অধিকাংশ সমাচার (২য় কিস্তি)
লিলবর আল-বারাদী
মানবসমাজে দিন-ক্ষণ গণনার
প্রচলন বহু প্রাচীন। তখন সূর্য ও চন্দ্রের উদয়-অস্তের উপর নির্ভর করে মানুষ
দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করত। দিন-ক্ষণ গণনার জন্য সমাজের
গণক-জ্যোতিষীরা মোটামুটি একটা নীতিমালাও তৈরী করেছিল। তবে আধুনিক
বর্ষপঞ্জীর মত স্থায়ী, সুশৃংখল কাঠামোবদ্ধ ছিল না সেসব গণনাপদ্ধতি। ইসলামের
আগমনের পূর্বে আরবরা চন্দ্রের হিসাবে দিন-ক্ষণ গণনায় অভ্যস্ত ছিল। ইসলামের
আগমনের পরও এ ধারার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে কুরাইশরা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য
চরিতার্থের জন্য ইহুদীদের কূট পরামর্শে চন্দ্রমাসের হিসাবে যে গরমিল
করেছিল, তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ রাববুল আলামীন ১০ম হিজরীতে আয়াত নাযিল
করেন, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ্র বিধানে আল্লাহ্র
কাছে মাস গণনায় মাস-বারটি (তেরটি নয়)। তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই
সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না’ (তাওবাহ ৩৬)।
ফলে হিজরী ১৭ সালে ওমর (রাঃ)-এর আমলে ইসলামী বর্ষপঞ্জী বা হিজরী সন
প্রবর্তিত হবার আগ পর্যন্ত মুসলমানরা সঠিক নিয়ম মোতাবেকই চন্দ্রবর্ষ
মোতাবেক সন গণনা করত।
হিজরী সন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সন। যার প্রতিটি দিন, মাস ও বর্ষ চন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। মুসলমানদের মৌলিক ইবাদতসমূহ চাঁদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এর উদয়-অস্তের উপর ভিত্তি করেই রামাযানের আগমন, ঈদ উদযাপন, লাইলাতুল ক্বদর, হজ্জ ও কুরবানীসহ নানাবিধ ইবাদত-বন্দেগীর সময় নির্ধারিত হয়। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র সুদৃঢ় ভিত্তি লাভের পর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য, সর্বোপরি চন্দ্রমাসের বিশেষ বিশেষ দিবস ও রজনী মুসলিম জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে একটি নির্ভুল দিনপঞ্জিকার আবশ্যকতা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে ‘হিজরী’ নামক এই গুরুত্বপূর্ণ সনের জন্ম হয়। নিম্নে হিজরী সনের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হ’ল।
হিজরী সন প্রবর্তনের পেক্ষাপট :
হিজরী সন প্রবর্তনের পূর্বে তৎকালীন আরববাসীরা সরকারী কিছু চিঠি-পত্র ও অফিসিয়াল কাগজ-পত্র ছাড়া সাধারণ চিঠি-পত্র ও দলীলপত্রে সন, মাস, দিন বা তারিখ লেখার প্রয়োজন মনে করতেন না। কারণ, তারা পত্র লেখার পরে কিংবা পত্র প্রাপ্তির পরে প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে গেলে তা সংরক্ষণ না করে ছিঁড়ে ফেলতেন।
