খলীফা বা আমীর নিযুক্ত করা কি যরূরী?
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী 1769 বার পঠিত
[সাইয়েদ
আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৩-১৯৯৯ খৃঃ) আধুনিক যুগে ভারত উপমহাদেশের একজন
খ্যাতনামা আলেম এবং প্রাজ্ঞ লেখক ও ইতিহাসবিদ। তিনি ছিলেন ভারতের খ্যাতনামা
ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘নাদওয়াতুল উলামা’র সাবেক ছাত্র এবং পরবর্তীতে
রেক্টর। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিক্ষাবিদ স্বীয় জ্ঞানবত্তা এবং
সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছিলেন। একজন অনারবী
হয়েও তিনি আরবী ভাষায় ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের পন্ডিত এবং তাঁর অধিকাংশ
গ্রন্থই রচিত হয়েছে আরবী ভাষায়। আরবী ও উর্দূ ভাষায় তাঁর লিখিত গ্রন্থের
সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক, যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখার মূল
বিষয়বস্ত্ত ছিল ধর্মতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস এবং সমকালীন মুসলিম জাহান।
এছাড়া তাঁর সেমিনার পেপার, প্রবন্ধ এবং ধারণকৃত বক্তব্যের সংখ্যা
সহস্রাধিক। ১৯৬৩ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের
সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮০ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘কিং ফয়সাল’ পুরস্কার লাভ
করেন। একই সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অক্সফোর্ড ইসলামিক
সেন্টারে’র চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৮১ সাল তিনি কাশ্মীর
ইউনিভার্সিটি কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে আরব
আমিরাত সরকার তাঁকে "Personality of the year" বা ‘বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব’
হিসাবে ঘোষণা করে। এছাড়া রাবেতা আলম, ওয়ামী প্রভৃতি সহ জাতীয়, আন্তর্জাতিক
বহু ইসলামী ফোরামের তিনি সম্মানিত সদস্য ছিলেন। আলোচ্য নিবন্ধটি লেখকের
ভাষণ সংকলন ‘পা-জা-সুরাগে যিন্দেগী’ থেকে গৃহীত যা ‘জীবন পথের দিশা’
শিরোনামে মাওলানা এ কিউ এম ছিফাতুল্লাহ বঙ্গানুবাদ করেছেন। ১৯৭২ সালের ১২ই
আগষ্ট দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসার মিলনায়তনে উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে
তিনি এই মূল্যবান বক্তব্যটি রেখেছিলেন-নির্বাহী সম্পাদক]
স্নেহাস্পদ হৃদয়ের টুকরা ছাত্রভাইয়েরা!
তোমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ইসলামী চেতনা ও জীবনধারার প্রেরণাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুগের চ্যালেঞ্জ সত্যিকারভাবে মুকাবিলার লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। তোমরা কিছুতেই যুগের চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করতে পারো না। অন্ততপক্ষে দারুল উলূম দেওবন্দ ও নাদওয়াতুল উলামা লাখনৌর পক্ষে যুগের দাবী ও চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করার কোন বৈধতা নেই; কেননা যুগের দাবী পূরণ ও যুগের চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় এ প্রতিষ্ঠানদ্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশ্চাত্য জড়বাদী দর্শন ও সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ধর্ম নৈতিকতা বর্জিত বৃটিশ শিক্ষা পদ্ধতিই ছিল তৎকালীন সময়ে সবচাইতে বড় ফিতনা। কিন্তু এটিও লক্ষণীয় বিষয় যে, ফিতনা কোন যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় আবার সকল যুগের ফিতনা ও তার প্রক্রিয়া একই ধরনের হয় না। বিভিন্ন যুগে নানা ফিতনার উদ্ভব ঘটে এবং মুসলিম উম্মাহ্কে নতুন নতুন সঙ্কটের আবর্তে নিক্ষেপ করে। জাহিলিয়াত নতুন নতুন রূপ ধরে অভিনব মুখোশ পরে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও চাকচিক্যময় মনমাতানো রূপ নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয়।
দার্শনিক মহাকবি আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন :
اگر چه پير هے مؤمن جواں هيں لات ومنات
‘মুমিন যদিও বৃদ্ধ, লাত-মানাতরা এখনও তরুণ’।
ছোট্ট একটি বাক্যের মাধ্যমে মহাকবি আল্লামা ইকবাল ভয়ংকর ও মারাত্মক সত্যের ইংগিত করেছেন। তিনি এখানে লাত ও মানাতরা বলতে শুধু মূর্তি ও প্রতিমাকে বোঝান নি বরং ইসলাম বিরোধী বাতিল মতবাদসমূহের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। প্রাচীন জাহিলিয়াত পুরো শক্তি নিয়ে প্রাণবন্ত থাকবে, আর মুমিন যারা সাইয়িদেনা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারী ও উত্তরাধিকারী, তারা সেকেলে গোঁড়ামি, হীনমন্যতা, বৈরাগ্য, পশ্চাদপসারণ, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ঘৃণ্য মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। আধুনিক জাহিলিয়াত নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রস্ত্ততি ও অভিনব আকর্ষণীয় স্লোগান নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হবে। আর মুমিনরা মৃত্যুর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়বে। তাদের জীবনের গতিশীলতা ও স্পন্দন যেন স্তিমিত হয়ে যাবে। চিন্তার ভারসাম্য হারিয়ে তারা মুক্তির সন্ধানে পলায়নপর মানসিকতায় ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে জীবন সংগ্রামের সংঘাতময় পথকে পরিহার করে সংসারত্যাগী বৈরাগ্যের আস্তানায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করবে। সংগ্রামের জীবন থেকে তাদের দূরে অবস্থানের কারণে বাতিলরূপী লাত ও মানাত ময়দানে নর্তন-কুর্দন ও লম্ফ-ঝম্ফ মেরে মুকাবিলার আহবান জানাতে থাকবে।
আধুনিক কালের সর্ববৃহৎ ফিতনা
শ্রোতামন্ডলী!
