ষড়রিপু সমাচার
লিলবর আল-বারাদী
আব্দুল আলীম 1013 বার পঠিত
[২০১১ সাল জুড়ে আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব রাজনৈতিক
পট-পরিবর্তনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় বইছে। বিশ্লেষকগণ
একে ‘আরব বসন্ত’ আখ্যা দিয়ে এর পশ্চাতে নানা কারণ, উপকরণ বিশ্লেষণে ব্যস্ত
রয়েছেন। দৃশ্যত এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দীর্ঘদিনের একনায়কতন্ত্র তিরোহিত
হয়ে এবার গণতন্ত্রের মুখ দেখতে যাচ্ছে আরব বিশ্ব। তবে অধিকাংশের আশংকা,
কট্টর মৌলবাদের দিকেই ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছে আরব। মেŠলবাদ বলতে কেবল ইসলামী
গণজাগরণ নয় বরং সংস্কারপন্থী সালাফী আন্দোলনের রাজনৈতিক উত্থানই যে তারা বড়
করে দেখছে, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে সালাফী আন্দোলনের অকস্মাৎ গতি
পরিবর্তন তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের বিষয়টি স্বয়ং
সালাফীদের মাঝেই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কেননা ইসলামের মৌল আক্বীদা ও
বাস্তবতার নিরিখে প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থাকে অধিকাংশ সালাফী
সংগঠন হারাম মনে করে থাকেন। সর্বোপরি মিসরে সালাফীদের এই উত্থান সর্বমহলেই
এক আলোচিত বিষয়। মিসরের সমাজ গবেষণা সংস্থা ‘আল-মারকাযুল আরাবী লিদ্-দিরাসাতিল
ইনসানিইয়াহ’ এ বিষয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যাতে মিসরে
সালাফীদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটা ধারণা
পাওয়া যেতে পারে। নিবন্ধটি আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুল আলীম বিন কাওছার
আলী। পরিশিষ্ট অংশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর উপর কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংযোজন
করা হয়েছে-নির্বাহী সম্পাদক]
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিশরীয় সমাজ অনেক রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং সামাজিক আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে। ২০১১ সালে ২৫ই জানুয়ারীতে পরিদৃষ্ট হয়েছে যার অকস্মাৎ বিস্ফোরণ। যার চূড়ান্ত দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়েছে ২০১১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী। এই বিপ্লব দীর্ঘ ৩০ বছরের ক্ষমতাসীন মিসরীয় নেতা হুসনী মোবারককে এক নিমিষে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক সকল শক্তি এই বিপ্লব থেকে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছে সাধ্যমত। আমরা এই নিবন্ধে ২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবে সালাফীদের অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
মিসরে সালাফীদের পরিচয়
মিসরসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সালাফীদের ধর্মীয় অবস্থান যথেষ্ট উঁচুতে। পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ থেকে দ্বীনী ভিত্তি গ্রহণ, সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী স্বচ্ছ আক্বীদার অনুসরণ এবং যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত ও অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে সুদৃঢ় অবস্থান। এতদসত্ত্বেও দুঃখজনক বিষয় যে, তারা এক ও অভিন্ন দল বা বলয়ে সুসংঘবদ্ধ নয়; বরং দৃঢ় একটি কেন্দ্রবিন্দু থাকা সত্ত্বেও তারা নানা দল-উপদলে বিভক্ত। ফলে সামাজিক পরিমন্ডলে তাদের মযবূত কোন অবস্থান পরিদৃষ্ট হয় না। তবে অতি সম্প্রতি মিডিয়ার বদৌলতে সালাফীরা মিশরীয় সমাজে তাদের বেশ একটা মযবূত অবস্থান অবলোকন করছে। নিম্নে মিশরে সালাফীদের উপস্থিতি ও তাদের কার্যক্রমের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হল-
মিসরের স্বীকৃত সালাফী সংগঠন এবং সংস্থাসমূহ
১. আল-জাম্ঈয়াহ আশ-শারঈয়াহ : শায়খ মাহমূদ খাত্ত্বাব সুবকী এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯১২ সালে ‘আল-জাম্ইয়াহ আশ-শারইয়াহ লিতা‘আউনিল আমিলীনা বিল-কিতাবি ওয়াস্-সুন্নাহ আল-মুহাম্মাদিইয়া’ নামে এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। নামটির অর্থ হচ্ছে, ‘পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাতে মুহাম্মাদীর অনুসারীদের পারস্পরিক সহযোগিতার শরঈ সংগঠন’। মিশরে উপনিবেশের ফলে মানুষের জীবন থেকে ইসলামী শরী‘আত দিনে দিনে দূরে সরতে থাকায় এবং শিক্ষাব্যবস্থার মোড় পরিবর্তন ঘটায় তিনি এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমা সংস্কৃতির কালো থাবা, নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়া, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী শরী‘আতের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়া এবং নানা বিদ‘আত ও কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসারও শায়খ সুবকীর এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল।
এই সংগঠনের শাখা সারা মিশর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। মিশরের জনকল্যাণমূলক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সুপরিচিত। গোটা মিশরে এর ৩৫০টিরও বেশী শাখা আছে। বর্তমান সংগঠনটির প্রধান হচ্ছেন ড. মুহাম্মাদ মুখতার মুহাম্মাদ আল-মাহদী। তিনি একজন আযহারী আলেম।
আক্বীদা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম : এই সংগঠন দ্বীনকে যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত থেকে মুক্ত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় এবং কবরে ছালাত আদায় করা, কবরে মানত করা, এর মাধ্যমে বরকত কামনা ইত্যাদি গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তুলে। স্বভাবতই তারা নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের দিকে আহবান জানানোর বিরোধী। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ মাহমূদ বিরচিত ‘আদ-দ্বীনুল খালেছ’ এই সংগঠনের দাঈদের মূল রেফারেন্স গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত। এই গ্রন্থটিকে একটি ফিক্বহী বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে, যেখানে দলীলসহ ফিক্বহী অভিমতসমূহ বর্ণিত হয়েছে এবং দলীলের ভিত্তিতে সর্বাধিক অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমতটি উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সংগঠন মনে করে, দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট শিরক-বিদ‘আতই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ্র বড় সমস্যা। দ্বীনকে কলুষমুক্ত করতে পারলেই মুসলিম জাতি তার হারানো সম্মান এবং মর্যাদা ফিরে পাবে। এতদ্সত্ত্বেও শায়খ সুবকী আল-আযহারের ছূফী পরিবেশে বেড়ে উঠায় ছূফীদের বিরুদ্ধে এই সংগঠন ততটা খড়গহস্ত নয়। তারা ছূফীদেরকে দুইভাগে ভাগ করেছে- ১. মধ্যপন্থী : যারা সুন্নাতের অনুসরণ করে। ২. চরমপন্থী : যাদের মধ্যে আক্বীদাগত এবং ফিক্বহী পথভ্রষ্টতা বর্তমান। এর প্রথম দলটির প্রতি তারা সহানুভূতিশীল মনোভাবাপন্ন।
