দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 874 বার পঠিত

১ম যুগে (২৩-৩৭৫) সিন্ধু এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্রসমূহ :

সিন্ধুতে হাদীছ চর্চা মূলতঃ ২য় শতাব্দী হিজরীর প্রথম দিকে শুরু হয়। কিন্তু ৪র্থ শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত তা তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেনি। এর কারণ হ’তে পারে মোটামুটি দু’টি। ১- খেলাফতের পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দুস্থান ও সিন্ধু এলাকা একটি স্থায়ী প্রশাসনিক অঞ্চলের মর্যাদার বদলে বরং অনেকটা সামরিক কলোনী এলাকা হিসাবে গণ্য হওয়ায় এই এলাকায় আভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার যথেষ্ট অভাব ছিল- যা ইল্মে হাদীছের চর্চার জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত ছিল। ২- যাতায়াতের কষ্ট ও অসুবিধার কারণে হেজায ও আরবের ইসলামী কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সিন্ধু তথা ভারতবর্ষের যোগাযোগ সহজ ও নিরাপদ ছিলনা। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল ব্যবসায়ী আরবগণই এদেশে আসা-যাওয়ার ঝুঁকি ও কষ্ট স্বীকার করেছেন। ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর স্বনামধন্য পর্যটক মাকদেসীও তাঁর সফর বৃত্তান্তে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষার্ধে (২৭০/৮৮৩ খৃঃ) মান্ছূরাহ ও মুলতানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম হ’লে এলাকায় সার্বিকভাবে অগ্রগতির সূচনা হয়। সিন্ধতে আরবদের শাসন তিনশত বৎসর যাবত কায়েম ছিল। তন্মধ্যে স্বাধীন যুগটি উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ভ্রমণকারীদের বর্ণনা মোতাবেক এই এলাকা তখন শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ ছিল। এই সময়ে ইল্মে হাদীছের যে অগ্রগতি সাধিত হয়, তা মূলতঃ আভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। এখানকার জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা ইলমে হাদীছে ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য হেজায, সিরিয়া, ইরাক, মিসর প্রভৃতি এলাকায় গমন করতেন এবং ঐ সমস্ত এলাকার ওলামায়ে কেরাম এই সব এলাকায় আগমন করতেন। বলাবাহুল্য চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে এসে সমস্ত সিন্ধু ইল্মে হাদীছের চর্চায় ভরপুর হ’য়ে ওঠে। ফলে অন্যান্য মাযহাবের লোক কিছু কিছু থাকলেও আহ্লেহাদীছের সংখ্যা এখানে সর্বদা বেশী ছিল। এই সময় ইল্মে হাদীছের কেন্দ্র হিসাবে প্রধানতঃ দেবল ও মানছূরাহ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল। তবে পঞ্চম শতাব্দী হিজরীতে এসে কুছদার (বেলুচিস্তান)-কেও আমরা উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকায় দেখতে পাই।

সিন্ধুর কেন্দ্র সমূহ ও সেখানকার মুহাদ্দিছবৃন্দ

১-দেবল : দেবল সিন্ধুর প্রসিদ্ধ প্রাচীন বন্দর নগরী যা বর্তমান করাচী ও থাট্রার মধ্যবর্তীস্থানে অবস্থিত ছিল। এখানেই মুহাম্মাদ বিন কাসিমের (৬৬-৯৬ হিঃ) হাতে সিন্ধুর রাজা দাহিরের পতন ঘটে। এই বন্দরের মাধ্যমেই আরব জগতের সঙ্গে সিন্ধুর ব্যবসায়িক ও ধর্মীয় যোগাযোগ সাধিত হয়। মুহাম্মাদ বিন কাসিম এখানে একটি মসজিদ কায়েম করেন ও প্রাথমিক ভাবে চার হাযার আরব মুসলিমকে এখানে এনে আবাদ করেন। ক্রমে এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এটি স্বাধীন মানছূরা রাজ্যের প্রধান বন্দর নগরীতে পরিণত হয়। শহরে লোকসংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, একশত শহরতলীয় গ্রাম সমৃদ্ধ এই বন্দর নগরীতে ২৮০/৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের এক ভূমিকম্পে কেবলমাত্র এই নগরীতেই দেড় লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেন। ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে এই নগরী ইসলামী শিক্ষা ও ইল্মে হাদীছ চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এমনকি আল্লাহর অপার অনুগ্রহে এখানে বেশ কয়েকজন হাদীছের রাবীও জন্মগ্রহণ করেন। এইসব মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের নিরলস তা‘লীম ও দা‘ওয়াতের ফলেই সিন্ধু ও হিন্দুস্থান এলাকায় আহ্লেহাদীছ আন্দোলন ব্যপ্ত হয়ে পড়ে।