ঐতিহাসিক বর্ণনামতে, খলীফ আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ইয়ামানের গভর্নর ইয়ালাব বিন উমাইয়া সর্বপ্রথম হিজরী তারিখ ব্যবহার করেন। তবে ওমর (রাঃ)-এর আমলে সর্বপ্রথম হিজরী সন গণনা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়।
খলীফা ওমর (রাঃ) একদিন আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর কাছে দিন-তারিখ বিহীন একটি পত্র লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) পত্র মারফত তাঁকে তারিখবিহীন পত্রের বিষয়টি অবগত করলে তিনি তা গুরুত্ব সহকারে আমলে নেন। এমনিভাবে হিজরী ১৬ সালে ওমর ফারুক (রাঃ)-এর কাছে একটি দলীল পেশ করা হয়, যেটাতে কোন সাল ও তারিখ ছাড়াই শুধু শাবান মাসের নাম উল্লেখ ছিল। এটা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, দলীল-পত্রে উল্লেখিত শাবান মাস চলতি বছরের না-কি গত বছরের তা কিভাবে বোঝা যাবে? ফলে বিষয়টি আরো জটিল সমস্যার রূপ ধারণ করে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৭শ হিজরী সনে ওমর (রাঃ) মজলিসে শূরা আহবান করেন এবং উক্ত সমস্যা নিরসনের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কামনা করেন।
হিজরী সনের প্রবর্তন ও নামকরণ :
নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী ১৭শ হিজরী সনে (কারো মতে ১৬ বা ১৮ হিজরীতে) ওমর ফারূক (রাঃ) কর্তৃক মজলিসে শূরা আহবানের পর কেউ কেউ রোমান আবার কেউ ইরানী সন গ্রহণের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। তবে অধিকাংশ ছাহাবীই নতুন স্বতন্ত্র ইসলামী সন প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। আলোচনা শেষে রোমান ও ইরানী সালের (কারণ এদু’টি মাস চন্দ্রমাসের ভিত্তিতে গণনা করা হত) অনুকরণ করে নতুন ইসলামী সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তা প্রণয়নের জন্য জ্যোতিষবিদ্যা, হিসাব বিজ্ঞান ও পারসিক সাল গণনায় পারদর্শী প্রাক্তন খুজিস্তানের অধিপতি নওমুসলিম হরমুজানকে সাদরে আহবান করা হয়। তার প্রণীত ও নবোদ্ভাবিত সন-তারিখ মজলিসে শূরার অনুমোদনসাপেক্ষে গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কিন্তু নব প্রবর্তিত ইসলামী সালের নাম ও ক্ষণ কখন থেকে গণনা করা শুরু হবে-এ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম সাল ও তারিখ হতে আবার কেউ তাঁর মৃত্যু তারিখ হতে গণনা শুরু করার পরামর্শ দেন। অবশেষে আলী (রাঃ) মদীনায় হিজরতের কারণে মহানবী (ছাঃ)-এর মহাসাফল্যের কথা উল্লেখ করে হিজরতের দিন (২২শে রবীউল আউয়াল/২৪শে সেপ্টেম্বর ৬২২ইং) হতে হিজরী সাল গণনার প্রস্তাব দেন। অবশেষে ওমর ফারুক (রাঃ) শূরা সদস্য ও ছাহাবীগণের সর্বসম্মতিক্রমে আলী (রাঃ)-এর অভিমতকে প্রাধান্য দিয়ে হিজরতের দিন থেকে ‘হিজরী সাল’ প্রবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী ‘রবীউল আওয়াল’ মাস থেকে হিজরী বর্ষ শুরু করার কথা ছিল। কেননা এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের মাস। কিন্তু প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী ‘মুহাররাম’ মাসকেই বছরের প্রারম্ভিক মাস করার জন্য ওছমান (রাঃ) পরামর্শ দেন। তাই আরো দু’মাস সংযুক্ত করে হিজরতের ২ মাস ৮ দিন পূর্ব হতে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। সেই হিসাবে হিজরী সনের প্রথম দিনটি ছিল ইংরেজী বর্ষপঞ্জিকার ১৬ই জুলাই ৬২২ খৃষ্টাব্দ।
হিজরী মাস সমূহের নামকরণ :
অন্যান্য বর্ষের ন্যায় হিজরী বর্ষের মাসসমূহ ১২টি। যা পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন হতে মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত (সূরা তওবা ৩৬)। এ সকল মাসসমূহকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যথা:- মুহাররম, ছফর, রবীউল আউয়াল, রবীউল আখের, জুমাদিউল উলা জুমাদিউল আখেরাহ, রজব, শা‘বান, রামাযান, শাওয়াল, যিলক্বদ, যিলহজ্জ। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের বহুযুগ পূর্ব হতে মাসের নামগুলো এরূপভাবে চলে আসছে। কথিত আছে, রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মের ১৫০ বছর পূর্বে ক্বিলাব বিন মুরারার নেতৃত্বে হজ্জের সময় আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের বৈঠকে উক্ত নামগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল। যে যুগ ছিল অন্ধবিশ্বাসী আরবগণ কর্তৃক শতশত দেব-দেবী ও মূর্তিপূজায় তিমিরাচ্ছাদিত। এতদসত্ত্বেও মাসের নামগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় কোন দেব-দেবী বা মূর্তির নামে এদের নামকরণ করা হয়নি। বরং নামকরণের পিছনে আরবীয় মৌসূমী কিছু প্রভাব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভূমিকা রেখেছে। হয়তবা এ কারণেই হিজরী ১৭তম বর্ষে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে হিজরী সন গণনা শুরু হলেও মাসের প্রাক্তন নামকরণকে স্বাগত জানানো হয়, এতে কোনরূপ পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়েনি। মাসগুলির নামের অর্থ এবং নামকরণের কারণ নিম্নে আলোচিত হল-
(১) মুহাররম : হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম। যা প্রাচীন আরবে ‘সফর উলা’ নামে পরিচিত ছিল। মুহাররম (محرم) শব্দটি আরবী হারমুন (حرم) ধাতু হতে উদ্গত। যার অর্থ মর্যাদাসম্পন্ন বা সম্মানিত। বিশেষতঃ এ মাসের ১০ তারিখ (আশূরা) ও অন্যান্য তারিখে অতীতের বহু নবী-রাসূল দাওয়াতী জীবনে প্রাণঘাতী সমস্যা কাটিয়ে উঠেছিলেন। যেমন মূসা (আঃ) ফেরাউন থেকে, ইব্রাহীম (আঃ) নমরূদী হুতাশন, ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তিলাভ, দাঊদ (আঃ) তার বিদ্রোহী পুত্র ও কাবাগৃহ আবরাহার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ায় এ মাসকে নিষ্কৃতি বা পরিত্রাণের মাস হিসাবে সম্মানিত করা হয়েছে। তাছাড়া চারটি ‘নিষিদ্ধ’ মাসের অন্যতম মাস হিসাবে সম্মান প্রদর্শনার্থে আরববাসীরা এ মাসে যাবতীয় যুদ্ধ বিগ্রহ ও অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকত। তাই এ মাসকে ‘মুহাররম’ বা সম্মানিত বলা হয়ে থাকে।