শায়খ সুবকী প্রচলিত রাজনীতি থেকে দূরে থেকে সুশৃংখল সাংগঠনিক কর্মতৎপরতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেজন্য সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে এই সংগঠন নাক গলায় না। সম্ভবত: এ কারণেই সংগঠনটি আজও টিকে আছে এবং সরকারও তাদের কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করেনি। তবে কেউ কেউ মনে করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনটি রাজনীতির দিকে মোড় নিয়েছে যা সংগঠনের মুখপত্র ‘আত-তিবইয়ান’ পত্রিকায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে শায়খ সুবকীর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতি এখন আর অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
সংগঠনের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
১. শায়খ মাহমূদ মুহাম্মাদ খাত্ত্বাব সুবকী : সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।
২. শায়খ আমীন মাহমূদ মুহাম্মাদ খাত্ত্বাব সুবকী : তিনি শায়খ সুবকীর সন্তান ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর সংগঠনের প্রধানের পদ অলংকৃত করেন। তিনিও আমৃত্যু সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৩. শায়খ আব্দুল লত্বীফ মুশতাহিরী : প্রতিষ্ঠাতা প্রধানের পর তিনিই হচ্ছেন সংগঠনের প্রসিদ্ধতম নেতা।
৪. মুহাম্মাদ মুখতার মাহদী : বর্তমান প্রধান।
২. জামা‘আতু আনছারিস সুন্নাহ আল-মুহাম্মাদিইয়াহ :
মিসরের প্রখ্যাত শায়খ মুহাম্মাদ হামেদ আল-ফিকীর হাতে রাজধানী কায়রোতে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শায়খ আল-ফিকী আযহারের রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হন এবং পরবর্তীর্তে সেখানকার একজন আলেম হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নেওয়ার পর তিনি দা‘ওয়াতী ময়দানে নেমে পড়েন। নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি আহবান এবং ছহীহ সুন্নাহ সংরক্ষণের পক্ষে তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম শীঘ্রই প্রসার লাভ করে এবং তাঁর বহু অনুগামী সৃষ্টি হয়। শায়খ আল-ফিকীর মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন আলেম এই সংগঠনের প্রধানের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৬৯ সালে মিশরীয় সরকার ‘আনছারুস সুন্নাহ’ সংগঠনের অনুমোদন বাতিল করে ‘আল-জাম্ঈয়াতুশ শারঈয়াহ’-এর সাথে একত্রিত করে দেয়। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এভাবে সংগঠনটির কার্যক্রম চলতে থাকে। অতঃপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদারনৈতিক ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে ২য় প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শায়খ রাশাদ শাফেঈ’র হাত দিয়ে সংগঠনটি আবার ডিক্লারেশন ফিরে পায়। মিসরের প্রত্যেকটি বড় বড় অঞ্চলে এই সংগঠনের শাখা ছড়িয়ে পড়ে। মিসরে এর প্রায় ১০০টি শাখা এবং ১০০০টি মসজিদ রয়েছে।
সংগঠনের আক্বীদা ও কার্যক্রম :
মানুষকে যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত থেকে নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান, সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী ছহীহ সুন্নাহ্র অনুসরণ, মানুষকে কিতাব ও সুন্নাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন করানো এবং যাবতীয় বিদ‘আত ও কুসংস্কার থেকে বিরত রাখাই এ সংগঠনটির কার্যক্রম ছিল। পূর্বতন ‘আনছারুছ ছুন্নাহ’-এর মত এ সংগঠনটিরও সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল যে, ইসলাম একাধারে ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থা, ইবাদত এবং শাসনকার্য পরিচালনার নাম। কিন্তু সংগঠনের মুখপাত্রগণ মিসরের পরিবেশে সমস্যাপূর্ণ-এমন কোন বিষয়ে সাধারণত আলোচনা করতেন না বা রাজনৈতিক কোন বিষয়ে কখনই মতামত প্রকাশ করতেন না।
তবে তাদের গঠনতান্ত্রিকভাবে সুশৃংখল সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার কারণে মিসরে সালাফী আন্দোলনের জন্য একটি উন্মুক্ত ময়দান সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও তাদের কার্যক্রম মূলতঃ আল্লাহ্র আইন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতাকেই নির্দেশ করে। সংগঠনের সাইনবোর্ডে তারা একাধারে সাংগঠনিক তৎরপরতা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সালাফী আন্দোলনের একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরী করেছে। যদিও মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের তৎপরতার দিকে সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি রাখে এবং তাদের নানা কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে থাকে।
সংগঠনটি ‘আত-তাওহীদ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করে। এর সক্রিয় কর্মী সংখ্যা ১০ হাযারের বেশী নয়। তবে জনকল্যাণমূলক ফাউন্ডেশনসমূহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরী এবং মসজিদসমূহের মাধ্যমে তাদের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে মিসরে। অবশ্য নববইয়ের দশক থেকে ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সরকারীভাবে তাদের কার্যক্রমে ও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির্উপর নিয়ন্ত্রণারোপ করা হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
শায়খ মুহাম্মাদ হামেদ আল-ফিকী, আব্দুর রাযযাক্ব আফীফী, আব্দুর রহমান ওয়াকীল, রাশাদ শাফেঈ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে ড. জামাল এবং ড. আব্দুল আযীম এই সংগঠনের কর্ণধার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দ্বিতীয়তঃ স্বল্প প্রসিদ্ধ সালাফী গ্রুপসমূহ
১. সালাফিইয়াহ মাদ্খালিইয়াহ :
