স্পেন বিজয় : ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়

ড. মুহাম্মাদ আতাউর রহমান 2866 বার পঠিত

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে স্পেন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাচীনকালে স্পেন আইবেরীয় উপদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। অপরূপ সুন্দর এই উপদ্বীপটি মুসলিম শাসনামলে আন্দালুস নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ২,৯৫,১৪০ বর্গমাইল। চারদিকে প্রাকৃতিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। উত্তর ও পশ্চিমে বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং পূর্বে পীরেনীজ পর্বতমালা। স্পেনের একটি বিশাল অংশ পীরেনীজ পর্বত দ্বারা গঠিত। চৌদ্দ মাইল প্রশস্ত জিব্রাল্টার প্রণালী উত্তর আফ্রিকা এবং তিনশ’ মাইল দীর্ঘ পীরেনীজ ফ্রান্স ও ইউরোপের অবশিষ্ট ভূ-খন্ড হতে একে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এটি আফ্রিকার সাথে ইউরোপ মহাদেশের যোগসূত্র রচনা করে এবং ভূমধ্যসাগরে নৌচলাচলের মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশের সাথে সম্পর্ক রজায় রাখে। পীরেনীজ পর্বতমালার পরেই ফ্রান্সের অবস্থান।

স্পেনে মুসলমানদের আগমন :

ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত স্পেনে ৭১১ খ্রীস্টাব্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানগণ ৭১১ থেকে ১৪৯২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আটশ’ বছর স্পেন শাসন করেন। পবিত্র কুরআনের বাণী ও মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নির্দেশ তাদেরকে দেশ বিজয়ে উৎসাহ যোগায়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তিরোধানের পর খলীফা আবুবকর (রা.) তাঁর স্বল্পকালীন শাসনামলে (৬৩২-৬৩৪ খ্রী.) বহিঃর্বিশ্বের দিকে তেমন মনোনিবেশ করতে পারেননি। দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে (৬৩৪-৬৪৪ খ্রী.) ইসলামী রাষ্ট্র সম্প্রসারণের প্রথম পর্যায় সূচিত হয়। কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারও দেশ বিজয়ের কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। তবে উমাইয়া খলীফা আল-ওয়ালিদের রাজত্বকালে (৭০৫-৭১৫ খ্রী.) মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রবল গতি সঞ্চারিত হয়। সাম্রাজ্য বিস্তারে ওয়ালিদের গৌরব ইতিহাসে চিরদিনই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। খলীফা ওমরের সময় বিজয়ের যে সূচনা হয়েছিল, তার সার্থক রূপ লাভ করে আল-ওয়ালিদের সময়। এ সময় মুসলিম আধিপত্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে সম্প্রসারিত হয়। দক্ষিণ-পূর্বে আমুরদরিয়া হতে উত্তর-পশ্চিমে আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। এ সুবিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, কুতাইবা, মুহাম্মদ বিন কাসিম, তারিক বিন যিয়াদ, মূসা বিন নুসাইর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। বিশ্ববরেণ্য রণনিপুণ মূসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদের শৌর্যবীর্য, পরাক্রম ও অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের বহু স্থানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। খলীফা আল-ওয়ালিদ ৭০৭ খ্রীস্টাব্দে ইয়ামানের অধিবাসী মূসা বিন নুসাইরকে ইসান বিন নোমানের স্থলে উত্তর আফ্রিকার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। মূসা তাঁর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ৭০৮ খ্রীস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকাকে মিসরের আওতা হতে সরাসরি দামেস্কের অধীনে আনেন। বার্বার বাইজান্টাইনদের মিলিত শক্তিকে মূসা পরাজিত করে মরক্কো (তিউনিসিয়া), তাঞ্জিয়ারসহ সমগ্র আফ্রিকাতে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর মূসা ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আইবেরিয়ান উপদ্বীপের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

৬৯৮ খ্রীস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজধানী কার্থেজ থেকে বাইজান্টাইনগণ বিতাড়িত হয় এবং তিউনিসে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বাহিনী সমগ্র উত্তর আফ্রিকা বিজয় করে দুর্বার গতিতে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর সংযোগকারী জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে ইউরোপে প্রবেশ করে। তারা অতি দ্রুতগতিতে ফ্রান্সের প্রবেশদ্বার পীরেনীজ পর্বতমালা অতিক্রম করার আকাঙ্খায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। মুসলমানগণ আলজেরিয়া হয়ে মরক্কোতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বার্বারগণ বাধার সৃষ্টি করে। তিউনিসিয়ার গভর্ণর মূসা বিন নুসাইর ৭০৮ খ্রীস্টাব্দে তাদের প্রতিরোধ করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে মূসা বিন নুসাইর তাঁর পক্ষ হতে আবু যুর‘আ তারীফ নামক একজন বার্বার মুসলিম যুবককে এ অভিযানে প্রেরণ করেন। আর তারীফকে এ অভিযানে প্রেরণের একটি কারণও ছিল-যা ইবনুল ‘ইযারী তার ‘আল-বায়ানুল মুগরিব ফী আখবারিল আনদালুস ওয়াল মাগরিব’ এ উল্লেখ করেছেন যে, জাযীরাতুল খাদরা বা সিউটার গথিক গভর্ণর জুলিয়ান তদানীন্তন আফ্রিকার মুসলিম গভর্ণর মূসা বিন নুসাইরের নিযুক্ত তানজার শাসক তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে মূসা বিন নুসাইরকে স্পেন অভিযান পরিচালনা করার অনুরোধ জানান। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, ‘সেসময় ইফ্রিকিয়া মুসলমানদের অধীনে সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের আশীর্বাদ লাভ করে জাগতিক উন্নতির দিকে অগ্রসরমান ছিল, তখন নিকটবর্তী আইবেরীয় উপদ্বীপ ভিজিগথ শাসনের লৌহকঠিন পদতলে পিষ্ট হচ্ছিল।’ এমতাবস্থায় কাউন্ট সিউটার গভর্ণর জুলিয়ান এবং উত্তর আফ্রিকার স্পেনীয় উদ্বাস্ত্তদের অনুরোধে মূসা বিন নুসাইর স্পেন অভিযানে নেতৃত্বদানের জন্য দামেস্কের খলীফা আল-ওয়ালিদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। খলীফা আবেদন মঞ্জুর করেন। মূসার প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ স্বরূপ জুলিয়ানের অনুগত কিছু ব্যক্তি ৭০৯ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেন আক্রমণ করেন। অন্যদিকে মূসা তাঁর ভৃত্য তারীফকে ৭১০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে ৪০০ পদাতিক ও ১০০ অশ্বারোহী বার্বার সৈন্যসহ স্পেনের দক্ষিণ উপকূল জরিপ ও প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন। তারীফ যে দ্বীপটিতে অবতরণ করেন সেটি আজও ‘তারীফা’ নামে তার স্মৃতি বহন করছে। তারা ৪টি জাহাজযোগে স্পেন পৌঁছেন। তারীফ পরিস্থিতি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদ নিয়ে মূসার নিকট প্রত্যাবর্তন করেন এবং অভিযান পরিচালনার অনুকূলে রিপোর্ট পেশ করেন। মূসা এ অভিযানে তারিক বিন যিয়াদকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁকে বলেন, ‘বৎস তোমার ওপর অত্যন্ত কঠিন দায়িত্বভার অর্পণ করছি। এ বিশাল  দেশ জয় করার জন্য আমার ছেলেদের বাদ দিয়ে তোমাকেই নির্বাচিত করছি। আগামীকাল শুক্রবার সালাতের পরই তুমি জাহাজ নিয়ে যাত্রা করবে।’ এরপর মূসা খলীফা আল ওয়ালিদের আদেশানুক্রমে ৭১১ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল (৯৯ হিজরীর ৮ই রজব) ৩০০ আরব ও ৭০০০ বার্বার সৈন্যের একটি দল তাঞ্জিয়ারের (Tangiers) শাসনকর্তা প্রখ্যাত সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন প্রেরণ করেন। এ সময় সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে মূসা এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণটি নিম্নরূপ-

