ফিলিপাইনের ইসলামী শহর আমার মাতৃভূমি মারাওয়ী সিটি
খাদীজা আমাতুল্লাহ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 589 বার পঠিত
আমার
কুরানিক জীবনবৃত্তান্ত শুরুর আগে একটা গল্পের কথা উল্লেখ করতে চাই যা আমার
হাফিযা হওয়ার স্বপ্নকে অঙ্কুরিত করেছিল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমি
যখন ৬ বছরের ছোট্ট মেয়ে তখন আমার শরীরে একটি অস্বাভাবিক রোগ বাসা বেঁধেছিল।
সেই রোগে আমার সমস্ত শরীর ফুলে উঠেছিল যা থেকে ক্রমাগত রক্ত-পুঁজ নির্গত
হচ্ছিল। এ কারণে পিতামাতার সাথে আমাকে কয়েকদিন হাসাপাতালে কাটাতে হয়।
সেখানে প্রতিরাতেই আমি ঘুম থেকে জেগে উঠতাম আর সবসময়ই মাকে দেখতাম
তাহাজ্জুদ পড়তেন আর আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করতেন যেন আমি সুস্থ হয়ে উঠি।
তিনি আমার পাশে এসে বসতেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত পড়ে আমার মাথা থেকে পা
পর্যন্ত হাত বুলিয়ে দিতেন। আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পরও উন্নতির কোন
লক্ষণ না দেখতে পেয়ে আমরা বাড়ী ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আল্লাহ্র উপরই
নির্ভর করতে থাকলাম। একদিন আমার পিতা একজন আলেমকে ডেকে নিয়ে আসলেন আমার
চিকিৎসার জন্য। যিনি কেবল কুরআনের কিছু আয়াত পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিলেন এবং
পানি পড়া খেতে দিলেন। আমি সে পানি খেলাম। খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠলাম। আবার
আগের মত সুস্থ উচ্ছল বালিকায় পরিণত হলাম। তাঁর মতে, এটা ছিল আল্লাহ্র
অদৃশ্য ইশারার ফল।
এই অভিজ্ঞতার পর আমি আমার ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হলাম। কুরআন পড়ার জন্য আমার মন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কিভাবে কুরআন আমাকে সুস্থ করল তা আমাকে জানতেই হবে। আল্লাহ সত্যিই বলেছেন, ‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত (ইসরা ৮২)।’ এমনকি জীবন-মৃত্যুর বিষয়টিও আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কেন আমার পিতামাতা আমার জীবন বাঁচাতে এত মরিয়া হয়ে উঠলেন? কি এই জীবন? বেঁচে থাকা কি খুব আবশ্যক? যদি আবশ্যক হয় তবে তা কেন? কেন আমরা পৃথিবীতে বেঁচে আছি? আমাদের এই অস্তিত্বের পিছনে কি এমন উদ্দেশ্য নিহিত? যদি কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকত তবে আমরা কোথায় থাকতাম, কি করতাম? কবর নিয়ে আমার নতুন ভাবনা শুরু হল। আমি খুব সচেতনভাবে খুঁজতে থাকলাম আল্লাহ্র অস্তিত্ব।
এরপর থেকে যত কষ্টই হোক না কেন, কোন সৎআমল করার সুযোগ পারতপক্ষে ছাড়তাম না। আল্লাহ সত্যিই বলেছেন, ‘হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না’ (বাক্বারা ২১৬)।
প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে আমি কুরআন শিক্ষার হালকায় যেতাম এবং প্রতি সপ্তাহান্তে তাফসীর, হাদীছ প্রভৃতি শেখার জন্য মাদরাসায় যেতাম। ১২ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বেই আমি কুরআন পড়া শিখে ফেললাম এবং বেশ কিছু সূরাও মুখস্থ করলাম। ততদিন আমি হাইস্কুলে পড়ি। হাইস্কুলে উঠে পড়াশোনার চাপ বাড়ায় আমি মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এমনকি কিছুদিন বাদে সেখানে