১৪১১/১৪১২ হিজরীতে সঊদী আরবের মদীনায় এই সালাফী গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্বীদা বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত মুহাম্মাদ আমান জামী এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগের অধ্যাপক শায়খ রবী বিন হাদী আল-মাদখালী এর হাল ধরেন। মদীনায় প্রতিষ্ঠিত এ গ্রুপটিরই একটি শাখা মিসরে ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় জন্মলাভ করে। মূলত: ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে ওলামাদের অবস্থানকে কেন্দ্র করেই এর জন্ম। এ গ্রুপটি একদিকে সে সময় কুয়েতে বিদেশী সৈন্য অনুপ্রবেশবিরোধী ওলামাদের ফৎওয়া সমর্থন করেনি, আবার সঊদী ‘হায়আতু কিবারিল ওলামা’র ফৎওয়াও সমর্থন করেনি-যারা বলেছিলেন, প্রয়োজনে বিদেশী শক্তির সহযোগিতা নেয়া যাবে। বরং উভয়মতের সংমিশ্রণে তারা মধ্যবর্তী এমন একটি মত প্রকাশ করেছিল, যা একদিকে বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশকে নির্বিচারে বৈধতা দেয় না আবার পুরোপুরি হারামও করে না।
সংগঠনটির আক্বীদা ও কার্যক্রম :
অন্যান্য সালাফী সংগঠনের মত এই সংগঠনটিও মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা বৈধ মনে করে না, যদিও তিনি ফাসিক হন। তবে তারা এই নীতিতে একটু বেশীই কট্টর। সংগঠনটি মনে করে, সরকারের কোনরূপ বিরুদ্ধাচরণ বৈধ তো নয়ই, এমনকি সরকারকে প্রকাশ্যে নছীহত করাও জায়েয নয়। এই নীতিকে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি মনে করে এবং এর বিরোধিতাকে মুসলিম শাসকের বায়‘আত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শামিল মনে করেন। মাদখালীরা আরো মনে করেন, শুধু সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখাই যথেষ্ট নয়; বরং সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকেই সমানভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, যেমন-দারুল ইফতা। তাদের মতে, রাষ্ট্র নিযুক্ত আলেমগণের ফৎওয়ার বিরোধিতা করাও কারো উচিৎ নয়। এমনকি যদি ওলামারা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ব্যাংকের সূদকে হালাল ঘোষণা করেন তবুও সে ফৎওয়াকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। এর কোন ব্যত্যয় করা চলবে না। যদি কেউ বিরোধিতা করে তবে সে ‘খারেজী’দের দলভুক্ত হয়ে যাবে।
অন্যান্য সালাফী সংগঠন থেকে কিছুটা ভিন্ন পথে হেটে তারা মনে করে, রাষ্ট্র এবং শাসকের সমন্বয়েই একটি মুসলিম জামা‘আত। তাই রাষ্ট্র ও শাসক ব্যতিরিকে ভিন্ন কোন ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা ইসলামী আদর্শ বিরোধী। একে তারা ‘হিযবিয়্যাহ’ বা ফির্কাবন্দী বলে মনে করে। কেননা এসব সংগঠন মুসলিম জামা‘আতের ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিরোধী। ফলে এসব সংগঠন পরিচালনাকারীরা তাদের দৃষ্টিতে ‘খারেজী’ এবং দ্বীনের মাঝে নব্যসৃষ্টিকারী মুবতাদি‘। তাদের দাবী, অন্যান্য ইসলামী দলসমূহের বিরুদ্ধে তাদের এই আক্রমাণত্মক মূলনীতির লক্ষ্য হল-উম্মতের মধ্যে ফের্কাবন্দীর অবসান ঘটানো এবং উম্মাহকে একক শাসকের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করা।
উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
মাহমূদ লুত্বফী আমের, উসামা আল-ক্বাওছী, মুহাম্মাদ সাঈদ রাসলান প্রমুখ।
২. আদ-দা‘ওয়াতুস সালাফিইয়াহ :
মিসরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের একদল নেতা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সালাফী আন্দোলনের একটি ইলমী ধারার কার্যক্রম শুরু করেন। মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক এ আন্দোলনের পরিচালনা কেন্দ্র ছিল আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। মুহাম্মাদ ইসমাঈল, সাঈদ আব্দুল আযীম, আবূ ইদরীস, আহমাদ ফরীদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বগণ এখান থেকেই মিসরের সর্বত্র এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিতেন। কায়রোতে এই সংগঠনের অন্যতম নেতা ছিলেন আব্দুল ফাত্তাহ যায়নী। ১৯৭৮ সালে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আন্দোলনের অনুসারী ছাত্ররা ইখ্ওয়ানুল মুসলিমীনের সাথে সম্পৃক্ত হতে অস্বীকার করে একটি পৃথক সালাফী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার নামকরণ করা হয় ‘মাদরাসা সালাফিইয়াহ’। এ সংগঠনের কর্ণধারগণ দলীয় প্রধানের পদবী হিসাবে ‘আমীর’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। কারণ তাদের মতে, এ শব্দটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আমীরের জন্য প্রযোজ্য। এর পরিবর্তে তারা দলীয় প্রধান আবূ ইদরীসকে ‘ক্বাইয়িমুল মাদরাসা আস-সালাফিইয়াহ’ লকব দিয়েছিলেন।
বেশ কয়েক বছর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গন্ডি ছাড়িয়ে সারা মিসরে এ সংগঠনের প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনুসারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা তাদের সংগঠনের নাম রাখেন ‘আদ-দা‘ওয়াতুস সালাফিইয়াহ’।
সংগঠনের আক্বীদা ও কার্যক্রম :
ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনের বুঝ অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র দুই মৌলিক উৎস থেকে তারা ইসলামের মর্মবাণী গ্রহণ করতে চান। তারা তাওহীদ প্রসঙ্গ, আক্বীদা শুদ্ধিকরণ এবং যাবতীয় শিরক-বিদ‘আতকে সর্বতোভাবে বর্জনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখেন। আর এই মানহাজকে যারা অনুসরণ করেন তাদের সবাইকে তারা দ্বীনী জ্ঞানচর্চাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের আহবান জানান। কেননা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই কেবল শরী‘আতের ফরয, সুন্নাত এবং ওয়াজিব সম্পর্কে বর্ণিত আদেশ-নিষেধসমূহ জানা সম্ভব। জ্ঞানচর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তাদেরকে ‘আস-সালাফিইয়া আল-ইলমিইয়াহ’ও বলা হয়।
এই সংগঠনটি মৌলিকভাবে তিনটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত :
১. তাওহীদ : অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্কে একক মেনে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে এবং শিরককে অত্যাবশ্যকভাবে বর্জন করতে হবে।
২. ইত্তেবা : অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-কেই একমাত্র অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। তিনি যা আনয়ন করেছেন তার সাথে কোনরূপ সংযোজন-বিয়োজন করা যাবে না। তাঁর অনুসরণের অর্থ হল- ‘রাসূল (ছাঃ)-এর পর যদি এমন কোন ব্যক্তি থাকে যার কথা ও কর্ম অনুসরণযোগ্য-তিনি হলেন রাসূল (ছাঃ)’।
৩. তাযকিয়া: অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান মোতাবেক আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে, অন্য কারো আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে নয়।
উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
মুহাম্মাদ ইসমাঈল, আহমাদ ফরীদ, সাঈদ আব্দুল আযীম, মুহাম্মাদ আব্দুল ফাত্তাহ, ইয়াসের বারহামী, আহমাদ হুত্বায়বাহ, ইমাদুদ্দীন আব্দুল গফুর প্রমুখ।