‘তারিকের অধিনায়কত্বে তোমরা শীঘ্রই যাত্রা করছ। তোমরা সকলেই জান সে বয়সে তরুণ এবং অনভিজ্ঞ। তোমাদের অনেকেই আছ, যারা তারিকের চেয়েও বয়সে বড় এবং তার চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ। কিন্তু তার মধ্যে নেতৃত্বের এমন সব গুণাবলী রয়েছে যা অধিকাংশ লোকের মধ্যে দুর্লভ। আল্লাহ তা‘আলার মেহেরবাণীতে তোমরা আজ মুসলমান। সুতরাং তোমরা জান নেতার প্রতি আনুগত্য বলতে কি বুঝায়। তোমাদের নেতার প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে ইসলামের যা নির্দেশ রয়েছে তোমরা অবশ্যই তা পালন করবে। স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে না আল্লাহ্র শাস্তি নেমে আসে তাদের ওপর। আল্লাহ এবং তাঁর দয়ার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা রেখ। জয় তোমাদের হবেই।’[i]

ওয়াকিদী বলেন, ‘মূসা বিন নুসাইরের আমিল তারিক বিন যিয়াদ হিজরী ৯২ সনে আন্দালুস আক্রমণ করেন। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম আন্দালুস অভিযানে যান।’ কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক প্রেরিত ৪টি জাহাজে তারিক বিন যিয়াদ জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করে তা দখল করেন। স্পেনের মাটিতে নেমে তারিক একটি পাহাড়ের ওপর আরোহণ করেন এবং সেখানে উড্ডীন করেন ইসলামের পতাকা। এ স্থানে অবস্থানকালে তারিক তাঁর নৌবহরের অধ্যক্ষ বদরকে ডেকে সকল জাহাজ পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ করেন। তরুণ ও দুঃসাহসী তারিক সুস্পষ্ট ভাষায় বদরকে জানিয়ে দেন, ‘আমরা আর ফিরে যাচ্ছিনা বদর। আমরা থাকতেই এসেছি। আল্লাহর রহমতে আমরা  জয়লাভ করবই। এদেশ আমরা শাসনও করব।’ তাঁর আদেশ মত জাহাজগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরদিন তিনি স্পেনের অভ্যন্তরে যাওয়ার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। যাত্রাকালে মুজাহিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন তারিক। ভাষণটি নিম্নরূপ- ‘ভাইসব আমরা আজ স্বদেশ থেকে অনেক দূরে। আমাদের প্রিয় স্বদেশ এবং এ শত্রু দেশের মাঝে রয়েছে এক বিশাল গভীর সমুদ্র। আমাদের দেশ থেকে আমাদের জন্য কোন সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারি না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ভেব না, তোমরা নিঃস্ব একাকী। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সঙ্গে আছেন। আমি জাহাজগুলো পুড়িয়ে ফেলেছি, যাতে তোমাদের মন থেকে দেশে ফেরার সম্ভাবনা মুছে ফেলতে পার। আমরা এসেছি, হে বন্ধুগণ! ফিরে যেতে নয়। বরং এসেছি, এ দেশকে স্বদেশ ভূমিতে পরিণত করতে। যদি আমাদের বিপদ কিছু ঘটেই, তবে এই জাহাজগুলো আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। শুধু আল্লাহর ওপরই আমাদের ভরসা করা উচিত। আমরা সেই আল্লাহরই বান্দা যিনি তাঁর রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর উম্মতদেরকে সাহায্য করেছিলেন বদর, হুনায়ন, কাদেসিয়া, আজনাদাইনের রণক্ষেত্রে ঘোর বিপদের মাঝে। আমরা যুদ্ধ করছি সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। পার্থিব ধন সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। আমরা এক অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী, যিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সাহায্য করেছেন অবিশ্বাসীদের দেশে এবং কুতাইবা বিন মুসলিমকে সাহায্য করেছেন সুদূর তুর্কিস্তানে। আমরাও যদি মুহাম্মদ বিন কাসিম ও কুতাইবার ন্যায় একই উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করি, যদি থাকে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিকতা, তবে আমরাও পাব জয়মাল্য। এস, আমরা ধর্মের পথে হই গাযী অথবা শহীদ।’

