ইউটিউবার দাঊদ কিম
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1043 বার পঠিত
[ইভোন রিডলে (Yvonne Ridley) একজন
বৃটিশ মহিলা সাংবাদিক। ১৯৫৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ডারহামে জন্মগ্রহণ
করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে নেন এবং সানডে টাইমস,
ইন্ডিপেন্ডেন্ট, দি অবজারভার, দি মিরর প্রভৃতি খ্যাতনামা পত্রিকায় কাজ
করেন। তিনি ‘সানডে এক্সপ্রেস’-এর প্রধান রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন
২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার মাত্র কয়েকদিন আগে
ছদ্মবেশে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন। কিন্তু তালেবানদের হাতে সাথে সাথেই
তিনি বন্দি হন। তাঁর বন্দি হওয়ার ঘটনা এ সময় বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার
পায়। পরবর্তীতে মুক্তিলাভের পর তিনি ইসলাম বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন।
অবশেষে ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। পবিত্র কুরআনের
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তিনি একে আখ্যা দিয়েছিলেন নারীদের জন্য
‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসাবে। বর্তমানে তিনি লন্ডনভিত্তিক প্রেস টিভিতে কাজ
করছেন এবং একজন শক্তিশালী মানবাধিকারকর্মী হিসাবে মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আন্দোলন পরিচালনা করছেন। ইসলাম
গ্রহণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন
পত্রিকা, ওয়েবসাইট ও ব্লগ থেকে প্রাপ্ত তার বন্দিজীবন এবং ইসলাম গ্রহণের
বিবরণভিত্তিক তিনটি সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো-নির্বাহী
সম্পাদক]
দুঃসাহসী বৃটিশ মহিলা সাংবাদিক ইভোন রিডলের নামটি ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি নাম। আফগানিস্তানের গগণচুম্বী পর্বতশৃঙ্গকে যিনি নত করেছিলেন তার দুঃসাহসিক মনোবল দ্বারা। জাদরেল পশ্চিমা সাংবাদিকরা যখন তালেবান-আলকায়েদার স্বর্গরাজ্য আফগানিস্তানের কথা ভেবে আতঙ্কে অাঁতকে উঠত এবং নাইন ইলেভেনের পর মার্কিন রণহুঙ্কারের পাল্টা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পাক-আফগান সীমান্ত জিহাদী আগ্নেয়গিরির সংকেত ঈষাণ কোনে জমাট বেঁধে উঠছিল তখন একজন মহিলা হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন র্যাডলি। কিন্তু ভাগ্যিস! তালেবানের অদক্ষ হাতেই ধরাশায়ী হলো বৃটিশ সাংবাদিকের নায়কসুলভ ও বীরত্বপূর্ণ সকল কৌশল। আফগান বোরকার মধ্যে তালেবানরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন, ভিন্ন জাত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন চামড়ার এক রমণীকে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অবশেষে তাঁর ঠাঁই হলো কারার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। পরে জানা গেল তিনি এক বিখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক। কিন্তু পরিস্থিতি তালেবানদের বাধ্য করল তাকে পর্যবেক্ষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখতে। আসুন রিডলের মুখেই আমরা শুনি তাঁর গ্রেপ্তার, মুক্তি ও ইসলাম গ্রহণের কাহিনী।
মিসরে একান্ত সাক্ষাৎকারে রিডলে
২০০৬ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত (WAMY)-এর সম্মেলনে বিশেষ অতিথির আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হলে সাংবাদিক হাসুনা হাম্মাদ সম্মেলনের ফাঁকে তাঁর কাছ থেকে নিচের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন।
প্রশ্ন : শুরুতেই আপনি কিভাবে ইসলামে প্রবেশ করে ধন্য হলেন সে সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।
রিডলে : আমি ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার আগে ‘সানডে এক্সপ্রেস’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আফগানিস্তানের ইসলামী দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন তালেবানদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ তালেবানের হাতে আমি বেআইনীভাবে আফগানিস্তানে প্রবেশ করার অভিযোগে গ্রেফতার হই। ১০ দিন আমি তাদের কাছে যিম্মী থাকি। প্রতিটি সময় আমি তাদের হাতে নিহত হওয়ার ভয়ে আতংকিত ছিলাম। ষষ্ঠ দিনে হঠাৎ তালেবানের এক শায়খ এসে আমাকে ইসলামে প্রবেশ করার দাওয়াত দিলেন। আমি বলে দিলাম এটা সম্ভব নয়। তবে তারা আমাকে মুক্তি দেয়ার শর্তে এ প্রতিশ্রুতি প্রদান করি যে, লন্ডন ফিরে গেলে আমি কোরআন নিয়ে গবেষণা করব। আসলে এ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তির সুযোগ বের করা। কেননা, আমি যেকোনো উপায়ে এ সংকট থেকে বের হতে চাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে কি, এ পথটি বা বলতে পারেন আমার এ কৌশলটি সফল হয়। অতঃপর তারা আমাকে এবং আমার সাথে অন্যান্যদেরও মুক্তি দিল। মোল্লা ওমর মানবিক কারণে আমাকে মুক্তি দেন। মুক্তিলাভের পর দেশে ফিরে আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি আমার কমিটমেন্ট রক্ষা করবো। আমি কুরআন শিখতে লাগলাম এবং দীর্ঘ ৩০ মাস ইসলাম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করি। বাস্তবিকই তখন আমি অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করছিলাম।
প্রশ্ন : তালেবানের হাতে বন্দী থাকাকালে আপনার সঙ্গে তাদের ব্যবহার কেমন ছিল?
রিডলে : আমি তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করি। অনশন করি। আমি যতই তাদের সাথে কঠোর আচরণ করতে থাকি ততই তারা আমার সাথে নম্র ব্যবহার করতে থাকে। তারা আমাকে বলত, তুমি আমাদের বোন। আমাদের অতিথি। আমরা চাই তুমি খুব স্বাচ্ছন্দে এখানে থাক। আমি মনে মনে ভাবতাম যে, যদি আমি তাদের সাথে নম্রতা প্রদর্শন করি, তাহলে তারা আমার সাথে কঠোর ব্যবহারে উদ্যত হবে। বিদ্যুতের শক, ধর্ষণ ইত্যাদি দ্বারা তারা আমাকে নির্যাতন করবে, আমেরিকা যা মুসলমানদের সাথে গোয়ান্তানামো এবং আবুগারীবের কারাগারে করে আসছে। কিন্তু আমি একজনকেও পেলাম না যে আমাকে হয়রানি করেছে কিংবা আমার দিকে খারাপ দৃষ্টি দিয়েছে।
প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনি কি কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন?
রিডলে : ইসলাম গ্রহণের পর আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। বৃটিশ সরকারী বাহিনী আমার ওপর নির্যাতন চালায় আমার ব্যক্তিগত কারণে নয়। শুধু কেবল ইসলামের কারণে। তবে আমি ব্লেয়ার সরকারের নিকট সম্মানিত ছিলাম। আমার কাছে এমন সব পত্র আসে যেখানে বলা হয়, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করবে কিংবা হিজাব পরিধান করবে সে যেন পাশ্চাত্য সমাজে নিজেকে সংঘাতের প্রথম কাতারে শামিল করে নিল। আর বাস্তবিকই হিজাব পরিধানকারী মহিলারা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মুখোমুখী। দুঃখের বিষয়, অনেক আরব ও মুসলিম দেশেও একই অবস্থা।
প্রশ্ন : আপনি কি কুরআনের ভাষায় আরবী শেখার ব্যাপারে কোন চিন্তা-ভাবনা করেছেন?
রিডলে : আমি আরবীতে শুধু একটি শব্দই জানি। আর তা হলো, আল-হক্ব (সত্য) এবং এ শব্দটি আমি আমার কথাবার্তা ও আলোচনায় প্রায়ই উল্লেখ করে থাকি।
প্রশ্ন : আপনার পরিবারের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? বৃটিশ প্রশাসনের ন্যায়?
রিডলে : আমার দুই বোন। বড় বোন বিশ বছর ধরে এক মুসলিম পরিবারের প্রতিবেশী হওয়ায় তিনি আমার ইসলাম গ্রহণের সংবাদে বিচলিত হননি, স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার দ্বিতীয় বোন আমাকে বিদ্রূপ করে বলেছিল, এবার তুমি আত্মঘাতি হামলার কাজটিও সেরে ফেল। আর আমার আম্মাও বিচলিত হয়ে গীর্জায় আসা-যাওয়া বাড়িয়ে দিলেন। তিনি স্বভাবতই খুবই ধার্মিক। এ বিষয়টি ইসলামের কাছাকাছি। আর যখন আমি তাকে ইসলামের সুস্পষ্ট দাওয়াত দিলাম, তিনি বললেন, আমার বয়স ৭৯। এ অবস্থায় আমার পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : আপনি এখন কোথায় কর্মরত আছেন?
রিডলে : ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি বিভিন্ন ইসলামী মিডিয়ায় ইংরেজী ভাষায় অনেক আলোচনা উপস্থাপনা করেছি। পাশ্চাত্য মিডিয়াতেও ইদানিং আমি লেখালেখি শুরু করেছি। আমার সর্বশেষ প্রবন্ধটি ছিল ‘হিজাব’ যেটি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়। অমুসলিম বন্ধুদের সাথেও আমার সুসম্পর্ক বজায় আছে। বর্তমানে আমি আল-জাযীরা ইংলিশ চ্যানেলে কর্মরত রয়েছি।
প্রশ্ন : মুক্তির পর আপনি যে ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন, তার মধ্যে প্রথম বই/গ্রন্থ কোনটি ছিল?
রিডলে : এটি ছিল শহীদ সাইয়েদ কুতুব রচিত ‘মা‘আলিমুন ফিত ত্বরীক’। এ কিতাবটি পড়ে আমি খুব প্রভাবিত হই। যারা এটা পড়েননি আমি তাদের সকলকে এটা পড়ার অনুরোধ করবো। বড় দুঃখের বিষয় আমি যখন মিসর গিয়েছিলাম তখন লাইব্রেরিতে এই বইগুলো পাইনি। উসামা বিন লাদেনের ওপর আমি নিজেই একটি বই রচনা করেছি। কারণ তিনি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে উদ্দেশ্য উসামা বিন লাদেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন নয়।
প্রশ্ন : ডেনমার্কের ঘটনার পর মুসলিম ও পাশ্চাত্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার কী মূল্যায়ন?
রিডলে : আমাদের শক্তি ঐক্যের মাঝে। যা আমরা পশ্চিমা পণ্য বয়কটের মাধ্যমে লক্ষ্য করেছি। অর্থনৈতিক বয়কট সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে আমি যায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্রের সমর্থক সকল দেশের কোম্পানিগুলোর পণ্য বয়কট করা উচিত বলে মনে করি। আমি তো এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, মুসলমানরা কীভাবে কোকাকোলা পান করে। তারাতো কোকাকোলা নয়, ফিলিস্তিনী ভাইয়ের রক্ত পান করছে। অর্থনৈতিক বয়কট হল মতপ্রকাশের একটি শান্তিপূর্ণ উপায়।
প্রশ্ন : পাশ্চাত্যের ইসলামভীতি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
রিডলে : আমি মনে করি, অন্যের সাথে সম্পর্ক ও কর্মপন্থা ঠিক করার আগে আমাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। বিশেষত মুসলিম সমাজে ঐসব লোকেরা যারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে; মিসরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ফারুক হোসনীর মত লোকেরা। আল্লাহ তার অন্তরকে রোগমুক্ত করুক। তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। সে তো বুঝতে পারেনি তার এসব বক্তব্য পাশ্চাত্যের মুসলিম নারীদের কত ক্ষতি করেছে। বলুন আমরা শত্রুর মোকাবিলা কীভাবে করি? সমস্যা তো আমাদের ভিতর থেকেই।
প্রশ্ন : এমন কোন মুসলিম মহিলার নাম বলুন ইসলাম গ্রহণের পর যারা দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন?
রিডলে : অনেক মুসলিম আরব মহিলা দ্বারা; তবে বিশেষ করে যায়নাব আল-গাযালী (র.)-এর কথা উল্লেখ করব। তাঁর আত্মজীবনী আমাকে মুগ্ধ করেছে।
তুর্কী পত্রিকার সাক্ষাৎকারে র্যাডলি
প্রশ্ন : আপনি কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করলেন?
রিডলে : প্রেসিডেন্ট বুশ তালেবান সরকারকে বিশ্বের সর্প বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করি, আমি তালেবানদের হাতে বন্দি হয়েছি, মার্কিনীদের হাতে নয়। আমি তাদের বন্দিশালায় যেন মেহমানখানায় অবস্থান করছিলাম। আমি কিভাবে তালেবানদের কৃতজ্ঞতা আদায় করব! কোন ভাষা পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত, তালেবান সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। আমি তাই স্থির করে নিলাম, আমি তাদের ধর্ম অধ্যয়ন করব। আর এ অধ্যয়ন ও গবেষণাই আমাকে ইসলামের পথ দেখাল।
প্রশ্ন : আপনি তালেবান যোদ্ধাদের হাতে কিছু দিন বন্দি ছিলেন, তাদের ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী?
রিডলে : সত্যিই তারা উত্তম মানুষ। ইউরোপে তো আমার অনেক মুসলিম বন্ধুরাও রয়েছেন। কিন্তু তারা আমাকে ঐভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি যেভাবে তালেবানরা পেরেছে। আমি ১০/১১ দিন এমন সব লোকের সাথে কাটিয়েছি যাদেরকে হিংস্র ও বর্বর বলে গালি দেয়া হতো; কিন্তু তারা তো কখনো সে রকম ছিল না। তাদের ভালোবাসা ও নিষ্ঠা আমার মাঝে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন : আপনার সাথে তাদের আচরণ কেমন ছিল?
রিডলে: তারা খুবই সম্মানজনক ও মানবিক ব্যবহার করেছে। যদি একে আবু গারীব বা গোয়ান্তানামোর সাথে তুলনা করেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, আমার বন্দিত্ব ছিল একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। আমি তাদেরকে কথা দিয়েছি, ইসলাম সম্পর্কে পড়ালেখা করব যদি তারা আমাকে মুক্তি দেয়। আমি সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, বৃটিশ সরকার যাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছে তারা বরং স্বাধীনতার যোদ্ধাই বটে; যারা নিজের দেশের জন্য মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে গ্রহণ করলেন?
রিডলে : আমি দীর্ঘ ৩০ মাস ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করেছি। আমি বিশেষত কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রভাবিত হই। আমি বিশ্বাস করি, একটি নতুন দুনিয়া আমি আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। আমি অনুভব করতে লাগলাম, একটি নতুন তাড়না আমাকে স্বীয় স্থানে স্থিতবস্থায় থাকার ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে অনুভব করতে লাগলাম, ঈমান আমার অন্তরকে প্রশান্ত করছে। মনে হচ্ছিল, আল্লাহ নিজেই আমার অন্তরে ইসলামের বীজ বপন করে চলেছেন এবং আমাকে ঐ আধুনিক সভ্যতার পংকিলতা থেকে মুক্ত করছিলেন যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার অন্তরে এক চমৎকার প্রশান্তি ও স্বস্তিবোধ-এর সূচনা হতে লাগল। এটা নিশ্চয়ই আল্লাহপ্রদত্ত। আর তখনই আমি মনে করলাম, ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণার সময় এসে গেছে। অমনি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলাম। আমি হয়ে পড়লাম তখন থেকে মুসলিম। আমি বিশ্বাস করি, একমাত্র আল্লাহ্ই আমাকে তার হেদায়াত দান করেছেন। আজ আমি ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করছি। আসলে ঈমান হলো এ দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম অনুভূতি।
প্রশ্ন : আপনার কি আপনার নাম পরিবর্তন করেছেন, নামটি কি তা জানতে পারি?
রিডলে : জি করেছি। তবে আমি এখন ঘোষণা করতে চাই না।
প্রশ্ন : কেন?
রিডলে : আমি মনে করি, এটা তার জন্য উপযুক্ত সময় নয়। যখন সময় হবে তখন অবশ্যই ঘোষণা করব। তবে এতটুকু বলব যে, তা এমন এক মুসলিম মেয়ের নাম যাকে প্রত্যেক মুসলিম ভালোবাসে।
প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনার আশেপাশে কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়?
রিডলে : তারা প্রথমে ব্যথিত হয়। বিশেষত আমার আম্মা। কেননা, পশ্চিমারা এমন আড়াল তৈরি করে রেখেছিল, যা ইসলামকে দেখার পথে প্রতিবন্ধক হয়েছিল। এ আড়াল দূর করা গেলে অনেক পশ্চিমাই কিন্তু ইসলামে প্রবেশ করবে। কারণ ইসলামের আত্মিক প্রশান্তির জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী।
প্রশ্ন : কিছু দিন আগ থেকে আপনি হিজাব পরা শুরু করেছেন, এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কি?
রিডলে : আমি নিজের জন্য মনে করি, হিজাব হলো মুসলিম নারীর সর্বোত্তম প্রতীক। এই হিজাবের বিরুদ্ধে অনেক সহিংসতা হয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি, কোন শক্তি আমার কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। হিজাব পরিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এটি আল্লাহ্র নির্দেশ। আখেরাতের চিরস্থায়ী জগতে আল্লাহ্র নির্দেশ পালন ছাড়া সৌভাগ্য আশা করা যায় না। ইসলাম গ্রহণ করার পর যে বিষয়টি আমাকে চরমভাবে আলোড়িত করে, তা হলো, হজের মৌসুমে হিজাব পরিহিতা হাজার হাজার নারীর দৃশ্য। আমার তখনই মনে হলো যেন ফেরেশতাদের সৈন্যদের মাঝে আমি অবস্থান করছি। সত্যিই এ অনুভূতিটি ছিল খুবই চমৎকার।
প্রশ্ন : তুরস্কের বিদ্যালয়গুলোতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আপনার জানা আছে কি?
রিডলে : হ্যঁা।
প্রশ্ন : এই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
রিডলে : এ নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে গর্হিত; বিশেষ করে তা এমন এক দেশে যার সাথে ইসলামের নামটি সম্পৃক্ত। বাস্তবিকই এ বিষয়টি আমাকে চরমভাবে আশ্চর্যান্বিত করেছে।
প্রশ্ন : হিজাব পরিধানকারী একজন নারী হিসেবে যদি আপনার ওপর এরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তা হলে আপনি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন?
রিডলে : আমি আমার অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
প্রশ্ন : এ দেশে হাজার হাজার মেয়ে এ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, আপনি তাদের ব্যাপারে কী বলেন?
রিডলে : অধিকার অর্জনের প্রয়াসে আমি তাদেরকে সমর্থন করি। আমার ঐসব বোনদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, তোমরা শেষ পর্যন্ত স্বীয় ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাও এবং আল্লাহ্র ওপর ভরসা রেখে এ সংগ্রামে লিপ্ত হও। বিজয়ের ব্যাপারে তোমরা হতাশ হবে না।
প্রশ্ন : পাশ্চাত্যরা দাবি করছে, ইসলাম নারীদের অধিকার খর্ব করেছে। ইসলামে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
রিডলে : আমি কখনো এ কথা বুঝতে পারি না, পশ্চিমাদের এসব প্রপাগান্ডার পিছনে কি কারণ রয়েছে? কেননা, ইসলাম নারীদেরকে যে মূল্যায়ন করেছে সেটিই তো আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, জান্নাত মায়ের পদতলে। পুরুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি হলো সে, যে পরিবারের সাথে সদাচরণকারী। এটি একটি চমৎকার বিষয়। সন্তান প্রসবের জন্য ইসলাম নারীদের বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। মাকে সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ভূষিত করেছে। আমার দৃষ্টিতে একজন সৎ মা-ই হলো মুসলিম নারীর সর্বোৎকৃষ্ট গুণ।
প্রশ্ন : ইরাক, ফিলিস্তীন সংক্রান্ত নানা কর্মসূচিতে আপনার ব্যাপক অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করি। ফিলিস্তীনে হামাসের বিজয় সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
রিডলে : নির্বাচনে হামাসের বিজয়ের সংবাদটি ছিল আমার জন্য সে সময় সবচেয়ে আনন্দদায়ক বিষয়। এটি ছিল আমাদের সিংহশার্দুল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিজয়। আমার দু’নয়ন দিয়ে পানি এসে যায় এবং আমি আল্লাহ্র প্রতি শুকরিয়া স্বরূপ সিজদায় লুটিয়ে পড়ি। শেখ আহমাদ ইয়াসিনের দৃশ্যগুলো বারবারই আমার চোখে ফুটে উঠতে থাকে।
প্রশ্ন : প্রায় এক সপ্তাহ যাবত পশ্চিমা পত্রিকাগুলো মহানবী (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র ছাপিয়ে চলছে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কি?
রিডলে : পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে আমি আরেকবার ক্রোধ লক্ষ্য করলাম। এ ধরনের ঘৃণ্য বিষয় বরদাশ্ত করা যায় না। পাশ্চাত্য অনুধাবন করতে পারেনি, মুসলমানদের হৃদয়গুলোতে মহানবী (ছাঃ)-এর বিশাল স্থান রয়েছে। তিনিই তো আমাদের সবকিছু। যে প্রতিক্রিয়া আমার ভাইয়েরা বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন করেছে তা আমাকে আনন্দিত করেছে। টিভির পর্দায় যখন মুসলমানদের বিক্ষোভ সমাবেশগুলোর দৃশ্য দেখি তখন আমার মনে হয়, বিশ্বের প্রতিটি স্থানে আমার ভাইদের অস্তিত্ব রয়েছে। আমি মুসলমানদের ভালোবাসি এবং অনুধাবন করি, আমার এই অনুভূতিই হলো ঈমান।
প্রশ্ন : তুর্কী জনগণের জন্য আপনার পয়গাম কী?
রিডলে : তাদেরকে ইসলামী আবেগভরা সালাম রইল আমার পক্ষ থেকে। মুসলমান হিসেবে আমাদের অনেক কিছু করণীয় রয়ে গেছে। ইসলামের বাণী সকলের নিকট পেঁŠছিয়ে দিতে হবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্যাতন বন্ধেও আমাদের কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের দেশে এসেছি যাতে ইরাক ও ফিলিস্তীনে দখলদারিত্ব অবসানে কিছু করতে পারি। চুপ করে বসে থাকা ছাড়াও আমাদের প্রত্যেকের অনেক কাজ রয়েছে। আপনারা জাগ্রত হোন। ছড়িয়ে যান। নানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করুন। দখলদারদের পণ্য বয়কট করুন। আল্লাহকে আহবান করুন। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলুন। এ আওয়াজ দ্বারা দুনিয়াকে পরিপূর্ণ করে দিন। ‘আল্লাহু আকবার’ সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ। আগামীকাল আমাদের বিজয় সংবাদ আসবে।
মক্কায় একান্ত সাক্ষাৎকারে র্যাডলি
আবরার আহমাদ : আফগানিস্তানে আপনার প্রবেশ এবং অন্তরীণ থাকাকালীন তালেবানদের সাথে আপনার সম্পর্কের বিষয়ে কিছু বলুন।
রিডলে : আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমার ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার ঘটনাটি ছিল তালেবানদের নিকট আমি বন্দি হওয়ার পর। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আমি বেআইনিভাবে আফগানিস্তানে প্রবেশ করি। এটি ছিল ১১ই সেপ্টেম্বরের পর। আসলেই আমি পরিচয় গোপন করে বোরকা পরিধান করে বেআইনিভাবে আফগানিস্তানে প্রবেশ করি। দশ দিন আমি বন্দি ছিলাম। মোল্লা ওমরের ব্যক্তিগত নির্দেশে পরে আমার মুক্তি হয়। এ অন্তরীন থাকাকালীন পুরো সময়টি জুড়ে আমার ভবিষ্যতের ব্যাপারে এক প্রচন্ড ভীতি আমার উপর চেপে বসেছিল। অথচ বরাবর তালেবানরা আমার সাথে ন্যায় ও সৎ ব্যবহার করে যাচ্ছিল। বিশ্ববাসীকে আমি এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, বন্দি থাকাকালীন আমি কোন প্রকার লাঞ্ছনা, দুর্ব্যবহার এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হইনি। আমাকে কোন হয়রানি করা হয়নি। বিশ্ববাসীর কাছে আমি এটাও স্বীকার করতে চাই, আমি আল্লাহ্র কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ যে, আমার গ্রেফতারি ছিলো একটি ‘বর্বর ও হিংস্র’ গোষ্ঠীর হাতে; মার্কিনীদের হাতে নয়। মুক্তির কিছুদিন পরেই আমি কোরআন শরীফ পড়তে শুরু করলাম। জনৈক তালেবান মোল্লা আমাকে এই কুরআনটি হাদিয়া দিয়েছিলেন। জালালাবাদের বন্দিশালায় তিনি আমার সাথে দেখা করেন। আমি তাকে চিনতে পারছি না এবং আমার মনে হয় তিনি কোন সাধারণ আফগানী নন। কেউ যদি আমাকে এখনো সেই ভদ্রলোকের পরিচয় দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করতে পারে তাহলে আমি কৃতজ্ঞ হবো। কেননা, এটি এমনি অনেকগুলো বাস্তব বিষয়ের অংশ, যা এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। যাহোক, সমস্ত আশা ও প্রত্যাশার বিপরীতে তালেবানরা আমাকে মুক্তি দিল। এটি ছিল ঐ সকালে যার আগের রাতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে এবং সে হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। আমি বিরামহীনভাবে কুরআন শরীফ অধ্যয়ন এবং গবেষণা চালিয়ে গেলাম। এই দিনগুলি ছিল আমার জীবনে চমৎকার আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের সূচনা। আর এখন তো আমি মক্কায় হজ করতে এসেছি, ঐ পোশাকেই যে পোশাক আমি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বন্দিশালায় পরিহিত ছিলাম। কেননা, এ ধরনের পোশাক (ইসলামী পোশাক) এক বিশেষ প্রতীকের প্রতিনিধিত্ব করে; যার পটভূমি ও ফলাফল আমি পরে অনুধাবন করতে পেরেছি।
আবরার আহমাদ : এখন আপনার অনুভূতি কেমন? এবং এই আধ্যাত্মিক ভ্রমণকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রিডলে : আমি আপনাকে সবচেয়ে গভীর আবেগময় এক অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। একদিন আমি পবিত্র কাবার পথে চলছিলাম, কিন্তু মানুষের চাপে প্রচন্ড ভিড়ের কারণে আমি হারাম শরীফে প্রবেশ করতে পারছিলাম না। এ ছিল এক অস্বস্তিকর অবস্থা। হঠাৎ ছালাতের জন্য আযানের ধ্বনি শুরু হলো। আর অমনি কয়েক মিনিটের মধ্যে এই উপচে পড়া মানব ভিড় কাতারে কাতারে সুশৃঙ্খল হয়ে পড়ল পূর্ণ শান্তভাবেই। আমি মনে করি, দুনিয়ার কোন বিশাল সামরিক বাহিনীও এই ডিসিপ্লিন দেখাতে পারবে না। আমি মনে মনে যেন চিৎকার করে বলতে লাগলাম, আল্লাহ্র বাহিনীর চেয়ে কোন বাহিনীই অধিক আনুগত্যশীল ও শক্তিশালী ডিসিপ্লিনের অধিকারী হতে পারবে না। তবে দুঃখের বিষয়, মসজিদের বাইরে এমন ধরনের ঐক্যের প্রতিকৃতি আঁকতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি আমাদের শক্তি প্রদর্শন করতে। আমরা যদি ঐক্যের শক্তি দ্বারা একতাবদ্ধ হতাম তাহলে দুনিয়াতে কেউ আমাদের ভূখন্ডে আগ্রাসন অথবা আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখাতো না। আমাদের জনগণকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। দুঃখের বিষয় মসজিদের বাইরে আমরা এই শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছি। যাইহোক, হারাম শরীফের এই সময়গুলো আমার জন্য আলোকিত মুহূর্ত ছিল; যা বিশ্বে একটি বৃহত্তম ও সর্বোত্তম পরিবারের সাথে আমার সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি গর্বের সাথে এটাও অনুধাবন করি, কোনো একদিন ঐসব ভাই-বোনের সাথে কোনো না কোনো স্থানে দেখা হবে যখন নূরের পথে চলার জন্য তারা আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, তারা অতি দ্রুত আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আসবেন। আমি এটাও অনুভব করছি, মুসলমান ভাইদের যে কোন কাজে সমানভাবে আমিও এগিয়ে যাবো।
আবরার আহমাদ : আপনার বর্তমান কর্মব্যস্ততা কী?
রিডলে : আমি বর্তমানে একটি সংগঠনের সাথে জড়িত। যার নাম ‘স্টপ পলিটিক্যাল টেরর’। সংস্থাটি বৃটিশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি মুসলমানদের সাহায্যার্থে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বৃটিশের এই কারাগারটি গুয়ান্তানামোর মতোই; যেখানে বিনা বিচারে কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুসলমানদেরকে বন্দি রাখা হয়েছে। আমরা তাদের মানবাধিকার রক্ষায় ও লজ্জাজনকভাবে বন্দি করে রাখার বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে আমি আরেকটি সংস্থার সাথে জড়িত যার নেতৃত্বে রয়েছেন জর্জ জালাবি। এটি রাজনৈতিক সংস্থা। আগামী ইলেকশনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক। যদি আমি এই নির্বাচনে সফল হতে পারি তাহলে আমি হব প্রথম বৃটিশ নারী যিনি হিজাব ধারণ করে পার্লামেন্টে প্রবেশ করবেন।
আবরার আহমাদ : কোন এলাকা থেকে আপনি নির্বাচন করবেন?
রিডলে : লেস্টার শহরের দক্ষিণাঞ্চল থেকে। যেখানে ব্যাপক সংখ্যক হিন্দি ও গুজরাটিদের বসবাস রয়েছে। তারা আমাকে ভালো করেই চিনে এবং আশা করি আমি তাদের আস্থা অর্জন করতে পারব; যা আমাকে তাদের পক্ষে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ এনে দিবে।
আবরার আহমাদ : কী কারণগুলো আপনাকে ইসলাম গ্রহণের দিকে উদ্বুদ্ধ করেছে? তালেবানদের সদ্ব্যবহার, না কুরআন শরীফ অধ্যয়ন?
রিডলে : বন্দিত্বের ষষ্ঠ দিনে জালালাবাদে জনৈক শায়খ আমাকে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ আছে কি না জিজ্ঞেস করলে আমি তাকে উত্তর দিয়েছিলাম, তাড়াহুড়ো করে এই মুহূর্তে আমি এমন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারব না, যা আমার জীবনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। আর আমিতো কারাগারের মধ্যেই। কিন্তু তোমরা আমাকে মুক্তি দিলে আমি তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, আমি গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন এবং ব্যাপকভাবে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করব। এই সাক্ষাতের আধাঘণ্টার মধ্যেই আমাকে রাজধানী কাবুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমাকে একটি অস্বস্তিকর কারাগারে রাখা হয়। এর কারণ প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। পরে আমি জানতে পেরেছি, মোল্লা ওমর আমাকে প্রথমে পুরুষ মনে করেছিলেন। তাঁকে শুধু এতটুকু সংবাদ দেয়া হয়েছিল, একজন পশ্চিমা সাংবাদিক আটক হয়েছে। শুধু এতটুকু জেনেই তিনি আমার বিষয়টা নিয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছিলেন। পরে তার এক উপদেষ্টা তাকে এ কথা অবগত করেন, আমি একজন মহিলা, পুরুষ নই। এটা জানতে পেরে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন এ কারণে যে, আমি এমন একজন মহিলা যার সাথে কোন নিকটাত্মীয় বা মহিলা সাথী নেই। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে কাবুলের মহিলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মনে হয় এই ধরনের বিষয়টি (পুরুষদের মাঝে একা মহিলার অবস্থান) তালেবানদের চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমার জন্য মোল্লা ওমরের সিদ্ধান্তের অর্থ ছিল জালালাবাদের অতি আরামদায়ক কারাগার থেকে কাবুলের নোংরা কারাগারে অবস্থান। মোল্লা ওমর এজন্য চিন্তিত ছিলেন নারীসঙ্গী ব্যতীত আমি অসহায়ের মতো। আর এটি শরী‘আতের পরিপন্থী।
আবরার আহমাদ : আপনার দৃষ্টিকোণে আপনি মনে করছেন যে, তালেবানরা শরঈ কারণেই কাবুলের কারাগারে স্থানান্তর করে আপনার প্রতি ইনসাফ করেছে। তবে আপনি কুরআন শরীফ অধ্যয়ন করার ব্যাপারে তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রিডলে : ভালো কথা। আমি যখন লন্ডনে নিরাপদে কোন আঘাত ছাড়াই ফিরে যাই, তখন আমি বিশ্বাস করলাম আমাকে মুক্তি দিয়ে তালেবানরা তাদের কথা ও প্রতিশ্রুতি রেখেছে সবরকম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। বিশেষ করে যখন তালেবানদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছিলো, তখন তো কেউ আমাকে জীবিত দেখবে তা কল্পনাও করেনি। তালেবানরা ওয়াদা রক্ষা করেছে। এবার আমি অনুভব করলাম, এখন ওয়াদা রক্ষার পালা আমার। অতঃপর আমি কুরআন পড়তে শুরু করলাম। আমাকে একজন শায়খ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর কুরআনের একটি চমৎকার অনুবাদ কপি উপহার দেন। আমি তৎক্ষণাৎই কুরআন শরীফের ঐসব আয়াত খুঁজতে লাগলাম যেগুলো নারীদের সংশ্লিষ্ট। কেননা, ইসলাম নারীদেরকে পশ্চাদপদ রেখেছে এই ধারণাটির বাস্তবতা সম্পর্কে জানার জন্য আমি দারুণভাবে পিপাসিত ছিলাম। কুরআনের দুই মলাটের মাঝে আমি তো এই ধারণার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। আমি তাই পেয়েছি যা আমি এতদিন শুনিনি। শিক্ষা, বিয়ে, উত্তরাধিকার সম্পদ এবং অন্যান্য অধিকারসমূহ আমি এটাও জানতে পেরেছি যে, যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি ছিলেন একজন নারী। ইসলামের প্রথম শহীদও ছিলেন একজন নারী। আরো জানি, আল্লাহ তো জান্নাতকে মায়েদের পদতলে করেছেন। রাসূলের এই হাদীছ সম্পর্কে অবগত হই যেখানে তিনি জনৈক ব্যক্তির এই প্রশ্ন ‘আমি কার সাথে উত্তম ব্যবহার করবো’-এর উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার মায়ের সাথে’।
আবরার আহমাদ : আপনার বর্তমান কার্যক্রম কী?
রিডলে : আমি বর্তমানে ‘ইসলামিক চ্যানেল’ নামে একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত আছি, ইউরোপের সর্বত্র তার পরিধি বিস্তৃত। আপাতত আমাদের প্রোগ্রাম সীমিত হলেও ভবিষ্যতে আমাদের রয়েছে বড় পরিকল্পনা। আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের প্রোগ্রাম বিস্তৃত করতে সচেষ্ট। সেখানে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অতি শীঘ্রই আমরা ইংরেজী ভাষায় সংবাদ প্রচারের জন্য কাজ শুরু করব। তবে চ্যানেলটিতে আমার কাজ হল, সপ্তাহব্যাপী প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম উপস্থাপন করা, যেখানে আমি বিশেষভাবে বৃটিশ মুসলমানদের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে থাকি; যার লক্ষ্য হল, মুসলমানদের উনণয়নের পথে সহায়ক বিষয়গুলো তুলে ধরা। চ্যানেলটির এক অধিবেশনে দেখা যায়, সরাসরি টেলিফোনের মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডের জনৈক মহিলা তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা দিয়েছেন। আর স্টুডিওতে যে শায়খ আমাদের সাথে উপবিষ্ট ছিলেন, তিনি ঐ ভদ্র মহিলাকে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করালেন। ঐ মুহূর্তগুলো ছিল চমৎকার ও ঐতিহাসিক। এটি ছিল আমাদের টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে কালেমায়ে শাহাদাতের প্রথম ঘোষণা।
সত্যিই আমি যা চাচ্ছি তা হল, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা; যা তারা ১১ই সেপ্টেম্বরের পরে হারিয়ে ফেলে। আমি বলতে চাই, আমাদের উচিৎ ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার বিষয়ে এত বেশি ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা, কোনো অবস্থাতেই আমরা তার জন্য দায়ী নই। আর এটি শেষ ঘটনাও নয়। বলুন তো, ফিলিস্তীনের বর্বরতার জন্য সকল ইহুদিকে কি সমানভাবে দোষারোপ করা যাবে? তেমনি ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার ব্যাপারেও সব মুসলমানকে অভিযুক্ত করা যায় না।
শায়খুল আযহার ও মিসরীয় মন্ত্রীর সমালোচনায় র্যাডলি
ইসলাম গ্রহণের পর বিভিন্ন আরব দেশের অসংখ্য সেমিনারে তিনি যোগদান করেন; ভ্রমণ করেন বিভিন্ন মুসলিম দেশ। মুসলিম দেশে তার সেই ভ্রমণের প্রাক্কালে অতি কৌতূহলপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতা তিনি উল্লেখ করেন। ঘটনাটি মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ মুসলিম ব্যক্তিত্ব শেখ সৈয়দ আলী তানতাভী সম্পর্কিত, যিনি বর্তমান ‘শায়খুল আযহার’ পদটি অলংকৃত করে আছেন। ইভোন রিডলে যখন তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন, তখন হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে অভ্যর্থনা জানাতে ‘শায়খুল আযহার’ উদ্যত হলে রিডলে নিজেকে তা থেকে বিরত রাখেন। প্রত্যুত্তরে বিব্রত শায়খ বলে উঠলেন, ‘তুমি মৌলবাদী’। আযহারের রেক্টর তার আশেপাশের লোকদের উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, ‘এ ধরনের (রিডলে) যারা নতুন ইসলামের দাওয়াত দ্বারা মুসলিম সমাজে অন্তর্ভুক্ত হন, তারা কেবল মৌলবাদী বক্তব্য ও কণ্ঠ ছাড়া অন্য কারো অনুকরণ করে না।’ রিডলে শায়খুল আযহারের এসব বাজে উক্তির সমালোচনা করে বলেন, ‘আমি কোনো বিশেষ দল বা শায়খের আনুগত্য জরুরী মনে করি না, আমি শুধু সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ্র কথাই বুঝি’।
২০০৬ সালে তিনি মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত মুসলিম সংস্থা (WAMY)-এর দশম সম্মেলনে মিসরের মন্ত্রী ফারুক হাসানের কড়া সমালোচনা করে তাকে বহিষ্কারের দাবি করেন। উক্ত সম্মেলনে রিডলে বলেন, আমি মিসরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে জানতে পেরেছি, এই মন্ত্রী মুসলিম নারীদের হিজাবকে পশ্চাদপদতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর চিহ্ন বলে আখ্যা দিয়েছেন। মিসরের জনগণকে আমি জিজ্ঞাসা করব, তারা কেন এমন লোককে স্তব্ধ করতে পারলেন না, যে হিজাব ধারণকারী প্রতিটি নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছে। তার এসব উক্তি অত্যন্ত কদর্যপূর্ণ ও ঘৃণ্য। এসব লোক যারা পশ্চিমাদের চেয়েও বেশি পশ্চিমা হতে চাইছে তাদের মুসলিম দেশের মন্ত্রীত্বের পদে থাকার কোন যোগ্যতা নেই। তাদেরকে স্বীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ।
তিনি আরো বলেন, হিজাব পাশ্চাত্যের নেতিবাচক জীবন যাপনকে প্রত্যাখ্যানের প্রতীক। এটি পশ্চিমাদের জন্য একটি নৈতিক বার্তা। অর্থাৎ আমরা তোমাদের মত জীবন ধারণ করতে চাই না। মিসরীয় মন্ত্রীর মত যেসব লোক পাশ্চাত্যদের চেয়েও বেশি নিজেদের পাশ্চাত্য প্রমাণ করতে চায়; তারা সর্বদা অন্যের প্রতি বিদ্রূপ ছড়িয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। উক্ত সম্মেলনে তিনি দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে এর জন্য মুসলমান শাসকদেরকেও অভিযুক্ত করেন।