(২) সফর : এ মাসটিকে পূর্বে ‘সফর আখেরাহ’ বলা হত। পরে ‘সফর উলা’ ‘মুহাররম’ নামের সাথে পরিবর্তিত হওয়ায় ‘সফর আখিরাহ’কে শুধু ‘সফর’ নামকরণ করা হয়। ‘صفر’ এর আভিধানিক অর্থ শূন্য, খালি বা হরিদ্রা বর্ণ। এ মাসে সাধারণত: আরববাসীদের ঘর-বাড়ি খালি বা শূন্য থাকত। কারণ তারা এ মাসটি ভ্রমণে কাটিয়ে দিত অথবা যুদ্ধে নামত এবং বনভূমিতে শক্তিপরীক্ষা করতে যেত। তারা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীর জনপদ ও সবুজ বাগ-বাগিচা ধ্বংস করত, ফসলাদি নষ্ট করত, সন্তান হত্যা করে মায়ের বুক খালি করত। এসব কারণেই এ মাসের নাম শূন্য, খালি বা সফর মাস রাখা হয়েছে। কারো মতে, আরবদের নিকট হেমন্তকাল ছিল বিশেষ মাস। হেমন্তকালে সাধারণত বৃক্ষের পাতা হলুদ বর্ণ হয়ে থাকে। তাই মৌসূমী প্রভাবের কারণে এ মাসকে সফর বা হরিদ্রা বর্ণের মাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগে আরববাসীরা ধারণা করত, এ মাস এলেই তাদের উপর কোন না কোন বিপদাপদ চেপে বসবে। তাই তারা এক কুলক্ষণের মাস বলে খুব ঘৃণা করত। তাদের এ কুধারণার মূলোৎপাটনকল্পে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করেন, ‘ছোঁয়াচে রোগ, কুলক্ষণ, পেঁচার ডাক এবং সফর মাসে অশুভ বলে কিছুই নেই’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৫৭৮-৮০)।
(৩) রবীউল আউয়াল ও (৪) রবীউল আখের বা রবীউছ ছানী : আরামীয় ভাষার শব্দ রবী‘ (ربيع)-এর অর্থ, বসন্তকালের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, সঞ্জীবনী বা সবুজের সমারোহ। ‘রবী’ বলতে বসন্তকালের মৃদু-মন্দ বৃষ্টিধারায় জন্মানো সবুজ বৃক্ষ-লতার সঞ্জীবনী সুধার মাস বুঝায়। মরুভূমির দেশে এই দুষ্প্রাপ্য প্রায় বৃষ্টির আগমনে আরববাসীর হৃদয়-মন সবুজ বৃক্ষ-লতার মত সঞ্জীবিত-সবুজাভ হয়ে উঠত।
কারো মতে, প্রতিশোধপরায়ণ আরববাসীরা সফর মাসে অন্য গোত্র থেকে যে সমস্ত ধন-সম্পদ লুটতরাজ করে বা জোরপূর্বক ছিনিয়ে আনত, ‘সফর’ কুলক্ষণী মাস হওয়ায় তা ভাগ-বাটোয়ারা না করে গোত্র প্রধানদের নিকট গচ্ছিত রাখত। অতঃপর রবী‘ বা মৃদু-মন্দ বৃষ্টির মাসে নির্ধারিত পন্থায় তা ভাগ করত। এই গচ্ছিত সম্পদ হাতে পেয়ে তারা মৃদু-মন্দ বৃষ্টির ধারায় আবেগাল্পুত হওয়ার ন্যায় খুশিতে পুলকিত হত। সে কারণে এ মাসের নাম রবী‘ রাখা হয়।
আল্লামা ইবনে কাছীরের মতে, এ মাস দু’টিতে আরবরা তাদের বাড়ীতেই অবস্থান করত। আর অবস্থান করাকে আরবীতে ربيع বলা হয়। তাই একে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
