বিদ‘আতের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

শরীফুল ইসলাম মাদানী 3250 বার পঠিত

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলূকাত তথা সৃষ্টির শেষ্ঠ জীব হিসাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করে তাদের জন্য ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনোনীত করে তার যাবতীয় বিধি-বিধান অহী মারফত জানিয়ে দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য যুগে-যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। অতএব, আল্লাহর মনোনীত ইসলাম ধর্ম পরিচালিত হবে একমাত্র আল্লাহর বিধান ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী। মানব রচিত বিধান অনুযায়ী ইসলাম পরিচালিত হতে পারে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন-ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন যার মধ্যে সামান্য সংযোজন-বিয়োজন করার অধিকার পৃথিবীর কোন মানুষকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, বর্তমানে দ্বীন-ইসলামের মধ্যে এমন কতগুলি কাজ ইবাদত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে যার কোন ভিত্তি কুরআন ও ছহীহ হাদীছে নেই। আর এই সকল কাজই হল বিদ‘আত যার অবধারিত পরিণাম জাহান্নাম। এই নিবন্ধে বিদ‘আতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল।

বিদ‘আতের শাব্দিক অর্থ :

البدعة শব্দটি মাসদার যা بدع ফে‘ল হতে নির্গত। যার শাব্দিক অর্থ হল, আরম্ভ করা, সৃষ্টি করা, আবিষ্কার করা ইত্যাদি। ইমাম নববী (রহঃ) বিদ‘আত শব্দের অর্থ লিখেছেন, البدعة كل شيء عمل على غير مثال سابق এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।

বিদ‘আতের পারিভাষিক অর্থ :

(ক) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,البدعة في الشرع : هي إحداث ما لم يكن في عهد رسول الله صلى الله عليه و سلم. ‘শরী‘আতের মধ্যে বিদ‘আত হল এমন নব আবিষ্কার, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না’।[1]

(খ) শায়খুল হাদীছ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, إن البدعة : ما لم يشرعه الله من الدين, فكل من دان بشيء لم يشرعه الله فذاك بدعة, و إن كان متأ ولا فيه. ‘বিদ‘আত হল আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের মধ্যে যা বিধিবদ্ধ করেননি। অতএব ঐ সকল কাজের প্রতি অনুগত হওয়া যা আল্লাহ তা‘আলা বিধিবদ্ধ করেননি সেটাই বিদ‘আত, যদিও তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হয়’।[2]

তিনি অন্যত্র বলেন, البدعت : ما خالفت الكتاب والسنت أو إجماع سلف الأمت من الاعتقادات والعبادات. ‘বিদ‘আত হল ইবাদত এবং বিশ্বাসের মধ্যে যা কিতাব (কুরআন), সুন্নাহ অথবা বিগত উম্মতের ইজমার বিপরীত’।[3]

(গ) আল্লামা জুরজানী (রহঃ) বলেন, البدعة : هي الفعلة المخالفة للسنة, سميت بالبدعة لأن قائلها ابتدعها من غير مقال إمام, وهي الأمر المحدث الذي لم يكن عليه الصحابة والتابعون, ولم يكن مما اقتضاه الدليل الشرعي. ‘বিদ‘আত হল : সুন্নাতের বিপরীত কাজ করা। এটাকে বিদ‘আত নামকরণ করা হয়েছে। এজন্য বক্তা ইমামের (নবীর) বাণীর বাইরের কথা উদ্ভাবন করেছে। আর ইহাই নব আবিষ্কৃত কাজ যার উপর ছাহাবী ও তাবেঈগণ ছিলেন না এবং যা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়’।[4]

(ঘ) ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) বলেন, البدعة عبارة عن فعلة تصادم الشريعة بالمخالفة, أو توجب التعاطي عليها بالزيادة أو النقصان. ‘বিদ‘আত এমন কাজকে বলা হয় যার মাধ্যমে বিরোধিতার দ্বারা শরী‘আতকে আঘাত করা হয়। অথবা শরী‘আতে কম-বেশী করার অভ্যাসকে ওয়াজিব করে নেওয়া হয়’।[5]

