অশুভ শক্তির হিংস্র থাবা : স্মৃতিময় ৯টি দিন
বযলুর রহমান
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 524 বার পঠিত
বাংলাদেশের
গড় আয়ু হিসেব করলে আমার জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় পার হয়ে গেছে। এর
অর্ধেকের বেশী কেটেছে দেশের বাইরে। এখন অবস্থান করছি দেশ থেকে সর্বোচ্চ
দূরত্বে, সময়ের হিসেবে ঠিক বারো ঘণ্টা, বাংলাদেশে যখন দিন তখন আমাদের রাত।
বিসিএস পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলে পরীক্ষকমন্ডলী, রসিকতা করেই কি না জানিনা, বাংলা বারো মাসের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। যখন গড়গড় করে বলে দিলাম তাঁরা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল যারা বিদেশে বড় হয় তারা এসব জানেই না, দেশে বড় হয়েই অনেক ছেলেমেয়ে এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা!’ বললাম, ‘আসলে যারা দেশের বাইরে থাকে তাদের দেশের প্রতি টানটা হয় অনেক বেশী। দেশের লোকজন দেশকে অনেকটা for granted ধরে নেয়। কিন্তু আমরা জানি বাইরে থাকলে দেশের জন্য, দেশের মানুষজনের জন্য কতটা টান অনুভব হয়। আমরা নিজেরা খেয়ে না খেয়ে দেশের মানুষের জন্য টাকা পাঠাই যেন তারা ভাল থাকে। আমাদের মরুভূমির বালি বা বরফের দেশে তুষারের বালিয়াড়ি দেখে চোখ হাঁপিয়ে ওঠে বাংলার সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত্রের সৌন্দর্যে অবগাহন করার জন্য; ইংরেজী, আরবী আর হরেক ভাষার ধ্বনির মাঝেও কান হাঁপিয়ে ওঠে বাংলা শোনার জন্য। হাজার মানুষের প্রাণস্পন্দনের ভীড়েও প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে একজন দেশী মানুষের মুখ দেখার জন্য। আমরা প্রতিটি বাংলাদেশী উৎসবে আনন্দিত হই যদিও যেদেশে থাকা হয় তাদের সেলেব্রেশন কবে আসে কবে যায় আমরা টেরও পাইনা। অধীর হয়ে বসে থাকি দেশের খবর শোনার জন্য। অস্থির হই দেশের খবর পড়ার জন্য। অপরিচিত কাউকে বাংলা বলতে শুনলে রাস্তায় থামিয়ে কথা বলি যেন আমাদের কতদিনের আত্মীয়! সুতরাং, আমরা বাইরে থাকি বলে দেশকে কম ভালোবাসি, এই ধারণাটা ভুল’’।
ছোটবেলায় আবুধাবীতে ছিলাম। স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মাঝে, দোকানে, রাস্তায়, সমুদ্রতীরে সর্বত্র ছিল ইরাকী, ইরানী এবং ফিলিস্তিনীদের ছড়াছড়ি। তখন ইরাক-ইরানের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু বিদেশে ওদের মধ্যে নেই কোন হিংসা, নেই কোন বিদ্বেষ। ওদের চোখের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন সে চোখে কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমির জন্য প্রাণের আকুতি। মুখের ওপর শত আনন্দেও কেমন যেন এক শংকার ছায়া। ফিলিস্তিনীদের দেখতাম ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। শুধু ছেলেমেয়েগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। বড় হলে পাঠিয়ে দেবে দেশে, যেন ওরা দেশের জন্য কিছু করতে পারে, দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে। Hopeless জেনেও কি যেন এক আশায় ভর করে তারা দশকের পর দশক এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে!
অনার্স-মাস্টার্সের সময়টা কেটেছে ইন্ডিয়াতে। দিল্লীতে বাবার কাজ ছিল আফগান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা। বিভিন্ন সময় বাবার সাথে অফিসে গিয়ে দেখেছি অফিসের দোভাষী ছেলেমেয়েগুলোকে। অসম্ভব স্মার্ট এই তরুণ-তরুণীগুলোর কেউ কেউ ডাক্তারী পড়তে পড়তে একদিন প্রাণের দায়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসে দেখল এখানে সে একজন অশিক্ষিত বেকার বৈ কিছুই নয়! সংসার চালানোর জন্য এই দোভাষীর কাজ পেয়েই তাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। আর যারা দেশেই অশিক্ষিত ছিল সেই মানুষগুলোর অবস্থা আরো নিষ্করুণ। সেই রামাযানের দিনে, ভরদুপুরে, দিল্লীর সেই কনকনে শীতে, কাঠফাটা রোদে, গার্ডদের লাথিগুঁতো খেয়েও মানুষগুলো মাঠের মধ্যখানে বসে থাকত, যদি আজ একটা কিছু ব্যবস্থা হয়! তাদের সবার চোখে স্পষ্ট দেখা যেত স্বদেশের সেই উষর প্রান্তরে ফিরে যাবার প্রবল আকাংখা, যদি কোনক্রমে প্রাণটুকুই রক্ষা করার ব্যবস্থা করা যায়!
যখন বাংলা পাঠ্যবইয়ে পড়তাম, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে এনেছি। এই একখন্ড স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের অহংকার’-গর্বে বুক ফুলে উঠত। আমার দুর্গত বন্ধুদের জন্য করুণা হত। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া- সে হোক না দরিদ্র বা পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র একটি দেশ- সে যে কি আরামের, কি আনন্দের তা কি করে বোঝানো যায়? পার্থক্যটা অনেকটা নিজের বিছানায় আর পরের বিছানায় ঘুমানোর মত। মাটিতে চাদর পেতে, ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে যে শান্তি, ফাইভ স্টার হোটেলের রাজকীয় বিছানায় শুয়েও সে শান্তির ঘুম আসেনা, তা আরামের হেরফের যেমনই হোক না কেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই অহংকারকে কেমন যেন ফাঁকা মনে হতে থাকে। যখন মাদ্রাজ ছিলাম, আমার পাশের বাসার বান্ধবী একদিন খুশীতে দৌড়ে এসে বলল, ‘জানো, আমরা ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বন্ধ করে দিয়েছি!’ আমার পান্ডুর চেহারা দেখে সে বুঝতে পারল খবরটা ওর কাছে যেমনটা মনে হয়েছিল, আমার কাছে ঠিক তেমন সুখপ্রদ নয়। আমতা আমতা করে সে বলল, ‘আসলে আমরা স্কুলে পড়েছি যে, আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। আমরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং আমার মনে হয়েছে আমরা যা করি তাতেই তোমরা খুশী হবে। তাই তোমাকে খবরটা দিতে এলাম’।
এই ফারাক্কা দেখেছি এই ঘটনার কয়েক বছর পর। এই উপমহাদেশের প্রায় সবারই পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে আত্মীয়-বন্ধু আছে। এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে কলকাতা গেছি। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ভাবলাম হাতে টাকা আছে, একটু ঘুরেফিরেই দেখি। রওয়ানা দিলাম দার্জিলিং। ট্রেন ফারাক্কা বাঁধের ওপর দিয়ে যখন যাচ্ছে তখন রাত তিনটা। আমাদের জানালা যেপাশে সেদিক থেকে গঙ্গার ইন্ডিয়ার অংশ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মত উঁচু সে নদীর থৈ থৈ স্রোত দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বভাবতই কৌতূহল হল একনজর নিজের দেশটাকে দেখার। ট্রেনের অন্যপাশে ছুট দিয়ে, ঘুমন্ত সহযাত্রীর গায়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তাকাই, দেখি কোথাও কিছু দেখতে পাচ্ছিনা! হায়! বাংলাদেশ গেল কই? প্রায় পাঁচ-দশ মিনিট ঝুলাঝুলি করে, চোখ পরিষ্কার করে, ফোকাস করার তীব্র চেষ্টায় চোখ চিকণ করে শেষে খুঁজে পেলাম প্রিয় জন্মভূমিকে, পরক্ষণেই তা চোখের জলের আড়াল হয়ে গেল। বাঁধের অনেক অনেক নীচে বিশুষ্ক তৃষিত জন্মভূমি আমার পানির অভাবে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে, পানি তো নেইই, নেই কোন গাছপালাও। আমরা তো খুঁজছিলাম দৃষ্টির সামনে, সে যে দৃষ্টিসীমার এতটা নীচে তা তো ভাবিনি!
ক’দিন আগে বাংলাদেশে এক আত্মীয়ার সাথে স্কাইপে কথা বললাম প্রায় তিনঘণ্টা। ব্যাকগ্র্রাউন্ডে ভেসে আসছিল কার্টুন, গান আর সিনেমার আওয়াজ। হতবাক হয়ে গেলাম যে এর সবটাই হিন্দিতে। বাচ্চারা পেছনে বসে কথা বলছে প্রায়ই হিন্দিতে! আমি চার বছর মাদ্রাজে ছিলাম। কোনদিন কোন বাসা থেকে হিন্দি চ্যানেলের শব্দ পাইনি, অথচ প্রত্যেক বাসায় ডিশ সংযোগ ছিল। ওরা আমাদের সাথে ইংরেজী বলত কিন্তু ভুলেও কখনো হিন্দি বলতনা। ওরা হিন্দিকে ঘৃণা করে, কেননা ওরা জানে ভাষাই হল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সবচেয়ে কার্যকরী বাহন। ওরা বাধ্য হয়ে ইন্ডিয়ার অংশ হয়ে আছে বটে কিন্তু দাক্ষিণাত্যের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে তামিল, মারাঠী, কেরালাইট বা আন্ধ্রাইট বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, ইন্ডিয়ান হিসেবে নয়। তাই ওদের নিজেদের পরিচয় ধরে রাখার এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা।
ওদের এই অনুভূতি যে ওদের স্বতন্ত্রতা ধরে রাখার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমি বুঝি। আমার তখন এগার বছর বয়স। আবুধাবীতে থাকি। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল কিছুদিন। তখন এক আইরিশ নার্সের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওকে বললাম, ‘তোমার দেশ যে আজ শত শত বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এর জন্য আমরা তোমাদের খুব শ্রদ্ধা করি। তুমি আমাকে তোমার দেশ সম্পর্কে কিছু বল’। সে অনেক কিছুই বলল, কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, কারণ সে এমন কিছুই বলেনি যা আমি আগে থেকেই জানিনা। তখন বললাম, ‘তুমি তোমার ভাষায় আমাকে কিছু বল, খুব সাধারণ কিছু, যেমন, ‘আমার নাম রুশীন’। ওর চোখ দু’টো জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমাদের স্কুলগুলোতে তো ইংরেজী পড়ানো হয়। শুধু আমি কেন, যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তারাও কেউ আর এখন আইরিশ বলতে পারেনা!’ ভাবলাম, ‘আহা! ওর একটা দেশ আছে, কিন্তু ওর কোন পরিচয় নেই, ভাষা নেই, নিজেদের পোশাক পর্যন্ত নেই। ওরা এমন একটি দেশের জন্য যুদ্ধ করছে যার কার্যত কোন অস্তিত্ব নেই! ওরা তো আসলে এখন আইরিশ নামধারী ইংরেজ!’
একই ঘটনা দেখেছি সিকিমে। একটি স্বাধীন দেশকে বৃহৎ প্রতিবেশী গিলে খেয়ে ফেলেছে। পৃথিবী নির্বিকার! সিকিম আর নেপালের লোকজন ইন্ডিয়ার বিভিন্ন এলাকায় দারোয়ান, ঠেলাগাড়ীতে করে মাল নিয়ে বিক্রি করা, সার্কাস ইত্যাদি খুচরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এটা খুবই স্বাভাবিক। ওরা না পারে হিন্দিতে লিখতে পড়তে, না পারে বিশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলতে। ওদের না আছে কোন পুঁজি আর না আছে কোন সম্পদ। দেশের সম্পদ সবই অন্যের হাতে। কি করবে ওরা বেঁচে থাকার বেঘোর সংগ্রাম ছাড়া?
সুতরাং পরাধীনতা আইরিশদের মত দেশের আক্ষরিক অস্তিত্ব থেকেও হতে পারে বা সিকিমের মত দেশ বিলীন হয়েও হতে পারে। আইরিশরা স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করছে আজ শত শত বছর, আফগানিস্তান স্বাধীনতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে শত বছর পার হয়ে গেল। আর কেউ যদি স্বাধীনতা অর্জন করেও তা বিকিয়ে দিতে চায়, তাকে কি রক্ষা করা সম্ভব? আমাদের হতভাগা দেশটা সেই ঐতিহাসিক কাল থেকেই মীরজাফরে পরিপূর্ণ। তাদের মেরেও শেষ করা যায়না। কত যুদ্ধ কত আন্দোলন, তবু তারা মাটি ফুঁড়ে গজাতেই থাকে আগাছার মত। তবে কি এই মীরজাফররাই আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে থাকবে? লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে স্বাধীনতার নামে পরাধীনতাই কি আমাদের ললাটলিখন?