দেবলের মুহাদ্দিছবৃন্দ :

১- আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হারূণ দেবলী আল-রাযী (২৭৫-৩৭০ হিঃ)ঃ ইনি দেবলে জন্মগ্রহণ করেন। বাগদাদে গিয়ে জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ আল-ফারিয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) এবং ইব্রাহীম বিন শারীক কূফীর নিকটে হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছের রাবী হওয়া ছাড়াও তিনি ইলমে কিরাআতে পারদর্শী ছিলেন। আহমাদ বিন আলী আল-বাদা (মৃঃ ৪২০ হিঃ), আবু ইয়ালা বিন দূমা (৩৪৬-৪৩১), কাযী আবুল ‘আলা ওয়াসেত্বী (মৃঃ ৪৩১ হিঃ) তাঁর শিষ্য ছিলেন।

২- শু‘আইব বিন মুহাম্মাদ আবুল কাসিম দেবলী : ইনি ইবনু আবী ক্বাত্ব‘আন নামে খ্যাত। ইনি মিসরে গিয়ে হাদীছ শিক্ষা করেন। তিনি হাদীছ বর্ণনা করেন। আবু সাঈদ বিন ইউনুস তাঁর নিকট থেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন। ৩০৫ হিজরীতে তিনি ইছফাহান গমন করেন এবং ৩১৩ হিজরীর দিকে তিনি দামেশকে গিয়ে হাদীছ বর্ণনা করেন।

৩- মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আবু জা‘ফর দেবলী (মৃঃ ৩২২/৯৩৪ খৃঃ) : হাদীছ শিক্ষার জন্য ইনি মক্কা সফর করেন। তিনি মুহাদ্দিছ হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেন। তিনি মুহাম্মাদ বিন যাম্বুর, মুহাম্মাদ বিন আলী আছ-ছায়েগ এবং সাঈদ বিন আবদুর রহমান আল-মাখযূমী হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেন। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আল-মুকরী (মৃঃ ২৮১ হিঃ), আহমাদ বিন ইবরাহীম বিন ফাররাস মাক্কী আল-আত্তার, আবুল হুসাইন মুহাম্মাদ আল-হাজ্জাজ (মৃঃ ৩৬৮ হিঃ) প্রমুখ বিদ্বানগণ তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করতেন। ইল্মে হাদীছে পারদর্শী হওয়া ছাড়াও তিনি সুফিয়ান ইবনু ওয়ায়না (১০৭-১৯৮ হিঃ)-এর ‘কিতাবুত তাফসীর’ সাঈদ বিন আবদুর রহমান আল মাখযূমী (মৃঃ ২৪৯ হিঃ)-এর নিকট হ’তে এবং আবদুল্লাহ বিন মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) -এর ‘কিতাবুল বির্র ওয়াছ ছিলাহ’ তাঁর শিষ্য হুসাইন আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৪২ হিঃ)-এর নিকট হ’তে শিক্ষা করেন। ৩২২ হিজরীতে তিনি মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন।