(ঙ) ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন, البدعة : عبارة عن طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشريعة, يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله سبحانه. ‘বিদ‘আত বলা হয় দ্বীন-ইসলামে এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চলু করাকে, যা শরী‘আতের বিপরীত এবং যা করে আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে আতিশয্য ও বাড়াবাড়ি করাই লক্ষ্য হয়’।[6]

তিনি অন্যত্র বলেন, البدعة المذمومة هي التي خالفت ما وضع الشارع من الأفعال أو التروك. ‘নিকৃষ্ট বিদ‘আত হল, আল্লাহ তা‘আলা যে সকল কাজ করার ও বর্জন করার বিধান দান করেছেন তার ব্যতিক্রম করা’।[7]

বিদ‘আতের প্রকারভেদ :

ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মানদন্ড থেকে বিদ‘আতের শ্রেণীভেদ করেছেন। নিম্নে তা আলোচিত হল।

(১) শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া অথবা না হওয়ার দিক থেকে বিদ‘আত দুই প্রকার। যথা :

(ক) البدعة الحقيقية তথা প্রকৃত বিদ‘আত : বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ইমাম শাতেবী (রহঃ) আল-ই‘তিছাম নামক গ্রন্থে বলেছেন, إن البدعة الحقيقية التي لم يدل عليها دليل شرعي لا من كتاب ولا من سنة ولا إجماع ولا استدلال معتبر عند أهل العلم ولا في الجملة ولا في التفصيل ولذلك سميت بدعة لأنها مخترعة على غير مثال سابق ‘প্রকৃত বিদ‘আত হল, যার সমর্থনে শরী‘আতের কোন দলীল নেই। না আল্লাহর কিতাব, না তাঁর রাসূলের সুন্নাত, না ইজমার কোন দলীল, না এমন কোন দলীল পেশ করা যায় যা বিজ্ঞজনের নিকট গ্রহণযোগ্য। না সংক্ষিপ্তভাবে, না বিস্তারিত। এ জন্যে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিদ‘আত’। কেননা তা মনগড়া, শরী‘আতে যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই’।[8]

উদাহরণ :

(১) আযানের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর দরুদ পাঠ করা বিদ‘আতে হাক্বীকী। কেননা তা কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবা দ্বারা সাব্যস্ত নয়।

(২) শবে বরাতকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে লিপ্ত হওয়া বিদ‘আতে হাক্বীক্বী। কেননা, এর কোন ভিত্তি ইসলামী শরী‘আতে নেই।

(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসার দোহাই দিয়ে তাঁর জন্ম দিবস পালনের লক্ষ্যে ঈদে মিলাদুন নবী পালন করা বিদ‘আতে হাক্বীক্বী। কেননা, এর কোন ভিত্তি ইসলামী শরী‘আতে নেই।

(৪) আল্লাহ তা‘আলার কথিত প্রেমিক সেজে আল্লাহু আল্লাহু বলে যিকির টানা বিদ‘আতে হাক্বীক্বী। ইসলামী শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি নেই।

(খ)البدعة الإضافية স্থান, সময় ও পদ্ধতিগত বিদ‘আত। যার দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইবাদত যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত এবং অপর দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদ‘আত যা মূলত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হলেও এর স্থান, সময় ও পদ্ধতি সুন্নাহ পরিপন্থী।

উদাহরণ :

(১) আযানের পরে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরুদ পাঠ করা শরী‘আত সম্মত। কিন্তু উচ্চ স্বরে দরুদ পাঠ করা সুন্নাত পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী বা বাড়তি বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত।

(২) জুম‘আর খুৎবা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে আযান দেওয়া সুন্নাত। পক্ষান্তরে মসজিদের ভেতরে খতীবের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন স্বরে আযান দেওয়া সুন্নাত পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

(৩) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের পূর্বে ও পরে সর্বমোট ১২ রাক‘আত ছালাত যাকে সুনানুর রাওয়াতেব বলা হয়। তা জামা‘আতবদ্ধ ছাড়াই একাকী আদায় করা শরী‘আত সম্মত। পক্ষান্তরে উল্লেখিত ছালাতগুলো জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করা সুন্নাহ পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

(৪) কুরআন তেলাওয়াত একটি উত্তম ইবাদত যার প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকী অর্জন করা যায়। কিন্তু ছালাতে রুকু এবং সিজদা অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত সুন্নাত পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

(৫) মৃত ব্যক্তির জন্য শোক পালন করা শরী‘আত সম্মত। কিন্তু শোক পালনের নামে দাঁড়িয়ে এক বা দু’মিনিট নীরবতা পালন করা অথবা কিছু সংখ্যক মানুষ মৃতের বাড়িতে একত্রিত হয়ে সকলে মিলে শোক পালন করা সুন্নাত পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

(৬) শা‘বান মাস বেশী বেশী ছিয়াম পালনের মাস, যে মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবচেয়ে বেশী নফল ছিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু মধ্য শা‘বানে শবেবরাতের উদ্দেশ্যে দিনে ছিয়াম ও রাতে ছালাত আদায় করা ইসলামী শরী‘আত পরিপন্থী যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

(৭) ফরয ছালাতের পরে একাকী দো‘আ বা মুনাজাত করা শরী‘আত সম্মত। এ সময় দো‘আ করার জন্য রাসূল (ছাঃ) অনেকগুলো দো‘আ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা পাঠ করতে কমপক্ষে পনের মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু উক্ত সময় ইমাম ও মুক্তাদীর সম্মিলিত মুনাজাত যা রাসূল (ছাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত নয় তা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত।

অতএব, বিদ‘আতে হাক্বীক্বী এবং বিদ‘আতে ইযাফী-এর মধ্যে পার্থক্য হল, ইসলামে যার কোন ভিত্তি নেই এমন কিছুকে নেকীর কাজ মনে করে পালন করা বিদ‘আতে হাক্বীকী। পক্ষান্তরে যে ইবাদত মৌলিকভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু স্থান, সময় ও পদ্ধতি কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী হলে তাকে বিদ‘আতে ইযাফী বলা হয়।

(২) কর্মে বাস্তবায়ন এবং বর্জনের দিক থেকে বিদ‘আত দু’প্রকার-

(ক) البدعة الفعلية তথা কর্মে বিদ‘আত : ইহা এমন কর্মকে বলা হয় যা ইসলামী শরী‘আত সমর্থিত নয়। অথচ উক্ত কর্মের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চায়।

বিদ‘আতীরা এই প্রকার বিদ‘আত সবচেয়ে বেশী করে থাকে। যেমন- শবেবরাতের নিয়তে শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করা । শবে মে‘রাজের নিয়তে ২৭ রজবের রাতে ইবাদত করা। ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা সহ বিভিন্ন দিবস পালন করা ইত্যাদি যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বিরোধী।

(খ) البدعة الةركية তথা বর্জনের মাধ্যমে বিদ‘আত : তা হল, ইসলামী শরী‘আতে বৈধ অথবা ওয়াজিব কোন বিষয়কে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বর্জন করা। যেমন- আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে হালাল কোন পশুর গোশত না খাওয়া যেমনভাবে হিন্দুরা গরুর গোশত খায় না। আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বিবাহ না করা যেমনভাবে খ্রিষ্টান পাদ্রীরা বিবাহ করে না।

(৩) বিশ্বাস ও কর্মে বাস্তবায়নের দিক থেকে বিদ‘আত দু’প্রকার-

(ক) البدعة الإعةقادية তথা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদ‘আত : তা হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত প্রশিদ্ধ বিষয়ের বিপরীত কোন বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, যদিও সে তার বিশ্বাস অনুযায়ী আমল না করে।[9]

যেমন- খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযেলা, মুরজিয়া, জাহমিয়া, ক্বাদারিয়া সহ বিভিন্ন পথভ্রষ্ট দলগুলির আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাস।

(খ) البدعة العملية তথা কর্মে বিদ‘আত : তা হ’ল, এমন কোন কাজকে ইবাদত হিসাবে পালন করা যা ইসলামী শরী‘আত সমর্থিত নয়।[10] অর্থৎ সুন্নাত পরিপন্থী আমল করা।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) কর্মের মাধ্যমে বিদ‘আতের প্রকারভেদ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সুন্নাত আনুযায়ী আমল করতে গেলে ছয়টি বিষয়ে সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে।[11] তা হল,