বর্তমান কালের সবচেয়ে বড় ফিতনা ও চ্যালেঞ্জ কি? এ যুগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ইসলামকে তার জীবনাদর্শের স্বাতন্ত্র্য, ইসলামী সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার বৈশিষ্ট্য, এর নিজস্ব তামাদ্দুন ও সমাজব্যবস্থা, ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা, এর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা পদ্ধতি, ভাষা ও সাহিত্য, বর্ণমালা ও শব্দকলা, তথা সমস্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। শত্রুদের উদ্দেশ্য হলো, কোন কোন ধর্মমত যেমন কতিপয় স্তবস্তূতি, পূজা অর্চনা, বিবাহ-শাদী, মৃতের সৎকার অনুষ্ঠান ইত্যাদি কার্যক্রমকে মূলধন করেই পরিচালিত হয়ে থাকে, ইসলামকে এ ধরনের নিছক অনুষ্ঠান সর্বস্ব একটি অপূর্ণাঙ্গ ধর্মে পরিণত করা।
আগামীকাল কী হবে জানিনা, তবে এখনো আশংকা পোষণ করি না যে, হিন্দুস্তানে আওয়াজ উত্থিত হবে যে, তোমরা ছালাত কায়েম করতে পারবে না, যাকাত দিতে পারবে না। বিশেষ ধরনের আক্বীদা পোষণ করতে পারবে না। তবে এখন হিন্দুস্তানের মুসলমানদের সামনে সে দুর্যোগপূর্ণ এমন সময় অবশ্যই উপস্থিত হয়েছে, যেখানে আকারে-ইঙ্গিতে অস্পষ্ট ভাষায় এমনকি সুস্পষ্টভাবেও দাবী উত্থাপিত হচ্ছে ও হবে যে, হিন্দুস্তানে বসবাস করতে হলে ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনধারার সাথে তোমাদের একাকার হয়ে যেতে হবে; মুসলমানদেরকে স্বেচ্ছায় সেসব আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ড হতে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করতে হবে, যা এ ভূখন্ডে আলাদা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অধিকারী একটি স্বতন্ত্র জাতি বলে চেতনা সৃষ্টি করে। তারা নিজেরাই যেন তাদের পারিবারিক আইন (পার্সোনাল) ও উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরাতন আইন পদ্ধতির বিলোপ সাধন ও পরিবর্তন দাবী করে সারা হিন্দুন্তানে একই ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও উত্তরাধিকারী আইন প্রবর্তন কার্যকরণের দাবী উত্থাপন করে। (সম্প্রতি ভারতে সুস্পষ্ট পারিবারিক আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে-অনুবাদক)।
মুসলমানরা নিজেদের শিক্ষা দর্শন, জীবনধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য নিজেদের খুন ঝরা সম্পদ ব্যয় করে খুন রাঙা পথের সিঁড়ি বেয়ে যুগ যুগ ধরে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তা যেন স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়, যাতে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চাহিদা মুতাবিক মুসলিম সন্তানদেরকে গড়ে তুলতে পারে।
এমনিতো ধর্মনিরপেক্ষতার গালভরা বুলি আওড়িয়ে বলা হবে, সরকার ইসলামের বিরোধী নয়, ইসলামকে খতম করার কোন ইচ্ছাও সরকারের নেই। সরকার তো এজন্য গর্বিত যে, বিশ্বের সবচাইতে বড় মুসলিম সম্প্রদায়টির বাস ভারতে। তাদের আবাদ থাকা ও উন্নতি-অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়াটা বাঞ্ছনীয়। এদের দ্বারা বড় কাজ নেয়া যেতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা দলীলরূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। আজ সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হচ্ছে যে, যদি মুসলমানরা ভারত ভূমিতে বসবাস করতে চায় তবে তারা যেন এদেশের জাতীয় জীবনধারার সাথে নিজেদেরকে একাকার করে তোলে, তারা যেন নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। আজকের দাবী হচ্ছে মুসলমান পরিচয় নিয়ে বসবাস করার ব্যাপারে আমদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করে রাখার মানসিকতাকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা তো সাময়িক হিস্টিরিয়া রোগীর মতো মাঝে মাঝে কিছু লোকের মন মগজে চেপে বসে, এ দাঙ্গা-হাঙ্গামার মানসিকতা অল্প সময়ের মধ্যে বিলু্প্ত হয়ে যাবে, পূর্বের তুলনায় এখন তা অনেক কমে গেছে (যদিও আহমেদাবাদ, মিরাট ও গুজরাটে এই সেদিনও ভারতের হিন্দু মহাসভার পান্ডারা সশস্ত্র পুলিশের সহযোগিতায় হাযার হাযার নারীপুরুষ, শিশু-কিশোরকে নির্বিবাদে, নির্বিচারে, নিষ্ঠুর ও পাশবিকভাবে হত্যা করেছে।- অনুবাদক)।
আমি এ অনুষ্ঠানে আপনাদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি- আসল সমস্যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়, হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা, সংকট ও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, হিন্দুস্তানের মুসলমানদের সুপরিকল্পিত চিন্তা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মানসিক দিক থেকে মুরতাদ বানাবার ষড়যন্ত্র, চিন্তা ও মননশীলতায় মুরতাদ বানানোর চক্রান্ত, সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার ক্ষেত্রে মুরতাদে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এ সত্যকে উপলব্ধি করতে খুব চিন্তা-গবেষণা, বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন নেই। দেওয়ালের লেখা থেকেই যেকোন সাধারণ লোক এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা যাদের ঈমানের অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন যে, আজকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা শুরু হয়েছে, আগামীকাল দারুল উলুম দেওবন্দ ও দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার পালা আসছে। সময়ের দাবী হচ্ছে আজ আমরা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণের জন্য কতটা দায়িত্ব সচেতনতা ও বলিষ্ঠতার পরিচয় দিতে পারি। তার উপর দারুল উলুম দেওবন্দ ও দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা লাখনৌর ভবির্ষ্যত নির্ভর করছে (বর্তমানে বাবরী মসজিদের ব্যাপারে ও মুসলিম পার্সোনাল ল’ ও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্র ভারতীয় মুসলমানদের জাগ্রত চেতনা, দায়িত্ব সচেতনতা ও বলিষ্ঠ মানসিকতার উপর হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ভবির্ষ্যত নির্ভর করছে- অনুবাদক)।
বিদ‘আত ও শরী‘আত বিরোধীদের সাথে আপনাদের অতীতের বুযুর্গদের আচরণ ও দায়িত্ব সচেতনতা
স্নেহাস্পদ ছাত্রবৃন্দ!