৪- আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ আবুল আববাস দেবলী (মৃঃ ৩৪৩/৯৫৪ খৃঃ)ঃ ইল্মে হাদীছ শিক্ষার জন্যই ইনি সে যুগে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল হাদীছ শিক্ষার কেন্দ্রগুলিতে সফর করেন। মক্কাতে তিনি স্বদেশী মুহাদ্দিছ আবু জা‘ফর দেবলী (মৃঃ ৩২২ হিঃ) ও মুফায্যাল বিন মুহাম্মাদ আল-জুন্দী (মৃঃ ৩০৮)-এর নিকট থেকে হাদীছ শিক্ষা করেন। এমনিভাবে বছরাতে আবু খলীফা আল-ক্বাযী (মৃঃ ৩০৫ হিঃ), বাগদাদে জাফর বিন মুহাম্মাদ ফারইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ), মিসরে আলী বিন আব্দুর রহমান ও মুহাম্মাদ বিন রাইয়ান, দামেশকে হাফেয আহমাদ বিন ওমায়ের বিন হাওসা (মৃঃ ৩২০), বৈরুতে আবু আব্দুর রহমান মাকহূল, হাফেয হুসাইন বিন আবু মা‘শার (মৃঃ ৩১৮), তাস্তারে আহমাদ বিন যুহায়ের তাস্তারী (মৃঃ ৩১২), আসকার মুকাররমে হাফেয আবদান বিন আহমাদ জাওলাক্বী (২১০-৩০৬) ও নিশাপুরে আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইসহাক ইবনে খুযায়মা (মৃঃ ৩১১) ছাড়াও সমকালীন অন্যান্য মুহাদ্দিছগণের নিকট হ’তেও হাদীছ শিক্ষা করেন। ইবনে খুযায়মার মৃত্যুর আগেভাগেই তিনি নিশাপুর পৌঁছে যান এবং তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শিক্ষানগরীতে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি হাদীছের শিক্ষক হিসাবে দরস দিতে থাকেন। তাঁর খ্যাতনামা ছাত্রমন্ডলীর মধ্যে ‘মুস্তাদরাকে হাকেম’-এর বিশ্ববিশ্রুত সংকলক হাফেয আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ হাকেম নিশাপুরী (৩২১-৪০৫) অন্যতম। ৩৪৩ হিজরীতে তিনি নিশাপুরেই ইন্তেকাল করেন। সেই প্রাচীনযুগে শুধুমাত্র ইলমে হাদীছের অন্বেষণে একজন ভারতীয় বিদ্বানের এইভাবে বিশ্বভ্রমণ সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় বৈ-কি!

৫- হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আসাদ দেবলী (মৃঃ ৩৫০/৯৬১ খৃঃ)ঃ ইনি আবু ইয়ালা মূছেলী (মৃঃ ৩০৭)-এর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। তাঁর সনদের মূত্র খ্যাতনামা ছাহাবী জাবির বিন আব্দুল্লাহ (মৃঃ ৭৮ হিঃ) পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ৩৪০ হিজরীর দিকে তিনি দামেশকে হাদীছের প্রচার ও শিক্ষাদান শুরু করেন। তাম্মাম তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্য ছিলেন।

৬- মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ দেবলী (মৃঃ ৩৫৪/৯৬৫ খৃঃ)ঃ ইনি অত্যন্ত নেককার ও সাধক আলেম ছিলেন। তিনিও ইলমে হাদীছের জ্ঞান লাভের জন্য বিদেশে গমন করেন। তিনি বছরার আবু খলীফা ফযল বিন হাবাব আল-জামহী (মৃঃ ৩০৫), বাগদাদের জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ আল-ফারিয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ), আসকার মুকাররমের আবদান বিন আহমাদ আস্-সুক্কারী (২১০-৩০৩) প্রমুখ বিদ্বানদের নিকট হ’তে হাদীছ শিক্ষা করেন। আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ হাকেম নিশাপুরী (৩২১-৪০৫) তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ শিষ্য ছিলেন।