(১) السبب তথা কারণ বা উদ্দেশ্য : অর্থাৎ কেউ যদি এমন কোন কারণে বা উদ্দেশ্যে ইবাদত করে যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পরিপন্থী, তাহলে তা সুন্নাত বিরোধী আমল হিসাবে গণ্য হবে যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না। যেমন- তাহাজ্জুদের ছালাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু শবেবরাত অথবা শবেমে‘রাজের উদ্দেশ্যে রাতে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করা বিদ‘আত। কেননা উল্লেখিত কারণ বা উদ্দেশ্য কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়।

(২) الجنس তথা শ্রেণী বা প্রকার : অর্থাৎ কেউ যদি এমন শ্রেণী বা প্রকারের ইবাদত করে যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয় তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- উট, গরু ছাগল অথবা ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু উল্লেখিত পশুর পরিবর্তে কেউ যদি ঘোড়া দ্বারা কুরবানী করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না।

(৩) القدر তথা পরিমাণ : অর্থাৎ যতটুকু ইবাদত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত কেবল ততটুকুই পালন করতে হবে। এর অতিরিক্ত করলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমল হিসাবে গণ্য হবে যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- যোহরের চার রাকা‘আত ফরয ছালাতের স্থানে পাঁচ রাক‘আত আদায় করলে সুন্নাত পরিপন্থী হবে। অনুরূপভাবে তারাবীহ-এর ছালাত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো ১১ রাকা‘আতের বেশী আদায় করেননি। কিন্তু যদি কেউ এই সুন্নাতকে উপেক্ষা করে ২০ রাক‘আত আদায় করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদতে পরিণত হবে যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না।

(৪) الكيفية তথা পদ্ধতি : অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে আদায় করেছেন সেই ইবাদত ঠিক সেই পদ্ধতিতে আদায় করলেই কেবল সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে। কিন্তু যদি কেউ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে নিজের মস্তিস্কপ্রসূত পদ্ধতিতে ইবাদত করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- দো‘আ বা মুনাজাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু তা হতে হবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন যে পদ্ধতিতে মুনাজাত করেছেন, তখন ঠিক সেই পদ্ধতিতে মুনাজাত করতে হবে। কিন্তু ফরয ছালাতের পরে, ঈদের ছালাতের পরে, মৃত মানুষকে দাফন করার পরে, বিবাহ বৈঠকে বর্তমানে প্রচলিত দলবদ্ধ মুনাজাত সুন্নাত পরিপন্থী যা স্পষ্ট বিদ‘আত।

(৫) الزمان তথা সময় : অর্থাৎ যে সময় যে ইবাদত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সেই ইবাদত সেই সময় পালন করতে হবে। সময়ের ব্যতিক্রম করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে যা আল্লাহর নিকট গ্রহণ হবে। যেমন- কেউ যদি ফযীলতের মাস হিসাবে রামাযান মাসে পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চায়, তাহলে তা বিদ‘আত হবে। কেননা পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল শুধুমাত্র কুরবানী ও আক্বীকাহ-এর দ্বারাই হবে যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।

(৬) المكان তথা স্থান : অর্থাৎ যেই স্থানে যেই ইবাদত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সেই ইবাদত সেই স্থানে পালন করতে হবে। স্থান পরিবর্তন করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে যা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। যেমন- রামাযানের শেষ দশকে মসজিদে ই‘তিকাফ করা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু কেউ যদি মসজিদের পরিবর্তে বাড়িতে ই‘তিকাফ করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না।

(৪) হুকুমগত দিক থেকে বিদ‘আত দু’প্রকার-

(ক) البدعة المكفرة তথা কুফরী বিদ‘আত : তা হল, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী শরী‘আতের অকাট্য কোন বিষয়কে অস্বীকার করা। যেমন- কোন ফরযকে ফরয হিসাবে গ্রহণ না করা, কোন হালাল বস্ত্তকে হারাম মনে করা, কোন হারাম বস্ত্তকে হালাল মনে করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধের ব্যতিক্রম বিশ্বাস করা ইত্যাদি।

(খ) البدعة غير المكفرة তথা কুফরী নয় এমন বিদ‘আত : ইহা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী শরী‘আতের কোন বিষয়কে অস্বীকার করা নয়। যেমন- মারওয়ানিয়্যাহদের বিদ‘আত যারা ছাহাবাদের মর্যাদাকে অস্বীকার করে। তারা কোন ছাহাবীকে মর্যাদাবান বলে স্বীকার করে না এবং কোন ছাহাবীকে কাফেরও বলে না।

বিদ‘আতে হাসানা ও সায়্যিআহ এই দুই ভাগে ভাগ করা যাবে কি?

প্রথমত যারা বিদ‘আতকে হাসানা তথা ভাল বিদ‘আত এবং সায়্যিআহ তথা খারাপ বিদ‘আত এই দুই ভাগে ভাগ করে এবং বলে বিদ‘আতে হাসানা ইসলামী শরী‘আতে বৈধ, তারা স্পষ্ট ভূলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ. ‘নিশ্চয়ই সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’ (ইবনু মাজাহ, হা/৪২)। অতএব, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেক প্রকার বিদ‘আতের উপর ভ্রষ্টতার হুকুম জারী করেছেন যা হেদায়াতের বিপরীত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أُوْلَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِ فَمَا أَصْبَرَهُمْ عَلَى النَّارِ ‘তারাই হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা এবং মাগফিরাতের পরিবর্তে আযাব ক্রয় করেছে। আগুনের উপর তারা কতই না ধৈর্যশীল’ (বাকারাহ ১৭৫)।

তিনি অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يُضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ - وَمَنْ يَهْدِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ أَلَيْسَ اللهُ بِعَزِيزٍ ذِي انْتِقَامٍ ‘আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই। আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত করেন, তার জন্য কোন পথ ভ্রষ্টকারী নেই। আল্লাহ কি মহাপরাক্রমশালী প্রতিশোধ গ্রহণকারী নন? (সূরা যুমার ৩৬-৩৭)।

দ্বিতীয়তঃ সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা যার ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে ইযাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তাদের কেউ বিদ‘আতে হাসানা এবং সায়্যিআহ এই দুই ভাগে ভাগ করেননি।

তৃতীয়ত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ। কেননা ইবাদতের মূল হল নিষিদ্ধ, যতক্ষন পর্যন্ত জায়েয হওয়ার দলীল না পাওয়া যায়। ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানা বিধিবদ্ধ হওয়ার কোন দলীল নেই। অতএব, বিদ‘আতে হাসানার দোহাই দিয়ে এমন কোন কাজকে বিধিবদ্ধ করা হারাম যার কোন ভিত্তি ইসলামী শরী‘আতে নেই।

শরীফুল ইসলাম মাদানী

[লেখক : লীসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদীআরব]


[1]. ইমাম নববী (রহঃ), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ৩/২২ পৃঃ।

[2]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল-ইসতিক্বামাহ ১/৪২ পৃঃ।

[3]. ঐ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৮/৩৪৬ পৃঃ।

[4]. জুরজানী, আত-তা‘রীফাত ১/৬২ পৃঃ।

[5]. ইমাম সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তেবা ওয়ান নাহী আনিল ইবতিদা, ৮৮ পৃঃ।

[6]. ইমাম শাতেবী, আল-ই‘তিছাম ১/৩৭।

[7]. ঐ, আল-মুওয়াফাকাত ২/৩৪২ পৃঃ।

[8]. ইমাম শাতেবী (রহঃ), আল-ই‘তিছাম ১/২৮৬ পৃঃ।

[9]. আলী মাহফূয, আল-ইবদা‘ ফী মায়াররিল ইবতিদা‘, পৃঃ ৪৬।

[10]. তদেব।

[11]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-ইবদা‘ ফী কামালিশ শারঈ ওয়া খাতারিল ইবতিদা‘, পৃঃ ২১-২৪।



বিষয়সমূহ: বিদআত
আরও