৩. সালাফিইয়াহ হারাকিইয়াহ :
আলেকজান্দ্রিয়াতে ‘দা‘ওয়াহ সালাফিইয়াহ’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় কায়রোর ‘শুবরা’ এলাকায় কয়েকজন যুবক ‘সালাফিইয়াহ হারাকিইয়াহ’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শায়খ ফাউযী সাঈদ, শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল মাক্বছূদ প্রমুখ।
সংগঠনের আক্বীদা ও কার্যক্রম :
দাও‘য়াহ সালাফিয়াহ্র মানহাজ অনুসরণ করার সাথে সাথে তারা মুসলিম সমাজে নারীদের পর্দাহীনতা এবং অনুরূপ সকল পাপাচারকে জাহেলী কর্মকান্ড মনে করতেন এবং এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের মতে, জামা‘আতবদ্ধভাবে বা দল গঠন করে দাওয়াতী কাজ করা যাবে; তবে এর জন্য শর্ত হচ্ছে, ফির্কাবন্দী করা যাবে না এবং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য ছাড়া নির্দিষ্টভাবে কোন চিন্তাধারার উপর গোঁড়ামি করা যাবে না। অর্থাৎ কোন একটি দলকে কেন্দ্র করে কারো সাথে বন্ধুত্ব করা বা শত্রুতা রাখা নিষিদ্ধ। এছাড়া আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত কোন ইসলামী দল ও গোষ্ঠীকে জাহান্নামী ৭২ ফেরকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
মুহাম্মাদ আব্দুল মাক্বছূদ, সাইয়্যেদ আরাবী, শায়খ ফাউযী, শায়খ নাশ‘আত ইবরাহীম প্রমুখ।
ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সালাফী গ্রুপসমূহ
মিসরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো কোন সংগঠনের সাথে জড়িত নয় বা সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রমের কোন প্রচেষ্টাও তাদের নেই। সাধারণত: একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সমবেত কিছু ছাত্রকে নিয়ে এসকল মাজমা‘ গড়ে উঠে। শিক্ষকদের প্রসিদ্ধি ও দাওয়াতী তৎপরতার উপর ভিত্তি করে এ সকল মাজমা‘র আকার ছোট-বড় হয়ে থাকে।
তাদের আক্বীদা ও কার্যক্রম :
তারা প্রথমত: মানুষের মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী (রা‘দ ১১)। তাদের মতে, মুসলিম উম্মাহ্র বর্তমান দশা কস্মিনকালেও পরিবর্তন সম্ভব নয়, যতক্ষণ না প্রতিটি ব্যক্তি ইসলামের বিশুদ্ধ মানদন্ড অনুযায়ী নিজেকে সংশোধন করে। প্রথমে ব্যক্তি নিজের অবস্থা সংশোধন করবে। অতঃপর আশেপাশের লোকদেরকে সংশোধন করবে। যেমন-তার নিজ পরিবার, সমাজ, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি। অনুরূপভাবে তারাও নিজেদের সংশোধন করে তাদের পরিবার, সমাজ ও বন্ধু-বান্ধবকে সংশোধন করবে। এভাবে গোটা জাতির পরিবর্তন সম্ভব। তারা অন্যান্য সালাফী গোষ্ঠীর মতই দ্বীনকে শিরক-বিদ‘আত মুক্ত করতে চান। অধুনা তারা তাদের আক্বীদা প্রচারে আধুনিক নানা মিডিয়া ব্যবহার করছেন। তবে রাজনীতির সাথে তারা জড়াতে আগ্রহী নন এবং এ বিষয়ে তারা প্রকাশ্যে কোন কথাও বলেন না।
উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ :
আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিকহ বিভাগের শিক্ষক উসামা আব্দুল আযীম, শায়খ মুহাম্মাদ হুসাইন ইয়াকুব, শায়খ আবূ ইসহাক্ব হুওয়াইনী, শায়খ মুছত্বফা আদাভী প্রমুখ।
সাম্প্রতিক বিপ্লবে সালাফীদের তৎপরতা
তাহরীর স্কয়ারকে মিসরীয় বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। বিপ্লবের দিনগুলোতে তাহরীর স্কয়ারেই ছিল সারাবিশ্বের চোখ। এই স্থানে বিপুল পরিমাণ লোক সমাগম সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ময়দানে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল দুই ভাবে দৃশ্যমান-
১. দলে দলে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ময়দানে নামা : এই বিক্ষোভ মিছিলই মিসরে সরকার পতনে মূল ভূমিকা রেখেছিল। কোন কোন মিছিলে কয়েক মিলিয়ন মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ময়দানে উপস্থিতিদের বেশীরভাগই স্বেচ্ছাসেবী এবং অরাজনৈতিক। তারা যুলম-অত্যাচার, দরিদ্রতা ইত্যাদির তাড়নায় বিক্ষুব্ধ হয়ে মাঠে নামে।
২. বিক্ষোভের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দলসমূহ : অর্থাৎ যারা এই বিক্ষোভ পরিচালনাকারী দলসমূহ। এই বিক্ষোভের অগ্নি প্রজ্জ্বলনে মিশরের রাজনৈতিক দলগুলিরই প্রধান ভূমিকা ছিল। বিশেষতঃ ময়দানে ইখওয়ান তথা ব্রাদারহুডের উপস্থিতিই ছিল সর্বাধিক চোখে পড়ার মত। বিক্ষোভকারীদের ৬০% থেকে ৭০% ভাগই ছিল এই সংগঠনের। আর সালাফীদের উপস্থিতি ছিল ১০% থেকে ২০%। বাক্বীরা ছিল খালেদ সাঈদ গ্রুপ, কিফায়াহ গ্রুপ ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের সদস্যগণ। বিক্ষোভে ইখওয়ানীরা অবশ্য সামনে থেকে নেতৃত্ব না দিয়ে পিছনে থেকে বিক্ষোভকারীদের সবরকম সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল মাক্বছূদ বা শায়খ নাশআত আহমাদ বা শায়খ ফাওযী সাঈদের নেতৃত্বাধীন সালাফীরাও ময়দানে নামে। বিক্ষিপ্তভাবে আরো অনেক সালাফীকে ময়দানে নামতে দেখা যায়। এককথায়, ময়দানে সালাফীদের তৎপরতাও ছিল যথেষ্ট। টিভি চ্যানেলগুলোতে তাদের বড় ধরনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বিক্ষোভকালীন ধারণকৃত এমন একটি ভিডিও ক্লিপও পাওয়া যাবে না, যেখানে অন্ততঃ একজন দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী পুরুষ বা একজন পর্দানশীন নেকাবধারী মহিলা নেই।
২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবে সালাফীদের ভূমিকা
১. বিপ্লব এবং বিপ্লবীদেরকে মদদ প্রদান : সালাফী দলগুলির মধ্যে কায়রোর সালাফী দলসমূহ ২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবের শুরু থেকেই বিক্ষোভকারীদেরকে সহযোগিতা করেছে। যাদেরকে আগে ‘সালাফিয়াহ জিহাদিয়াহ’ বলে আখ্যা দেওয়া হত। এদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে ইতিপূর্বে বারবার গ্রেফতার ও হয়রানী করা হয়েছিল। তাই এই গোষ্ঠীগুলি বিপ্লবকে কেবল সহযোগিতাই করেনি; বরং তাদের অনেকেই সরাসরি মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছে। ২৫শে জানুয়ারী থেকে ১১ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বিপ্লবের দিনগুলিতে শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল মাক্বছূদ, শায়খ নাশআত আহমাদ, শায়খ ফাউযী সাঈদসহ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে। এই গ্রুপের নেতারা যুবকদের উদ্দেশ্যে হোসনী মোবারকের অপশাসন থেকে মুক্তির জন্য বক্তব্য পেশ করেন, যা যুবকদেরকে বিপ্লবের বৈধতা সম্পর্কে সংশয় দূর করে তাদেরকে আরো উজ্জীবিত এবং শক্তিশালী করে তোলে।