৭- খালাফ বিন মুহাম্মাদ দেবলী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)ঃ তিনি আলী বিন মূসা দেবলীর নিকট হ’তে দেবলে হাদীছের ইল্ম হাছিল করেন। পরে তিনি বাগদাদ গমন করেন ও সেখানে হাদীছের দরস দিতে থাকেন। সেখানে আবুল হোসায়েন বিনুল জুন্দী (৩০৬-৩৯৬) ও আহমাদ বিন ওমায়ের তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্য ছিলেন।

৮- ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ দেবলী (মৃঃ ৩৪৫/৯৫৬ খৃঃ)ঃ ইনি মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন আবদুল্লাহ আবু জা‘ফর দেবলীর (মৃঃ ৩২২/৯৩৪ খৃঃ) পুত্র ছিলেন। ইনিও পিতার ন্যায় হাদীছের রাবী ছিলেন। তিনি বাগদাদের হাফেয মূসা বিন হারূণ আল-বায্যায (মৃঃ ২৯৪ হিঃ) এবং মক্কার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ বিন আলী আছ-ছায়েগ আল-কাবীর (মৃঃ ২৯১) ও অন্যান্য ওলামায়ে হাদীছের নিকট হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেন।

৯- আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আবুল আববাস দেবলী (মৃঃ ৩৭৩ হিঃ)ঃ ইনি একজন দুনিয়াত্যাগী হাফেয ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ ছিলেন। সপ্তাহে মাত্র একটি কাপড় নিজ হাতে সেলাই ও জুমআর দিনে সোয়া দিরহাম মূল্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সর্বদা ছিয়াম ও তেলাওয়াতের মধ্যে দিন গুযরান করতেন। বহু কারামতের অধিকারী ছিলেন। রামাযানে সাহারীর সময় কেবলামুখী হ’য়ে তেলাওয়াতে রত থাকা অবস্থায় মিসরে তাঁর মৃত্যু ঘটে। কথিত আছে যে, তাঁর জানাযায় মিসরের সমস্ত লোক হাযির হয়েছিল, কেউ বাড়ীতে অবশিষ্ট ছিল না।

১০- আলী বিন মূসা দেবলীঃ ইনি খালাফ বিন মুহাম্মাদ দেবলীর (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) উস্তায ছিলেন। ইনি দেবল ও বাগদাদ উভয় স্থানে হাদীছের দরস দিয়েছেন। আলী বিন মূসা চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর মুহাদ্দিছ ছিলেন।

১১- মুহাম্মাদ বিন হুসাইন আবুবকর দেবলীঃ তিনি মুহাম্মাদ বিন নুছাইর ইবনু আবী হামযাহ এবং জা‘ফর বিন হামাদান ইবনু আবী দাঊদ-এর নিকট হ’তে কিরাআত শিক্ষা করেন। তিনি একজন বিশ্বস্ত রাবী ছিলেন। হাফেয আবুল হাসান আলী বিন ওমর দারাকুতনী এবং আব্দুল বাকী বিনুল হাসান তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন। তাঁর অন্যতম উস্তাদ ইবনু আবী দাঊদ নিশাপুরী ৩৩৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসাবে বলা চলে যে, তিনি চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর মানুষ ছিলেন।