তারিকের স্মৃতি বিজড়িত সেই স্থান আজও জাবালুত তারিক (তারিকের পর্বত) নামে তাঁর স্মৃতি বহন করছে। পরবর্তীকালে তিনি সেখানে ‘রাবাত’ নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ পাহাড়টি পরবর্তী আক্রমণ পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করে জিব্রাল্টার থেকে উপকূল পথে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন। তারিক একটি আরবীয় ঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। মুসলিম বাহিনী সকল বাধা অতিক্রম করে কার্থেজ’ ও ‘লাগুন দে জান্দা’ অধিকার করেন। স্পেনের মার্সিয়া প্রদেশের গভর্ণর থিওডোমী রডারিককে মুসলিম বাহিনীর আগমন সংবাদ প্রেরণ করেন। থিওডোমীর রডারিককে লিখেন- ‘মহামহিম রাজা, আমাদের দেশ যাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের নামধাম কিছুই জানি না। এমনকি আমি বলতে পারছি না তারা কোত্থেকে এসেছে, তারা কি আকাশ থেকে নেমে এসেছে, না পাতাল ফুড়ে এসেছে তা জানি না। তাদের সংখ্যা ৭,০০০ বেশী হবে না। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ সাধারণ, অস্ত্রশস্ত্র হালকা। তাদের অশ্বের সংখ্যাও খুব কম। কিন্তু তারা এতই সাহসী যে তা চিন্তাও করা যায় না। তাদের গতি ক্ষিপ্র। তাদের শিবিরে তারা মিষ্টভাষী, কোমল অন্তঃকরণের লোক। তাদের সুন্দর ব্যবহার মানুষের অন্তরকে জয় করে। তারা ভদ্র এবং মিষ্ট। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তারা সিংহের চেয়েও সাহসী, বাঘের চেয়েও হিংস্র। তারা বিদ্যুতের মতই ক্ষিপ্র। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা পাহাড়ের মত অটল হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড় ভেদ করা সম্ভব। কিন্তু তাদের ব্যুহ ভেদ করা যায় না। সংক্ষেপে বলতে গেলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা অসম্ভব। তাদের সেনাপতি একজন সুদর্শন তরুণ। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন, তিনি একজন সাধারণ সৈনিকের মত পোশাক পরিধান করেন এবং একজন সাধারণ সৈনিকের মতই অস্ত্রসজ্জিত। অথচ সকলেই তাকে সম্মান করে। আমাদের পবিত্র দেশ থেকে এ আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করার জন্য আমি ৩টি যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি পরাজিত হয়েছি। যদিও আমার সৈন্যবাহিনী তাদের চেয়ে বহুগুণ বেশী ছিল। আমার সৈন্যরা এ বিদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আর সাহস পাচ্ছে না। তারা ভীত হয়ে পড়েছে। এ আক্রমণকারীদের সমুচিত শাস্তি প্রদান করে আমাদের পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’

স্পেনে মুসলমানদের আগমনের সংবাদে আতঙ্কিত রডারিক অতি দ্রুত অন্যান্য সামন্ত নৃপতিদের সেনাসহ ১ লক্ষের একটি সম্মিলিত বাহিনী সুসজ্জিত করেন। এই বাহিনীর সঙ্গে অনেক রাজপুত্র ও খ্রিস্টান পুরোহিত ছিলেন। পুরোহিতরা ক্রুশ হাতে নিয়ে এসেছেন খ্রিস্টান যোদ্ধাদের আশীর্বাদ করতে এবং মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করতে। রডারিকের প্রস্ত্ততির খবর পেয়ে তারিক আরো সৈন্য পাঠানোর জন্য আফ্রিকায় অবস্থানরত মূসাকে অনুরোধ জানান। ফলে আফ্রিকা থেকে আরো ৫,০০০ বার্বার অশ্বারোহী সৈন্য আসে তারিকের শক্তি বৃদ্ধি করতে। এ নবাগত অশ্বারোহী বাহিনী ছিল বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী এবং যুদ্ধের কঠোরতায় অভ্যস্ত। সর্বোপরি তারা ছিল ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ এবং নেতৃত্বের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে মে (৯২ হিজরীর ২২ রজব) ‘লূকা’ উপত্যকায় গোয়াদিলেট নদীর উপকূলে মেদিনা সিদনিয়ার শহর ও হ্রদের মধ্যবর্তী স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। তারিকের সেনাবাহিনীতে মুবিস আর-রূমী নামে একজন গ্রীক মুসলমান সৈনিক ছিলেন। তারিক ইসলামের মহান ঐতিহ্য অনুযায়ী মুবিস আর-রূমীর নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি পাঠালেন রডারিকের নিকট শান্তির প্রস্তাব দিয়ে। রূমী রডারিককে বললেন, ‘হে স্পেনীয় নরপতি, আপনাকে জানাচ্ছি যে, আমরা এসেছি সাগরের ওপারের এক দেশ থেকে। বেশী দিনের কথা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের মত এবং আপনার মত আমরাও নিমজ্জিত ছিলাম পাপ পঙ্কিলতায়। লজ্জাজনক কাজ করতাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে একজন সর্বশেষ পয়গম্বর নিযুক্ত করে আমাদের ওপর তার অপার করুণা বর্ষণ করেছেন। সেই মহামানব আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। অল্প সময়ের ভেতর এক অলৌকিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন আমাদের মধ্যে। তিনি তার মহান শিক্ষা এবং কার্যাবলী দ্বারা বদলে দিয়েছেন জীবন সম্বন্ধে আমাদের পূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি। অধঃপতনের গভীর গহবর থেকে তিনি আমাদের তুলে এনেছেন। যে আলোকবর্তিকা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাই আমরা বহন করে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে। আমরা তার বাণী বহন করে ফিরছি মরুভূমি, সমভূমি এবং উপত্যকায়। আমরা আপনার নিকট এসেছি এ আশা নিয়ে যে, আপনাকে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারব এবং সঠিক পথ দেখাব। আমরা এসেছি আপনাকে আপনার রাজ্য এবং ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করতে নয়। বরং আপনাকে দিতে এসেছি ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব। আপনি দ্বিগুণ উপকৃত হবেন যদি আমাদের ধর্ম এবং জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করেন। অন্যথায় আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি আমাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে। তাহলে আমরা হব আপনার জীবন এবং সম্পত্তির জিম্মাদার। আপনাকে দেব আমরা আপনার ধর্মকর্মের স্বাধীনতা। যদি আপনি আমাদের প্রস্তাব দু’টি গ্রহণ না করেন, তবে তরবারি দ্বারাই আমাদের বিরোধের মীমাংসা হবে।’

রূমীর বক্তব্য শ্রবণ করে রডারিক বলেন- ‘আমরা আপনার সন্ধির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করছি। আমি আপনাদের প্রাণে মারব না যদি আপনারা আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যান। যে সমস্ত মালামাল আপনারা হস্তগত করেছেন আমাদের শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে তা দ্বিধাহীন চিত্তে আপনাদের দান করছি। আর ক্ষমা করছি, যে রক্তপাত আপনারা ঘটিয়েছেন সেই অপরাধ।’ এরপর রূমী বলেন,

‘আপনি আমাদের যা দিতে চাচ্ছেন সেজন্য আমাদের মহান সেনাপতির পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু আমাদের দাবি পুনরায় উত্থাপন করছি। আপনাকে আমরা আবার জানাচ্ছি আমাদের দেশ থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, এক বিরাট উদ্দেশ্যে। আমাদের উদ্দেশ্য আপনার নিকট ব্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের হটিয়ে দেই। আমরা আপনার যুদ্ধের প্রস্তাব গ্রহণ করছি।’

পরদিন ফজরের ছালাতের পর চূড়ান্ত যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তারিক সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক দিকনির্দেশনামূলক হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন। ভাষণটি নিম্নরূপ-

‘এ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার কোন পথ নেই। সম্মুখে রয়েছে শত্রু, পিছনে আছে নদী। একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান এবং তার পুরষ্কার পাবে এ বিশ্বাসেই আছে তোমাদের নিরাপত্তা। এই গুণাবলীর যদি অধিকারী হও, তবে তোমরা হবে অজেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্যই বড় কথা নয়, আসল কথা হচ্ছে ঈমান, যা নিয়ে যুদ্ধ করছ। আমাকে অনুসরণ করবে, যদি আমি আক্রমণ করি, তোমরাও আক্রমণ করবে। যদি আমি থেমে যাই, তোমরাও থামবে। আমি সেই অহংকারী অবিশ্বাসীর সঙ্গে যুদ্ধ করব। যদি আমি মৃত্যুবরণ করি, তবে আমার মৃত্যুতে তোমরা দুঃখ করো না, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ো না। পুরুষের মত যুদ্ধ করে যেও। তোমাদের নিজকে এবং তোমাদের জাতিকে অপমানিত করো না। যদি কাপুরুষের পরিচয় দাও, তবে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে যাবে তোমাদের নাম। আর যদি সাহসের পরিচয় দিতে পার, তবে পাবে এ সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যশালিনী দেশের শাসন ক্ষমতা। মনে রেখ, যদি তোমরা জয়লাভ কর তবে তোমরা হবে গাযী আর যদি মৃত্যুবরণ কর তবে হবে শহীদ। আল্লাহ এবং তার নবী তোমাদের দেখছেন এবং তোমাদের সঙ্গে আছেন। কারণ তোমরা যুদ্ধ করছ তাদের জন্যই।’

এরপর গোয়াদিলেট নদীর তীরে উভয় বাহিনীর মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ প্রায় ৭ দিন স্থায়ী হয়। এ যুদ্ধে রডারিকের কয়েকজন সৈন্য প্রথম দিকে তারিকের পক্ষ অবলম্বন করে। রডারিকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আন্তরিকভাবে স্পেনে মুসলিম শাসনকে অভিনন্দন না জানালেও মনেপ্রাণে রাজা রডারিকের পতন কামনা করত। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ শেষে গনিমতের মাল নিয়ে দেশে ফিরে যাবে এবং রডারিক যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত অথবা পরাজিত হবে। এ সুযোগে তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করা নিরাপদ হবে। কিন্তু তাদের সে আশা চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তারিকের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে গথিক বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ‘কারতাজিন্না’ নামক স্থানে ভীষণ যুদ্ধে রডারিকের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। হাজার হাজার গথ সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। রাজা রডারিক প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে গিয়ে গোয়াদিলেট নদী অতিক্রমকালে নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করে ইতিহাসের পাতা হতে চিরবিদায় গ্রহণ করল। ইউরোপের মাটিতে মুসলিম আধিপত্যের সোপান প্রোথিত হ’ল এবং ইউরোপের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হ’ল। তারিক কয়েকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করলেন। দাফন করলেন শহীদদের লাশ এবং ঠিক করলেন পরবর্তী পরিকল্পনা। আর এভাবেই স্পেনে ইসলামের অগ্রযাত্রার সূচনা হয়।

তারিক দূত পাঠিয়ে কায়রোয়ানে অবস্থানরত সেনাপতি মূসা বিন নুসাইরকে তাঁর সাফল্যের ফলাফল ও স্পেনের অবস্থা বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। মূসা স্পেন বিজয়ের খবর শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। এ মহাবিজয়ের সংবাদ শুনে কায়রোয়ানে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেদিন সবচেয়ে বেশি খুশী হয়েছিলেন মূসা। কিন্তু এ সময় মূসা তারিককে তাঁর অগ্রাভিযান স্থগিত রাখর নির্দেশ দেন। বিচক্ষণ সমরবিদ তারিক ভিজিগথদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ না দিয়ে অনতিবিলম্বে আক্রমণের প্রস্ত্ততি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি গনিমতের মাল নিয়ে আফ্রিকায় না ফিরে রডারিকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অবাক করে দেন এবং শহরের পর শহর দখল করেন। বিজয়দীপ্ত তারিক বাহিনী  কারমোনা, সিডোনিয়া, কর্ডোভা, গ্রানাডা ও ইজিসা বা একিজা দখল করেন। এরপর মুসলিম সেনাবাহিনী পূর্ব স্পেন গমন করেন এবং রডারিকের পক্ষে থিওডোমীর শাসনাধীন সম্পূর্ণ পূর্ব স্পেন, ভ্যালেন্সিয়া ও আলমেরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকা অতিদ্রুত দখল করেন। মুরসিয়ার গিরিসঙ্কটে থিওডোমীর অল্পসময়ের জন্য মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু অচিরেই মুরসিয়া ও অরিহুয়েলার পতন ঘটে।