কায়রোর বাইরে প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলিতে অন্যান্য সালাফী সংগঠনসমূহের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় এবং তারাও বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্ম হয়ে মোবারক সরকারের পতনের দাবী তোলে।
প্রখ্যাত দাঈ শায়খ মুহাম্মাদ হাস্সান বিপ্লব সমর্থক সালাফী দাঈদের কাতারে অন্যতম ছিলেন। বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও শেষের দিকে নিজের সন্তানদেরকে নিয়ে বিপ্লবের কেন্দ্র তাহরীর স্কয়ারে এসে উপস্থিত হন এবং রক্তপাত, নির্যাতন বন্ধ করে হোসনী মোবারককে গদি ছাড়ার আহবান জানান। এরপর ড. নাছর ফরীদ, ড. আলী সালূস, ড. আব্দুস সাত্তারসহ আযহারের আরো অনেক সালাফী নেতা এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। তারা বিক্ষোভকারীদেরকে সহযোগিতা করেন এবং তাদের ভূমিকাকে যুক্তিসঙ্গত বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন। তবে তারা বিপ্লবীদেরকে ভাঙচুর ইত্যাদি অপরাধ না করা আহবান জানান।
২. বিপ্লবের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ : ২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিলেন যারা, তাদের মধ্যে শায়খ মাহমূদ মিছরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিপ্লবীদের ময়দান ছেড়ে ঘরে ফেরার আহবান জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেই ময়দান ছাড়তে হয় এবং বিপ্লবীরা তাকে আর এ বিষয়ে নছীহত করারও সুযোগ দেয়নি। ইতিপূর্বে শায়খ মিছরী টেলিভিশনের পর্দায় দেশকে ফিৎনা-ফাসাদ থেকে রক্ষার্থে অবিলম্বে এই বিপ্লব-হাঙ্গামা বন্ধের আহবান জানিয়েছিলেন।
বিপ্লব বিরোধীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকজন হচ্ছেন, শায়খ মুছত্বফা আদাবী। তিনি মিশরীয় টিভি চ্যানেলে এই বিপ্লবের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং যুবকদেরকে ঘরে ফেরার আহবান জানান। তিনি বলেন, এমন বিপ্লব দেশে ফেৎনা-ফাসাদ, খুন-রাহাজানি এবং মুসলিমদের মধ্যে আত্মঘাতি লড়াই ছাড়া কিছুই বয়ে আনবে না। তিনি আরো বলেন, মুসলমানদের পারস্পরিক এই লড়াইয়ে যদি কোন ব্যক্তি নিহত হয় তাকে শহীদ বলা যাবে না। এভাবে তিনি সাধ্যমত নিরুৎসাহিত করেন তাহরীর স্কয়ার দখলকারীদের।
আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মাদ হুসাইন ইয়াকুব। যিনি এই বিপ্লবকে একটি ‘আত্মবিনাশী ফেৎনা’ বলে আখ্যা দেন। তিনি যুবকদেরকে ঘরে ফেরার এবং ময়দানের পরিবর্তে মসজিদকে অাঁকড়ে ধরার আহবান জানান। তিনি বিপ্লবকে নিরুৎসাহিত করতে ফেৎনা-ফাসাদ সংক্রান্ত হাদীছসমূহের উদ্ধৃতি পেশ করে যুবকদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।
৩. নীরব ভূমিকা পালন : এক্ষেত্রে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ আবূ ইসহাক্ব আল-হুওয়াইনীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর টেলিফোন-মোবাইল পর্যন্ত বন্ধ করে রাখেন। তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকেও এ বিষয়ে কোন কিছু জানা যায়নি। এমনকি অদ্যাবধি তাঁর সুস্পষ্ট মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
৪. অস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ : আলেকজান্দ্রিয়ার ‘দাওয়াহ সালাফিইয়াহ’ সংগঠনটির অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। এই সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ড. ইয়াসির বারহামী প্রাথমিকভাবে এক প্রশ্নের উত্তরে ২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবের বৈধতা নাকচ করে ফৎওয়া প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘দ্বীনের পাবন্দী, দেশের কল্যাণে আমাদের দায়িত্বশীলতা, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা এবং দেশে শত্রুদের ফেৎনা বিস্তারের সুযোগ বানচাল করার জন্য আমরা ২৫শে জানুয়ারীর বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নই...’। ২৯শে জানুয়ারী এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গতকালের মিছিল-মিটিংয়ে দেশ ও জনগণের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, চুরি-ডাকাতি, লুণ্ঠন ইত্যাদি হয়েছে, তা কারো অজানা নয়। কারাগারে বন্দী অপরাধীদেরকে মুক্ত করা, সরকারী অফিস-আদালত, জনগণের বাসা-বাড়ী ভাঙচুর করা কোনক্রমেই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না; বরং বিপ্লব দীর্ঘায়ু হলে এসব অপরাধকর্ম আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং এসব অপরাধ ঠেকাতে প্রত্যেক মুসলিমকে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে’।
কিন্তু ৩১শে জানুয়ারী এবং ১লা ফেব্রুয়ারী এ সংগঠনের পক্ষ থেকে আরো দু’টি পৃথক বিবৃতি প্রদান করা হয়, যাতে তারা বিপ্লব পরবর্তী সরকারের প্রতি আগাম কয়েকটি দাবী উত্থাপন করেন। তাদের এ সকল দাবী থেকে স্পষ্টতই ফুটে উঠে যে, তারা বিপ্লবীদের দাবীসমূহের সাথে একমত। যেমন-জরুরী আইন অবশ্যই তুলে নিতে হবে। প্রত্যেকটি সরকারী পদে এবং মন্ত্রণালয়ে আল্লাহভীরু যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। দেশে চলমান বিশৃংখলাকে প্রতিরোধ করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্য অধিদপ্তরকে সংস্কার করতে হবে। সরকারী নির্দেশে যেসব পুলিশ কর্তৃক অপরাধ এবং অবিচার ঘটেছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে হবে ইত্যাদি।
শায়খ বারহামী তাদের এই বিপরীতমুখী অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরে বলেন, তারা জনগণের বৈধ দাবীকে সমর্থন করেন ঠিকই, তবে ফেৎনা-ফাসাদ এবং শরী‘আত বিরোধী কর্মকান্ডকে বৈধ মনে করে না।
‘দা‘ওয়াহ সালাফিইয়া আলেকজান্দ্রিয়া’ এই বিপ্লবকে তাদের ঘর গোছানোর কাজে ব্যবহার করে এবং এই সুযোগে তারা আলেকজান্দ্রিয়া, ত্বানত্বা, মানছূরা, কায়রোসহ অনেক জায়গায় সমাবেশের আয়োজন করে। তারা বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সংবিধান যেন ইসলামী শরী‘আতভিত্তিক হয় সে ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেন। তাদের এই ভূমিকাই মূলত: মিসরের রাজনীতিতে সালাফীদের জন্য নতুন একটি অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যা ছিল ইতিপূর্বে ধারণার বাইরে।
বিপ্লবে সালাফীদের ভূমিকা মূল্যায়ন
সত্যি কথা বলতে মিশরীয় বিপ্লবে সালাফীদের প্রাথমিক ভূমিকায় এটা স্পষ্ট করে বলা কঠিন ছিল যে, তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। যেমন-একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে তারা কি দেশের ক্ষমতা পেতে চায়? আর এর জন্য তারা কোন নীতিই বা মেনে চলবে? নাকি সরকারে অংশগ্রহণ না করে বাহির থেকে কেবল সরকারের উপর চাপসৃষ্টিকারী প্রেসার গ্রুপ হিসাবেই তারা সন্তুষ্ট থাকবে?
এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে, কোন কোন সালাফী সংগঠন এই বিপ্লবের বাস্তবতাই পরিমাপ করতে পারেনি, পারেনি এর আভ্যন্তরীণ শক্তির বিপুলতা অনুমান করতে। সেজন্য বলা যায়, ইখ্ওয়ানীরাই ছিল প্রকৃতঅর্থে এই বিপ্লবের সক্রিয় শক্তি এবং বিপ্লবে তাদের গড় অংশগ্রহণ ছিল শতকরা ৭০ ভাগ। আর সেকারণেই সরকার তাদেরকে মতবিনিময়ের জন্য আহবান করেছিল। যদিও ইখওয়ানীরা এ দায়িত্ব না নিলেও ‘দাওয়াহ সালাফিয়াহ’ দলটির পক্ষে ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়নের দাবী নিয়েই বিক্ষোভকারীদের পরিচালনা করার সুযোগ ছিল। কেননা এ বিপ্লব চূড়ান্ত অর্থে এমনই একটি জাতীয় বিপ্লবে পরিণত হয়েছিল যে, সেখানে ইসলামীপন্থী, সেক্যুলার বা অন্য মতাদর্শের সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কারো মাঝে কোন ভেদাভেদ ছিল না।
অন্যদিকে এই অস্পষ্টতার সাথে সালাফীদের কিছুটা স্ববিরোধীতাও যুক্ত হয়েছিল। শায়খ ইয়াসির বারহামী স্পষ্ট করেই বলেন যে, সালাফী পন্ডিত শায়খ হাযেম ছলাহ আবু ইসমাঈলের পক্ষ থেকে বিপ্লবী যুবকদের উদ্যমী ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা ছিল মূলত: বাস্তবে ঘটে যাওয়া এক অসাধারণ বিপ্লবের স্ত্ততিগান। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তিনি তাদের বিক্ষোভ মিছিল-মিটিংকে সমর্থন করেছেন।
একই দ্বিচারিতা দেখা যায় বিপ্লবের পরও। এ সময় সালাফীরা অনেক ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যেমন- তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, যা ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদের নীতিবিরোধী। তাদের সাম্প্রতিক অবস্থান যেন এটাই ইঙ্গিত করছে যে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বভৌমত্বকে যেন পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে এবং শরী‘আতের পরিবর্তে জনগণের ইচ্ছাকেই সংবিধানের ভিত্তি হওয়ার বিষয়টি অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও মেনে নিয়েছে। ফলে বিষয়টি এমনই দাড়াচ্ছে যে, খিলাফতের পরিবর্তে গণতন্ত্রই হতে যাচ্ছে আগামী সংবিধানের ভিত্তি। সালাফীরা তাদের এই স্ববিরোধী অবস্থানকে কিভাবে আগামীতে মোকাবিলা করবেন সেটাই দেখার বিষয়।
পরিশিষ্ট :
মিসরের জাতীয় নির্বাচন ও সালাফীদের অবস্থান
২০১১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী মোবারক সরকারের পতনের ৮ মাস পর অন্তর্বতীকালীন সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩ দফায়। গত বছর ২৮-২৯শে নভেম্বর’১১ ১ম দফা ভোট গ্রহণের পর ১৪-১৫ ডিসেম্বর’১১ ২য় দফা এবং ৩-৪ জানুয়ারী’১২ ৩য় দফা ভোট গ্রহণ করা হয়। এই নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব সকল হিসাব-নিকাশ যে উল্টে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনে ৬৫% ভোট পেয়েছে ইসলামপন্থীরা, যা সত্যিই সকল পূর্বানুমান ছাড়িয়ে গেছে। ফলে মিসরের শাসনক্ষমতা যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ইসলামপন্থীদের হাতেই যাচ্ছে তা সুনিশ্চিত। পার্লামেন্টের মোট ৫০৮টি সীটের মধ্যে জনগণ নির্বাচিত ৪৯৮টি সীটে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’ সমর্থিত ২২ দলীয় গণতান্ত্রিক ব্লক ‘ফ্রীডম এন্ড জাস্টিস’ পার্টি জয়লাভ করেছে সর্বাধিক ২৩৫টি সীটে (৩৭.৫%)। আল-বাদাভী নেতৃত্বাধীন সেক্যুলার ব্লক ‘নিউ ওয়াফ্দ’ পার্টি এবং আহমাদ হাসান সাঈদ নেতৃত্বাধীন ইজিপশিয়ান ব্লক লাভ করেছে যথাক্রমে ৩৮টি (৯.২%) ও ৩৫টি (৮.৯%) সীট। অন্যদিকে ‘দাওয়াহ সালাফিয়াহ’ সমর্থিত ১৬ দলীয় ইসলামী ব্লক ‘হিযবুন নূর’ পার্টি জয়লাভ করেছে ১২৩টি সীটে। প্রথমবারের মত রাজনৈতিক পার্টি গঠন করেই সালাফীরা সর্বমোট ভোটের ২৭.৮ শতাংশ (৭৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ২৬৬টি ভোট) তথা এক-চতুর্থাংশেরও বেশী ভোট লাভ করেছে, যা ছিল একেবারে অচিন্তনীয়। সম্মিলিত ইসলামিক ব্লকের ১২৩টি সীটের মধ্যে সালাফী দল ‘হিযবুন নূর’ এককভাবেই লাভ করেছে ১১১টি সীট এবং পরবর্তীতে ১৮০ সদস্য বিশিষ্ট শূরা কাউন্সিলেও তারা পেয়েছে ৪৫টি সীট।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা মিসরের নতুন সংবিধান রচনা করবেন। রচনা সম্পন্ন হবার পর এই সংবিধানের উপর একটি গণভোট আয়োজিত হবে। অতঃপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া পুরোপুরি সম্পন্ন হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে ৩০শে জুন ২০১২ পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, গত ২৪শে মার্চ ‘হিযবুন নূর’ শায়খ হাযেম ছলাহ আবু ইসমাঈলকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে মনোনায়ন প্রদান করেছে। শায়খ আবু ইসহাক আল-হুয়ায়নীসহ অন্যান্য সালাফী আলেমগণ এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন।
হিযবুন নূর পার্টির পরিচয় :