যাওয়ার আর প্রয়োজন বোধ করতাম না। কোন হালকাতেও যেতাম না। কুরআনও তেমন পড়তাম না। এই অবস্থায় টানা দুই বছর চলে গেল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমার চেতনা নিশ্চিহ্ন করে দেননি। কলেজে প্রবেশের পূর্বে আমি হঠাৎ করে আমার ‘আমি’কে আবার ফিরে পেলাম। ঘটনা এই ছিল যে, আমার মা আমাকে বকা-ঝকা করতে শুরু করলেন মাদরাসা ও হালকা পরিত্যাগ করায়। আমি তাঁকে অনুযোগ করে বললাম, ‘মা, আমাকে চাপাচাপি করো না, এতদিন পর সেখানে যেতে আমার লজ্জা করছে।’ কিন্তু কোন যুক্তি মেনে না নিয়ে তিনি আমাকে পীড়াপীড়ি করতেই থাকলেন আর বললেন, তুমি যদি না যাও তাহলে আমি কখনই তোমাকে ক্ষমা করব না। বাধ্য হয়েই একদিন মাদরাসায় যেতে রাজি হলাম। কিন্তু প্রস্ত্ততির জন্য ঘরে যখন কুরআন খুলে বসলাম, দেখি আমি কুরআন পড়া প্রায় ভুলেই গেছি। আমার পড়ার গতি অনেক ধীর হয়ে গেছে। আমার এ অবস্থা দেখে আমিই হতবাক হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারিনি দুই বছরের মধ্যে আমার এত অধঃপতন হয়েছে। আমার মনে হল, আমি তো জাহান্নামে চলে গিয়েছি। আমি তো শয়তানের দাস হয়ে পড়েছি। কতদিন যাবৎ কুরআন পাঠ ছেড়ে দিয়েছি! সেদিন আমি খুব কাঁদলাম। আল্লাহ্র কাছে আমার হেদায়েতের জন্য খুব দো‘আ করলাম আর প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি অবশ্যই মাদরাসায় ফিরে যাব এবং দ্বিগুণ উদ্যমে দ্বীনী জ্ঞানার্জনের জন্য লেগে পড়ব। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি প্রতিজ্ঞামত কুরআন শিক্ষার হালকায় ভর্তি হলাম এবং আরবী ভাষা শেখার জন্য ‘মা‘হাদুল লুগাহ আল আরাবিয়া’ (আরবী ভাষা শিক্ষা ইনিস্টিটিউট)-এ নাম তালিকাভুক্ত করলাম। তাছাড়া সপ্তাহান্তে তাফসীর ও হাদীছের ক্লাসে অংশ নেয়া শুরু করলাম। কোথাও ইসলামী সেমিনার অনুষ্ঠিত হলে সাধারণতঃ বাদ দিতাম না। অচিরেই আমি আমার জীবনে আল্লাহ্র রহমত ও বরকতের ছোঁয়া অনুভব করতে লাগলাম। শিক্ষকের পড়া আমি দ্রুত মুখস্ত করতে পারতাম। আর সকল প্রশংসা আল্লাহ্র, অন্যদের চেয়ে একটু আগেভাগেই আমি পড়া শিখে ফেলতে লাগলাম।
তারপর আমার নিকটজনদের কাছে সুযোগমত ইসলামের হুকুম-আহকাম পালনের দাওয়াত দেয়া শুরু করলাম। তাদের বুঝাতে লাগলাম, কোথায় রাসূলের সুন্নাত আর কোথায় আমরা? আমাদের সৎআমলের প্রতিযোগিতা করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি আর জান্নাত লাভের চেষ্টা করা উচিৎ, না কি খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি আর জাহান্নাম দখলের প্রতিযোগিতা করা উচিৎ? বাড়িতে কি আমরা কুরআন পড়ি? পরিবারের কতজন সদস্য কুরআন ঠিকমত পড়তে পারে? আমাদের কতজন কুরআনের অর্থ জানে? কেন বিনোদনের অনুষ্ঠানে ১ম সীট দখলের জন্য আমরা প্রতিযোগিতা করি, অথচ ছালাতের সময় জামা‘আতের শেষ কাতার ধরি? বর্তমান প্রজন্মের এ দুরবস্থা কেন? পশুর মত তারা যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে, আর বিবাহপূর্ব সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ ও পরিবারে অশান্তির রাজ্য বিস্তার করছে? কেন আমরা স্রষ্টার পরিবর্তে সৃষ্টিকে সন্তুষ্ট করার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি? কেন মূর্খের মত প্রতিযোগিতা করছি কে বেশী স্টাইলিশ আর কে বেশী ফ্যাশন্যাবল? অথচ আমরা সবাই মুসলিম। এক আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পিত। আমাদের উচিৎ ছিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত মানবতার সর্বোত্তম জীবনাদর্শকে আপন বলয়ে ও সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। যেমন আল্লাহ বলেন, তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা কর’ (বাক্বারা ১৪৮)। তিনি আরো বলেছেন, ‘আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনব্যাপি, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্ত্তত রাখা হয়েছে (আলে ইমরান ১৩৩)।
জীবনের এই আসল লক্ষ্য হারিয়ে মুসলিম যুবসমাজ তাদের আত্মপরিচয় হারাচ্ছে। তারা বিনোদন জগতের সেলেব্রিটিদের নিয়ে মেতে থাকছে। যে কণ্ঠ ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে ঝংকৃত হয়ে উঠার কথা ছিল সে কণ্ঠে এখন নষ্ট সংস্কৃতির জয়গান। আল্লাহভীতির অভাব, আল্লাহ্র মাহাত্ম্য না জানা আর ইসলামী জ্ঞান না থাকার কারণে আমরা মূর্খতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি। আমরা ইসলামী জ্ঞানার্জনকে অবহেলা করে চলি। এর জন্য মোটেও সময় বের করতে পারি না। যে কুরআনকে আল্লাহ মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য নাযিল করেছিলেন, যে রাসূল (ছাঃ) ইসলামী জীবনাদর্শকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট নযীর রেখে গেছেন, তা সযত্নে দূরে ঠেলে আমরা কিসের পিছনে ছুটছি? আজকের কলুষিত সমাজে খুব কম সংখ্যক মানুষই এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত। আল্লাহ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমীন!!
এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদেরকে অবশ্যই সর্বপ্রথম সঠিক জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দিতে হবে। বৈষয়িক জ্ঞানার্জনের পূর্বে কুরআন ও সুন্নাহ্র মৌলিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্র মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ (আহযাব ২১)। বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে (ফাতির ২৮)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২১৮, হাসান)।
আল্লাহ্র কসম! মুসলিম তরুণ সমাজের এই দুরবস্থাই আমাকে একজন দাঈ এবং হাফিযা হিসাবে গড়ে তুলেছে। আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে কোন ইসলামী স্কুলে কুরআন ও হাদীছের শিক্ষক হিসাবে প্রস্ত্তত করতে। আমার একটাই পরিকল্পনা এই ফিৎনা থেকে আমি নিজেকে রক্ষা করব এবং আমার সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্য সাধ্যমত সংগ্রাম চালাব।
এবার কুরআন হিফযের প্রসঙ্গে আসি। মিন্দানাও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গত বছর ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে অনেক। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ শত চাপের মধ্যেও আমি কুরআন হিফয অব্যাহত রেখেছিলাম। এমনকি আরবী ভাষা শিক্ষা এবং তাফসীর ক্লাসও চালিয়ে গেছি। আমার দৈনিক শিডিউল ছিল এমন যে, সপ্তাহের ৩দিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে যেতাম, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ‘মা‘হাদুল লুগাহ’তে যেতাম আর শেষ বিকালে যেতাম মাদরাসায় কুরআন হিফযের ক্লাসে। সপ্তাহের বাকি ২ দিন পুরোটাই ইউনিভার্সিটিতে কাটাতে হত। আর সপ্তাহান্তে তাফসীর ক্লাসে অংশ নিতাম। শুধু রাতেই বাড়িতে থাকতাম এবং ক্লাসের পড়া, হোমওয়ার্ক করতাম। শোয়ার আগে আবার কুরআন তেলাওয়াত করে প্রাত্যহিক কর্তব্য শেষ করতাম। সাধারণতঃ ফজরের পূর্বেই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম এবং কুরআন হিফয করতে বসতাম। কারণ আমার জন্য হিফযের সর্বোত্তম সময় ছিল ফযরের পূর্বে এবং পরে। দৈনিক অন্ততঃ ১ পৃষ্ঠা মুখস্থ করার পর উঠতাম। তারপর ঘর-দোর ঝাড়া-মোছা করে সকালের নাস্তার কাজে মাকে সাহায্য করতাম। এর মধ্যে ক্লাসের সময় হলে ক্লাসের জন্য প্রস্ত্ততি নিতাম। তবে ১৫ পারা মুখস্থ করার পর আমার দৈনন্দিন রুটিন একটু পরিবর্তন করলাম। দ্রুত হিফয শেষ করার জন্য আপাতত: আরবী শিক্ষার ক্লাস বন্ধ করে দেই। হিফযের সাথে সাথে কুরআনের অর্থ বোঝারও চেষ্টা করি। হিফযের ব্যাপারে আমি এমনই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি যে, দৈনিক ১ পৃষ্ঠার স্থলে ৩/৪/৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুখস্থ করতে লাগলাম। কখনও ক্লাসের বাইরে শিক্ষকের বাড়িতে যেয়েও পড়া শুনিয়ে আসতাম। যখনই অবসর পেতাম হিফযে সময় দিতাম। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন টিচারের পড়ায় মনোযোগ না আসলে গোপনে কুরআন খুলে পড়তাম। বাড়িতেও হোমওয়ার্ক করার সময় কুরআন পার্শ্বে রাখতাম। শোয়ার সময় মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখা শায়খ সুদাইস বা শুরাইমের তেলাওয়াত শুনতাম। অবশেষে সেই কাংখিত দিন আসল। ৬ই এপ্রিল ২০১১। আমার সমগ্র সত্তা সেদিন আনন্দে, প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে উঠল। চোখ বেয়ে নামল আনন্দাশ্রুর বন্যা। আবেগে এতটাই রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ি যে, পরবর্তী ৪ দিন আমি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলাম।
যদিও ৬ ভাইবোনের বড় সংসারে আমাকে যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা, সেমিস্টার চেঞ্জ পরীক্ষা, এসাইমেন্ট লেখা, কেস-রিপোর্ট জমা দেয়া ইত্যাদি কাজে আমার ব্যস্ততাও ছিল প্রচুর। কিন্তু এসব কিছুই আমার ‘হাফিযা’ হওয়ার স্বপ্ন পূরণে বাঁধা সৃষ্টি করেনি আলহামদুলিল্লাহ।
তবে এটা সত্য যে, হিফয সম্পন্ন করা মানেই যে সব শেষ তা নয় বরং এটা আরেকটি নতুন অধ্যায়ের শুরু। হিফযের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে, কিন্তু হিফয করার পর হিফয ধরে রাখার জন্য বার বার যে পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তার কোন সীমা নেই। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন এই পুনরাবৃত্তি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। খুব কঠিন দায়িত্ব। তারপরও আমি পরম সুখী এজন্য যে, কুরআন আমার সার্বক্ষণিক সাথী। যদি কোনদিন কুরআন না পড়ি, মনটা খুব হতাশ হয়ে পড়ে। একটা কথা আমি নিজেকে সব সময় স্মরণ করিয়ে দেই যে, কুরআনের হাফিযা হওয়া কেবল নামের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, আমাকে আমার কাজ দিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে। আমি সব সময় খেয়াল রাখি যেন আমার প্রতিটি কাজ কেবল আল্লাহ্র উদ্দেশ্যেই হয়। সবসময় সতর্ক থাকি যেন আমার নিয়তে কোন ত্রুটি না হয়ে যায়। আল্লাহ আমাকে এবং সকল মুসলিম ভাই-বোনকে সে তাওফীক দান করুন-আমীন! রাসূল (ছাঃ) বলেন, নিয়তের উপরই আমলসমূহ নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যে সে নিয়ত করে (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১)।
সকল প্রশংসা আল্লাহ্র যে আমাদের মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক ‘মিন্দানাও স্টেট ইউনিভার্সিটি’র একটি বিল্ডিং ভাড়া নিতে পেরেছিলেন যার নাম দিয়েছিলেন ‘দারুস সালাম’। এর উদ্দেশ্য ছিল এমএসইউ-এর স্টুডেন্টরা যারা দাওয়াতের কাজ করতে চায় বা কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দিতে চায়, তারা যেন স্বচ্ছন্দে এই বিল্ডিংটি ব্যবহার করতে পারে। আমি ও আমার কিছু বোন এই সুযোগটি কাজে লাগালাম। আমরা একটি বিজ্ঞপ্তি তৈরী করে বিভিন্ন কলেজ বিল্ডিং-এর নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেই। এতে আমরা ভালই সাড়া পাই। গত দুই সেমিস্টারে অনেক ছাত্রী এখানে কুরআন, হাদীছ ও আরবী ভাষা শিক্ষালাভ করেছে। আমরা সবাই এখানে স্বেচ্ছাসেবক। বর্তমানে ফিকহ, সীরাহ, তাফসীর প্রভৃতি বিষয়ে এখানে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা একটি সেমিনারও আয়োজন করেছি।
দারুস সালামে ক্লাস নিতে গিয়ে প্রথম দিকে আমি বেশ ভয় পেতাম। কেননা আমার স্টুডেন্টদের অনেকেই মাস্টার্সে অধ্যয়নরতা ছিলেন। আর বাকীরা আমার বয়সী। তবে যখন ভাবতাম আমার সব প্রচেষ্টাই কেবলমাত্র আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য, তখন ভয় ও দুশ্চিন্তা কেটে যেত। সুন্দরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারতাম আলহামদুলিল্লাহ। যখনই কোন কাজ কঠিন মনে হয় তখনই আমি আল্লাহ্কে স্মরণ করি। এতে সে কাজ আমার কাছে আর কঠিন মনে হয় না। বরং সাবলীল প্রশান্তিময় হয়ে উঠে। তখন মনে হয় আমি আল্লাহ্র সাহায্যে যেন হিমালয় পাহাড়কেও পদাঘাত করে আমেরিকা পাঠাতে পারব...হাহা..। আমার প্রিয় উক্তিটি দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানছি। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একজন কুরআনের হাফেযের পরিচয় হল, সে দীর্ঘ রাত ধরে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়রত থাকবে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। সে ছিয়াম পালন করবে অথচ বাকীরা আহারে ব্যস্ত থাকবে। সে অন্তর্যাতনায় পীড়িত বোধ করে, যখন মানুষ খুশীতে আত্মহারা থাকে। সে নিশ্চুপ থাকে যখন মানুষ বেহুদা কথাবার্তা বলে। সে বিনয়াবনত থাকে যখন মানুষ কর্কশ আচরণ করে। সে হবে বিচক্ষণ, শান্ত ও বাকসংযত। কর্কশ আচরণ, গাছাড়া উদাসীনভাব, উত্তপ্ত মেজাজ, হৈ-হল্লা ইত্যাদি থাকবে তার চরিত্রের সম্পূর্ণ বাইরে (ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছফওয়াহ, ১/৪১৩ পৃঃ)।’
আল্লাহ আমাদের সকলকে অনুরূপ চরিত্রের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আল্লাহ আমাদের মুসলিম তরুণসমাজকে সঠিক আক্বীদা ও আমলের দিকে পরিচালিত করুন। আমাদের সকলকে সরল ও সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমীন!
খাদীজা আমাতুল্লাহ
লেখিকা : জেনারেল এডুকেশন বিভাগ, মিন্দানাও স্টেট ইউনিভার্সিটি, মারাওয়ী সিটি, মিন্দানাও।