১২- হাসান বিন হামেদ বিনুল হাসান দেবলী (মৃঃ ৪০৭/১০১৬ খৃঃ)ঃ ইনি একই সঙ্গে কবি, সাহিত্যিক, মুহাদ্দিছ ও বড়দরের ব্যবসায়ী ছিলেন। এতগুলো গুণের একত্র সমাবেশ ঘটায় তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ আরবী কবি আবু তাইয়িব আহমাদ আল-মুতানাব্বী (৩০৩-৩৫৪ হিঃ) একদা বাগদাদে তাঁর বাড়ীতে মেহমান হয়ে বলেন,لو كنت مادحا تاجرا لمدحتك ‘যদি আমি কোন ব্যবসায়ীর প্রশংসা করে কবিতা লিখতাম তবে আপনাকেই প্রশংসা করতাম।’ তিনি আলী বিন মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আল-মূছেলী (মৃঃ ৩৫৯ হিঃ), দা‘লাজ (মৃঃ ৩৫১), মুহাম্মাদ আন-নাক্ক্বশ (মৃঃ ৩৫১),আবু আলী ছুমারী (মৃঃ ৩৬০) প্রমুখ বিদ্বানগণের নিকট হ’তে হাদীছ শ্রবণ করেন। ইল্মে হাদীছের প্রতি তাঁর এত বেশী আগ্রহ ছিল যে, যখন তিনি হাদীছ বর্ণনা করতেন তখন দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরত। ইল্মে হাদীছে তিনি এতই ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন যে, দামেশক ও মিসরের মত শিক্ষা নগরীতে তিনি হাদীছ শিক্ষা দিতেন। তিনি বিশ্বস্ত রাবী ছিলেন। ৪০৭ হিজরীতে মিসরে পরলোক গমন করেন। উপরের আলোচনা থেকে ধারণা করা যায় যে, সে যুগের দেবলী মুহাদ্দিছগণ সমস্ত ইসলামী দুনিয়ায় অত্যন্ত পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। ফলে তাঁদের তৎপরতা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও পরিব্যপ্ত ছিল। তবুও স্বদেশ তাঁদের খিদমত হ’তে মাহরূম হয়নি। বরং তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে দেবল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় আহলেহাদীছ জনগণের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান থাকে।

২য় কেন্দ্র : মানছূরাহ

সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবাদ শহর হ’তে ৪৭ মাইল উত্তর-পূর্বে শাহজাদপুর শহর থেকে আট মাইল দূরে সিন্ধু নদীর তীরে (করাচীর সন্নিকটে) প্রাচীন মানছূরা নগরীর ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। সিন্ধু বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম (৬৬-৯৬ হিঃ)-এর পুত্র সেনাপতি আমর বিন মুহাম্মাদ (মৃঃ ১২৬/৭৪৪ খৃঃ) ১১০ হিজরী মোতাবেক ৭২৮ খৃষ্টাব্দে এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তখন হতে সপ্তম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত ‘মানছূরাহ’ ছিল সিন্ধুর রাজধানী ও সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ নগরী। মানছূরাতে ইল্ম ও আলিমের খুব কদর ছিল। অধিকাংশ অধিবাসী আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে এখানে স্বাভাবিকভাবেই ইল্মে হাদীছ চর্চা খুব বেশী ছিল। মসজিদগুলি হাদীছের আলোচনায় সর্বদা গুলযার থাকত। এখানকার মুহাদ্দিছগণ সর্বদা হাদীছের দরস ও তাদরীসে মশগুল থাকতেন। তাঁরা হাদীছ বিষয়ক কেতাবাদি লিপিবদ্ধ করতেন। লেখনীর ক্ষেত্রে কাযী আবুল আববাস মানছূরীর নাম সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ।

মানছূরার মুহাদ্দিছবৃন্দ :

১-আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আবুল আববাস তামীমী আল-মানছূরী