আপনারা যে চিন্তাধারার আলিমকুলের সাথে জড়িত, আপনাদের এ কথা জানা আছে ভালভাবেই যে, আপনাদের অতীতের বুযুর্গরা বিদ‘আতের সাথে বিন্দুমাত্র সমঝোতা বা আপস করতে রাযী হননি। আপনাদের বুযুর্গরা মিলাদ-কিয়ামকে কোথাও সমর্থন করেননি। এমন অনেক কুসংস্কার ও প্রথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, যাকে ধর্মীয় কর্তব্য ও দ্বীনি ঐতিহ্য বলে আমল করা হচ্ছে, কিন্তু আপনারা যে চিন্তাধারা (school of thought) ও মাসলাকের অনুসারী সে আলিমগণ সর্বদাই এসব বিদ’আত, কুসংস্কার ও শরী‘আত বিরোধী প্রথা ও ক্রিয়াকান্ডের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছেন, এগুলোকে ভিত্তিহীন ও বিদ‘আত বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিদ‘আত ও শরী‘আত বিরোধী প্রথা ও কুসংস্কার-এর বিরোধিতার বিষয়ে মূল্য তাদেরকে দিতে হয়েছে। তাদের জীবন সংকটাপন্ন হয়েছে, তাদেরকে বিদ‘আতপন্থীরা সামাজিকভাবে বয়কট করেছে। তাদেরকে মসজিদ থেকে বলপূর্বক বের করে দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কুফর ও গোমরাহীর অপবাদ দেয়া হয়েছে। তাঁদেরকে সামাজিক জীবনের বহু সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁরা বিদ‘আতের প্রতি বিন্দুমাত্র নমনীয়তা প্রদর্শন করতে রাযী হননি ও কোন প্রকার আপসকামিতা বা দুর্বলতা প্রদর্শন করেন নি।
আপনারা এও জানেন আমি নিজেও ঐ শিবিরের সাথেই সংশ্লিষ্ট, যারা শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করেন, হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে বিদ‘আতের বিরোধিতা করেন। বরং রক্তের দিকে আমি সে খান্দানেরই অন্তর্ভুক্ত যারা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন জাগ্রত চেতনার অধিকারী ছিলেন। আমার বংশ ও মানসিকতার সম্পর্ক হযরত সাইয়িদ আহমদ শহীদ (রঃ)-এর সাথে রয়েছে, যারা সমগ্র উপমহাদেশে তাওহীদী আদর্শ ও সুন্নাতে রাসূলকে পুনর্জীবিত করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন এবং জীবনের বিনিময়ে ইসলামের পুনর্জাগরণের ও সুন্নাতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি আরও অগ্রসর হয়ে বলতে চাই, যে আপনাদের শিবিরেও সাইয়িদ আহমদ শহীদ (রঃ), ইসমাঈল শহীদ (রঃ)-এর আন্দোলনের প্রভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। এজন্য আমি ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করে থাকি এবং তা চোখে, মুখে ও বক্ষে ধারণ করে রাখাকে মর্যাদা ও গৌরবের বলে মনে করি। আমি নিজেকে এ ঐতিহ্যের অধিকারীর দাবীদার বলে প্রকাশ করতে কোন প্রকার লজ্জা ও হীনমন্যতাবোধ করি না, আর এ থেকে হাত গুটিয়েও নিতে চাই না। আমার সমস্ত চিন্তা, গবেষণা, গ্রন্থ ও প্রকাশনা, আমার ক্ষুদ্রতম শ্রম ও চেষ্টা এ ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও প্রতিরক্ষার জন্য নিবেদিত রয়েছে। এরই প্রচার, প্রসার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।
ميں كه مري نوا ميں هے آتش رفته كا سراغ
ميري تمام سر گزشت كهوئے هوون كي جستجو
‘আমার বিলাপ ধ্বনিতে খুঁজে পাবে তুমি
অতীতের অগ্নিঝরা পথের দিশা,
আমার গোটা কাহিনীই হচ্ছে বিস্মিতদের অনুসন্ধান।’’
আমার এ অপরিপক্ব হাতে ইতিপূর্বে ‘দাওয়াত ও আযীমত’ গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছি (গ্রন্থটি অধ্যাপক আবূ সাঈদ ওমর আলী কর্তৃক অনূদিত হয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে-অনুবাদক)।
কয়েক হাযার পৃষ্ঠা সম্বলিত উল্লিখিত গ্রন্থের রচয়িতা হিসাবে আপনাদের মুহাসিবা বা পর্যালোচনা করার অধিকারও আমার রয়েছে।
আপনারা অতীতের এই বুযুর্গদের পদাংক অনুসারী হওয়ার দাবীদার, যারা দ্বীনের মধ্যে সামান্যতম বিকৃতি ও পরিবর্তনকে বরদাশ্ত করেন নি।
আজ বিদ‘আত ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থাই কেবল সমস্যা নয়, আজকের সমস্যা অগণিত, অন্তহীন। আজকে সমস্যা প্রকাশ্য শিরক, মূর্তিপূজা, কবর পূজা, বৈদান্তিক দর্শন, ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতা, হিন্দুদের মিশ্রিত সমাজদর্শন ও সংস্কৃতির অনুসরণ ও গ্রহণের সমস্যা। অপরদিকে ভারতের মুসলমানদের কাছে কম্যুনিজম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা ধর্মহীনতাকে গ্রহণ ও বর্জনের মৌলিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আজকে প্রশ্ন হচ্ছে, এমন এক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ ও বর্জন করার, যে জাতীয়তাবাদ শুধু সে ভূ-খন্ডের সাথে সংমিশ্রণের মাঝেই সীমিত, যে ভূ-খন্ডে আমাদের জৈবিক জন্ম। আজকে ভূখন্ডভিত্তিক এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে আমরা বেঁচে থাকবো না মৃত্যুবরণ করবো, এ জটিল সমস্যার আবির্ভাব ঘটেছে। আজকের সংকট ও সমস্যা অতীতের সকল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের চেয়েও ভয়ংকর। আর এ সমস্যা ও সংকট উত্তরণের জন্য ভারতে অবস্থানকারী মুসলিম উম্মাহ্কে সর্বাধিক মজবুত ঈমান, দৃঢ়তা, সাহসিকতা, স্থিরতা, ত্যাগ ও কুরবানী প্রদর্শনের তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান বিপ্লবের বিদ্যুৎগতি
