তাক্বওয়া বা আল্লাহ্ভীতি
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1139 বার পঠিত
আল-কুরআনুল কারীম :
1- يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ-
(১) ‘হে মানুষ! তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন কি যিনি তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রূযী দান করেন? তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ? (ফাতির ৩৫/৩)।
2- وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ-
(২) ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোয় সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে- হে আমার রব, আমাকে সামর্থ দাও, তুমি আমার উপর ও আমার পিতা-মাতার উপর যে নে‘মত দান করেছ, তোমার সে নে‘মতের যেন আমি শোকরিয়া আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি যা তুমি পসন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মাঝে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে তওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’ ( আহকাফ ৪৬/১৫)।
3- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَُ-
(৩) ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)।
4- قَالَ يَا مُوسَى إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِسَالَاتِي وَبِكَلَامِي فَخُذْ مَا آتَيْتُكَ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ-
(৪) ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আমি তোমাকে আমার রিসালাত ও বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে লোকদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়েছি। অতএব যা তোমাকে দেই তা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হও’ ( আ‘রাফ ৭/১৪৪)।
5- وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ-
(৫) ‘আর যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেয়। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)।
হাদীছে নববী :
6- عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم- عَلَى الْمِنْبَرِ مَنْ لَمْ يَشْكُرِ الْقَلِيلَ لَمْ يَشْكُرِ الْكَثِيرَ وَمَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللَّهَ وَالتَّحَدُّثُ بِنِعْمَةِ اللَّهِ شُكْرٌ وَتَرْكُهَا كُفْرٌ وَالْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ-
(৬) নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,‘অল্প পেয়ে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বেশীতেও সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। যে মানুষের (উপকার পেয়ে তার প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আল্লাহর নে‘মতের আলোচনা করা কৃতজ্ঞতা এবং আলোচনা না করা অকৃতজ্ঞতা। জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমত, আর বিচ্ছিন্ন জীবন আযাব।[1]
7- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا أَبَا هُرَيْرَةَ كُنْ وَرِعًا تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ وَكُنْ قَنِعًا تَكُنْ أَشْكَرَ النَّاسِ وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا وَأَحَسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَكَ تَكُنْ مُسْلِمًا وَأَقِلَّ الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ-
(৭) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে আবু হুরায়রা (রাঃ)! তুমি আল্লাহ ভীরু হয়ে যাও, তাহ’লে লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী হ’তে পারবে। তুমি অল্পে তুষ্ট থাকো, তাহ’লে লোকদের মধ্যে সর্বোত্তম শোকরিয়া আদায়কারী হ’তে পারবে। তুমি নিজের জন্য যা পসন্দ করো, অন্যদের জন্যও তাই পসন্দ করবে, তাহ’লে পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে। তোমরা প্রতিবেশীর প্রতি সদাচারী ও দয়াপরবশ হও, তাহ’লে মুসলমান হ’তে পারবে। তোমরা হাসি কমাও, কেননা অধিক হাসি অন্তরাত্নাকে ধ্বংস করে’।[2]
8- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يَدْخُلُ أَحَدٌ الْجَنَّةَ إِلاَّ أُرِىَ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ، لَوْ أَسَاءَ، لِيَزْدَادَ شُكْرًا، وَلاَ يَدْخُلُ النَّارَ أَحَدٌ إِلاَّ أُرِىَ مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ، لَوْ أَحْسَنَ، لِيَكُونَ عَلَيْهِ حَسْرَةً-
(৮) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে কোন লোকই জান্নাতে প্রবেশ করবে, অপরাধ করলে জাহান্নামে তার ঠিকানাটা কোথায় হ’ত তা তাকে দেখানো হবে যেন সে অধিক অধিক শোকরিয়া আদায় করে। আর যে কোন লোক জাহান্নামে প্রবেশ করবে নেক কাজ করলে জান্নাতে তার স্থান কোথায় হ’ত তা তাকে দেখানো হবে যেন এতে তার আফসোস হয়’।[3]
9- زِيَادٌ أَنَّهُ سَمِعَ الْمُغِيرَةَ يَقُولُ قَامَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى تَوَرَّمَتْ قَدَمَاهُ فَقِيلَ لَهُ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا-
(৯) মুগীরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিন তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) এত অধিক ছালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পদযুগল ফুলে যেত। তাঁকে বলা হ’লো, আল্লাহ তো আপনার অতীত ও ভবিষৎ যাবতীয় গুনাহসমূহ মার্জনা করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি কি একজন শোকর আদায়কারী বান্দা হব না? ।[4]
10- عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ لَمَّا نَزَلَ فِى الْفِضَّةِ وَالذَّهَبِ مَا نَزَلَ قَالُوا فَأَىَّ الْمَالِ نَتَّخِذُ قَالَ عُمَرُ فَأَنَا أَعْلَمُ لَكُمْ ذَلِكَ. فَأَوْضَعَ عَلَى بَعِيرِهِ فَأَدْرَكَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَأَنَا فِى أَثَرِهِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىَّ الْمَالِ نَتَّخِذُ فَقَالَ لِيَتَّخِذْ أَحَدُكُمْ قَلْبًا شَاكِرًا وَلِسَانًا ذَاكِرًا وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِينُ أَحَدَكُمْ عَلَى أَمْرِ الآخِرَةِ-
(১০) ছাওবান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, সোনা-রোপা
(মূল্যবান সম্পদ) পুঞ্জীভূত করে রাখার সমালোচনায় কুরআনের আয়াত নাযিল হ’লে
ছাহাবীরা বলেন, তাহ’লে আমরা কোন সম্পদ ধরে রাখবো? ওমর (রাঃ) বলেন, আমি তা
জেনে তোমাদের বলে দিবো। অতঃপর তিনি তাঁর উটকে দ্রুত হাঁকিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর
সাক্ষাত পেয়ে গেলেন। আমিও তার পিছনে পিছনে গেলাম তিনি বলেন, হে আল্লাহর
রাসূল! আমরা কোন সম্পদ সঞ্চয় করব? তিনি বললেন, তোমাদের যে কেউ যেন, একটি
শোকরকারী হৃদয়, একটি যিকরকারী জিহবা এবং আখিরাতের কাজে সাহায্যকারী একজন
স্ত্রীকে গ্রহণ করে’ ।[5]
11- عَنْ صُهَيْبٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ-
(১১) হযরত ছুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারু জন্য এরুপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শোকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।[6]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. হাসান বাছরী (রহঃ) বলেছেন, ‘আমার নিকট এ বার্তা পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন জাতির উপর অনুগ্রহ করেন তখন তাদের মধ্যে শোকর করার প্রতীতি জাগিয়ে দেন। যদি তারা শোকর করে তবে আল্লাহ তাদের নে‘মত বাড়িয়ে দিতে পারেন। আর যদি তারা অকৃতজ্ঞতা দেখায় তাহ’লে তাদের নে‘মতকে আযাবে রূপান্তরিত করতে পারেন’।[7]
২. মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব বলেন, ‘শোকর হ’ল, আল্লাহকে ভয় করা এবং তার আনুগত্যসূচক আমল করা’ ।[8]
৩. ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন, বান্দার চলনে, বলনে আল্লাহর নে‘মতের প্রকাশ হল এমন বিষয়, যা অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে ও শরীরের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে বিনয় ও আনুগত্য দিয়ে প্রকাশ পায়’।[9]
৪. ইমামুল হারামাইন আবু আলী আল-জুওয়াইনী (রহঃ) বলেন,‘দুনিয়ার বিপদাপদ মূলত বান্দার পক্ষে শোকর আদায়ের বিষয়। এগুলোও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নে‘মত। তার প্রমাণ এই যে, বিপদাপদ বান্দার জন্য অনেক অনেক কল্যাণ, প্রচুর ছওয়াব ও মহৎ উদ্দেশ্য বয়ে আনে, যার তুলনায় আপতিত বালা-মুছীবত কিছুই না’।[10]
সারবস্ত্ত :
১. শুকরিয়া হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসা অর্জনের মাধ্যম।
২. শুকরিয়া আদায়কারী ব্যক্তি মানুষ ও সমাজের কাছে প্রিয় থেকে প্রিয়তর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় ।
৩. শুকরিয়া আদায়কারী ব্যক্তি প্রশান্ত চিত্ত, শীতল চক্ষুর অধিকারী হন ফলে তার প্রতিটি কাজ আখেরাত কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। আর কারো প্রতি সে হিংসাও বোধ করে না।
৪. শুকরিয়াকারী ব্যক্তির শুকরিয়া শুধু তার কথায় নয়, বরং তার যাবতীয় কাজের মাধ্যমে তার সৌন্দর্য ফুটে উঠে ।
৫. শুকরিয়া হলো পরিপূর্ণ ঈমান ও সুন্দর ইসলামের দলীল যা বান্দার নেকী ও ধৈর্যের মাধ্যমে প্রতিবিম্বিত হয়।
[1]. আহমাদ হা/১৮৪৭২, হাদীছ হাসান।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭; ছহীহুল জামে’ হা/৭৮৩৩।
[3]. বুখারী হা/৬৫৬৯; মিশকাত হা/৫৫৯০।
[4]. বুখারী হা/৪৮৩৬; মিশকাত হা/১২২০।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৬, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[6]. মুসলিম হা/২৯৯৯; মিশকাত হা/৫২৯৭।
[7]. শুআবুল ঈমান হা/৪৫৩৬।
[8]. তাফসীরে ত্বাবারী ১০/৩৫৪ পৃঃ ।
[9]. মাদারিসুস সালেকীন ২/২৪৪ পৃঃ।
[10]. মানাবী, ফায়যুল ক্বাদীর ২/১৩৩।