মুরসিয়া ও অরিহুয়েলা বিজয়ের পর সেনাপতি তারিক গথ রাজধানী টলেডো অভিমুখে অগ্রসর হন। মুসলিম বাহিনীর দুর্বার অগ্রাভিযানে ভীত রাজন্যবর্গ, অভিজাত শ্রেণী ও যাজকগণ রাজধানী ত্যাগ করে আস্ত্তরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সাধারণ জনগণ ও ইহুদী সম্প্রদায় উৎফুল্লচিত্তে খ্রীস্টান ও অভিজাত শ্রেণী কর্তৃক পরিত্যক্ত শহর ও নগরের শাসনভার মুসলমানদের হস্তে সমর্পণ করে। তারিক বিনা বাধায় নগরে প্রবেশ করেন। নগরবাসীদের সাথে তিনি অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করেন। রাজধানী বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী প্রচুর পরিমাণে গনিমত লাভ করেন। জন্ম তারিখ, নাম, অভিষেক ও মৃত্যুর তারিখ উৎকীর্ণ করা স্বর্ণের ২৪টি রাজমুকুট এ গনিমতের মধ্যে ছিল। এগুলো গীর্জার গুপ্তস্থান হতে উদ্ধার করা হয়। এভাবে খলীফা আল-ওয়ালিদের রাজ্যসীমা সুদূর ইউরোপ ভূখন্ড পর্যন্ত প্রসার লাভ করে। তারিক তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক বিজয়ের জন্য স্মরণীয়। গথিক শাসকদের পরাজিত করে তিনি সীমাহীন খ্যাতি অর্জন করেন। মুসলমান ও তাদের মিত্রগণ দেশের উত্তরাঞ্চলে পলাতক খ্রিস্টানদের পরিত্যক্ত শহরগুলোতে বসতি স্থাপন করে। বিজিত শহরগুলোতে মুসলমান গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। এভাবে সেনাপতি তারিক মধ্য-পূর্ব স্পেন জয় করে স্পেনে মুসলিম পতাকা উড্ডীয়মান করতে সক্ষম হন। তারিকের শাসনাধীনে স্পেনের সাধারণ মানুষ এ আক্রমণকে তাদের কাছে আশীর্বাদরূপে গণ্য করেছিল। এখানেই সেনাপতি তারিকের সফলতার বীজমন্ত্রটি প্রোথিত।

মূসা বিন নুসাইরের স্পেন আগমন :

৭১২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে (৯৩ হিজরীর রজব মাসে) ১৮,০০০ সৈন্য নিয়ে আফ্রিকা হতে সেনাপতি মূসা বিন নুসাইর স্পেন যাত্রা করেন এবং কঙ্করময় খিদরী দ্বীপে পদার্পণ করেন। আরব অভিজাত ইয়ামেনের হাবিব বিন আবু আবাদাহ ফিহরী ইউসুফ আল-ফিহরীর পূর্বপুরুষ, রাসূল (ছাঃ)-এর সাহাবাদের বংশধর ও কিছু বার্বার সর্দার সমন্বয়ে গঠিত হয় তাঁর সেনাবাহিনী। আফ্রিকায় আগত কাউন্ট জুলিয়ানরা মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। মূসা ইচ্ছাপূর্বক তারিকের অগ্রাভিযানের পথ পরিহার করে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হন। প্রথমেই তিনি সিদনীয়া ও কারমোনা দখল করেন। এ দু’টি শহর তখনও পর্যন্ত মুসলিম শাসনাধীনে আসেনি। কয়েকমাস অবরোধের পর মূসা সেভিল অধিকার করেন। এরপরই নিয়েবলা ও বেজা বিজিত হয়। মূসা মেরিদাতে ভিজিগথদের এক শক্তিশালী সৈন্য দলের দুর্লঙ্ঘ্য প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। দীর্ঘ এক বছর অবরোধের পর মেরিদা শহর রক্ষায় নিয়োজিত সেনাদল ৭১৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ জুন আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ী বেশে মূসা টলেডোর নিকটবর্তী তারাভেরাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তারিক মূসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তৎকালীন প্রথানুযায়ী দুই বিজয়ী বীর তাঁদের মধ্যে অসি বিনিময় করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুই খ্যাতিমান বীরের সাক্ষাৎ আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘মূসা তারিককে তাঁর আদেশ অমান্য করার জন্য বেত্রাঘাত করেন (আল-বিদায়াহ ৯/৮৩; ইবনুল আছীর, আল-কামেল ফিত তারীখ ২/৩৪৩)।’ প্রবল বিক্রমশালী বীর সেনাপতি তারিক সামরিক শৃঙ্খলার প্রতি নজিরবিহীন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নীরবে এ অপমান সহ্য করেন। তাঁর এ সীমাহীন ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞা আমাদেরকে ওমর (রা.) ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘আবুবকর (রা.) খালিদকে ইয়ারমুক যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। যুদ্ধ চলাকালে আবুবকর (রা.)-এর ইন্তেকাল হলে ওমর (রা.) খিলাফত লাভ করেন। হিজরী ১৭ সনে ওমর (রা.) তাঁকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। খালিদ অবনত    মস্তকে খলীফার সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং একজন সাধারণ সৈনিক বেশে বাকী যুদ্ধে শরীক থাকেন।’ পরবর্তীতে মূসা ও তারিকের মধ্যে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মূসার নামে ল্যাটিন ভাষায় স্বর্ণ মুদ্রা চালু করা হয়। এরপর তাঁরা সম্মিলিত অভিযান শুরু করেন। সম্মিলিত বাহিনী আরাগোনা আক্রমণ করলে সেখানকার শাসক কাউন্ট ফরচুন আত্মসমর্পণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সারাগোসা, বার্সিলোনা, আন্তুরিকা, লিঁওন, লেগিয়া ও ক্যান্টাবেরিয়ার রাজধানী আমায়া মুসলমানদের অধিকারে আসে। উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য শহর একের পর মুসলমানদের করতলগত হয়। ফলে অনধিক দু’ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ স্পেন মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং উত্তরে পীরেনীজ পর্বতমালা পর্যন্ত এর সীমানা সম্প্রসারিত হয়।