অতীতের সমাজ বিপ্লব ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে আগমন করতো, যুগ যেমন ছিল বিপ্লবও তেমনি ছিল। আগেকার বিপ্লব ছিল হস্তিগতি, উষ্ট্রগতি, গরুর গাড়ির গতিসম্পন্ন; খুব বেশী হলে দ্রুতগামী অশ্বের গতিতে বিপ্লব সাধিত হতো। রেলগাড়ি আবিষ্কারের পর বিপ্লব রেলের গতিতে সম্পন্ন হতে লাগল। বিমান যান আবিষ্কারের পর বিপ্লব বিমানের গতি লাভ করল। বর্তমান প্রযুক্তি বিজ্ঞানে উৎকর্ষতার সাথে রেডিও, টেলিভিশন, আণবিক শক্তি, রকেট, কম্পিউটার আবিষ্কারের সাথে বিপ্লবের গতি ইথার, আণবিক শক্তি ও রকেটের গতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজকে যেকোন ঘটনা-দুর্ঘটনা ও বিপ্লবের সংবাদ ও প্রভাব এক মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে প্রভাব, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের পরিধি ও কর্মসীমা
আজ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার যুগ, সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগ। জাতীয় পরিষদের প্রয়োজনীয় আইন গ্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রের কর্মসীমা শুধু প্রতিরক্ষা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও কর আদায় করার মধ্যেই সীমিত নয়, রাষ্ট্র এখন শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনের সকল দিককেই নিয়ন্ত্রণ করে। রাতে সংসদের অধিবেশনে আইন পাস হয়ে পরে ঘরে-বাইরের কোন কিছুই আজ রাষ্ট্রের এখতিয়ারের বাইরে নেই। দিনেই গোটা দেশে তা কার্যকর করা হয়। বিচিত্র নয় আজকে আমরা এ শিক্ষাঙ্গনে বসে আলোচনায় রত রয়েছি, আর অপরদিকে পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছে, সেখানে হয়তো কোন আইন পাস হয়ে যাচ্ছে আর আগামীকাল তা গোটা দেশে কার্যকর হয়ে আমাদের জীবনে অকল্পনীয় ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আনবে। আপনারা অবগত আছেন যে, আগেকার দিনে মানুষের ব্যক্তিজীবনের গন্ডিতে হস্তক্ষেপ করতো না, ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি সম্পদের ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন ছিল; পার্সোনাল ‘ল’, বিবাহ-শাদী, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উত্তরাধিকার আইন সকলে নিজস্ব ধর্মমত ও বিশ্বাস অনুসারে প্রতিপালন করতো। রাষ্ট্র এ সকল ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতো না, শিক্ষাক্ষেত্রে সবাই নিজ বিশ্বাস ও সভ্যতা সংস্কৃতির বুনিয়াদে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতো। রাষ্ট্র কোন বিশেষ আকীদা-বিশ্বাস বা চিন্তাধারা গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতো না, আজ পৃথিবী বদলে গেছে। আপনাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে যে, আপনাদেরকে কোন স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে? আপনারা তো এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে সীমিত পরিবেশে অত্যন্ত খুশী ও আনন্দের সাথে অবস্থান করছেন। চতুর্দিকে জ্যোতির্ময় চেহারা নজরে পড়ছে। আল-কুরআন ও হাদীছের বাণীর গুঞ্জরণ ছাড়া আপনাদের কর্ণকুহরে অপর কোন ধ্বনি প্রবেশ করছে না। দারুত তাফসীর ও দারুল হাদীছে ও মসজিদের পবিত্রতম রূহানী পরিবেশ আপনাদের আত্মাকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করে তুলেছে। দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্রের এক মন-মাতানো, মোহনীয় সুন্দরতম পরিবেশে আপনারা দিনযাপন করছেন। কিন্তু কাল আপনারা যখন এ পরিবেশ হতে বাইরে যাবেন, শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর আপনারা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, বিভিন্ন ছুটির সময় আপনারা যখন নিজ নিজ এলাকায় নিজ নিজ শহরে ও গ্রামে যাবেন, তখন সম্পূর্ণ ভিন্নতর পরিবেশ পরিস্থিতি আপনাদের নযরে পড়বে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না আগামী ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে দেশের অভ্যন্তরে কি ধরনের পরিবর্তন সূচিত হবে?
আপনারা যদি আপনাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ হতে দূরে অবস্থান করেন, পরিবেশ ও পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন না করেন, তবে নিজের ঘরেই পরবাসী হয়ে থাকতে হবে। আপনাদের অবস্থা হবে ‘আপনি ঘরমে বেগানা?’