মানছূরা এই খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ বাল্যকালে স্বদেশে শিক্ষালাভের পর উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন করেন। তিনি পারস্যে মুহাদ্দিছ আবুল আববাস বিন আছরাম (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) এবং বছরায় আবু রওক আহমাদ আল-হাযরানী (মৃঃ ৩৩২ হিঃ)-এর নিকট হ’তে হাদীছ শিক্ষা করেন ও বর্ণনা করেন। তিনি পারস্যের পশ্চিম এলাকা আরজান-এর ক্বাযী নিযুক্ত হন। ৩৬০/৯৭০ খৃষ্টাব্দে তিনি রেখারায় গেলে খ্যাতনামা হাদীছ সংকলক আবু আব্দুল্লাহ হাকেম নিশাপুরী (৩২১-৪০৫) তাঁর নিকট থেকে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করেন। এতেই বুঝা যায় স্বীয় যুগে তিনি কত বড় নামকরা মুহাদ্দিছ ছিলেন। ইমাম হাকেম বলেন যে, তিনি এযাবত যত মুহাদ্দিছের সাক্ষাত লাভ করেছেন, তন্মধ্যে আবুল আববাস মানছূরীকে সর্বাপেক্ষা তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন দেখতে পেয়েছেন। ৩৭৫/৯৮৫ খৃষ্টাব্দে ভূপর্যটক মাকদেসী যখন মানছূরাতে আসেন, তখন তিনি আবুল আববাস মানছূরীকে তাঁর নিজস্ব মাদরাসায় বসে হাদীছের দরস দিতে দেখেন। মানছূরী একজন উঁচুদরের লেখকও ছিলেন। ইবনু নাদীম (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তাঁকে ‘যাহেরী’ মাযহাবের দশজন শ্রেষ্ঠ বিদ্বানের অন্যতম হিসাবে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তথাপি তাঁর বিরুদ্ধে স্বীয় আকীদার সমর্থনে হাদীছ জাল করার অভিযোগ আছে।

২-আব্দুল্লাহ বিন জা‘ফর বিন মুররাহ মানছূরী (মৃঃ ৩৯০ হিঃ)

তিনি হাসান বিন মুকাররম ও তাঁর সহযোগী মুহাদ্দিছগণের শিষ্য ছিলেন। খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫) তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি কৃষ্ণবর্ণের মানুষ ছিলেন। উক্ত দু’জন সেরা হাদীছবিশারদ ছাড়াও মানছূরাতে ছোট বড় বহু মুহাদ্দিছ ছিলেন। যাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ৩৭৫ হিজরী পর্যন্ত মানছূরাতে অধিকাংশ অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন।

৩য় কেন্দ্র : কুছদার (বেলুচিস্তান)

কুছ্দার বেলুচিস্তানের দক্ষিণাংশে কালাত অঞ্চলে অবস্থিত। আরব শাসনামলে এই এলাকাকে ‘তূরান’ বলা হ’ত। তখনকার সময়ে তুরানের রাজধানী ও সমৃদ্ধ নগরী ছল। আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে (৪১-৬০) সর্বপ্রথম ছাহাবী সিনান বিন সালামাহ মুহবিক্ব আল-হুযালী (৮-৫৩ হিঃ) কুছদার জয় করেন। কিন্তু বাশিন্দাগণ চুক্তি ভঙ্গ করে। পরে মানযার বিন জারূদ আল-আবাদী বুকান ও কীকান জয়ের পর এই এলাকা জয় করেন। পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ বিন কাসিম-এর সময়ে (৯৩-৯৬ হিঃ) সিন্ধুর অন্যান্য এলাকার ন্যায় এই এলাকাও নিয়মিতভাবে ইসলামী খেলাফতের অধীনস্থ হয়। উল্লেখ্য যে, কুছদারে এক সময় খারেজীদের শাসন ছিল। কিরমানী, ফারিস ও খুরাসান হ’য়ে স্থলপথে আরবদের সঙ্গে এই শহরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আরবরা এখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের জন্য মসজিদ ছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রথম দিকে এখানে কোন হাদীছ শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে এবং দেরীতে হ’লেও চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে এসে আমরা এখানে দু’একজন মুহাদ্দিছের সন্ধান লাভে সমর্থ হয়েছি- যাঁদের মাধ্যমে এইসব এলাকায় হাদীছভিত্তিক জীবন গঠনের আন্দোলন বিরাজিত থাকে। যেমন-

১-জা‘ফর ইবনুল খাত্ত্বাব আবু মুহাম্মাদ আল-কুছদারী :

কুছদারে জন্মগ্রহণকারী এই বিদ্বান একজন দুনিয়াত্যাগী মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আবুল ফযল আবদুছ ছামাদ বিন মুহাম্মাদ বিন নাছীর আল-আছেমীর নিকটে হাদীছ শিক্ষা করেন এবং তাঁর কাছে হাদীছ শিক্ষা করেন হাফেয আবুল ফতূহ আব্দুল গাফের বিন হুসাইন বিন আলী কাশগড়ী। তিনি বল্খে বসবাস করেন। মুহাদ্দিছ জাফর বিনুল খাত্তাব সেই সকল প্রাচীন হাদীছবিশারদগণের অন্যতম ছিলেন, যারা পঞ্চম শতাব্দী হিজরীর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন।

২-সিবাওয়ায়েহ্ বিন ইসমাঈল বিন দাঊদ বিন আবুদঊদ আল-কুছদারী

সিবাওয়ায়েহ্ বিন ইসমাঈল বিন দাঊদ বিন আবুদাঊদ আল-কুছদারী মক্কায় জীবন কাটান ও সেখানেই হাদীছ শিক্ষা দেন। তিনি আবুল কাসিম আলী বিন মুহাম্মাদ আল-হুসাইনী, আবুল ফাত্হ রাজা বিন আবদুল ওয়াহেদ আল-ইছ্ফাহানী এবং হাফেয আবুল হুসাইন ইয়াহ্ইয়া বিন আবুল হাসান রাওয়াসীর নিকট হ’তে হাদীছ শিক্ষা করেন। ৪৬০ হিজরীর কিছু পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।

আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, ৯৩ হিজরীতে সিন্ধু এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনস্থ অঞ্চলে পরিণত হ’লেও এবং তাবেঈদের আগমন ঘটলেও এই এলাকায় ইল্মে হাদীছের নিয়মিত চর্চা তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়নি। আববসীয় খলীফা মাহ্দী (১৯৮-২১৮) হ’তে সিন্ধু এলাকা বিভিন্ন আরব সর্দারদের অধীনে মাহানিয়া, হিবারিয়া, সামিয়াহ প্রভৃতি কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। যদিও সকলে আববাসীয় খলীফাদের নামে খুৎবা পাঠ করতেন। সিন্ধুতে স্বাধীন আরব রাজ্যসমূহ কায়েম হ’লে এর ফলে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্ট হয় এবং তা ইল্মে হাদীছ-এর প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। রাজনৈতিক শান্তি ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার ফলে চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর শেষার্ধে সিন্ধু এলাকায় ইল্মে হাদীছের চর্চা এত বেড়ে যায় যে, এখানকার ছাত্ররা আরব, সিরিয়া, ইরাক ও মিসরের হাদীছ শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে গমন করত। এমনকি বাগদাদ ও খোরাসান থেকে মুহাদ্দিছগণ দেবল ও মানছূরাতে এবং এইসব এলাকার মুহাদ্দিছগণ মক্কা, দামেশক, বাগদাদ ও মিসরে গিয়ে হাদীছ শিক্ষা দান করতেন। সাম‘আনী (মৃঃ ৫৬৬ হিঃ)-এর বর্ণনা মতে খ্যাতনামা আহলেহাদীছ বিদ্বান আবু ওছমান ছাবূনী (৩৭৩-৪৪৯ হিঃ) -এর নিকট হাদীছ শিক্ষার জন্য হিন্দুস্থানী ছাত্রগণ নিশাপুর পর্যন্ত গমন করেছিলেন। হাদীছের এই ব্যাপক চর্চার ফলে এই অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মাকদেসীর সাক্ষ্য অনুযায়ী ৩৭৫ হিজরীতে মানছূরা ও সিন্ধু অঞ্চলে আহলেহাদীছ জনসংখ্যা সর্বাধিক ছিল। কিন্তু আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই অব্যাহত অগ্রগতির মুখে হঠাৎ অশনিপাত ঘটে মুলতান ও মানছূরাতে শী‘আ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে। এর পর শুরু হয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাসে প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসরের এক দীর্ঘ অবক্ষয় যুগ।

 [‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গৃহীত]।



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও