মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় : সালাফী আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে এর ভূমিকা
মীযানুর রহমান
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 5514 বার পঠিত
{কাবাগৃহের
পর মুসলিম উম্মাহ ২য় সর্বাধিক আকর্ষণের কেন্দ্র হল রাসূল (ছাঃ)-এর
স্মৃতিবিজড়িত মাসজিদুন নববী। হজ্জের কোন অংশ না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে হজ্জে আগত প্রত্যেক মুসলমানই এক ভিন্ন আবেগে মাসজিদুন নববীতে
আগমণ করেন। সেই মাসজিদুন নববীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়েই এবারের বিশেষ
নিবন্ধটি পত্রস্থ করা হল- নির্বাহী সম্পাদক।}
প্রাকইতিহাস :
৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর সোমবার। নবুয়তের চতুর্দশতম বর্ষ। মক্কা থেকে রাসূল (ছাঃ) ৮ দিনের সংগ্রামমূখর পথ বেয়ে মদীনার (তৎকালীন ইয়াছরিব) উপকণ্ঠে কোবা নামক স্থানে এসে অবতরণ করলেন। মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথী আবু বকর (রাঃ)- দু’জনের এই ছোট্ট কাফেলাকে সাদর সম্ভাষণে অভিষিক্ত করল মদীনাবাসী। সেখানে ৪ দিন বিরতির নিয়ে ১২ই রবিউল আওয়াল শুক্রবার তিনি মদীনার কেন্দ্রস্থলে স্বীয় মাতৃবংশ বনু নাজ্জার পল্লীতে আসলেন এবং মসজিদে নববীর বর্তমান অবস্থানে ছাহাবী আবূ আইয়ূব আনসারী (রাঃ)-এর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন। মদীনাবাসীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। আনাস (রাঃ) বলেন, মদীনায় সেদিনের মত আনন্দোজ্জ্বল সোনালী দিন আমি আর কখনো দেখিনি। কিছুদিন পর রাসূল (ছাঃ) একটি মসজিদ নির্মাণের মনস্থ করলেন এবং তাঁর উটনী ‘কাছওয়া’র থেমে যাওয়ার স্থানকে মসজিদের জন্য নির্বাচন করলেন। এই জমি ছিল সাহল ও সুহায়েল নামক দুই ইয়াতীম বালকের মালিকানাধীন। তাদের কাছ থেকে জমি ক্রয়ের পর ইসলামের ১ম মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হল। অতঃপর আনছার ও মুহাজিরদের দীর্ঘ সাত মাসের যৌথ পরিশ্রমে কাঁচা ইটের ভিত এবং খেজুর পাতার ছাউনীতে খেজুর গাছের কান্ড দিয়ে নির্মিত খুঁটির উপর ৯৮×১১৫ ফুট আঙ্গিনা (১১০০ বর্গমিটার) ও ৭ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মিত হল। এ মসজিদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে লাগল পবিত্র মদীনা নগরী। অবশেষে তা কেবল মসজিদই রইল না বরং পরিণত হল অহিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার এক অভূতপূর্ব প্রাণকেন্দ্রে, পরিণত হল নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান পার্লামেন্ট এবং বিচারালয়েও। পরিণত হল তাওহীদের এমন একটি বিপ্লবী শিক্ষাকেন্দ্রে, যেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ছাহাবীগণ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, হিজরতের পর প্রথম ১৬ মাস বায়তুল মুকাদ্দাস তথা উত্তরদিকে কিবলা ছিল। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল্লাহর দিকে তথা দক্ষিণ দিকে কিবলা নির্ধারিত হয়। নিম্নে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে এই মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল।
মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ কার্যক্রম
রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা :
হিজরতের পর মদীনায় যেন বিদ্যুৎগতিতেই ইসলামের প্রসার ঘটতে লাগল। মসজিদে নববীতে জায়গা দ্রুতই সংকীর্ণ হয়ে আসতে লাগল। ফলে মসজিদ সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। অতঃপর ৭ম হিজরীতে খাইবার যুদ্ধের পর রাসূল (ছাঃ) মসজিদটিকে প্রস্থে ৪০ হাত এবং দৈর্ঘ্যে ৩০ হাত সম্প্রসারণ করলেন। এতে মসজিদটি ২৫০০ বর্গ মিটারের একটি বর্গাকার গৃহে পরিণত হল।
উমার বিনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর যামানা (১৭হিঃ):
আবু বকর (রাঃ)-এর যুগে মসজিদের পুরানো খুঁটিগুলো বদলিয়ে নতুন খুঁটি লাগানো হয়। অতঃপর উমার বিনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ১৭ হিজরীতে মসজিদটিকে সুপরিসরভাবে পুনঃনির্মাণ করেন। এতে মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৪০ ফুট, প্রস্থ ১২০ ফুট এবং উচ্চতা ১১ ফুটে পরিণত হল। নির্মাণকার্যে আগের মতই কাঁচা ইট ও খেজুর গাছের কান্ড ব্যবহার করা হয়।
ওছমান বিন আফ্ফান (রাঃ)-এর যামানা (২৯হিঃ) :
২৯ হিজরীতে ওছমান (রাঃ) পুণরায় মসজিদে নববী সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনি কিবলার দিকে, উত্তর পার্শ্বে এবং পশ্চিমে সম্প্রসারণ করেন। সম্মুখভাগে তাঁর সম্প্রসারণকৃত সীমাটি আজও পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এই নির্মাণকাজে তিনি খোদিত পাথর, প্লাস্টার এবং ছাদে চন্দন কাঠ ব্যবহার করেন। প্রায় ১০ মাস ধরে এর নির্মাণকাজ করা হয়। তিনি মসজিদে ছালাত আদায়ের জন্য মেহরাবের মত একটি কামরা নির্মাণ করেন, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ছালাত আদায় করাতেন। এর কারণ ছিল যেন ছালাতের সময় উমর (রাঃ)-এর হত্যাকান্ডের মত কেউ তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করতে না পারে। কামরাটি ছিল জানালাবিশিষ্ট যা দিয়ে মানুষ তাঁকে বাইরে থেকে দেখতে পেত।
উমাইয়া যুগ (৮৮ হিঃ) :
উমাইয়া শাসক আল ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক ৮৮ হিজরীতে (৭০৭ খৃঃ) মদীনার তৎকালীন গভর্নর উমর বিন আব্দুল আযীযকে মসজিদে নববী পুননির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য নির্দেশ দেন। প্রায় ৩ বছর ধরে এই নির্মাণ কাজটি করা হয়। এ সময় মসজিদটির পূর্বদিকে ৩০ হাত এবং পশ্চিম দিকে ২০ হাত সম্প্রসারণ করা হয়। উম্মুল মুমিনীনগণের গৃহসমূহ তথা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই সাহাবী আবু বকর ও উমর (রাঃ)-এর কবরও মসজিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। মসজিদ নির্মাণে উমার বিন আব্দুল আযীয নকশাদার মর্মর পাথর, লোহা এবং সীসা ব্যবহার করেন। অভ্যন্তরীণ দেয়ালে সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশাও অংকন করা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম মসজিদে নববীর ৪ কোনায় ৫০ হাত বিশিষ্ট ৪টি মিনার সংযোজন করেন এবং রাসূল (ছাঃ) ও ওছমান (রাঃ)-এর ছালাতের স্থানে মিহরাব নির্মাণ করেন।
আববাসীয় যুগ (৯১ হিঃ) :
আববাসীয় শাসক আল মাহদী ৭৭৮ খৃষ্টাব্দে হজ্জের সফরে আসেন এবং মদীনার গভর্নর জা‘ফর বিন সুলাইমানকে মসজিদটি আরো সম্প্রসারিত করার নির্দেশ দেন। অতঃপর তিন বছর ধরে এর সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসময় মসজিদটি উত্তর দিকে আরো ১০০ ফুট বৃদ্ধি করা হয়। আববাসীয় যুগেই মসজিদের যমীনকে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় এবং মসজিদের দেয়ালসমূহে মোজাইক পাথরের আস্তরণ দেয়া হয়।
মামলুকী শাসনামল (৬৫৪ হিঃ) :
৬৫৪ হিজরীতে এক অগ্নিকান্ডে মসজিদে নববী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর আববাসীয় শাসক মু‘তাছিম বিল্লাহ পরবর্তী বছর সংস্কার কাজ শুরু করেন, কিন্তু তাতারীদের হামলার কারণে তা আর শেষ করে যেতে পারেননি। অতঃপর মিসর ও ইয়ামানের শাসকগণ বাকি কাজ সম্পন্ন করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। ৬৭৮ হিজরীতে (১২৭৯ খৃঃ) মামলুক সুলতান কালাউন সর্বপ্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের উপর একটি গম্বুজ প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮৬ হিজরীতে (১৪৮১ খৃঃ) মসজিদে নববী ২য় বারের মত অগ্নিকান্ডের শিকার হয়। এসময় সুলতান আশরাফ কায়েতবায়ী দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং মসজিদের পূর্বাংশে বর্ধিত করেন। তিনি ২২ হাত উঁচুতে মসজিদের ছাদ নির্মাণ করেন এবং রাসূল (ছাঃ) কবরের উপর একটি কালো পাথরের গম্বুজও নির্মাণ করেন।
ওছমানীয় শাসনামল :
ওছমানীয় সুলতানগণের আমলে প্রয়োজন মোতাবেক এ মসজিদের সংস্কারকাজ পরিচালিত হয়। তবে সে সময় মৌলিক কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়নি। এভাবে প্রায় ৩৭০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১২৬৫ হিজরীতে (১৮৪৯ খৃঃ) তুর্কী সুলতান আব্দুল মজিদ (১ম)-এর নির্দেশে মসজিদটিকে ভেঙ্গে নতুন নকশায় পুনঃনির্মাণ করা হয়। শুধু রওযা মুবারক, ওছমান (রাঃ) ও সুলায়মানের মেহরাব এবং প্রধান মিনার অক্ষত রাখা হয়। কেননা এসবের নকশা ছিল খুব নিখুঁত ও সৌন্দর্যমন্ডিত। মদীনার পার্শ্ববর্তী আকীক উপত্যাকার আল-হারাম পাহাড় খনন করে সেখানে প্রাপ্ত লাল পাথর দিয়ে মসজিদের মূল ভবন তৈরী করা হয়। পুরো মসজিদের মেঝে ও দেয়ালকে মার্বেল পাথরে মুড়িয়ে দেয়া হয়। নানা নকশায় গম্বুজগুলোর অভ্যন্তরভাগ চিত্রিত করা হয়। ফলে স্থাপত্যশৈলী এবং নান্দনিকতায় মসজিদে নববী পরিণত হয় এক বিস্ময়কর সৌন্দর্যের প্রতীকে। ১২৭৭ হিজরীতে (১৮৬০ খৃঃ) সালে এই নির্মাণকাজ শেষ হয়।
১৮১৭ খৃষ্টাব্দে তুর্কী সুলতান মাহমুদ (২য়) রাসূল (ছাঃ)-এর কবর উপরস্থিত গম্বুজে নীল আস্তরণ লাগান। অতঃপর ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে তাতে সবুজ আস্তরণ দেন। অদ্যাবধি গম্বুজের উপর এ সবুজ রংই স্থায়ী রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ওছমানীয় আমলে চার মাযহাবের লোকদের জন্য মসজিদে নববীতে আলাদা আলাদা ইমাম নিয়োগ করা হয়েছিল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব অনুসারীদের নিয়ে পৃথকভাবে ছালাত আদায় করতেন। বর্তমান সঊদী হুকুমত কায়েমের পূর্ব পর্যন্ত এই নীতি চালু ছিল। বর্তমানে মসজিদের যে মেহরাবটিকে সুলায়মানী মেহরাব বলা হয় তা পূর্বে মেহরাবে হানাফী নামে পরিচিত ছিল।
সঊদী শাসনামল
১৯৩২ সালে সঊদী শাসনামল শুরু হবার পর থেকে মসজিদে নববীর অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। কয়েকটি ধাপে এ সংস্কার সাধিত হয়েছে।
প্রথম সম্প্রসারণ ও পুনঃনির্মাণ :
বাদশা আব্দুল আযীয ১৯৫৩ সালে সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারকার্য আরম্ভ করেন। মূল মসজিদের আয়তন তখন ছিল মাত্র ৬,২৪৬ বর্গমিটার। সংস্কারের পর মসজিদের মোট আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ১৬,৩২৬ বর্গমিটার। ১৯৫৫ সালে প্রায় ৫০ মিলিয়ন রিয়াল ব্যয়ে মসজিদের নতুন ইমারত নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। এ সম্প্রসারণকার্যের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল পুরো মসজিদ এ সময় কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করা হয়। এতে ছিল ২৩২টি পিলার। মসজিদের ৫টি মিনার থেকে ৩টি ভেঙ্গে ফেলা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত দুটো নতুন মিনার নির্মিত হয়। প্রত্যেকটি মিনার ছিল ৭২ মিটার উঁচু। ১৯৭৩ সালে বাদশাহ ফয়সাল পুনরায় মসজিদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ দফায় মসজিদের চত্বরে মুছল্লীদের রোদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ছাতা স্থাপন করা হয়।
২য় দফা সম্প্রসারণ :
বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আযীয মসজিদে নববীর যে সম্প্রসারণ কাজ হাতে নেন তা এ যাবৎকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ। এই সম্প্রসারণের পর মসজিদের আয়তন প্রায় ৭ গুণ (৯৮.৫০০ বর্গমিটার) বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে এ সম্প্রসারণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে তা সমাপ্ত হয়। ভবনটিতে রয়েছে বেজমেন্ট, নিচতলা ও ছাদ। ভবনের মূল অংশ নিচতলার ৮২,০০০ বর্গমিটার স্পেস জুড়ে ৬ মিটার ব্যবধানে পিলার রয়েছে মোট ২১০৪টি, যার প্রতিটির নিম্নাংশ দিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে রয়েছে ২৭টি উন্মুক্ত চত্বর বা প্লাজা যার প্রতিটি ভ্রাম্যমান গম্বুজবিশিষ্ট এবং প্রয়োজনে তা উন্মুক্ত করা যায়। মসজিদের ছাদেও ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে ৯০ হাজার মুছল্লী একত্রে ছালাত আদায় করতে পারে। মসজিদের মূল ভবন তথা রিয়াযুল জান্নাতের সামনের দু’অংশে বিভক্ত দু’টি খোলা চত্বরে মোট ১২টি স্বয়ংক্রিয় শ্বেতশুভ্র সোনালী কারুকার্যময় ছাতা স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া বিশাল বহির্চত্বরে চমৎকারভাবে সুসজ্জিত আরো প্রায় ২৫০টি স্বয়ংক্রিয় ফোল্ডিং ছাতা স্থাপিত হয়েছে।
মসজিদের চতুর্পার্শ্বে রয়েছে বিশাল খোলা চত্বর। যার আয়তন ২,৩৫,০০০ বর্গমিটার। এর কিছু অংশ সাদা শীতল মর্মর পাথর দিয়ে মোড়ানো যাতে সূর্যতাপে তা তেতে না উঠতে পারে। বাকি অংশ গ্রানাইট পাথরে ঢাকা। এখানে ৪,৩০,০০০ মুছল্লী একসাথে ছালাত আদায় করতে পারেন। প্রথম সম্প্রসারণের পর মূল মসজিদের ধারণ ক্ষমতা যেখানে ছিল ২৯,৭৭৮ জন, ২য় সম্প্রসারণের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৬৮,০০২ জনে। সুতরাং সবমিলিয়ে এখন ৭,৮৮,০০২ জন মুছল্লী এক সঙ্গে ছালাত আদায় করতে পারে। ইমারতের মূল রং সাদা, যার মধ্যে লাল-কালোর মিশ্রণ রয়েছে। মসজিদের উত্তর-পূর্বকোণে ১৬,০০০ বর্গমিটার এবং পশ্চিম-উত্তর কোণে ৮০০০ বর্গমিটার স্থান মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে।
মসজিদের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড অফিস থেকে পরিচালিত হয়। মসজিদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য মসজিদ থেকে ৭ কি.মি. পশ্চিমে বিশ্বের বৃহত্তম এয়ারকন্ডিশনিং মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে সুড়ঙ্গপথে বিশেষ পাইপ ও টিউবের মাধ্যমে মসজিদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মসজিদের সার্বিক তত্বাবধানে প্রায় ১৩০০ কর্মী নিয়মিত কর্মরত রয়েছে।
নতুন সম্প্রসারণ পরিকল্পনা :
প্রতিবছর দ্রুতগতিতে যিয়ারতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে বর্তমান সঊদী বাদশাহ আব্দুল্লাহ নতুন করে মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এই সম্প্রসারণ শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা মোতাবেক মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে সার্বিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এক বিশাল কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে। ২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে নির্মিতব্য এই বিশাল কমপ্লেক্সটি ২০১২ সালের হজ্জ মওসূমের পর পুরোদমে শুরু হবে এবং ৩টি ধাপে ২০৪০ সাল নাগাদ সমাপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মসজিদে নববীতে প্রায় ১৬ লক্ষ মুছল্লীর জায়গা সংকুলান হবে।
বিশেষ কিছু স্থানের বর্ণনা
রাসূল (ছাঃ)-এর রওযা :
মসজিদে নববীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত রাসূল (ছাঃ)-এর হুজরাখানা ও কবর। ৮৭ হিজরীর পূর্ব পর্যন্ত হুজরাখানাটি মসজিদের বাইরে ছিল। মসজিদ প্রশস্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলে হজরাগুলোকে মসজিদের মধ্যে শামিল করে নেয়া হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর কবরসহ একই স্থানে পশ্চিম-পূর্ব হয়ে শায়িত আছেন আবু বকর (রাঃ) এবং উমর (রাঃ)। কিবলার দিক থেকে প্রথমে শায়িত রয়েছেন রাসূল (ছাঃ)। তাঁর উত্তর পার্শ্বে যথাক্রমে রাসূল (ছাঃ)-এ সিনা বরাবর আবুবকর (রাঃ) এবং তাঁর সিনা বরাবর উমর (রাঃ)-এর কবর। এরপর একটি কবর দেয়ার স্থান বাকী রয়েছে যেখানে ঈসা (আঃ)-এর কবর হবে মর্মে একটি যঈফ হাদীছ পাওয়া যায় (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৭২)। চতুষ্কোনবিশিষ্ট ঘরে অবস্থিত এই তিনজনের কবরকে ঘিরে একটি পাঁচ কোনা উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে দেন উমর বিন আব্দুল আযীয (র.) যাতে হুজরাটি কাবার মত না দেখায় এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ তাকে ঘিরে তাওয়াফ করা না শুরু করে। ৬৬৮ হিজরীতে সুলতান রুকুনুদ্দীন বায়বারাস কবরগাহের চারপাশ দিয়ে লোহা ও পিতলের জালি দিয়ে ঘিরে দেন, যাকে ‘মাকছূরা’ বলা হয়। ৮৮৮ হিজরীতে সুলতান কাতেবায়ী লোহা ও পিতলের ঘন জালি দিয়ে ছাদ পর্যন্ত ঢেকে দেন। পরবর্তীতে তুর্কী সুলতান সুলায়মান খান (৯২৬-৯৪৮ হিঃ) ‘মাকছূরা’র উপর মর্মর পাথর লাগিয়েছেন। অনেক মুছল্লী এই ‘মাকছূরা’কেই রাসূল (ছাঃ)-এর হুজরা ভেবে ভুল করে। এই মাকছূরার চারটি দরজা রয়েছে। তবে সবগুলোই বন্ধ থাকে। কেবলমাত্র পূর্বদিকে ‘বাবে তাওবা’টি বিশেষ উপলক্ষে খোলা হয়।
স্মর্তব্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কবর মসজিদের মধ্যে হয়নি, যেমনটি অনেকে ধারণা করে। বরং আয়েশা (রাঃ)-এর গৃহে তাঁকে কবরস্থ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মসজিদ প্রশস্ত করতে গিয়ে বাধ্যগত অবস্থায় তাঁর কবর মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রিয়াযুল জান্নাহ :
রাসূল (ছাঃ)-এর কবর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানকে রিয়াযুল জান্নাত বলা হয়। এই স্থানটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার ঘর থেকে মিম্বর পর্যন্ত স্থানটুকু জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগান এবং আমার মিম্বর কিয়ামতের দিন হাউযে কাউছারের উপর স্থাপন করা হবে (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৪)। স্থানটি দৈর্ঘ্যে ২২ মিটার এবং প্রস্থে ১৫ মিটার। কয়েকশ মানুষ এখানে একসাথে ছালাত আদায় করতে পারে। হজ্জের মৌসুমে এর দুটি প্রবেশপথে প্রচন্ড ভিড়ের সামাল দেয়ার জন্য পুলিশ পাহারারত থাকে। পৃথকভাবে বোঝানোর জন্য স্থানটিতে ভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে মোড়া রয়েছে।
মিম্বর :
রাসূল (ছাঃ) সর্বপ্রথম খুৎবা দিতেন একটি খেঁজুর গাছের খুঁটিতে। অতঃপর ৮ম হিজরীতে তাঁর জন্য ঝাউগাছের কান্ড দিয়ে ১ মিটার উচ্চতার একটি মিম্বর তৈরী করা হল। মিম্বরটি ছিল ৩ সিঁড়ি বিশিষ্ট যার ৩য় ধাপে রাসূল (ছাঃ) বসতেন। আবু বকর (রাঃ) খলীফা হবার পর রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মানার্থে ২য় ধাপে বসতেন। এরপর উমর (রাঃ) ৩য় ধাপে বসতেন এবং মাটিতে পা রাখতেন। ওছমান (রাঃ)ও ছয় বছর পর্যন্ত ৩য় ধাপেই বসতেন। তারপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর বসার স্থানেই বসা আরম্ভ করলেন। আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ) হজ্জ করতে এসে এই মিম্বরের ধাপ বৃদ্ধি করে দেন। ফলে তা ৯ ধাপ বিশিষ্ট হল। পরবর্তী খত্বীবগণ ৭ম ধাপে বসতেন যা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর মিম্বরের ১ম ধাপ। ১২৫৬ খৃষ্টাব্দে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মিম্বরটি সেভাবেই ছিল। এরপর আরো কয়েকবার নির্মিত হয়। কিন্তু ১৪৮১ খৃষ্টাব্দে আবার আগুনে পুড়ে গেলে মিম্বরটি পাকা করা হয়। সর্বশেষ ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে তুর্কী সুলতান তৃতীয় মুরাদ মর্মর পাথর দিয়ে বানানো স্বর্ণের প্রলেপে সুসজ্জিত কারুকার্যময় একটি মিম্বর প্রেরণ করেন। এই মিম্বরে ১২টি সিঁড়ি রয়েছে। ৩টি সিঁড়ি বাইরে এবং ভিতরে ৯টি। আজও পর্যন্ত এই মিম্বরটিই মসজিদে নববীতে শোভা পাচ্ছে।
মিনার :
রাসূল (ছাঃ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় মসজিদে নববীতে কোন মিনার ছিল না। সর্বপ্রথম ৯১ হিজরীতে উমর বিন আব্দুল আযীয মসজিদের চার কোনে চারটি মিনার নির্মাণ করেন। সর্বশেষ সম্প্রসারণে নির্মিত নতুন ৬টি মিনারসহ মোট মিনারের সংখ্যা বর্তমানে ১০টি। নতুন মিনারগুলোর উচ্চতা ১০৪ মিটার। মিনারের চূড়া স্বর্ণালী চন্দ্রাকৃতি এবং সর্বাঙ্গ অত্যন্ত সুদৃশ্য কারুকার্য দ্বারা খচিত। মিনারগুলো স্নিগ্ধ আলোকসজ্জার কারণে রাতের বেলায় অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে উঠে।
গম্বুজসমূহ :
মসজিদে নববীর ছাদে রাসূল (ছাঃ)-এর কবর বরাবর স্থানে নির্মিত গম্বুজটি সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন ৬৭৮ হিজরীতে (১২৭৯ খৃঃ) মামলুক সুলতান কালাউন। অতঃপর ৮৮৬ হিজরীতে (১৪৮১ খৃঃ) অগ্নিকান্ডে মসজিদে নববী ক্ষতিগ্রস্ত হবার পর সুলতান আশরাফ কায়েতবায়ী পুণরায় একটি কালো পাথরের গম্বুজ নির্মাণ করেন। পরবর্তী শাসকদের আমলে তাতে সাদা এবং নীল রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছিল। ৯৪৬ হিজরীতে গম্বুজের উপর তুর্কী খেলাফতের প্রতীকবাহী চন্দ্রাকৃতি স্থাপন করেন মক্কার শরীফ ওয়াছেল। অতঃপর ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে (১২৫৮ হিঃ) তুর্কী সুলতান মাহমূদ খান গম্বুজের উপর সবুজ রঙের প্রলেপ দেন। তখন থেকে এটি ‘কুববাতুছ ছাখরা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
উল্লেখ্য যে, ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ওয়াহ্হাবী সংস্কারবাদীরা মদীনা আক্রমণ করার পর বাকী‘ কবরস্থানের সকল কবরের উপর থেকে গম্বুজ ভেঙ্গে ফেললেও এই গম্বুজটি অপসারণ করেননি। এর কারণ সম্পর্কে আল্লামা রশীদ রেযা তাঁর ‘আল-ওয়াহহাবিয়্যুন ওয়াল হিজায’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সম্ভবত মুসলিম জনসাধারণের হৃদয়পটে রাসূল (ছাঃ)-এর সুমহান মর্যাদা এবং গম্বুজটির বিশ্বব্যাপী পরিচিতির দিকে লক্ষ্য রেখে ফিৎনার আশংকায় ওয়াহ্হাবীগণ এই গম্বুজটি ভাঙ্গা থেকে বিরত ছিলেন’ (পৃ.৬৯-৭১)। তাই কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও এবং এর বিরুদ্ধে সঊদী ওলামায়ে কেরামের সোচ্চারকণ্ঠ হওয়া সত্বেও অদ্যবধি ‘কুববাতুছ ছাখরা’ বা সবুজ গম্বুজটি অক্ষত রাখা হয়েছে। ‘কুববাতুছ ছাখরা’ ছাড়াও মসজিদের বিভিন্ন স্থানে আরো ২৭টি স্থানান্তরযোগ্য গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে।
স্তম্ভসমূহ :
রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে মসজিদে নববীতে ৩৫টি খেজুর কান্ডের খুঁটি ছিল। পরবর্তীতে মসজিদ প্রশস্ত হওয়ার সাথে সাথে খুঁটির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে খুঁটির সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। তবে মসজিদের অভ্যন্তরে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে যেসকল স্থানে স্তম্ভ ছিল তা অদ্যবধি অক্ষত রাখা হয়েছে। ফলে মসজিদের সম্মুখভাগে স্তম্ভের সারি বেশী ঘন হয়ে গেছে। তুর্কী আমলে যখন মসজিদ সংস্কার করা হয়, তখন খুঁটির সংখ্যা কমিয়ে মসজিদের ভিতর খালি জায়গা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে মদীনার আলেমগণ এসব ঐতিহাসিক খুঁটি ভাঙ্গার বিরোধিতা করলে সে অবস্থাতেই খুঁটিগুলো রেখে দেয়া হয়।
দরজাসমূহ :
মসজিদে নববীর দরজা রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে ছিল ৩টি। পরে উমর (রাঃ) এ সংখ্যা ছয়টিতে উন্নীত করেন। সর্বশেষ সংস্কারের পর মসজিদে নববীতে বর্তমানে মোট ১১টি সদর দরজাসহ মোট ৮১টি দরজা রয়েছে। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে রয়েছে বাবে জিবরীল যে দরজা দিয়ে রাসূল (ছাঃ) প্রবেশ করতেন। খন্দকের যুদ্ধের পর জিবরীল (আঃ) এই দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলে একে বাবে জিবরীল বলা হয়।
শেষকথা :
মসজিদে নববী বর্তমান বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মসজিদ এবং ইসলামে বৈধ ৩টি তীর্থযাত্রাস্থলের অন্যতম। রাসূল (ছাঃ)-এর পবিত্র স্মৃতিবিজড়িত হওয়ার কারণে মুসমানদের সাথে রয়েছে এই মসজিদটির এক অপরিমেয় আবেগের বন্ধন। প্রতিবছর হজ্জের সময় ছাড়াও লক্ষ লক্ষ মুসলমান মসজিদে নববী যিয়ারতের উদ্দেশ্যে গমণ করে থাকেন। প্রতিবছরই বাড়ছে এ সংখ্যা। ফলে গত পৌনে একশ বছরেই মসজিদে নববীকে সম্প্রসারণ করতে হয়েছে প্রায় ১০০ গুণ। ২০৪০ সাল নাগাদ যা পৌঁছাবে প্রায় ২০০ গুণ। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান গতিতে। মুসলিম জাতির হৃদয়পটে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি যে অফুরন্ত ভালবাসার ফল্গুধারা বইছে প্রতিনিয়ত, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। এই ভালবাসা বহ্নিশিখা হয়ে যদি কোনদিন মুসলিম জাতির হৃদয় জগত ছাপিয়ে তাদের কাজে-কর্মে, আমলে-আদর্শে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, সেদিন যে পৃথিবীর বুকে পরিবর্তনের রূপরেখা সূচিত হতে খুব বেশী সময় লাগবে না, তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!