মিসরীয় বিপ্লবের পর মিসরে হঠাৎ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়া সালাফী সংগঠন ‘দাওয়াহ সালাফিয়াহ’ বা ‘দাওয়াহ মুভমেন্ট’ তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট হিসাবে ‘হিযবুন নূর’ পার্টি গঠন করে ২০১১ সালের ১২ই মে। পবিত্র কুরআনে স্বীয় কওমকে লক্ষ্য করে শু‘আইব (আঃ)-এর উদ্ধৃত বক্তব্য তথা ِإنْ أُرِيدُ إِلاَّ الإِصْلاَحَ مَا اسْتَطَعْتُ (অর্থাৎ আমি আমার সাধ্যমত সংশোধন চাই-হুদ ৮৮)-এ আয়াতটিকে মূলনীতি করে ‘হিযবুন নূর’ তাদের শ্লোগান নির্ধারণ করেছে ‘هوية ودولة عصرية’ অর্থাৎ ‘আত্মপরিচয় ও আধুনিক রাষ্ট্র’। পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে ইমাদুদ্দীন আব্দুল গফুর এবং ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাইয়েদ মুছত্বফা, যিনি বর্তমানে পার্টির সংসদীয় দলের প্রধান।
অতীতে মিসরের সালাফীরা রাজনীতিতে জড়াতে কোন আগ্রহ দেখাননি। কেননা তারা বিশ্বাস করতেন, যে প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি ভুয়া এবং অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা। এজন্য মিসরীয় বিপ্লবের শুরুতে তাঁরা প্রথমে নিশ্চুপ এবং পরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু মিসরীয় বিপ্লব শুরু হলে তারা শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে বিপ্লবের সমর্থনে রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়েছিলেন, যদিও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলকে তারা সমর্থন করেননি। তারা ধারণা করেছিলেন, এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানো মূলত আমেরিকারই কারসাজি। এর মাধ্যমে তারা সরকারকে দিয়ে মিসরীয় জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদেরকে বিভক্ত করতে চায়।
কিন্তু বিপ্লবের পর তাদের আগের অবস্থান একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তারা মিসরের পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী পরিচিতিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে নতুন একটি দল হিসাবে ‘হিযবুন নূর’ নির্বাচনে যে সফলতা পেয়েছে তা তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং মিসরীয় সমাজে সালাফীদের গ্রহণযোগ্যতারই পরিচায়ক। ৩০শে মে’১১ নির্বাচনী ইশতিহার প্রকাশ করা হয়। ৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৪২ পৃষ্ঠার ইশতিহারে তারা উল্লেখ করেছিলেন, ‘হিযবুন নূর’ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশৃংখলা দূরীকরণ ও জনগণের জান-মালের নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেবে। তারা আরও ঘোষণা করেন যে, তারা নির্বাচিত হলে মিসরকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। দেশের অধিকাংশ জনগণের আক্বীদা-বিশ্বাস অনুসারে মিসরের পরিচিতি হবে ইসলামী এবং আরব দেশ হিসাবে। মিসরের সরকারী ভাষা হবে আরবী, রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, ইসলামী শরী‘আত হবে আইন রচনার ভিত্তি। দেশের সংবিধান যেভাবেই রচিত হোক না কেন, এই মৌলিক বিষয়গুলোকে সর্বাবস্থায় সংবিধানের উর্ধ্বে বিবেচনা করা হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সূদী লেনদেন উচ্ছেদ করা হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বত্র ইসলামী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হবে ইত্যাদি।
তবে সালাফীদের ভোট পাওয়ার পিছনে এসব অঙ্গীকারের তেমন ভূমিকা ছিল না। কেননা ইখওয়ানের প্রতিশ্রুতিও কম-বেশী অনুরূপই ছিল, এমনকি মোবারক সরকারের সংবিধানেও প্রায় হুবহু ধারা সন্নিবেশিত ছিল। তাই সালাফীদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে তাদের বাহ্যিক অনাড়ম্বরতা, শরী‘আতের পাবন্দী এবং উদার মানসিকতা তাদের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের ব্যাপকভিত্তিক দাতব্য কার্যক্রমও তাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তারা ভোট পেয়েছেন সাধারণত: সেসব নতুন ভোটারের, যারা কট্টর ইসলামপন্থী কিন্তু ইখওয়ানীদের সংকীর্ণ দলকেন্দ্রিক মানসিকতা, অনুদারতা এবং স্বার্থবাদী ধ্যান ধারণার কারণে তাদের উপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ।
সমালোচনা :
যত মহৎ লক্ষ্যেই সালাফীগণ রাজনীতির ময়দানে পদার্পণ করুন না কেন, তাদের এই নীতি পরিবর্তনকে সাধারণ সালাফীপন্থীদের অনেকেই সুদৃষ্টিতে নেননি। দীর্ঘকাল যাবৎ দ্বীনের ব্যাপারে যে আপোষহীন ভাবমূর্তির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল সালাফী আন্দোলন, তার এই আপোষমুখী ছন্দপতন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যার প্রমাণ মিলেছে তাদের নিজস্ব^ ওয়েবসাইটেই। বেশকিছু সমালোচনামূলক প্রশ্নের উত্তরে তারা তাদের বর্তমান অবস্থান ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে এভাবে-
১. আপনারা ইতিপূর্বে প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে পাপাচার বলে এসেছেন, কিন্তু এখন আপনারা নিজেরাই সর্বশক্তি নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন-এটা কেন?
উত্তর : রাজনীতি হল জ্ঞানের অনুশীলন ও তার কার্যকরী প্রয়োগ, একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিপালন ও তা বাস্তবায়নের প্রয়াস। জ্ঞান ও তত্ত্বগতভাবে ইতিপূর্বেও আমরা যেমন রাসূল (ছাঃ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের গৃহীত সর্বশ্রেষ্ঠ নীতির (শরঈ রাজনীতি) অনুসরণ করে এসেছি, আজও করে যাচ্ছি। পরিস্থিতি বিবেচনায় সমাজের সার্বিক কল্যাণ বা সমস্যার দিকে লক্ষ্য রেখে ইজতিহাদের সুযোগ সর্বাবস্থায় রয়েছে। পূর্ববর্তী শাসনামলে যে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তাতে শান্তিপূর্ণভাবে শরঈ নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কেননা তৎকালীন সময়ে সরকার সুযোগ পেলে কেবল বিরোধীদের গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হত না; বরং শরঈ আইনের কোন একটি তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তা নিমিষেই পরিত্যাগ করার মত বেপরোয়া ছিল। এর প্রমাণ ভুরি ভুরি। সাথে সাথে অপসারিত প্রেসিডেন্ট স্বৈরতান্ত্রিকভাবে কলমের জোরে পার্লামেন্ট চালাতেন। তাই তৎকালীন রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে আমরা বৈধ মনে করিনি।
২. জাতীয় সংসদসমূহ অনেকের দৃষ্টিতে কুফরী সংসদ কেননা তা শরী‘আত অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। বর্তমানে এমন কি সংস্কার এসেছে যে আপনাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে গেল?
উত্তর : মোবারক সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের সংবিধানে যে নতুন সংশোধনী আনা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল ইসলামী শরী‘আতবিরোধী সমস্ত আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। এই আইন অনুমোদনের পর ইজতিহাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মিসরের পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ আর অবৈধ নয়। কিন্তু তৎকালীন ন্যাশনালিস্ট পার্টির একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার কারণে অন্য কোন দলের পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি নিরর্থক হয়ে পড়ে। ফলে আমরা সে সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি।
প্রশ্ন : উদারপন্থীদের সাথে ‘হিযবুন নূর’-এর যে জোট বাধার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে ‘হিযবুন নূর’-এর বক্তব্য কী?
উত্তর : এর উত্তরে ‘দাওয়াহ সালাফিয়াহ’ নেতা ড. ইয়াসের বারহামী তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইট ‘ছওতুস সালাফ’-এ বলেন, শরী‘আতবিরোধী মতাদর্শের কোন দলের সাথে জোট বাধার বিষয়টিতে আমি সাধারণভাবে বলব, এটা জায়েয নয়। তবে আল্লাহ্র মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে প্রয়োজনে জোট বাধা যেতে পারে। তবে এটা হতে হবে কেবলমাত্র হক্বকে বিজয়ী করার স্বার্থে। প্রচলিতঅর্থে যদি বিষয়টি হক্ব-বাতিল যাই হোক সকল ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে পরস্পরের সহযোগী হবে-এমনটি হয়, তবে তা কখনই জায়েয হবে না। অনুরূপভাবে ঐ সকল মৈত্রীতাও জায়েয নয়, যা তথাকথিত কেকের মত বিভক্তিকে সমর্থন করে। অর্থাৎ উদারপন্থীরা তাদের মত উদারপন্থার প্রচার করবে, গণতন্ত্রীরা গণতন্ত্রের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হাতে আইন রচনার ভার তুলে দিবে, আবার ইসলামপন্থীরা নিজ অবস্থানে থেকে নিজেদের মত ইসলাম প্রচার করে যাবে-এ ধরণের জোট গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এতে ‘হিলফুল ফুযূল’-এর মত হক্বকে বিজয়ী করা বা মযলূমের অধিকার সংরক্ষণের কোন স্বার্থ নেই। এটা একটা ভ্রান্ত ক্বিয়াস।
শেষকথা
এটা সত্য যে, মিসরের নির্বাচনে সালাফীদের বিজয় একটা বড় ঘটনা এবং মিসরে তাদের জনসমর্থনও যে কতটা তুঙ্গে তার একটা অভাবনীয় চিত্র ফুটে উঠেছে এ নির্বাচনে। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে সালাফীরা কেবলমাত্র একটি তাত্ত্বিক গোষ্ঠী নয়; বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখার মত গভীর আন্দোলনী শক্তি তাদের মাঝে সমভাবে বর্তমান। বিশ্ব মিডিয়াতেও তারা বড় ধরনের ইতিবাচক-নেতিবাচক কাভারেজ পেয়েছেন। ফলে হঠাৎ করেই দৃশ্যপটে এসে যথেষ্ট সমীহ অর্জন করতে পেরেছে মিসরের সালাফীরা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি আপাতত আড়ালে পড়ে গেছে তা হল, এ নির্বাচনে সালাফীদের জয় হয়েছে বটে, কিন্তু তারা খুইয়েছে অনেক কিছুই। আপাতত যত যুক্তি এবং মহৎ উদ্দেশ্যের কথাই বলা হোক না কেন, প্রকৃতঅর্থে এতে সালাফীদের নৈতিক পরাজয়ই ঘটেছে। কেননা যে আদর্শের জন্য সালাফীদের আপোষহীন সংগ্রাম, যে সুন্নাতে নববীকে সুরক্ষা দানের জন্য তাদের সুখ্যাতি, যে খুলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের শাশ্বত প্রতিজ্ঞা-এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই প্রতিজ্ঞার শুভ্র পরিচ্ছদে কি বড় এক কালো ছোপ রেখাপাত করল না? এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মিসরে সালাফীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বিপুল বিজয় অর্জনে সালাফীপন্থীদের প্রকৃতঅর্থে খুশী হওয়ার মত কিছু ঘটেনি। কেননা যে বিজয়ের জন্য তাদেরকে দীর্ঘদিনের লালিত আদর্শকে বিকিয়ে দিতে হয়েছে, যে আদর্শের লড়াইয়ে নেমে তাদেরকে আপন ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করতে হয়েছে, তাতে গর্বের কিছু নেই বরং তা নিতান্তই লাঞ্ছনার। ইতিমধ্যেই ইরান সম্পর্কে তারা যে আপোষমুখী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের আপোষকামিতার যে সকল দৃষ্টান্ত ফুটে উঠছে, তাতে একটি কট্টর আদর্শিক আন্দোলনের পথ থেকে পিছু হটে প্রচলিত স্বার্থবাদী আদর্শহীন গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হতে তাদের খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। আল্লাহ আমাদেরকে সুমতি দান করুন এবং সকল প্রকার দুনিয়াবী স্বার্থ ও লোভ-লালসা থেকে হেফাযত করুন। এ মুহূর্তে আল্লাহ্র নিকট কায়মনোবাক্যে আমরা এই দো‘আই করতে পারি-‘হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না, আমাদেরকে হেদায়াত দানের পর এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা (আলে ঈমরান ৮)।
লেখক : মাস্টার্স অধ্যয়নরত (উছুলুদ্দীন), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।