অভ্যন্তরীণ সংকট
অমুসলিম শাসকগণ যদি মুসলমানদের ব্যাপারে অস্পষ্ট ও ইংগিতে কোন কথা বলতে চান, তখন মুসলিম নামধারী ঘরের শত্রু বিভীষণরা উচ্চৈস্বরে প্রকাশ্যভাবে বলতে শুরু করেন, মুসলমানদের ভারতে বসবাস করতে হলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির (হিন্দু আচরণ ও সংস্কৃতির) মধ্যে তাদেরকে বিলীন হয়ে যেতে হবে। এমনকি তারা আরো অগ্রসর হয়ে নগ্নভাবে দালালি করে বলা শুরু করেছে যে, মুসলমানদেরকে আলাদা স্বাতন্ত্র্য ও সংহতির কথা ভুলে গিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে মিশে যেতে হবে। এর মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। মুসলমানদের স্বতন্ত্র তাহযীব ও তামাদ্দুনের কথা বেমালুম ভুলে যেতে হবে। এমনকি চীন ও স্পেনের মুসলমানদের মতো ভারতীয় মুসলমানদের তাদের আরবী ও ইসলামী নাম রাখার প্রচলনকেও বিলীন করে দিয়ে ভারতীয় ভাষায় নিজেদের নাম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেয় মুসলমানদেরকে ভারতে বসবাস করতে করতে হলে এমন সব আচরণ ও ব্যবহার পরিহার করতে হবে যাতে করে ‘আমি-তুমি, আমরা-তোমরা’-এর ব্যবধান বিদ্যমান থাকে। এখানে মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার মধ্যে পার্থক্যকারী কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। বর্তমান ভারতীয় নেতৃবৃন্দের ভাষা ও আচরণে এ দৃষ্টিভঙ্গিই পরিস্ফুট যে তারা ভারতীয় মুসলমানদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ ও পার্থক্য চিরতরে মুছে ফেলার পক্ষপাতী।
আমাদের জীবনধারা সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ও ইসলামের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্টমন্ডিত
আমাদের জীবন দর্শনে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা আগে থেকেই সুনির্ধারিত রয়েছে, একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘সর্বজাতিগ্রাসী’ এ ভূখন্ডে আমাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য, আদর্শ ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ ও মর্যাদা নিহিত। আমাদের সুনির্ধারিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুস্পষ্ট জীবনধারার আলাদা বৈশিষ্ট্যসহ টিকে থাকার রহস্যও এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে। আমরা ভারতের আর্য, অনার্য, দ্রাবিড় ও আদি ভারতীয়দের মিশ্রিত জাতিসত্তার মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারিনা।
ইসলাম তো তার সূচনালগ্ন থেকেই ঈমান ও কুফর, তাওহীদ, শিরক, হালাল-হারাম, হেদায়েত ও গোমরাহীর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারিত করে রেখেছে। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا ‘যে তাগুতী শক্তির অবাধ্যতা প্রকাশ করে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে; সে নিশ্চয়ই এমন মজবুত রজ্জু ধারণ করেছে যা কখনও টুটে যাবার মতো নয়’ (বাকারা ২৫৬) ।
সর্বধর্মীয় ঐক্য নয়, সত্যের ঐক্য
ইসলাম সর্ব ধর্মের মিশ্রণের ঐক্যে নয়, সত্যের সুমহান একত্বের আদর্শে বিশ্বাসী, অব্যক্ত সর্বধর্ম এক নয়। সত্য এক ও অভিন্ন। ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেয়, فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ ‘সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর গোমরাহী ছাড়া আর কি অবশিষ্ট থাকে? তারপরও (তোমরা সত্যকে পরিহার করে) তোমরা কোন পথে ধাবিত হচ্ছো?’ (ইউনুস ৩২)। ইসলামের নিজস্ব স্বতন্ত্র আকবীদা বিশ্বাস রয়েছে, এর নিজস্ব তামাদ্দুন ও সভ্যতা রয়েছে, এর স্বতন্ত্র আইন, সমাজ দর্শন ও সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। ইসলামের মূলগ্রন্থ (মূল উৎস) পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা দেয়া হয়েছে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ (আরাফাতের ময়দানে) আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলামকে) পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং একমাত্র ইসলামকে আমার মনোনীত দ্বীন হিসাবে নির্ধারিত করে দিলাম’ (মায়িদা ৩)।
সংস্কার ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির মর্যাদা ও কর্ম
আমার প্রিয়ভাজনেরা!
ব্যক্তির মহৎ আকাঙ্খা ও মহৎ চেতনা ইসলামের পুনর্জাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে ভরপুর। এটা জাতীয় ও সামাজিক ইতিহাস। কিন্তু এর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে শুধু ব্যক্তির মহৎ চেতনা ও আকাঙ্খা, দুর্বার সাহসিকতা, অতুলনীয় প্রজ্ঞা, অসাধারণ যোগ্যতা ও দূরদর্শিতাই এ কাজের সবচেয়ে ক্রিয়াশীল শক্তি। ইসলামের জীবন-মরণের প্রশ্ন যখনই দেখা দিয়েছে, যখন কোন বাতিল শক্তি ইসলামের সম্মুখে চ্যালেঞ্জ আকারে দেখা দিয়েছে, তখনই আল্লাহর ফযল ও করমে উল্লিখিত গুণাবলী সম্পন্ন কোন মর্দে কামিলের আবির্ভাব ঘটেছে। কোন দৃঢ়চেতা বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অসাধারণ ধী-শক্তি ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী আদর্শ চরিত্র সম্পন্ন দৃঢ় উদ্যম ও প্রত্যয়শীল মহান ব্যক্তিত্ব জন্মলাভ করেছেন এবং ইসলামের পুনর্জাগরণ ও সংস্কারের পতাকা উত্তোলিত করে নবোদ্ভূত বাতিল পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছেন। এজন্যে কোন কাউন্সিল বা পরামর্শ সভা বসেনি। উমর বিন আব্দুল আযীয (রঃ), হাসান বসরী (রঃ) থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুদাদ্দিছ দেহলভী (রঃ) ও তাঁর খানদানের অপরাপর মহান ব্যক্তিগণ, এমন কি বর্তমান সময় পর্যন্ত দ্বীনের দাঈদের ব্যাপারে একথা একইভাবে সত্য-
كار زلف تست مشك افشاني اما عاشقان
مصلحت را تهمتے بر أهوئے چين بسته اند
তোমারই কৃষ্ণকেশদাম বিতরণ করে সুরভি,
প্রেমিকরা অযথাই এজন্যে চীনের মৃগকে
কৃতিত্ব দিয়ে থাকে।
মুজাদ্দিদে আলফেছানী, সাইয়েদ আহমাদ সিরহিন্দী (রঃ), শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রঃ)-এর অবদান
মুজাদ্দিদে আলফেছানী (রঃ) প্রসংগে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল (রঃ) যথার্থই বলেছেন-
وه هند ميں سرمايه ملت كا نگهبان
الله نے بروقت كيا جس كو خبردار
‘তিনিই তো ছিলেন উপমহাদেশে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সম্পদের সত্যিকার রক্ষক।
আল্লাহ্ পাক যাকে সময়মতো করে দিয়েছিলেন সতর্ক।’
তাঁরই মহান খেদমতের বদৌলতে উপমহাদেশে মুসলিম মিল্লাতের সম্পর্ক মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আরবের প্রতিষ্ঠিত হিজাযী দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, উপমহাদেশের ইসলামী জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৈদান্তিক দর্শনের ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণের পরিবর্তে শরী‘আতে মুহাম্মাদী বক্ষে আমানত থাকার সুযোগ লাভ করে। তাঁরই গোপন হাতের ইংগিতে দ্বীনের বক্ষে কুঠারাঘাত বর্ষণকারী আকবরের সিংহাসনে মহীউদ্দীন আলমগীর আওরঙ্গজেবের মত ফিক্হ শাস্ত্রবিদ ইসলামী আদর্শের দৃঢ় প্রত্যয়শীল ইসলামী চেতনা সম্পন্ন মর্দে মুমিন দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফতওয়া আলমগীরীর অমর গ্রন্থ রচনা ইসলামী আইনবিদগণকে চিরন্তনতা দান করেন। তারপর এ উপমহাদেশে দ্বীনের সংস্কার ও পুনর্জাগরণের সবচেয়ে মূল্যবান ও উল্লখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রঃ)। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) এবং তাঁর খান্দানের খেদমতের ফলশ্রুতিই দেওবন্দ, সাহরানপুর, দিল্লী ও লাখনৌতে ইসলামের খুশবু ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের প্রস্ত্ততকৃত দস্তরখানের নেয়ামত গ্রহণ করেই সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধিত হয়েছে। আমরা সবাই তাঁদের প্রস্ত্ততকৃত ও পরিবেশিত দস্তরখানের নেয়ামত থেকেই ফায়দা হাসিল করেছি। দারুল উলূম দেওবন্দ ও দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা, মাযাহারুল উলুমসহ অন্যান্য মাদরাসাগুলো তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ঝর্ণাধারারই ফলশ্রুতি (আহলেহাদীছদের প্রতিষ্ঠিত বানারস, দারভাংগা, মৌকা প্রভৃতি স্থানের মাদরাসাসমূহও তাঁদের প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে আলো সংগ্রহ করেছে-অনুবাদক)।
ইতিহাসের কঠিন মুহূর্ত
আমি ইতিহাসের ছাত্র। ইতিহাস আমার খুব প্রিয় ও পসন্দনীয় বিষয়। উপমহাদেশের ইতিহাস আমি যতটুকু গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি, তার আলোকে বলতে পারি যে, হিন্দুস্থানের হাযার বছরের ইতিহাসে বর্তমানের চেয়ে কঠিন মুহূর্ত কখনো আসেনি, এজন্য বর্তমান যুগে অবস্থার পরিবর্তন সাধন, মন ও মগজকে আকৃষ্ট করার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ ও মুকাবিলা, ভাবপ্রবণতা ও আবেগ দর্শন, মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন, চিন্তাধারার বিবর্তনের জন্য এতসব উপাদান, উপায়-উপকরণ রয়েছে যা অতীতে কখনো পরিদৃষ্ট হয়নি। আগের কালের লোকদের কাছে কি উপায় উপকরণই বা ছিল? রাজনীতির এ শিন্নী ও চাটনী ছিল কি?
গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের শ্লোগান ছিল? প্রেস, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ছড়াছড়ি ছিল? আজকের একাডেমী, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহ ছিল? সভা-সমিতি, মিছিল-শোভাযাত্রা সম্বলিত এমন প্রচারণা পদ্ধতি ছিল?
এ যুগের আবুল ফযল ও ফৈযী
অতীতকালের সবচেয়ে বড় ফিতনা বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহীকে বলা হয়ে থাকে; কিন্তু সেকালে কি আজকের যুগের মত শাসকগোষ্ঠীর হাতে এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষায়তন ছিল, লাখ লাখ সংখ্যায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাদি ছিল? আধুনিক যুগে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক উপায়-উপকরণ, প্রচারযন্ত্র, রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল, যা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পূর্বের কথা পশ্চিমে পৌঁছিয়ে দেয়?
এটা সত্যি যে, আকবরের কাছে আবুল ফযল ও ফৈযীর মত মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক বর্তমান ছিল। আমি আবুল ফযল ও ফৈযীর যোগ্যতাকে শুধু স্বীকারই করি না, বরং তাদের বিস্ময়কর মেধা ও যোগ্যতা দর্শনে অভিভূত হয়ে পড়ি, কিন্তু আজ আবুল ফযল ও ফৈযীরা সংখ্যায় কত? সে যুগে তারা একাকী ছিল। বর্তমান যুগে আবুল ফযল ও ফৈযীদের প্রতিষ্ঠান কায়েম রয়েছে, সে যুগের আবুল ফযল ও ফৈযীদের মধ্যে মাঝে মাঝে ধর্মীয় চেতনা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠতো, যা ফৈযীর কলম হতে ‘সাওয়াতিউল ইলহাম’ নামক প্রসিদ্ধ নুকতাযুক্ত হরকতমুক্ত তাফসীর গ্রন্থের মত অতুলনীয় গ্রন্থাকারে রচিত হয়েছে। কিন্তু আজকের আবুল ফযল ও ফৈযীদের সে ইসলামী চেতনা ও অনুভূতিটুকুও অবশিষ্ট নেই। তাদের মধ্যে সে ইসলামী আবেগ ও সম্পর্ক নেই, যা তদানীন্তন যুগের প্রগতিবাদী ও আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
নাস্তিকতাবাদ ও সংশয়বাদের নতুন নতুন দ্বার
বন্ধুগণ! বর্তমান যুগের দর্শন শাস্ত্র ও ইলমে কালাম শক্তিহীন। আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মানুষকে নাস্তিক্যবাদের দিকে অনুপ্রাণিত ও আকৃষ্ট করে তোলার মত সে প্রভাব ও শক্তি অবশিষ্ট নেই। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানের আজ কোন আগ্রহও নেই। বর্তমান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের চিন্তার বিবর্তনের ফলে ধর্মীয় চেতনা, পরকালের প্রত্যয়, অদৃশ্য সার্বভৌম শক্তির প্রতি বিশ্বাসের প্রেরণা ও চেতনা যুক্তি প্রমাণসহ আজ বিজ্ঞান দর্শন দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে। আজকের বিজ্ঞান ও দর্শন নাস্তিক্যবাদ ও সন্দেহবাদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে একত্ববাদ ও প্রত্যয়বাদের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ ও প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞান ও দর্শন ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো আর ধর্ম বিশ্বাসী পন্ডিতদের অস্থিরতা উদ্বেগের কারণ নয়। কিন্তু তার পরিবর্তে রাজনৈতিক দর্শন, অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ইউরোপীয় জড়বাদী সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে আজ নাস্তিকতা ও সন্দেহবাদ সৃষ্টির কাজ নেয়া হচ্ছে। সমাজতত্তব ও ইংরেজী সাহিত্যের মাধ্যমে বর্তমানে নাস্তিকতাবাদ ও সংশয়বাদ ছড়ানো হচ্ছে।
আপনাদের কাছে এটা হয়তো চরম বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে যে, বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও উর্দূ সাহিত্য বিভাগও নাস্তিক্যবাদ ও সংশয়বাদের প্রচারণার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিয়াতের ফ্যাকাল্টিই ধর্মীয় চেতনা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল ফ্যাকাল্টি।
বাস্তবধর্মী পর্যালোচনা ও ব্যাপক প্রস্ত্ততি
আমাদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভংগী, উদার মন, বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা সহকারে অনুধাবন করতে হবে। আমাদেরকে ভালভাবে দেখতে হবে, জীবনের বিশাল কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্বে ইসলামী দাওয়া ও ইসলামী শরী‘আর হেফাযতে মহান দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য কতটা প্রন্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের নিজেদেরকে কতটা আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে। আধুনিক রণকৌশল কতটা রপ্ত করতে হবে ও কতটা দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
মহান কুদরতের ইচ্ছায়ই আপনারা এ যুগে জন্মলাভ করেছেন, তাকদীরে ইলাহী এ যুগের জন্য আপনাদেরকে নির্বাচিত করেছেন। আপনাদেরকে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে হবে আপনারা কোন যুগের জন্য সৃষ্ট? এটি এক কথায় চিন্তা, গৌরব, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ও মুবারকবাদের বিষয়। মুবারকবাদ এই জন্য যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগে আপনাদেরকে যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন এবং এতবড় মহান দায়িত্ব আপনাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। আপনারা এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন। যুগের এ সংকট ও সময়ের মারাত্মক অবস্থাকে অনুধাবন করে আল্লাহর দরবারে যোগ্যতা ও তাওফীক কামনা করে দু‘আ করুন, যেমনভাবে আপনাদের অতীতের বুযুর্গরা বিদ‘আতের, দ্বীনের বিকৃতিকরণ ও যুগের ফিতনার মুকাবিলা করেছেন, বিপর্যয় ও গোমরাহী থেকে জাতিকে রক্ষা করেছেন, আপনারা যেন তেমনিভাবে যুগের বিদ‘আত, বিকৃতি, ফিতনা ও গোমরাহীকে স্বার্থকভাবে প্রতিহত করতে পারেন।
ধর্মের পাশ্চাত্য ধারণা ও তার ফিতনা
আপনারা পাশ্চাত্যের এ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করুন, ধর্মের ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা যা ধর্মকে শক্তিহীন ও প্রভাবহীন রেখে বাস্তব জীবনে ধর্মের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করে রেখেছে, ধর্মদ্রোহী জড়বাদী ইউরোপীয় স্বীকৃত ধর্মদর্শন হচ্ছে এই যে, ধর্ম হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার যা সর্বপ্রকার স্বাধীন শিক্ষাব্যবস্থা, প্রগতিশীল ধ্যানধারণা ও সার্বজনীন সভ্যতা ও দর্শনের পরিপন্থী। ভেবে দেখুন, এরপর হিন্দুস্থানের মুসলমানদের অবস্থা কি দাঁড়াবে?
আলামা ইকবাল অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই তার চিত্রায়ণ করেছেন এভাবেঃ
ملا كو جب ملگئ هند هيں سجده كي اجازت
نادان يه سمجهتا هے كه إسلام هے آزاد
মোল্লা যখন ভারতে কেবল ছালাত আদায়ের অনুমতি পেল,
বেকুফ তাকেই মনে করল এই তো পেয়ে গেছি
পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা।
চিন্তা ও চরিত্র গঠন
এ সংঘাতমুখর পরিস্থিতির মুকাবিলার জন্য আপনাদেরকে অবশ্যই পূর্ণ মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে হবে, তা হবে জন্মগত, চরিত্রগত ও আধ্যাত্নিকভাবে।
একদিকে আধুনিক ফিতনা ও দর্শনসমূহের বিবর্তন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। কেননা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি ও তার সঠিক পরিচয় জানা, তার রণকৌশল ও পদক্ষেপ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা শত্রু মুকাবিলার উপযুক্ত পূর্ব শর্তস্বরূপ। অপরদিকে নিজস্ব আদর্শের প্রতি দৃঢ়-প্রত্যয়, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও বিজয় সম্পর্কে সুদৃঢ় বিশ্বাস, আত্ম-মর্যাদাবোধ, আত্ম-পরিচিতি, আদর্শের চেতনাবোধ এতটা তীব্র ও প্রখর হতে হবে যে, বাতিলপন্থীদের মনে আপনাদের আক্বীদা-বিশ্বাস বিবেক ক্রয়ের কল্পনাও যেন কোনদিন মনে স্থান না পায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা একমুঠো যবের বিনিময়ে বিক্রি ও নিজেদের জ্ঞান, যোগ্যতা ও কলা-কৌশল নিলামে চড়াবার চরিত্র সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা নিছক জড়বাদী বিকৃত দর্শনে বিশ্বাসী নয়।