মূসা পীরেনীজ পর্বতমালার অপর প্রান্তে অভিযান প্রেরণের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে আরো অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ফ্রান্সের অভ্যন্তরে সেনা অভিযান প্রেরণে খলীফা আল-ওয়ালিদের সমর্থন ছিল না বলে মুসলিম বাহিনী ‘রোন’ নদী অতিক্রম করেনি। রোন নদীর তীরে মুসলমানগণ আরবী ভাষায় উৎকীর্ণ লিপি দেখতে পান। এটি ফ্রান্সের শাসক পেপিন অথবা খলীফা ওয়ালিদের দূত মুগীছ স্থাপন করেছিলেন বলে অনুমিত হয়। এতে লিখিত ছিল ‘ক্ষান্ত হও আর অধিক অগ্রসর হয়ো না, ইসমাঈলের সন্তানগণ প্রত্যাবর্তন কর।’ এ শিলালিপি দেখে মুসলিম সেনাবাহিনী পিছিয়ে আসে।

মূসা ও তারিকের দামেস্কে প্রত্যাবর্তন :

সেনাপতি মূসা  ও তারিক যখন ফ্রান্স সীমান্ত থেকে দক্ষিণ ইউরোপ বিজয়ের পরিকল্পনা করছিলেন ঠিক তখনই রাজধানী দামেস্কে প্রত্যাবর্তনের জন্য খলীফা ওয়ালিদের জরুরী নির্দেশ লাভ করেন। ৭১৩ খ্রীস্টাব্দে তারা স্পেন ত্যাগ করে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন। স্পেনে তাঁদের অবস্থানকাল যথাক্রমে ২ বছর ৪ মাস ৩ বছর ৪ মাস ছিল। স্পেন ত্যাগের পূর্বে মূসা সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র আবদুল আযীয উত্তর আফ্রিকার ভাইসরয়ের অধীনে স্পেনের গভর্ণর নিযুক্ত হন। তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় সেভিলে। অপর পুত্র বীর যোদ্ধা আবদুল্লাহকে ইফ্রিকিয়ার দায়িত্বভার অর্পণ করেন। কনিষ্ঠ পুত্র আবদুল মালিক মরক্কোর শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঞ্জিয়ারকে সদর দফতর করে আবদুস সালেহ উপকূল রক্ষা ও নৌবাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন। এরূপে নববিজিত সাম্রাজ্যের শাসনভার যোগ্য হস্তে ন্যস্ত করে হিজরী ৯৬ সনে মূসা ও তারিক স্পেন ত্যাগ করেন। বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পত্তি নিয়ে তারা সগৌরবে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

- লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, বারিধারা ক্যাম্পাস, ঢাকা।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও