নতুন অভিযাত্রার প্রারম্ভে

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক 380 বার পঠিত

জ্ঞানার্জনের মূলত ২টি পথ। একটি বই পাঠের মাধ্যমে দ্বিতীয়টি চলার পথে অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আসে। আর এই বাস্তব অভিজ্ঞতার ঝুলি সফরের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের প্রায় ১৪টি স্থানে সফরের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন যেমন- আনকাবুত ২০, ফাতির ৪৪, নাহল ৩৬, নমল ৬৯, রূম ৪২, মুহাম্মাদ ১০ প্রভৃতি।  সম্প্রতি আমার ভারতে আসার পিছনে মূলত জ্ঞানার্জনের এই দু’টি পথকে একত্রে গ্রথিত করার একটা প্রয়াস ছিল। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ভারত একটি পরিচিত নাম। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী, আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী, সম্রাট জাহাঙ্গীর, আলমগীর, শাজাহান, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অগণিত মহান আলেম-ওলামা, রাজা-বাদশাহ ও পন্ডিতদের নাম ছোট থেকে কত শুনে আসছি।  তাঁদের জন্মভূমি, পদচারণাস্থল ভারত যাওয়ার ইমেজ একটু আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। ২৩টি প্রদেশে বিভক্ত এই বিশাল দেশটি সামরিক, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক, খেলাধূলা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে। এমন একটি দেশ সফরে যাওয়ার পিছনে মূলত ২টি উদ্দেশ্য কাজ করছিল-

১. উত্তর দিনাজপুরে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ ও পরিচয়। ২. উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা। ইতিমধ্যে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেছি। কিন্তু আমার একান্ত আগ্রহ বিদেশে পড়াশোনা। আমার বাপ-চাচারাও এদেশে পড়াশোনা করে গেছেন। আমার আগ্রহ দেখে আববুও রাজি হলেন। সবমিলিয়ে দিন-ক্ষণ ঠিক করে ভারত গমণের প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করলাম। পাসপোর্ট- ভিসার সকল প্রকার কাজ সম্পন্ন করে ১লা আগষ্ট ২০১১ বা‘দ ফজর আমরা সপরিবারে চাপাইনবাবগঞ্জ বর্ডারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি।

মুসলিম দেশের একজন নাগরিকের এই কি অধিকার? : সোনা মসজিদ কাস্টমস অফিসে পৌঁছার পর নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক পাসপোর্টধারীর ছবি ও চেহারা মিলিয়ে নিচ্ছে দায়িত্ব পালনরত অফিসার। এক পর্যায়ে বোরকা পরিহিতা আমার আম্মাকে নেকাব খুলতে বললে তিনি অস্বীকার করেন। এই নিয়ে বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়। কাস্টমস অফিসার বললেন, ‘কুরআন হাদীছে কোথাও মুখ ঢাকার কথা নেই। নেকাব না খুললে আপনাকে ব্লাক-মার্কেটিং-এর অভিযোগে হয় জেলে পাঠাবো আর না হয় আপনার ভিসা বাতিল করা হবে’। জবাবে আম্মা বললেন, ‘আমি এদেশের স্বাধীন নাগরিক। নেকাব খোলা বা না খোলা এটা আমার ব্যক্তিগত অধিকারভুক্ত ব্যাপার। এতে আপনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এটা মানবাধিকার লংঘন। তবে হ্যাঁ, আপনাদের এখানে কোন মহিলা অফিসার থাকলে নেকাব খুলতাম। যেহেতু নেই, সেহেতু খোলা সম্ভব নয়। আপনারা ভিসা বাতিল করেন বা থানায় নিয়ে যান তাতে আমার আপত্তি নেই।’ আম্মার দৃঢ়তা দেখে অফিসারটি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ঠিক আছে, আমরা না হয় ছেড়ে দেব, কিন্তু ভারতের কাস্টমস অফিস কিন্তু মুখে ছাই দিয়ে মুখ খুলবে।’ ভারতের কাস্টমস অফিসে একই অবস্থার সৃষ্টি হ’লে আমরা ভাবলাম হিন্দু দেশ, পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আরো কঠিন হবে। কিন্তু আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে তারা জবাব দিল ‘ঠিক আছে নেকাব যখন খুলবেন না, আমরা আপনার ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দিতে চাইনা, আপনি যেতে পারেন।’ মুসলিম নামধারী আমাদের এ সমস্ত দূর্মুর্খদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক!

রক্তের টান : চাপাইনবাবগঞ্জ বর্ডার থেকে মালদা রেলস্টেশন এবং সেখান থেকে ট্রেনযোগে আমরা উত্তর দিনাজপুরে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং রাত ৮টার দিকে সেখানে পৌঁছে গেলাম। রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয় বলতে আমরা আমাদের দুই দাদার ছেলে-মেয়েদের জানতাম। তবে ছোট থেকেই দাদা-দাদীর মুখে ঐ দেশে বসবাসরত আমাদের আত্মীয়দের গল্প শুনতাম। আমাদের সাথে ইতিপূর্বে তাদের কোন প্রকার সাক্ষাত হয়নি। কিন্তু আমাদের নিয়ে তাদের উৎসাহ-আনন্দ, স্নেহ-সম্মান, আর বিদায়ের বেলায় তাদের অঝোর ধারায় কান্না দেখে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম কাকে বলে রক্তের বাঁধন।

শায়খ আব্দুল মতীন সালাফীর মাদরাসা পরিদর্শন : দ্বীনের সেবায় তাঁর অবদান মুহতারাম আমীরে জামা’আতের মুখে বহুদিনের শোনা। তাই খুব আগ্রহ নিয়ে ৩ আগস্ট’১১ শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী সাহেবের মাদরাসায় গেলাম। ৫০০ ছেলে ও ১০০০ মেয়ে নিয়ে আলাদা আলাদা বিল্ডিংয়ে পাঠদানের সুব্যবস্থাসম্পন্ন একটি বড় মাদরাসা। এখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি IT কলেজও আছে। মাদরাসা থেকে প্রতিবছর ছাত্ররা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী সাহেবের মৃত্যুর পর এই ৩টি প্রতিষ্ঠান ও এগুলোর সম্পত্তির কর্তৃত্ব নিয়ে তাঁর সন্তান ও ভাইদের মনোমালিন্যে মাদরাসার পরিবেশ কিছুটা খারাপ হ’লেও শায়খের সুযোগ্য সন্তান মতীউর রহমান মাদানীর কর্মতৎপরতায় তা কাটিয়ে উঠবে আশা করা যায়। আববুর পরিচয় জানতে পেরে তারা খুবই আন্তরিকতা দেখায় এবং বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের কার্যক্রম ও গালিব স্যার সম্পর্কে জানতে চায়।

দার্জিলিং, ভয় ও আনন্দের মিশেলে একদিন : কিষাণগঞ্জ-শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। বড় বড় নাম না জানা হাজারো সবুজ গাছে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বত, ঝর্না বেয়ে ছুটে আসা পানির শাঁ শাঁ শব্দ, জনমানবহীন নির্জন রাস্তা, চোখের পলকে পার হয়ে যাওয়া দু-একটি গাড়ী ছাড়া নির্জন পাহাড়ী বনের রাস্তায় চোখে পড়ার মত কিছু নেই। আশ-পাশের প্রকৃতিকে কেন যেন আমাদের শত্রু মনে হ’তে লাগল। দুপুর ১টার সময়ও ঘন ছায়ার কারণে সূর্যি মামার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছেনা। বুঝলাম এখানে সারাটা দিনই সন্ধ্যার মত আবছা আবছা অন্ধকার বিরাজ করে। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে উপরের দিকে উঠতে উঠতে এত উপরে চলে আসলাম যে, একদিকে শত শত ফিট উচুঁ পাহাড় অন্য দিকে শত শত ফুট নিচু খাঁদ। ড্রাইভারের বিন্দুমাত্র অসচেতনতায় ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। কোন কোন পাহাড়ের উচ্চতা দেখে মনে হচ্ছিল এটাই হয়তোবা সর্বোচ্চ পাহাড়। কিন্তু আমাদের এই ধারণা বারবার ভুল প্রমাণিত হ’তে লাগল। প্রতিটি পাহাড়ে পৌঁছার পর তার চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চতার পাহাড় চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে সবচেয়ে বড় পাহাড় নির্বাচন করার দায়িত্ব ছোট ভাইদের কাঁধে অর্পণ করে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আর বলতে লাগলাম سبحان الله وبحمده। সবাই মিলে উপরে উঠার দো‘আ পড়ছিলাম الله اكبر

এক সময় গাড়ি মেঘের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল। চারিদিকে কুয়াশার মত। হেডলাইট জ্বালিয়েও রাস্তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ তখন দুপুর ১টা। উপরে উঠতে উঠতে এক পর্যায়ে মেঘকে আমাদের গাড়ি থেকে নিচে ঘূর্ণায়মান দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে ঠান্ডা অনুভূত হতে লাগল। দার্জিলিং-এর অধিবাসীদের আমরা মাফলার, জ্যাকেট, মোজা পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। অথচ এর ৫/৬ ঘণ্টা পূর্বে পশ্চিম বাংলায় খালি গায়ে ফ্যান চালিয়েও থাকা মুশকিল ছিল। তাও আবার এখন ভরদুপুর। সেখানে গিয়ে আমরা একটি মসজিদে উঠলাম। দার্জিলিং-এ মোট ৩টি মসজিদ ও ২টি মাদরাসা রয়েছে। সেখানে একজন নওমুসলিম আহলেহাদীছ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ফিরে আসার পথে উপর থেকে নিচে নামার ঝুঁকি, তারপর আবার রাত। ঘন জঙ্গলঘেরা অন্ধকার রাতে ভয়ংকর পাহাড়ী রাস্তায় চলতে গিয়ে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। এমনকি আমরা ইফতারীর কথা পর্যন্ত ভুলে যাই। মাগরিবের প্রায় আধা ঘণ্টা পরে ইফতারীর কথা মনে পড়ে। ফেরার সময় একটা কথাই মনে বাজছিল, এইরূপ অপার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশের মূল দাবীই হল-আল্লাহ্র অস্তিত্বের অবশ্যম্ভবীতা, যা মূর্খ নাস্তিকরা অনুধাবন করতে পারে না, আর পারলেও স্বীকার করে না।

বানারাসের মুসাফিরখানা : ঈদুল ফিতরের ২ দিন পর কিষাণগঞ্জ থেকে ইউপি (উত্তর প্রদেশ) এর রাজধানী লাক্ষ্ণৌ-এর উদ্দেশ্যে একাই রওয়ানা হই। ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ‘নাদওয়াতুল ওলামা’ নামক উপমহাদেশের সেই বহুল প্রসিদ্ধ মাদরাসায় পৌঁছে ফজরের ছালাত আদায় করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এক বিশাল এলাকা জুড়ে মাদরাসার অবস্থান। অভ্যন্তরীণ ফাঁকা জায়গাগুলো অত্যন্ত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিতভাবে ছেটে রাখা নজরকাড়া পাতাবাহার ও ফুলের বাগানে সুশোভিত। আরবী সাহিত্য, হাদীছ, ফিক্হসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভবন। ফাযিলিয়াত (দাওরা) ২ বছরের কোর্স। এর পূর্বে আলিয়া ৪ বছরের কোর্স। ছাত্ররা নিজস্ব খরচে (মাসিক ৫০০ রূপী) পড়াশোনা করে। সংক্ষিপ্ত পরিদর্শন শেষে আমি ‘জামে‘আ সালাফিয়া বানারাসে’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। প্রায় বিকাল ৫টার দিকে বানারাসের রেউরিতালায় অবস্থিত ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দে’র কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জামে‘আ সালাফিয়া’য় পৌঁছি। সেখানে পৌঁছার পর মূল চিন্তা ছিল বিদেশ-বিভূঁইয়ে রাত কোথায় কাটাব। পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই। আর শহরের মসজিদগুলো এশার পরপরই তালাবদ্ধ হয়ে যায়। পরিশ্রান্ত অবস্থায় চারিদিক থেকে হতাশা এসে ঘিরে ধরল। হোটেলে থাকা তো অনেক ব্যয়বহুল, যা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করার পর একজন বলল আপনি এখান থেকে নয়সড়ক, ডালমন্ডি যান। সেখানে একটি মুসাফিরখানা আছে, যেখানে কম খরচে থাকতে পারবেন। সেখানে পৌঁছার পর জানে পানি ফিরে পেলাম। রুম ভাড়া রুমের মান অনুযায়ী ২৩ থেকে ৭০ রূপী পর্যন্ত। বারান্দা ৬ রুপী। আর জিনিস-পত্র রাখার আলমারী ১২ রুপী। মাত্র ২৩ টাকায় একদিনের জন্য সিঙ্গেল রুম ভাড়া পাওয়া যায়। ডালমন্ডির মুসলিম সমাজের নিজস্ব দানে পরিচালিত হয় মুসাফিরাখানা। বহু দরিদ্র অসহায় মানুষ যাদের কোন সহায়-সম্বল নেই, তারা অল্প খরচে এখানে অবস্থান করে কোন না কোন আয়ের পথ বের করতে সক্ষম হয়। এখানে বহু মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয় যাদের জীবনে অনেক আশা ছিল। যারা অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়ে পলাতক। আবার অনেকেই অভিমান করে এসেছেন। তাদের সকলের নতুন জীবন শুরু হয়েছে এই মুসাফিরখানাকে ভিত্তি করে। অসহায় মানবতা ও পথহারা পথিকের তাই শেষ অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মুসাফিরখানা। সত্যি বলতে কি পবিত্র কুরআনে মুসাফিরের সহযোগিতা সম্বলিত আয়াতগুলির বাস্তব নমুনা এ মুসাফিরখানা। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে। বল, তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোন ভাল কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত’ (বাক্বারা ২১৫)

হেফজখানায় ছাত্রদের হীনমন্যতা : বানারাস মাদরাসায় ভর্তির সময় শেষ হয়ে গেছে। তাই ভাবছি কি করব। অবশেষে এই মুসাফিরখানায় থেকেই একটি হেফজখানা খুঁজে ভর্তি হই। হাফেজী মাদরাসায় পড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। প্রায় ৫ মাস হেফজখানায় কাটানোর পর আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। চেটগঞ্জ ও সিলেট বাজারের দুইটি মাদরাসার মোট ১০০ জন ছাত্রের প্রায় সকলের উপর আমার ব্যক্তিগত জরিপ থেকে বুঝতে পারি, গড়ে প্রায় সব হেফজখানার ছাত্রদের একই অবস্থা। প্রায় ৪০/৫০ ছাত্র যাদের বয়স হবে ১৮-২৫ বছরের মধ্যে। বাকীরা ছোট। প্রথমতঃ এই ছাত্ররা আরবী ভাষা জানেনা তথা কুরআনের অর্থ জানেনা। হাদীছ, ফিক্হ, বালাগাত, ফারায়েয তো বহুদূরের কথা। দ্বিতীয়তঃ বহির্বিশ্বের পরিস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে এরা একেবারেই ওয়াকিফহাল নয়। এমনকি অনেকেই তাদের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি পর্যন্ত ভালভাবে পড়তে পারেনা। এদের অধিকাংশের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য তারাবীহ পড়ানো, ইমামতি করা, মিলাদ পড়ানো। সত্যি বলতে কি স্রেফ কুরআন মুখস্তকারী, দ্বীনী জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ এই ইমামদেরকে জনগণ আলেম বলে মানবে এবং তাদের দেওয়া ফৎওয়া মেনে চলবে। তা’হলে সমাজের অবস্থা কি দাড়াতে পারে তা মহানবী (ছাঃ)-এর বাণীতেই খুব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি-আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআন ও হাদীছের বিদ্যা ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নেবেন না বরং আলেম উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে উঠিয়ে নেবেন। এমনকি মানুষ অজ্ঞ মূর্খদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। তাদেরকে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করলে তারা ইলম ছাড়াই ফৎওয়া দিবে এবং নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে ও অপরকে পথভ্রষ্ট করবে (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/২০৬)। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞান থেকে এই দূরত্ব সৃষ্টিই মুসলিম সমাজের অধঃপতনের মূল ও একমাত্র কারণ।

অন্যদিকে কুরআনখানি, চল্লিশা, সাবীনা খতম, ফাতেহা পাঠ আরো নাম না জানা কত শত বিদ‘আতী অনুষ্ঠানের সব চাপ হেফজখানার ছাত্রদের উপর। এরা নিজে পড়বে, না কি অনুষ্ঠানপ্রিয় ধনীদের গোলাম হয়ে ইসলামকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করবে? এ ছাড়াও ছোট বয়স থেকে মানুষের দেয়া অর্থের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকে থেকে এই ছেলেগুলি ধনীদের টাকার গোলামে পরিণত হয়। ফলে পরবর্তী জীবনেও তারা টাকার সামনে মাথা উঁচু করতে পারে না, বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে সত্য বলতে পারেনা।

মূলত ছেলেরা স্কুলে যেভাবে ইংরেজী B তে B00K শিখে একই সাথে এর অর্থও জেনে নিচ্ছে। ঠিক তেমনি আরবী শেখার সময় ‘আলিফে’ ‘আহাদ’ মানে ‘এক’ যদি জানত এবং পুরোপুরি না হলেও আবছা আবছা অর্থ বুঝে কুরআন হেফজ করত, তাহলে তাদের মধ্যে এতটা অজ্ঞতা থাকতনা। এছাড়া আমাদের মাদরাসাগুলোতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মোট ১২ বছরের সিলেবাসের সাথে কুরআন মুখস্ত করানোর ব্যবস্থা করা যায় এবং হাদীছের দাওরার সাথে কুরআনেরও দাওরা চলে, তাহলে এটা একটা বড় পদক্ষেপ হবে। এইরূপ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যৎ মুসলিম সমাজ হয়তোবা অজ্ঞতার বেড়াজাল থেকে অনেকটাই মুক্তি পেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অধীর আগ্রহে এমন একটি সিলেবাস দেখার অপেক্ষায় রয়েছি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!! ব্যক্তিগতভাবে একটা কথা বলে রাখি, এ দুই মাদরাসায় অবস্থানকালীন আল্লাহ আমাকে মোটামুটি ৩ মাসের মধ্যেই পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার তাওফীক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। তবে মুখস্থ ধরে রাখা যে কত কঠিন ও কত বেশী দাওরার প্রয়োজন তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। 

জামে‘আ সালাফিয়া বানারাসের অভিজ্ঞতা : রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে বিদ্যা উঠিয়ে নেয়া হবে, মূর্খতা বেড়ে যাবে, যেনা বৃদ্ধি পাবে এবং বেশী বেশী শরাব পান করা হবে (বুখারী, মিশকাত হা/৫২০২)

কিন্তু বাস্তবতা যেন এর উল্টো। আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে যতগুলো মাদরাসা ছিল এখন সে সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশী। আর আগে যে ছাত্রসংখ্যা ছিল এখন তার চাইতে ছাত্রসংখ্যাও অনেক বেশী। দিন দিন বিভিন্ন ক্যাটাগরীর বাহারী নাম ও চমকপ্রদ মোড়কে সাড়া জাগানো পরিকল্পনা নিয়ে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষাও লাগামহীন গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে বিদ্যা উঠে যাচ্ছে কিভাবে, বাহ্যত বৃদ্ধিই তো পাচ্ছে? মূলত হাদীছের উদ্দেশ্যটি এই আয়াতের মধ্যে লুকিয়ে আছে- إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ অর্থাৎ ‘জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে’। তথা যারা আল্লাহকে ভয় করে তারাই জ্ঞানী। সুতরাং নবীর বলা বিদ্যা বা জ্ঞানের মূল মাপকাঠি হ’ল তাক্বওয়া। একজন মূর্খ তাক্বওয়াবান, একজন জ্ঞানী পাপীর চাইতে শ্রেয়। দেশের হানাফী-আহলেহাদীছ বড় বড় ৬টি মাদরাসা এবং বিদেশের বড় ২টি ও ছোট প্রায় ৭টি মাদরাসার অবস্থা দেখার পর আমার সামনে এই আয়াতটিই বার বার ভেসে উঠেছে। আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, এই যামানায় বিদ্যা অর্জন করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু বিদ্যার মূল উদ্দেশ্য তথা তাক্বওয়া অর্জন করা বড়ই কঠিন। জাতির পথপ্রদর্শক মাদরাসা ছাত্ররা আজ অপসংস্কৃতির ভয়াবহ ছোবলে লক্ষ্যহীন হয়ে পড়েছে। মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট জাতির পথপ্রদর্শকদের আদর্শচ্যূত করে ফেলেছে। বিদ্যা তাদেরকে ধর্মপ্রাণ করেছে, কিন্তু ধর্মভীরু করেনি। একদিকে বুখারীর দারস অন্যদিকে নাটক-সিনেমা, একদিকে কুরআন তিলাওয়াত অন্যদিকে এয়ারফোন, একদিকে মসজিদের আযান অন্যদিকে প্রেমালাপ। হায় আক্ষেপ! ওঝাকে যদি ভূতে ধরে ভূত ছাড়াবে কে?