(৫) জুমাদাল উলা ও (৬) জুমাদাল আখেরাহ বা জুমাদাছ ছানিয়াহ : ‘জুমাদা’ শব্দটি ‘جمد’ থেকে উদ্গত। এর অর্থ জমাট বাঁধা, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। যে সময় এ মাস দু’টির নামকরণ করা হয়, সে সময় এ দু’টি মাস এমন সময় আসত যে, বৃষ্টির অভাবে মাটি অত্যধিক কঠোর ও শুষ্ক হয়ে যেত। তখন মাটি হতে কোন উদ্ভিদ জন্মাতে পারত না এবং জমাট বাঁধা পাথরের মত শক্ত হয়ে যেত। সেজন্য এ মাসের নাম ‘জুমাদা’ রাখা হয়।
(৭) রজব : রজব শব্দটি رجب শব্দ থেকে গৃহীত। অর্থ সম্মানিত। এই মাসটি মর্যাদাপূর্ণ মাস বলে একে রজব বলা হয়। ইসলামপূর্ব যুগে এই সম্মানিত মাসে লুটতরাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-খারাবি ইত্যাদি নিষিদ্ধ ছিল। তৎকালীন আরববাসীরা এ মাসেই হজ্জ ও উমরা পালন করত। ‘মুযার’ নামক প্রবল প্রভাবশালী একটি গোত্র এ মাসের প্রতি অধিক ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যাবতীয় রক্তপাত, লুটতরাজ ইত্যাদি অন্যায় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকত। এই বিশেষ কারণে আরবগণ এক ‘রজবে মুযার’ বলে আখ্যায়িত করত। ইসলামও এ মাসটিকে ‘আশহুরুল হুরুম’ বা ‘নিষিদ্ধ মাসসমূহের অন্যতম মাস’ বলে ঘোষণা করেছে।
(৮) শা‘বান : ‘شعبان’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ পৃথকীকরণ। এ মাসে আরববাসীরা খাদ্য ও পানির খোঁজে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে নানা স্থানে ঘুরাফেরা করত। লুটপাট করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে এদিক- ওদিক ছড়িয়ে পড়ত। এ মাস তাদের জীবনকে বর্হিমুখী করে তুলত। তাই এ মাসের নাম ‘শা‘বান’ রাখা হয়। সাইয়্যেদ আমীর আলী বলেন, ‘শা‘বান’ অর্থ বৃক্ষলতাদি মুকুরিত হবার মাস। সম্ভবত যে মওসুমে বা আবহাওয়ায় এই মাসটির নাম রাখা হয় তখন আরবে বৃক্ষ ও ফলমূলের গাছ মুকুরিত হতো। তাই একে ‘শা‘বান’ নামকরণ করা হয়েছে।
(৯) রামাযান : ‘রামাযান’ আরবী শব্দ ‘رمض’ মূলধাতু থেকে উদ্গত। এর অর্থ পুড়িয়ে ফেলা, জ্বালানো বা ভস্মীভূত করা। নামকরণের সময় এ মাস ভীষণ গরমকালে আরম্ভ হত। লু-হাওয়া প্রবাহিত হত। মানুষ ও জীব-জানোয়ার পানিশূন্য মরুময় আরবে গরমের দরুন ছটফট করত। উটের পা পুড়ে যেত। হাওয়া যেন আগুনের ফুলকি মনে হত। এ সব মৌসুমী কারণেই এ মাসের নামকরণ করা হয় রামাযান। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে রামাযান মাসে একটানা ছিয়াম সাধনার ফলে মানুষের ইন্দ্রিয়লব্ধ পাপরাশি ধ্বংস করা হয় বা জৈব প্রবৃত্তিকে ক্ষুৎ-পিপাসার আগুনের জ্বালিয়ে দুর্বল করে ফেলা হয় বলে এ মাসটিকে ‘রামাযান’ মাস বলা হয়েছে।
(১০) শাওয়াল : شوال শব্দটি ‘شول’ মাসদার থেকে উদ্গত। অর্থ উত্তোলিত হওয়া, উত্তোলন করা বা বহন করা ইত্যাদি। এ মাসে উটনী বাচ্চা প্রসব করত এবং লেজ পিঠে করে রাখত। এ জন্যেই এই মাসের নাম হয়ে যায় শাওয়াল। কারো মতে, শব্দটি ‘شائلة’ ধাতু থেকে উদ্গত। যার অর্থ, ৭/৮ বছরের দুগ্ধহীন উষ্ট্র। প্রাক-ইসলামী যুগে এ মাসের নামকরণের সময় সম্ভবত: সবুজ ঘাসের অভাবজনিত কারণে উষ্ট্রের দুগ্ধ হত না, শুকিয়ে যেত। তাই একে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
(১১) যুলক্বা‘দাহ : যুলক্বা‘দাহ আরবী শব্দ। এটি (قعد) ধাতু থেকে উৎসারিত। অর্থ বসা, অবস্থান করা, উপবেশন করা, নড়াচড়া না করা ইত্যাদি। সুতরাং ‘যুলক্বা‘দাহ’ অর্থ বসে থাকার মাস, অবস্থান করার মাস। এ মাসটিও নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এজন্য আরবের লোকেরা এ মাসে বাড়ীতে বসে থাকত। তারা যুদ্ধের জন্যেও বের হত না এবং সফরের উদ্দেশ্যেও যাত্রা শুরু করত না। যুদ্ধ চলমান থাকলে মুলতবি ঘোষণা করত। তাই এ মাসকে ‘যুলক্বা‘দাহ’ নামকরণ করা হয়েছে।
(১২) যুলহিজ্জাহ : আরবী মাসের সর্বশেষ মাসের নাম যুলহিজ্জাহ বা যিলহজ্জ। এটি একটি ঐতিহাসিক নাম। প্রাক-ইসলামী যুগ হতে এ মাসে হজ্জব্রত পালিত হত বলেই এর নামকরণ করা হয় যিলহজ্জ।
আরবীতে সপ্তাহিক দিনগুলির নাম ও নামকরণের কারণ :
ঐতিহাসিক আল-বেরূনীর মতে, প্রাচীন আরবে সপ্তাহের ধারাবাহিক নামগুলো প্রচলিত ছিল এরূপ-শিয়ার, আওয়াল, আহ্ওয়ান, জুবার, দুবার, মু’নিস এবং উরূবা। প্রাচীন আরব কবিদের কবিতার মধ্যে এ নামগুলোর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবে আধুনিক হিজরী সনের সাপ্তাহিক দিনগুলিতে এগুলির কোন অস্তিত্ব নেই। বরং সপ্তাহের দিনগুলির আধুনিক আরবী নাম হল-
১. يوم السبت (ইয়াউমুস সাবত)-শনিবার। ‘ইয়াউম’ অর্থ দিন এবং ‘সাবত’ অর্থ বিশ্রাম গ্রহণ করা। অর্থাৎ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘বিশ্রামের দিন’। হিব্রু শব্দ ‘সাববাত/সাভাত’ থেকে ‘সাবত’ শব্দটি গৃহীত হয়েছে। ইহুদীদের বিশ্বাসমতে, ঈশ্বর ৬ দিনে আসমান-যমীন সৃষ্টির পর ৭ম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)। এজন্য ইশ্বরের সম্মানার্থে তারাও এ দিনটি বিশ্রামের দিন হিসাবে গ্রহণ করে (বাইবেল, এক্সোডস ২০/৮-১১)।
২. يوم الأحد (ইয়াউমুল আহাদ)-রবিবার। ‘আহাদ’ অর্থ এক। অর্থাৎ বিশ্রামের পর সপ্তাহের ১ম দিন।
৩. يوم الإثنين (ইয়াউমুল ইছনাইন)-সোমবার। ‘ইছনাইন’ অর্থ দুই। অর্থাৎ সপ্তাহের ২য় দিন।
৪. يوم الثلثاء (ইয়াউমুল ছুলাছা)-মঙ্গলবার। ‘ছুলাছা’ অর্থ তিন। অর্থাৎ সপ্তাহের ৩য় দিন।
৫. يوم الأربعاء (ইয়াউমুল আরবি‘আ)-বুধবার। ‘আরবি‘আ’ অর্থ চার। অর্থাৎ সপ্তাহের ৪র্থ দিন।
৬. يوم الخميس (ইয়াউমুল খামীস)-বৃহস্পতিবার। ‘খামীস’ অর্থ পাঁচ। অর্থাৎ সপ্তাহের ৫ম দিন।
৭. يوم الجمعة (ইয়াউমুল জুম‘আ)-শুক্রবার। ‘জুম‘আ’ অর্থ একত্রিত হওয়া। অর্থাৎ জুম‘আর ছালাতে একত্রিত হওয়ার দিন।
আধুনিক কালে চান্দ্রবর্ষের হিসাব :