আমাদের শিক্ষা দর্শনের বৈশিষ্ট্য কবির ভাষায় প্রতিফলিত হয়েছে এভাবে-
هر دو عالم قيمت خود گفته
نرخ بالا كن كه ارزاني هنوز
‘হে যুগ! তুমি যত চড়া দামই দিতে চাও না কেন
দু’জাহানের বিনিময়েও তুমি পাবে না আমাদেরকে খরিদ করতে।’
আধুনিককালে বিবেক বিক্রেতাদের ভীড়
এ যুগটা হচ্ছে বিবেক বিক্রি ও ঈমান বিক্রির যুগ। অনেক বড় বড় গন্ডিত, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক যাদের প্রতিভা ও পান্ডিত্যের তুলনায় আমরা হিসাবেরও যোগ্য নই; কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, বিবেক বলতে কোন কিছুর অস্তিত্বের সন্ধানও তাদের কাছে পাওয়া যায় না; তাঁদের মস্তিষ্কের স্থানে মস্তিষ্ক আছে আবার অন্তরের স্থানেও মস্তিষ্ক সংযোজিত হয়ে আছে বরং তাদের বক্ষদেশে স্পন্দিত হৃদয়ের পরিবর্তে একটা বলিষ্ঠ কলম রক্ষিত আছে, যা দিয়ে তারা স্বার্থের বিনিময়ে যা ইচ্ছে তাই লিখে দিতে পারেন। এ লেখার সময় তাঁদের অন্তরে আখেরাতের জবাবদিহিতার, বিবেকের দংশন বা অনুশোচনার কোন প্রশ্নই উঠে না। যুগের তালে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত যুগের দাবী মোতাবেক নিজেদেরকে চিনে নিতে তাদের কোন আপত্তি থাকে না। যুগের তালে তাল মিলিয়ে চলার এবং তার ভাষ্যকার সাজার সীমাহীন যোগ্যতা তাদের রয়েছে।
নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
আপনারা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে শিক্ষকতার যোগ্যতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন, আল্লাহ তা‘আলা এতে বরকত দান করুন, আপনারা নামী দামী ওয়ায়েয, খতীবরূপে বরকত লাভে ধন্য হোন। আপনারা খ্যাতিমান লেখক, গ্রন্থকার হয়ে খ্যাতি অর্জন করুন। এ সকল গুণ আমার মধ্যেও রয়েছে। অথচ বর্তমান যুগের প্রত্যাশা ও দাবী হচ্ছে অন্য কিছুর। আজকের যুগের প্রয়োজন এমনি সব মর্দে-মুমিন ও কর্মবীরের, যাঁরা এ যুগকে চেনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে এক নতুন প্রত্যয়, এক নতুন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তি দান করতে পারে। অন্যথায় ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় তথা গোটা দেশ চরম সংকটের সম্মুখীন হবে। আমাদের পদতলে মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি কুরআনুল কারীমের বর্ণিত আয়াতের ভাষায়, أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَأْتِي الْأَرْضَ نَنْقُصُهَا مِنْ أَطْرَافِهَا ‘তারা কি দেখতে পাচ্ছে না আমি যমীনকে তার প্রান্তসীমা হতে কিভাবে গুটিয়ে আনছি’ (রা‘দ ৪১)। অন্য আয়াতে এসেছে, ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ ‘আর যখন যমীন এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে আসলো এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিসহ হয়ে উঠল’ (সূরা তওবা ১১৮)।
আমরা আজ যে ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্গ গড়ে তুলেছি এবং তুলছি, এটি কোন প্রস্তর নির্মিত স্থান বা সমভূমি নয়, এ হচ্ছে বালুকা রাশির স্তূপ, যে বালুকা ঝড় ও বাতাসের ঝাপটা ক্রমেই উড়িয়ে নিচ্ছে, যা ক্রমশ আমাদের পায়ের নীচ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। যাকে আল কুরআনের ভাষায় كَثِيْبًا مَّهِيْلاً(ধ্বসে যাওয়ার মতো বালু কণা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তত্ত্বজ্ঞান ও আত্মজ্ঞান
প্রিয় বন্ধুগণ!
ইতিহাস আপনাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার আগে, ইতিহাসের নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্য আপনাদের চোখ খুলে দেওয়ার আগে নিজেদের চোখ উন্মোচিত করে দেখুন, চারপাশের অবস্থা অবলোকন করুন! দেখুন যুগের বিবর্তন আচমকা আমাদেরকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে ? মাওলানা কাসিম নানুতুবী (রঃ), মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুংগেরী (রঃ), মাওলানা শিবলী নু‘মানী (রঃ)-এর যুগ আর বর্তমান যুগের অবস্থার পার্থক্য অনুধাবন করুন। আপনারা দৃঢ় আস্থার সাথে নিজেদের মন-মানসিকতা গড়ে তুলুন। শিক্ষকমন্ডলী এ ব্যাপারে সহযোগিতা দান করুন। আপনারা যখন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রতম গন্ডী থেকে বেরিয়ে জীবনের বৃহত্তম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন তখন যেন কঠিন বাস্তবের সাথে তালমিলিয়ে চলতে পারেন, জীবন যুদ্ধে বাস্তবতার সাথে পাঞ্জা লড়ে চলতে পারেন। আপনাদের এ জামা‘আত ছিন্নবস্ত্র পরিহিত দুর্বল দেহের অভ্যন্তরে সুপ্ত সিংহরা লুকিয়ে আছে, আপনাদের মধ্যে এমন সব বিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী দ্বীনের দাঈ, নিঃস্বার্থ সংস্কারকরা লুকিয়ে আছে যাঁদের খবর আপনারা ও আপনাদের উস্তাদরাও রাখেন না, আপনাদের বন্ধু বান্ধবরাও জানেন না।
আমি সে সকল সুপ্ত প্রতিভার অধিকারীদেরকে এ দুর্বল শক্তিহীন কণ্ঠে আহবান জানাচ্ছি, তাদের হ্নদয় দুয়ারের কড়া নাড়ছি- হায় তাদের কর্ণকুহরে ও হ্নদয় কন্দরে আমার এ ক্ষীণ কণ্ঠ যদি সাড়া জাগাতো ! সুপ্ত আত্মাগুলো যদি জেগে উঠতো!! আপনারা যদি আপনাদের ঘুমন্ত যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন হতেন, আল্লামা ইকবাল ঈদের চাঁদকে সম্বোধন করে যা বলেছিলেন, আমি আপনাদেরকে সম্বোধন করে তাই বলছি :
بر خود نظر كشاز تهي دامني مرنج
در سينه تو ماه تمامـﮯ نهاده اند
নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ, রিক্ত মনে করোনা শিকার,
বক্ষে তোমার লুকিয়ে আছে পূর্ণিমারই পূর্ণ চাঁদ।