আহলেহাদীছ আন্দোলনের সাংগঠনিক তৎপরতার মরুভূমি : ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর মারকাযী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  জামে‘আ সালাফিয়ার সাথে এই পাঁচ মাসে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। প্রায় প্রতি শুক্রবারে জুম‘আর ছালাত এখানেই পড়তাম। এখানে ছাত্রসংখ্যা ৭০০/৮০০। ৫৮০০০ বই সমৃদ্ধ একটি বিশাল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী রয়েছে এখানে। মাদরাসার পশ্চিম পার্শ্বে সুরম্য মসজিদ। বাদশাহ ফয়সালের সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালের দিকে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই বছরের আলেমকে H.S.C এবং ৩ বছরের ফযিলিয়্যতকে বি.এ.-এর মান দেয়। এ সার্টিফিকেট দিয়ে ভারতের প্রায় ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি ও জামেয়া মিল্লিয়া ইউনিভার্সিটি দিল্লী। বর্তমান বছরের ৩১শে মে মার্চ পর্যন্ত ফরম বিতরণ ও ২৫শে জুলাই ভর্তি পরীক্ষা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই মাদরাসার অনেক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেও আমি আহলেহাদীছ সংগঠনের আমীরের নাম সংগ্রহ করতে পারিনি। এখান থেকে محدث (উর্দু) ও  صوت الأمة (আরবী) নামে দুটি পত্রিকা বের হয়। বর্তমান নাযিম আব্দুল্লাহ সউদ। আমি নওদাপাড়ার সাথে তুলনা করে অাঁচ করতে পারলাম যে, এরা আরবী ও ইংরেজী কথা বলা ও লেখায় অধিক পারদর্শী হলেও সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল। শাহ ইসমাঈল ও সৈয়দ আহমাদের জাযবার লেশমাত্র এদের মাঝে নেই। ঘুমন্ত আহলেহাদীছ সমাজের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা আমি তাদের মাঝে খুঁজে পাইনি। তার অন্যতম কারণ হিসাবে আমি যা বুঝতে পারি তা হল পুরো ইন্ডিয়ায় ছাত্রদের জন্য সেরকম কোন যুবসংগঠন নেই। কেরালায় একটি আছে যারা তাদের নিজস্ব স্থানীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে কার্যক্রম চালায়। তাছাড়া ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এরও কোন কার্যক্রম সেখানে দেখিনি। কেবল এতটুকুই শুনেছি গত ২/৩ মার্চ দিল্লীর রামলীলা ময়দানে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দে’র কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে কাবা শরীফের ইমাম প্রধান অতিথি ছিলেন। তবে বানারাসেই জামেয়া সালাফিয়া থেকে ৫/৬ কিঃ মিঃ দূরে একটি মাদরাসা আছে নাম ‘ইহয়াউস সুন্নাহ’ (রাজারবিহা)। এখানে একটি আহলেহাদীছ মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি যুবসংগঠন গড়ে উঠেছে নাম- ‘জমঈয়তু শুববানিল মুসলিমীন’। যার আমীর জুনায়েদ মাক্কী এবং নায়েবে আমীর আব্দুল কাইয়ুম মাক্কী। এটি আবার যুবকদের নিয়ন্ত্রিত কোন সংগঠন নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য। উক্ত সংগঠনের সাথে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর কোন সম্পর্ক নেই। এই দেশে  SIO  (Student Islamic Organization) এবং ISO সহ অন্যদলগুলোর যুবসংগঠন থাকলেও আহলেহাদীছের কোন যুব সংগঠন না থাকাটা আমার বিবেকে ধাক্কা দিয়েছে। আহলেহাদীছদের অনেক বই খুঁজেছি, পড়েছি। কিন্তু আহলেহাদীছ সম্পর্কে জানার জন্য ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের লিখিত থিসিসের মত তথ্যসমৃদ্ধ বইও আমি পাইনি।

যাহোক দীর্ঘ এ ছয় মাসে ভারতে অবস্থানকালে যতটুকু অভিজ্ঞতাটুকু আমার হয়েছে তা নিতান্ত অপ্রতুল নয়। ভাল-মন্দ মিলিয়ে এ অভিজ্ঞতাগুলো আগামী দিনে আমার জীবনের পথ চলায় দিকনির্দেশনা দেবে এটা সুনিশ্চিত।  



বিষয়সমূহ: জ্ঞানার্জন
আরও