অনার্সের অরিয়েন্টেশনের দিন
আমাতুল্লাহ
স্যুটকেস
গোছাতে গিয়ে দেখি লুঙ্গিটা ধরছে না। একটু ঠেসে ঢুকাতে গিয়ে মনে হল, বাড়ী
থেকে আসার সময় আববা ঠেসে ঠেসে আমাদের ব্যাগে জিনিস-পত্র ঢোকাতেন। বেডশীট
থেকে শুরু করে গাছের ফল, ডালের বড়ি, কাচা সবজি-সব কিছু দিতে চাইতেন। একবার
তো গাছের সুপারিও দিয়ে দিয়েছিলেন। মা দেখে হেসেই অস্থির, ‘তোমার ছেলে কি
পান খায়, যে সুপারী দিচ্ছ!’ মনে হত, পারলে তিনি পুরো বাড়ীটাই তুলে আমার
সাথে দিয়ে দিবেন।
কয়েক বছর পর সপরিবারে বাড়ীতে যাচ্ছি। আমার বিষয়ে আববার প্রধান অনুযোগ ছিল, বাড়ীতে অনেক দিন পর পর যাওয়া নিয়ে। আববা চাইতেন, তার বউমা, নাতি-পুতি সবাই মিলে বাড়ীতে যাই। দেশেই থাকি, অথচ সবাই মিলে যাওয়া হত না। আজ যাব কাল যাব করে আমারও যেতে দেরী হয়ে যেত। শীতে যেতাম না ঠান্ডা লাগবে বলে, গরমে ঝিনাইদায় খুব গরম পড়ে, ফাল্গুন-চৈত্রে রাস্তাঘাটে খুব ধুলা থাকে, বর্ষাকালে আমার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়লে সর্দি লেগে যায়, ঈদে রাস্তার যে হুজ্জত, অফিসে খুব কাজ- এই সব অজুহাতে আমার যাবার তারিখ কেবলই পিছাত। আববা বলতেন, নিজের গাড়ী আছে-এসব অজুহাত কেন? আমি তখন সড়ক দুর্ঘটনার কতভাগ প্রাইভেট কারের কপালে ঘটে তার পরিসংখ্যান শুনাতাম। আমি বাড়িতে যেতে তালবাহানা করলেও, আববা আমাদেরকে না দেখে থাকতে পারতেন না। অনেক সময় মাসে একাধিকবার এসেছেন। তার এনার্জি ছিল প্রচুর। সকালে বাসে উঠে বিকালে আমার বাসায় পৌঁছে আবার পরদিন সকালেই চলে যেতেন। আমরা ভাবতাম তিনি অত্যন্ত শক্তসামর্থ্য মানুষ, ভাবতাম এত কষ্ট করতে পারেন, কারণ তার এনার্জি ছিল প্রচুর। আসলে এনার্জি নয়, যে জিনিসটির তার প্রাচুর্য্য ছিল তা হচ্ছে ভালোবাসা।
এখন আমরা সবাই মিলে যাচ্ছি, তার অতি আদরের বউমা, তার স্বপ্নের নাতি-পুতি সবাই, যাচ্ছি শুধু তাকেই দেখতে!!!
আমার বাসায় স্বল্পকালীন অবস্থানকালে তার একটা রুটিন ছিল। খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই তিনি যেতেন নিউ মার্কেটে, বই কিনতে। তিনি বই কিনতেন পাগলের মত। বুক ভিউ এর সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আসার আগেই কথা বলে রাখতেন। বুক ভিউতে গেলে তারা কয়েক ডজন বই এর একটা স্তুপ তার জন্য রেডি করে রাখত। একজন বই আর লেখকের নাম বলত। যদি বইটি তার লাইব্রেরীতে না থাকত, তাহলে সেগুলো আলাদা করে কিনে রাখা হত। তিনি টাকা দিয়ে যেতেন, বই চলে যেত পার্সেলে।
তার এই বাছবিচার না করে বই কেনা নিয়ে আমি মাঝে মাঝে মৃদু আপত্তি করতাম। হজ্জে গেলে তিনি প্রচুর আরবী ইসলামী বই কিনলেন। আমি বললাম, আপনি-আমি কেউই আরবী পড়তে পারি না, ঝিনাইদহ শহরে আরবী বই পড়ে বোঝার মত লোকও হয়তবা নেই। তিনি বললেন, বই থাকলে পাঠকের অভাব হবে না। অবাক ব্যাপার যে, তার আরবী বই এর জন্য অনেক দূর থেকে এখন গবেষকেরা আসেন। শেষ যখন তার সাথে দেখা হল, তিনি একটা বই এর নাম করে বইটি কিনে পাঠানোর কথা বললেন। ঢাকায় ফেরার পর একবার ফোন করে খবরও নিয়েছেন, বইটি কেনা হয়েছে কিনা। মা একটু রসিকতা করে বললেন, ‘তোমার কিছুই মনে থাকে না, আবার একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের নাম ঠিকই মনে থাকে!'
বই এর শখ তার ছোট বেলার। তা নিয়ে একটা মজার ঘটনাও আছে। তখন তিনি ক্লাস সিক্স-সেভেনে। ১৯৫১-৫২ সালের কথা। শরৎচন্দ্রের কোন একটা বই তার কেনার খুব ইচ্ছা। সেই সময়ে উপন্যাস পড়াটাই অভিভাবকেরা ভালো চোখে দেখতেন না। তার উপর কিনে পড়া! দাদা বইটি কেনার টাকা দেননি। আববা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভীষণ একরোখা। বইটি তাকে কিনতেই হবে। বই কেনার টাকা উপার্জনের জন্য আর কোন পথ না পেয়ে বসে গেলেন রাস্তায় ইট ভাঙতে। কেউ একজন তা দেখে ফেলে এবং দাদাকে খবর দেয়। সেই কৈশর থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একটা লাইব্রেরী করার। আল্লাহ্র ইচ্ছায় তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল।
আববা আত্মীয়-স্বজনকে খুব পছন্দ করতেন। নানা অসিলায় তার বিশাল বংশের কয়েকশ আত্মীয়কে দাওয়াত দিতেন। এমনকি আমি বাড়ীতে গেলে দেখতাম অনেককে তিনি খবর দিয়ে রেখেছেন। আজ তার বাড়ীতে এত মানুষ যে দাড়ানোর মত জায়গা নেই!
জুমআ‘র ছালাতে আমাদের পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব তার কথা বলতে গিয়ে অনেক কথার মধ্যে বললেন, ‘আমি ছিলাম তার দানের একজন রেগুলার খদ্দের। সময়ে-অসময়ে তার কাছে যেতাম নানা ধরনের সহায়তার দাবী নিয়ে। দরিদ্র কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তার কাছে গেলে বিয়ের খবরটা তিনি দিয়ে দিবেন। গরীব ছাত্রের পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের টাকা দরকার, তাকে জানালেই হ’ল। কারো চিকিৎসার জন্য সহায়তা প্রয়োজন, নুরুল আমিন সাহেবের কাছে গেলে কিছু একটা হবে।
এই কাজটাও তিনি করতেন নেশার মত করে। নিজে চলতেন কিছুটা কিপ্টেমি করে। কিন্তু আল্লাহ তার দানের হাতকে রেখেছিলেন অনেক প্রশস্ত। আববাকে অনেক সময় বলেছি, আপনি যে আমাকে বকাবকি করেন, আমি তো আপনার ক্লোন। আমার চেহারা থেকে শুরু করে স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ -সবই তো আপনার মত। তিনি খুব খুশী হতেন। কিন্তু এখন বুঝি, আমি তার এক কণাও হতে পারিনি। অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে তিনি কিছু আপাত: অযৌক্তিক কাজও করতেন। কয়েক বছর আগে তার পিত্তথলীতে পাথর ধরা পড়ে। তিনি কোন ওষুধ খেলেন না। অপারেশন করতে যে খরচ হবে, তা একজন দরিদ্রকে দিয়ে আসলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, কোন ওষুধ ছাড়াই তার পিত্তথলির পাথর চলে গিয়েছিল। দানের মধ্যে তিনি জাগতিক সব সমস্যার সমাধানও খুঁজতেন।
তিনি খুব গোছালো আর সংসারী ছিলেন। মা কি রান্না করবেন, তাও তিনি ঠিক করে দিতেন। আমাকে কথায় কথায় বলতেন, ‘তোমার তো সাংসারিক বুদ্ধি একদমই নেই’। আমি তার এ ধারণা খন্ডন করতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, আমি তো ঘর-সংসার করছি, বাচ্চাদের দেখছি, বাজার-সদাই করে সংসারই তো চালাচ্ছি। তিনি বলতেন, বেবীরা বাবা-মায়ের কাছে চিরকালই বেবী থাকে।
তিনি এত সংসারী ছিলেন যে, তার অনন্তঃ সংসারের সব আয়োজনও তিনি করে রেখে গিয়েছেন। শুরুর দিকে ধর্মপালন ততো না করলেও গত দুই যুগ ধরে ধর্মকে তার মূল উৎস থেকে জেনে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। তার অসুস্থতার সময়ে গ্রামের বাড়ির জমাজমি চাচাদের মধ্যে বণ্টনের সময়ে তিনি দাদার ভিটের জমির কোন অংশ নেননি, নিয়েছেন পারিবারিক কবরস্থানটি। তার এই সংসারের অনন্ত জীবনে যেন আল্লাহ তাকে সুখে রাখেন, শুধু এই দোয়াটাই করি, এই দোয়াটাই চাই।
মোহায়মিন, ঝিনাইদহ