চন্দ্রমাসের হিসাবে প্রতিটি দিন গণনা শুরু হয় মাগরিব তথা সূর্যাস্তের পর থেকে পরবর্তী দিন সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। আর প্রতিটি চান্দ্রমাস সমাপ্ত হয় ২৯ দিন ১২/১৩ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ডে। একে সাধারণভাবে ২৯ ও ৩০ দিনে গণনা করা হয়। ওমর (রাঃ)-এর সময়ের এই গণনা নির্ভুলভাবে অদ্যাবধি মুসলিম জাহানে প্রচলিত আছে। প্রতিটি চান্দ্রবর্ষ সমাপ্ত হয় ৩৫৪ ঘণ্টা ৮/২০ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে। তাই হিজরী বর্ষকে সাধারণভাবে ৩৫৪ দিনে ধরা হয়। সেই হিসাবে সৌরবর্ষ থেকে চান্দ্রবর্ষ প্রতিবছর ১১ দিন করে ছোট হতে থাকে। এভাবে ৩৩টি চান্দ্রবর্ষ ৩২টি সৌরবর্ষের সমান হয়। আর প্রতি বছর থেকে অবশিষ্ট ৮/৯ ঘণ্টাকে কয়েকবছর পর পর সমন্বয় করতে হয়। এজন্য সৌরবছরের ন্যায় হিজরী সনেও অধিবর্ষ (Leap year) রয়েছে। প্রতি ৩০ বছরে ১১টি অধিবর্ষ ও ১৯টি সাধারণ বর্ষ থাকে। অধিবর্ষগুলো ৩৫৫ দিনে ধরা হয়। সাধারণভাবে দু’টি চন্দ্রমাস ৫৯ দিনে শেষ হয়। এজন্য ধারাবাহিকভাবে এক মাস ৩০ দিনে এবং পরবর্তী মাস ২৯ দিনে সমাপ্ত হয়। এ হিসাব অনুযায়ী চন্দ্রমাসের ১ম, ৩য়, ৫ম, ৭ম, ৯ম, ১০ম ও দ্বাদশতম মাস ২৯ দিনে হয়।
হিযরী সনকে খৃষ্টাব্দে রূপান্তর করার নিয়ম :
হিজরী সনকে খৃষ্টাব্দে বা খৃষ্টাব্দকে হিজরী সনে রূপান্তরের জন্য বর্তমানে ডিজিটাল ক্যালকুলেটর রয়েছে। তবে হাতে হাতে হিসাব করতে চাইলে নিম্নোক্তভাবে করা যায়।
১ম ধাপ : প্রথমে হিজরী সনকে ৩৩ দিয়ে ভাগ করে শুধু ভাগফলটি গ্রহণ করুন (ভাগশেষের চিন্তা বাদ রাখুন)।
২য় ধাপ : এরপর হিজরী সন থেকে ভাগফলটি বিয়োগ করুন।
৩য় ধাপ : সবশেষে বিয়োগফলের সাথে ৬২২ (হিজরতের বর্ষ) যোগ করুন। সর্বশেষ এই যোগফলটিই হবে কাংখিত ফল।
উদাহরণ : ১৪৩৫ হিজরীতে খৃষ্টাব্দ সন কত হবে?
উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী- ক) ১৪৩৫÷৩৩ = ৪৩ (এখানে ১৬ ভাগশেষ, যা ধর্তব্য নয়)। খ) ১৪৩৫-৪৩=১৩৯২। গ) ১৩৯২+৬২২=২০১৪। এটিই হল কাংখিত খৃষ্টাব্দ। একই নিয়মে পূর্বের সালও বের করা যাবে।
খৃষ্টাব্দকে হিজরী সনে রুপান্তর করার নিয়ম :
১ম ধাপ : প্রথমে ইংরেজী সাল হতে ৬২২ (হিযরতের বর্ষ) বিয়োগ করে বিয়োগফলকে শতাব্দী ও অশতাব্দী নামক দু’টি অংশে বিভক্ত করতে হবে।
২য় ধাপ : এরপর শতাব্দী অংশকে ৩ দিয়ে গুণ করতে হবে।
৩য় ধাপ : আর অশতাব্দী অংশ ০০-৩৩ এর মধ্যবর্তী হলে ১, ৩৩- ৬৬ এর মধ্যবর্তী হলে ২ এবং ৬৬-৯৯ এর মধ্যবর্তী হলে ৩ যোগ করতে হবে।
৪র্থ ধাপ : ইংরেজী সাল হতে ৬২২ বিয়োগ করলে বিয়োগফল যদি ১০০০ বা তার বেশী হয় তবে আরো ১ যোগ করুন। সর্বমোট যোগফলটিই হবে হিজরী সাল।
উদাহরণ : ২০১৩ সালে হিজরী সাল কত হবে?
উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী- ক) ২০১৩-৬২২=১৩৯১ (হিজরতের বর্ষ বিয়োগ করে)। খ) ১৩×৩=৩৯ (শতাব্দী অংশ ১৩ গুণন ৩)। গ) অশতাব্দী অংশ ৯০ হওয়ায় যোগ হবে=৩। ঘ) বিয়োগফল ১৩৯১ হওয়ায় যোগ হবে=১। সর্বমোট যোগফল= ১৪৩৪ (১৩৯১+৩৯+৩+১)। এ ফলটিই কাংখিত হিজরী সাল।
সূত্র :
১. তাফসীর ইবনে কাছীর।
২. মুহাম্মাদ সগীর উদ্দীন মিঞা, চন্দ্রমাসের ইতিকথা।
৩. ইসলামী বিশ্বকোষ।
লেখক : সহ-পরিচালক, সোনামণি।