ছিল। খুশী হ’লাম এই ভেবে যে, ভারতের নামকরা প্রতিষ্ঠানে আজ জুম‘আ পড়ব ও খুৎবা শুনব। কিন্তু হতাশ হ’লাম। চার পাশে বিল্ডিংভরা ছাত্র-শিক্ষক। তার মাঝেই মসজিদে খুৎবা হচ্ছে ওজস্বিনী ভাষায়। অথচ মুছল্লী নেই। আমাকে দিয়ে গড়ে ১০/১২ জন মুছল্লী। বাকীরা জামা‘আত দাঁড়ানোর পর আসল। আমার সহ্য হলো না। সরাসরি শায়খুল জামে‘আহকে ধরে বসলাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন।

এবার মুনীরকে নিয়ে গেলাম পাশেই বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। উদ্দেশ্য লাইব্রেরী। গোল বাধল গেটে গিয়ে। বিশাল উঁচু স্বরস্বতীর মূর্তি। মেইন গেইটের দু’পাশে দুই খাম্বার উপরে দেবীর দুই পা। দুই পায়ের নীচ দিয়ে যেতে হবে। আমি রিকশা থামিয়ে নেমে গেলাম। মুনীরকে বললাম, অন্য কোন গেইট আছে কি-না। নযর পড়ল, পাশের ছোট সাইড গেইটের দিকে। কোনমতে একজন যাওয়া যায়। ঢুকে গেলাম ঐ পথে। প্রহরী পুলিশ হতবাক হয়ে দেখল। মুনীর ভয় পেয়ে গেল। ইশারায় ডেকে নিলাম। পুলিশগুলো কিছু বলল না। মুনীর ভয়ে ভয়ে ঢুকে বলল, ভাই বিদেশে এসে এরূপ করবেন না। কিছুদিন আগে এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে। বললাম আল্লাহ সব জায়গায় থাকেন। তিনিই সর্বোত্তম পাহারাদার।

ভিতরে ঢুকে খেয়াল হ’ল এখানে আমাদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা পিএইচডি করতে আসেন। দেখি কাউকে পাওয়া যায় কি-না। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ করতেই কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। তাদের মাধ্যে ভূগোলের আব্দুল ওয়াহহাব ভাই (ঝিকরগাছা, যশোর) আমার বেশী কাছের। তাকে নিয়ে লাইব্রেরীতে গেলাম। তার আগে উনি বললেন, ভাই! রাজশাহী, বেনারস সব জায়গায় আপনার একই পোষাক? এটা তো হিন্দু ইউনিভার্সিটি। বললাম, আপনার ভয় লাগলে থাকুন, আমি একাই যাচ্ছি। বেচারা লজ্জা পেয়ে সাথে এলেন। নীচে বসা এসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান। অভ্যাসবসে তাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের জওয়াব দিলেন। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিলেন লাইব্রেরিয়ান। তিনি সরাসরি আমার দিকে আসছেন দেখে তাকেও সালাম দিলাম। উনিও সালাম নিলেন। দু’জনেই এবার কথা বলতে শুরু করলেন। আপ শায়েদ বাংলাদেশী হ্যাঁয়? বললাম, জী হাঁ। বললেন, জনাব! এয়সে পোষাক আওর দাড়ি লে কার কোঈ প্রফেসর আ কার হাম কো সালাম কাহনা শায়েদ এহী পহেলা মরতবা হ্যায়। হামারা মোর্দা ঈমান তাযা হো গিয়া হায়। আজ হাম খোদ আপ কি খিদমত কারেঙ্গে। এরপরেও আমি হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে উভয়ে বলে উঠলেন, হাম নাচীয মোর্দা মুসলিম হ্যায়, লেকিন পোষাক মেঁ হাম হিন্দু হ্যাঁয়। হাম কো মাফ ফরমাইয়ে। বললাম, মেরা সাথী এহ প্রফেসর ভি বাংলাদেশী হ্যাঁয় আওর মুসলমান হ্যাঁয়। বললেন, উনকে পাস দাড়ি ভি নেহী হ্যায়, পোষাক ভি নেহী হ্যাঁয়, কেয়সে সামঝূঁ কে ওহ মুসলিম হ্যাঁয়? আব্দুল ওয়াহহাব বললেন, ভাই! আপনার সাথে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম, এখন ভয় কেটে গেছে। হাঁ আব্দুল ওয়াহহাব এর পর থেকে দাড়ি রেখেছেন এবং তার লাইফেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে অল্প দূরেই গয়া-কাশি দেখতে গেলাম। পাশেই মসজিদ দেখলাম। তারপর চলে এলাম। পরিচিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেলালকে সাথে নিয়ে এবার আযমগড় রওয়ানা হ’লাম। 

(ক্রমশ)



আরও