বাংলার আকাশে পরাধীনতার কালো মেঘ (নাস্তিক্যবাদ ও হেফাজতে ইসলাম প্রসঙ্গ)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম 2126 বার পঠিত
অবতরণিকা :
মায়ানমারের আরাকান প্রদেশের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। বর্তমানে বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিস্তীন, মরো (মিন্দানাও), কাশ্মীর প্রভৃতি সমস্যার মতই রোহিঙ্গা সমস্যাও মুসলিম বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান ট্রাজেডী। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস হাযার বছরের পুরনো। অষ্টম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে সেখানে তাদের বসতি গড়ে উঠেছে। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, সেনাবাহিনী প্রভৃতি অঙ্গন ছাড়াও আরাকান রাজসভায় তাদের ভূমিকা ছিল অনন্য। এমনকি মুসলিম অমাত্যবর্গের পৃষ্টপোষকতায় আরাকানে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়েছিল। নরমিখলার (১৪৩০-১৪৩৪) সময় থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের রাজ দরবার মুসলিম প্রভাবিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রী, কাযী এবং রাজ্যের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী পর্যন্ত ছিল মুসলিম। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুর, (থদোমিন্তার শাসনকাল ১৬৪৫-১৬৫২), প্রতিরক্ষামন্ত্রী মো: সোলাইমান (সান্দা থু ধম্মার শাসনকাল ১৬৫২-৮৪), প্রতিরক্ষামন্ত্রী আশরাফ খান (রাজা থিরি থু ধম্মার শাসনকাল ১৬২২-৩৮)। তাছাড়া তখন আরাকান রাজসভার (অমাত্যসভা) পৃষ্ঠপোষকতায় ও উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় মুসলিম কবিগণ সাহিত্য সাধনা করতেন এবং তাদের হাতেই বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। সুতরাং তারা ঐতিহাসিকভাবে সেখানকার স্থায়ী ও বৈধ নাগরিক।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের ইতিহাস প্রায় হাযার বছরের পুরনো। অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে সময়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পর্যায়ে আরাকানে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে এবং এটি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। কিন্তু বৃটিশ প্রশাসন ১৯৪৮ সালে বার্মাকে স্বাধীনতা দানের পূর্বে অত্যন্ত সুকৌশলে রোহিঙ্গা-মগদের মধ্যে বিভেদের সূত্রপাত ঘটায়, যাতে করে সেখানে কাশ্মীরের মত স্থায়ীভাবে রক্তপাত ঘটানো যায়। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা উত্তর বার্মা সরকার ঐতিহাসিক সত্যকে পদদলিত করে রোহিঙ্গাদেরকে ক্বল্লা বা বহিরাগত হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন আরম্ভ করে। তাদেরকে ক্রমশঃ প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদপূর্বক গোটা প্রশাসনকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মগদের হাতে তুলে দেয় এবং নিয়ন্ত্রিত করে ফেলে তাদের নাগরিক অধিকার। ১৯৪২, ৫৮, ৭৪, ৭৮ ও ৯১ সালে বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে বর্মীসেনা ও স্থানীয় মগরা যৌথভাবে তাদেরকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, জবরদস্তি শ্রম এক কথায় সমস্ত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক নির্যাতনের মাধ্যমে হাযার হাযার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এবং লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে স্বদেশ ছেড়ে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশে পলায়ন করে। ১৯৯১ এর পূর্বে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বি-পক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিলেও ১৯৯১-৯২ সালে আগত শরণার্থীদের অনেকেই নানা কারণে স্বদেশে ফেরত যেতে পারেনি। রোহিঙ্গা উৎখাতের অংশ হিসাবে ১৯৩৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ছোট ও বড় আকারে প্রায় ১০০টি সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মিলিটারি স্টাইলে অপারেশন পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক কালের মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা আরও একটি রোহিঙ্গা নিগ্রহের মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত।
আরাকানের পরিচিতি :
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র বার্মা বা মিয়ানমারের অর্ন্তগত বর্তমানে ‘রাখাইন স্টেট’ নামে পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী পাহাড় দ্বারা আবৃত একটি অনিন্দ্য সুন্দর রাজ্য আরাকান। আরাকানের জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ ইসলামের অনুসারী মুসলমান। তাদের মধ্যে থাম্ভইক্য, জেরবাদী, কামানচি, রোহিঙ্গা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও রোহিঙ্গীয় মুসলিম তাদের মধ্যে বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী। আরাকান উত্তর অক্ষাংশের ১৭.১৫০ ও ২১.৭০০ এর মধ্যে এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ৯২.১৫০ ও ৯৪.৫৫০ এর মধ্যে অবস্থিত। উত্তরে চীন ও ভারত, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব-পশ্চিমে বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তবর্তী নাফ নদীর মধ্যসীমা এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম। পূর্বে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ইয়োমা পর্বতমালা। এ সুদীর্ঘ, দুর্গম, সুউচ্চ ও বৃহৎ ইয়োমা পর্বতমালা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত মিয়ানমার থেকে আরাকানকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। নাফ নদী আরাকান ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত রেখা হিসেবে কাজ করে। বৃটিশ শাসিত আরাকানের আয়তন ছিল ২০,০০০ বর্গ মাইল। বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪,২০০ বর্গমাইল। উত্তর আরাকানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ, তন্মধ্যে ২০ লক্ষ মগ-বৌদ্ধ, ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান, ৪ লক্ষ সর্বপ্রাণবাদী (animists) এবং ২ লক্ষ হিন্দু ও খৃষ্টান।
রোহিঙ্গাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
কাশ্মীর, ফিলিস্তীন, মরো, পূর্ব তিমুর প্রভৃতির মতই রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের স্থায়ী অধিবাসী। রোহিঙ্গাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনায় বহুমুখী বির্তক ও মতপার্থক্য রয়েছে। আরাকান খৃষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ অব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাযার বছর যাবত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সে স্বাধীন আরাকানের ম্রাউক উ বংশের রাজা নরমিখলা প্রতিষ্ঠিত রাজধানী ম্রোহাং-এর বাংলা উচ্চারণ রোসাং। রোসাং-এর অধিবাসীদেরকে রোসাইংগা বা রোহিঙ্গা বলা হয়। আরবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে আরাকানে ইসলাম আগমন করে। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজা মহৎ ইঙ্গ চন্দ্রের (৭৮৮-৮১০খৃঃ) রাজত্বকালে আরবীয় মুসলিম বনিকগণ নৌবহর নিয়ে আরাকানে আকিয়াব বন্দরসহ দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ক্যান্টন বন্দর এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন। কথিত আছে যে, এ সময় কয়েকটি আরবীয় বাণিজ্য বহর রাহাম্বী দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হয় এবং জাহাজের আরোহীরা রহম (দয়া) রহম বলে চিৎকার করলে স্থানীয় জনগণ তাদের উদ্ধার করে। আরাকানের অধিবাসীরা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণ অবলোকন করে সেখানেই বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে রহম জাতির লোক বলে মনে করত এবং পরবর্তীতে রহম শব্দটি বিকৃত হয়েই রোহিঙ্গা হয়েছে বলে অনেক মনে করেন। রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি রাখাইন শব্দ থেকে যথা- রাখাইন>রোয়াং>রোহিঙ্গা। রোয়াং তিববতী শব্দ, যার অর্থ আরাকান। অদ্যাবধি চট্টগ্রাম যেলায় রোয়াং এবং রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা দ্বারা যথাক্রমে আরাকান ও আরাকানের অধিবাসীদেরকে বুঝায়। আরাকানে বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ শাহের সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মাদ সোলায়মান ‘শাহ’ উপাধী লাভ করে সিংহাসনে উপবিষ্ট হন এবং লংগিয়েত থেকে রাজধানী লেম্ব্রু (Lembru) নদীর তীরবর্তী ম্রোহাং (Mrohaung) নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং সেখানে রাজত্ব পরিচালনা করেন। এ মোহাং শব্দটি মুসলমানদের লেখায় রোসাংগ লিখিত হয়। চট্রগ্রামে জনগণের নিকট রোসাংগ শব্দটি রোয়াং বা রোহাং নামে পরিচিত। এ রোয়াং বা রোহাং শব্দটিই বিকৃত হয়ে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত লাভ করে (মো. মাহফুজুর রহমান, রোহিঙ্গা সমস্যা : বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গী (১৯৭৮-১৯৯৪); সেপ্টেম্বর ২০০০, ২৩-২৪ পৃঃ)।
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের রোহা যেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত তারা তুর্কী কিংবা আফগানী। কারণ ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকরা ইসলাম প্রচার ও প্রসারে আফগানিস্তানের রোহা অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে পাঠিয়েছিলেন। রোহা অঞ্চলের মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং। এ রোহা ও রোহাং শব্দ থেকে রোহিঙ্গা নামকরণ করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, রোয়াং তিববতী বর্মী শব্দ, যার অর্থ আরাকান। এ মতে, রোয়াং শব্দের অপভ্রংশ রোহিঙ্গা। মোট কথা, আরাকানের সর্বশেষ রাজধানী হচ্ছে ম্রোহাং, আর তার মুসলিম উচ্চারণ হ’ল রোহাং। এ রোহাংয়ের মুসলিম অধিবাসীদেরকে রোহিঙ্গা বলা হয়।
সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী থেকে আরবীয় বাণিজ্য বহরের মাধ্যমে আরাকানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছলেও মূলত ১৪৩০ সালের পর নরমিখলা ওরফে সোলাইমান শাহের শাসন আমল থেকেই রোহিঙ্গাদের বিকাশ শুরু। বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ শাহ নরমিখলাকে হৃতরাজ্য পুনরুদ্বারের জন্য প্রথমত ২০,০০০ দ্বিতীয়ত ৩০,০০০ সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। রাজ্য পুনরুদ্ধারোত্তর সৈন্যরা আর স্বদেশ ফেরত না গিয়ে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে আরাকানে বসতি স্থাপন করে। ফলে আরাকানে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নরমিখলার পরবর্তী শাসকগণ ব্যাপক ভূমিকা রেখে রাজ্যের সমস্ত শাখায় মুসলমানদের নিয়োগ প্রদান করেন। তাদের সহযোগিতায় ও মুসলিম অমাত্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার ফলশ্রুতিতে মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন দৌলত কাযী, আলাওল, হায়াত মাহমূদ, মাগন ঠাকুর, মর্দন, নসরুল্লাহ খান প্রমুখ রোসাঙ্গ রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। ৬৮০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ ইবনুল হানিফ ইসলাম প্রচারের জন্য প্রথম আরাকান উপকূলে আগমন করেন। ইবনুল হানিফ ও তার স্ত্রীর স্মৃতিস্তম্ভ মংডু উপত্যকায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবম শতাব্দী থেকে প্রচুর মুসলমান প্রথম বার্মিজ সম্রাট অসারাথার সময়কালে আরাকানে বসতি স্থাপন শুরু করেন। তিনি ১০৫৫ খৃষ্টাব্দে বার্মিজ সম্রাট আনারাথার রাজদরবারে মুসলমানদের অনেক উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ জুন ২০১২, বর্ষ ৩, সংখ্যা ১০৩)। রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যের আদি বাসিন্দা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরবে যখন থেকে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে, তখন থেকে আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ন্যায় এখানেও ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে (ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিন এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, রাজশাহী ১৯৯৬, পৃ: ৪০৩)। তাছাড়া আরাকানকে প্রাচীন সময়ে রাহমী রাজ্যভুক্ত এলাকা বলে ধারণা করা হয়। যাকে এখন রামু বলা হয়। তৎকালীন রাহমী রাজা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য এক কলস আদা উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিল। যা তিনি সাহাবীগণকে বণ্টন করে দেন (প্রাগুক্ত পৃঃ ৪০৩)। ধারণা করা হয়, তখন থেকেই এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল এবং স্থানীয় রাজাসহ সাধারণ অধিবাসীরা ইসলামকে সাদরে বরণ করেছিল। তাছাড়া বৃটিশ শাসনামলে ভারত, বাংলা ও বার্মার রাজ্যসীমা একই হবার কারণে অনেক মুসলমান ভাগ্যান্বেষণে আরাকানে পাড়ি জমিয়েছিল। যাদের মধ্যে কেউ স্বদেশ ফিরে এলেও কেউ কেউ সেখানে স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলে। তাছাড়া বাংলার গভর্নর সুলতান নাছিরুদ্দীন শাহের সহযোগিতায় বাদশাহ সুলায়মান শাহ কর্তৃক ১৪৩০ সালে আরাকানে প্রথম মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের উৎপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনী :
১৯৪২ সালের পূর্বে দু’একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া রোহিঙ্গারা ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সকল প্রকার স্বাধীনতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিল। স্থানীয় মগ সম্প্রদায়ের সাথে তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। যার ফলে বার্মার বর্তমান নাম মায়ানমারে থাকিন পার্টির (Thakin party) নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হ’লে পার্টির নেতৃবৃন্দ আরাকানের মগ নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা স্বাধীনতাতোত্তর আরাকানকে বর্মীভুক্ত রাখতে মুসলমান ও মগদের মাঝে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টির পরিকল্পনা করে। যেভাবে বৃটিশরা ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছিল। তারা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মগদের মাঝে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। ১৯৩৭ সালে বৃটিশ বার্মা আলাদা করার পর বৃটিশ প্রশাসন HOME RULE (local self Government of 1937) জারি করে বার্মায় অভ্যন্তরীণ স্থানীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে বর্মী নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেয়। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানী দিয়ে ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুইনসহ নিচু অংশে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে ৩০,০০০ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাছাড়া ১৯৪০ সালে মুসলমানদের উপর বৌদ্ধ ধর্ম ও তার প্রচারক গৌতম বুদ্ধের অবমাননার অভিযোগ এনে থাকিন পার্টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করে, যার পরিণতি হিসেবেই ১৯৪২ সালে আরাকানে মুসলিম নিধনযজ্ঞ সংগঠিত হয়।
অং সানের নেতৃত্বে ত্রিশ সদস্যের একটি দল জাপানে গোপনে পালিয়ে গেলে জাপান সরকার তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। জাপানের অর্থ, প্রশিক্ষণ ও নিজস্ব তত্ত্বাবধানে BURAMA INDEPENDENT ARMY (BIA) গঠিত হয়। এই BIA-এর কিছু সদস্য জাপানী সেনাবাহিনীর সাথে অগ্রবর্তী হয়ে আরাকানে এলে স্থানীয় মগরা BIA-এর সহযোগীতায় আরাকানের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনীর অস্ত্র-শস্ত্র হস্তগত করে আকিয়াব, রাহিডং, মাব্রা, মিনাবিয়া, পুনাজুয়ে, বাহার পাড়া, মহানুযী, পাকটুলিসহ গোটা আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। যা ‘৪২ ম্যাসাকার’ হিসাবে কুখ্যাত। আরাকানের পথে পথে ছিল হাযার হাযার মানুষের লাশ, নাফ নদী ছিল অসংখ্য নারী, আবাল বৃদ্ধ-বণিতাসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের লাশে পরিপূর্ণ। এ সময় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় এবং প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের ঘরবাড়ী উচ্ছেদ করা হয় (ইসলামী বিশ্বকোষ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা : সেপ্টেম্বর ১৯৯৬) ২২শ খন্ড পৃঃ ৭২৩)।
বার্মা কর্তৃপক্ষ ১৯৪৭ সালে নতুন শাসনতান্ত্রিক পরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রণীত ভোটের তালিকায় সন্দেহভাজন নাগরিক অজুহাতে আরাকানে মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলোকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়। ১৯৪৮ সালে আরাকান থেকে মুসলমানদের বিতাড়ন ও তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি সৃষ্টির জন্য আকিয়াবের মগ ডেপুটি কমিশনার ক্যাইউ (Kyawu)-এর নেতৃত্বে ৯৯ শতাংশ মগদের নিয়ে ইমিগ্রেশন অ্যাক্টের অধীনে তদন্তের নামে Burma Territorial Force (BTF) গঠিত হয়। BTF উত্তর আরাকানের বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান, ওলামা ও হাযার হাযার মানুষ হত্যা করে এবং মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের বাড়িঘর জালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার দেয়।
আরাকানে প্রথম মুহাম্মাদ জাফর হুসাইন কাওয়াল নামে আকিয়াবের জনৈক যুবক রোহিঙ্গা আন্দোলনের সূচনা করেন। রোহিঙ্গাদের বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে সশস্ত্র বিপ্লবে যোগদানের জন্য রোহিঙ্গা যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত হন আববাস নামে এক যুবক। তাদের আন্দোলন মূলত মুজাহিদ আন্দোলন নামে পরিচিত ছিল। মুজাহিদ আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তাদের আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য প্রথমে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় প্রধানমন্ত্রী ঔনু রেডিওর মাধ্যমে তাদেরকে স্বদেশী (Indigenous Ethnic Community) ঘোষণা করে। তাদেরকে সরকারী পদে ও চাকরীর প্রলোভন দেখায়। পার্লামেন্ট ও অন্যান্য সংস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃত হয় এবং ৫৭-এর নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার লাভ করে সাতটি আসনে বিজয়ী হয়। শাসক শ্রেণী একদিকে প্রতিশ্রুতি দেয় অপর দিকে তাদের উপর কঠোরভাবে সামরিক চাপ সৃষ্টি করে এবং Combined Emmigration And Army Operation, Union Military Police Operation প্রভৃতি নামে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালায়। জেনারেল নে উইন রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা যাতে করে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই জন্য ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশের ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহ রাষ্ট্রীয়করণ করে। জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় এসে রোহিঙ্গা নির্মূলের জন্য আরাকানী মগদের উস্কিয়ে দেয়। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের United Rohingya Organisation, The Rohingya Youth Organisation, Rangoon University, Rohingya Students Association, Rohingya Jamiatul Ulama সহ প্রভৃতি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ নিষিদ্ধ করেন (মো.মাহফুজুর রহমান, রোহিঙ্গা সমস্যাঃ বাংলাদেশের দৃষ্টিভংগী, পৃঃ ৮৫)। যা রোহিঙ্গারা তাদের বাঁচার তাগিদে ও অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি ১৯৬৫ সালে Burma Broadcasting Service (BBS) (নিয়মিত ভাবে রোহিঙ্গা ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠান) এবং ১৯৬৬ সালে সমস্ত বেসরকারী সংবাদ পত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬৪ সালে টাকার মুদ্রা মূল্য রহিত করা হয়, ফলে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মগরা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে জমাকৃত অর্থের মূল্যমান নতুন টাকা ফেরৎ পেলেও রোহিঙ্গারা তাদের ডিপজিটকৃত টাকা ফেরৎ পায়নি।
তাছাড়া সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ও রেশন বিতরণের সার্বিক দায়িত্ব মগদের হাতে থাকায় মুসলমানদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৬৭ সালে বার্মার রাজধানী রেংগুনে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকারীভাবে রোহিঙ্গাদের মজুদকৃত খাদ্য-শস্য জোর পূর্বক আদায় ও লুটপাটের মাধ্যমে তাদের গোলা শূন্য করে। এ দিকে ১৯৬৬ সালে সামরিক অফিসারগণ শিউ কাই (Shwe kyi) ও কাই গান (Kyi Gan) অপারেশনের নামে রাতের শেষ প্রহরে মুসলিম এলাকায় হানা দিয়ে ভয়ংকর মারণাস্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম নিধনযজ্ঞে মেতে উঠে এবং মহিলাদের ইজ্জত হরণ করে। ১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী মিন গন নামক জনৈক দুর্ধর্ষ সেনাপতির নেতৃত্বে সশস্ত্র অবস্থায় অধিবাসীদের জাতীয়তা যাচাইয়ের নামে National Registration Card (NRC) তল্লাশীর অজুহাতে বিভিন্নমুখী নির্যাতন চালায়। এই অভিযানের নামে ১৭ ফেব্রুয়ারী প্রায় ৪০০ জন রোহিঙ্গা মহিলাদের ধরে অমানবিক নির্যাতন এবং তাদের শ্লীলতাহানী করে। তাছাড়া ১ মার্চ ড্রাগন অপারেশনের নামে শতশত রোহিঙ্গা গ্রেফতার এবং অমানবিক নির্যাতন চালায়। এমনকি ১৬ মার্চ তাদের উন্মত্ত লালসা মেটানোর জন্য আরো ১০০ জন মহিলা ধরে নিয়ে যায়। এ অপারেশনে ১০ হাযারেরও বেশী রোহিঙ্গা হত্যা করা হয়, প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসে এবং পথিমধ্যে ৪০ হাজার নারী, শিশু ও বৃদ্ধা অকাতরে মৃত্যুবরণ করে (ঐ, পৃঃ ৯০)। মিয়ানমার সামরিক জান্তা ১৯৯২ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে আরাকানের মংডু শহরে ৫টি রোহিঙ্গা পল্লী জালিয়ে দেয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই আরাকানের বিভিন্ন শহর হতে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রেফতার করে নির্যাতন করে। ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তারা ১৯৯১ সালের ২০ ডিসেম্বর হতে ১৯৯২ সালের ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত ২২ দিনে আরাকান থেকে প্রায় ২১ হাযার রোহিঙ্গা যুবক এবং ৫ হাযার যুবতীকে অপহরন করে এবং তাদের উপর অমানবিক নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। কারো শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অসুস্থ রোহিঙ্গা যুবকরা যখন পালাতে যায় তখন নির্যাতনকারীরা তাদের পেছন দিক হতে পেটাতে থাকে এবং ক্রুর হাসি হেসে বলে, ‘কোথায় তোদের আল্লাহ? তাকে এসে তোদের রক্ষা করতে বল’ (ঐ, পৃঃ ১৫২)। ১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাসে ৫ দিনের ব্যবধানে ক্ষুধা, অনাহারে-অর্ধাহারে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এক হাযার রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটে। ২০০০ সালের জানুয়ারী মাসে রোহিঙ্গাদের ৪৫০টি বাড়ী ধ্বংস এবং বসতবাড়ী ও কৃষি খামারের ২০০ একর জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
২০১২ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার পর মায়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা জাতির উপর উৎপীড়নের ভুলে যাওয়া ইতিহাস আবারও জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা এমন একটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্টী, যারা নিজ দেশেও পরবাসী। বিশ্বের সবচেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, উদ্বাস্ত্ত ও বন্ধুহীন। বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্রহীন নাগরিক ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক নিষ্পেষণ ও নিপীড়নে বিশ্ব মানবতা আজ শোকার্ত। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী জনৈক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীকে নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিককালে আরাকানে বৌদ্ধ-রোহিঙ্গা দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। আকিয়াবের রামব্রির একজন রাখাইন শিক্ষিকা দুই ছাত্রকে পিটানোর কারণে ছাত্রদের ভাইয়েরা ঐ শিক্ষিকাকে মারধর করে। ফলে শিক্ষিকা মারা য়ায়। তার লাশ মুসলিম পল্লীর পাশে একটি ছড়ায় ফেলে রাখা হয়। তদন্তে এ ঘটনায় মুসলিমরা জড়িত নন বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু রাখাইনরা তা বিশ্বাস না করে প্রতিশোধ নিতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ জুন ২০১২)। ৩ জুন সানডুতে ১০ মুসলিম বাসযাত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করে বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা। অতঃপর তারা মুসলমানদের লাশের উপর থুতু ও মদ ঢেলে নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠে। এ সময় পাশেই থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও এই পৈশাচিক উল্লাসে শরীক হয়। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করার জন্য মুসলমানগণ ৮ জুন জুম‘আর ছালাতের পর একত্রিত হলে রাখাইন মগরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে ৯ জুন হতে বৌদ্ধ, রাখাইন, সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে মুসলিম উচ্ছেদ শুরু করে। দেশটির নাসাকা বাহিনী রাখাইনরা একযোগে মুসলমানদের হামলা চালায়। তারা মুসলিম যুবতীদের ধরে নিয়ে যায় পাহাড়ের গভীর অরণ্যে। নাসাকা বাহিনী নির্বিচারে গণগ্রেফতার করে মুসলিম যুবকদের। তারা মুসলিম চিকিৎসক, শিক্ষকসহ যাকে যেখানে যে অবস্থায় পেয়েছে তাকে সেখানেই জবাই করে, পিটিয়ে নৃশংস হত্যাকান্ডের তান্ডব নৃত্য চালায়। মুসলমানদের বাড়িঘর লুটপাট-ভাংচুর করে। অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয় সহায়-সম্পদ ও মসজিদগুলো। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে রোহিঙ্গা বসতি। তাদের সেই করুণ আর্ত-চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের হামলা, অগ্নিসংযোগ, হত্যার মুখে বাঙ্গালী জাতি যেভাবে পালিয়েছিল গ্রাম ছেড়ে, ছুটেছিল আশ্রয়ের সন্ধানে। রক্তাক্ত, অগ্নিদগ্ধ, ধর্ষিত হয়েছিল আমাদের স্বদেশ। রোহিঙ্গারা এখন ঠিক তেমনি কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। রোহিঙ্গারা আরাকানে শত শত বছর ধরে নির্যাতিত, নিস্পেষিত, শোষিত, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার। যে রোহিঙ্গারা একদিন আগেও সম্পদশালী ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সহায়-সম্পদ হারিয়ে উদ্বাস্ত্ত ও শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। হাযার হাযার বাড়িঘর পুড়িয়ে তাদের উদ্বাস্ত্ত করা হয়েছে। হাযার হাযার তরুণীকে তারা ঘর থেকে ধরে নিয়ে বলাৎকার করেছে। মুূসলমানদের হত্যা করে তাদের লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে সাগরে। এমনকি মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাদের মাথা ন্যাড়া করে রাখাইন ভিক্ষু সাজাতে লাল কাপড় মুড়িয়ে ছবি তোলে। এরপর উল্টো মুসলমানরা রাখাইন ভিক্ষুদের হত্যা করেছে মর্মে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রচার করে। মুসলমানদের রক্তস্রোতে ভেসেছে পুরো আরাকান রাজ্য। অসহায় শিশু-কিশোর, ধর্ষিতা, মযলুম মানুষের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। এমতাবস্থায় তারা অত্যাচারী জনপদ হতে মুক্তিলাভের জন্য বুভুক্ষু হৃদয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। আল্লাহর ভাষায়- وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا ‘তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না। অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা প্রার্থনা করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই অত্যাচারী জনপদ হ’তে মুক্ত কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে অভিভাবক প্রেরণ কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে সাহায্য কারী প্রেরণ কর (নিসা ৪/৭৫)।
মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রোহিঙ্গা নিধনের জন্য রাখাইনরা শত বৎসরব্যাপী বিভিন্ন অপারেশন ও দাঙ্গার মাধ্যমে তাদের সমূলে উৎপাটন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে তাদের জন্য নতুন পরিচয় পত্র তৈরি করা হয়েছে। সে পরিচয়পত্র নিয়ে তারা রাখাইন প্রদেশের মধ্যে বন্দি থাকবে, এর বাইরে যেতে পারবে না এবং তারা কেউ বিয়ে-শাদী করতে পারবেনা। বিবাহিত হলে দু’টির বেশি সন্তান নিতে পারবে না। তারা ঘর থেকে বের হলে তাদের পেছনে থাকবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা ও মগদের নজরদারী। অং সান সুচির নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক মিয়ানমার উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছে তার জন্য প্রয়োজনীয় আদমশুমারী করা হবে ২০১৪ সালে। আর এতে সহায়তা করবে জাতিসংঘ। আর এই আদমশুমারীতে যদি রোহিঙ্গা বলে কোন জাতির অস্তিত্ব না থাকে তাহ’লে তাদের মিয়ানমারে না থাকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় হয়ে যাবে বলে মনে করে মিয়ানমার সরকার। এই জন্য তারা সুনিপুণ কিছু কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তা হ’ল-
১. আরাকানে যে সকল রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের যত জনকে সম্ভব হত্যা করা হবে।
২. ব্যাপকতর হত্যা-ধর্ষণের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে চলে গেলে তাদের ফেরত নেওয়া হবে না।
৩. যারা পালিয়ে যাবে না তাদের ধরে মিয়ানমারের বন্দিশালায় বা সরকারী সুরক্ষিত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে যাদের স্ট্যাটাস হবে তারা অনুপ্রবেশকারী বাঙালী টেররিষ্ট (দৈনিক আমার দেশ, ২১জুন ২০১২,বর্ষ-৯,সংখ্যা-১৬৮)।
বার্মিজ বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা আরাকানী বৌদ্ধ রাখাইনদের সাথে মিলে আরাকানকে মুসলিমশূন্য করার নীলনকশা করছে। আদি ফিলিস্তিনীদের হটিয়ে যেমন সেখানে বাইরের ইহুদীদের এনে বসানো হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে আদি রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে সেখানে রাখাইনদের এনে বসানো হচ্ছে। কারণ মিয়ানমার চায় তাদের নেতৃত্বে সেখানে এক ধরনের বৌদ্ধরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের আশংকা মালয়েশিয়ার মত মিয়ানমারও একদিন বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্র থেকে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে।
অং সাং সুচির দৃষ্টিভঙ্গি :
‘রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’-সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে এই প্রবচনটি বেশ প্রযোজ্য। কারণ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যখন হাযার হাযার বাড়িঘর পুড়ে ভস্মীভূত হচ্ছে তখন শান্তিতে নোবেল প্রাপ্ত বার্মিজ নেত্রী অং সাং সুচি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ চষে বেড়াচ্ছেন নির্বিঘ্নে এবং নোবেল পুরস্কারটি গ্রহণ করতে নরওয়ে গেছেন। একদিকে অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলছে রোহিঙ্গা বসতিতে, অন্যদিকে শান্তির জন্য নোবেল নিতে ছুটেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা ইউরোপের নরওয়েতে। রাখাইন প্রদেশের হাযার হাযার বিপন্ন মানুষ ও জনপদ যখন আর্তনাদ করছে, তখন শান্তিতে নোবেলের জন্য তার ইউরোপ সফর সত্যিই এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। শান্তির প্রতিভু কথিত অং সাং সুচি তার এই গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপ সফরে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি উপস্থাপন করেননি এবং সম্প্রাদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কোন বক্তব্য তিনি প্রদান করেননি। অথচ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর পরই ইয়াঙ্গুনে মুসলিম নেতারা তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সুচি নেতাদের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। যখন রাখাইন রাজ্য রক্তের স্রোতে ভাসছে, যত্র-তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধর্ষিত মা-বোনের লাশ যখন কুকুরের খাদ্য হচ্ছে, যখন তাদেরকে নিজস্ব বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, কিংবা তারা শরণার্থী হয়ে উত্তাল সমুদ্রে ভাসছে, তখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সুচি একটি বারের জন্যও এর নিন্দা করলেন না। অথচ তিনিও আর দশজন নারীর মতই একজন নারী। একজন নারীর চোখের সামনে অন্য একজন নারী ইজ্জত লুট করা হচ্ছে, পালাক্রমে তাদেরকে রাখাইনরা ধর্ষণ করছে। কিন্তু আফসোস! এর প্রতিবাদ করার মত সামান্য সৎসাহস তার নেই। যখন তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত গৃহবন্দি ছিলেন তখন তার বাসভবন ঘেসে ছিল সামরিক জান্তার নিরাপত্তা চৌকি। নিরাপত্তা কর্মীদের তিনি বৌদ্ধ ধর্মের শান্তির কথা বলতেন, গণতন্ত্রের কথা বলতেন, মুক্তির কথা বলতেন। আজ তিনি মুক্ত আকাশের নিচে দেশ-মহাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন নির্বিঘ্নে, তাকে বলা হচ্ছে গণতন্ত্রের মানসকন্য, অথচ তিনি আজ নিশ্চুপ। মায়ানমারে গণতন্ত্রের উষালগ্নে এ কোন দৃশ্যের অবতারণা! হাস্যকর মনে হয় যখন গণতন্ত্রের মানসকন্যা নোবেল পদকটি গ্রহণকালে কি অদ্ভূত বৈপরিত্যের দৃষ্টান্ত রেখে বক্তব্য রাখছিলেন এভাবে- ‘তার মূল লক্ষ্য এমন একটি পৃথিবী যেখানে অবহেলিত গৃহহীন আর আশাহত মানুষ খুuঁজ পাওয়া যাবেনা। পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জায়গা হবে মানুষের স্বাধীন বাসভূমি, থাকবে শান্তি আর মানবাধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা’ (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ জুন ২০১২ বর্ষ ৩ সংখ্যা ১০৩)। অথচ ১৪ জুন জেনেভায় যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে, তখন কিন্তু তিনি রাখাইন বা মায়ানমার সরকারের উৎপীড়নের নিন্দাও করেনি। বরং আমাদের শোনালেন সেই চর্বিত চর্বণ, ‘বির্তকিত নাগরিত্ব আইন’। বিদেশী মিডিয়ায় তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে- We have to be very clear about what the laws of citizenship are and who are entitled to them (দৈনিক সমকাল, ২৪ জুন ২০১২)। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করলেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক নন। সরাসরি তিনি একথাটা বলেনি কিন্তু তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে এ কথাটিই ফুটে উঠেছে। এমনকি অং সাং সুচি ও তার দল এনএলডি ও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। অং সাং সুচি ও তার দল রোহিঙ্গাদের অভিহিত করেছে ‘বাংঙ্গালী টেরোরিষ্ট’ হিসেবে। অং সাং সুচিকে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করলেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন? হাস্যোজ্বল সুচি তখন উত্তরে বলেন, ‘রোহিঙ্গা! তারা আবার কারা?’ তিনি এখন তাদেরকে kala অর্থাৎ ‘বিদেশী’ বলেছেন। সুচির স্মরণ রাখা উচিত ছিল তার পিতা ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয় নেতা আর রোহিঙ্গারা সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয় নেতাকে পূর্ণভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার পিতা অং সানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন মুসলমানদের নেতা উ’ রাযাক।
পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি :
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত, চীন এবং পশ্চিমারা যথারীতি মুখে কুলুপ এটে মজা দেখছে। আজ আরাকান ইস্যুতে কেউ মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীকে কিছু বলছে না। মিয়ানমার সরকারকে মোটেই চাপ দিচ্ছে না। পশ্চিমারা তাদের প্রয়োজনে পশ্চিমা বধু অং সান সুচিকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আরাকানে মানুষ নিধনের মহাদুর্যোগে মানবতার দেবী কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাশে নেই। পশ্চিমা মানবতাবাদীরা তাকে টু প্রশ্নটি করছেনা। বরং তাকে উপর্যুপরি উপঢৌকন, ফুলেল সম্মাননায় ভরিয়ে তুলছেন। তারা তাকে বলছেন না যে, এভাবে নির্লজ্জের মত ফুলের মালা না নিয়ে প্রকৃত মানব দরদীর মতো নিজের দেশের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াও। ওদের রক্ষা কর। প্রয়োজনে তোমাকে আবারও নোবেল দেওয়া হবে। এটা মতলবাজ পশ্চিমাদের ভন্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে থাকে কোন রাষ্ট্রের অঢেল সম্পদরাজি লুটের দুর্দমনীয় বাসনা। আজ মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে হালকা হালকা। পশ্চিমাদের নজর মূলত মিয়ানমারের মাটির নিচের অফুরন্ত সমুদ্র সম্পদের দিকে। আর এই সম্পদরাজির লোভে পশ্চিমারা মায়ানমারের শাসকগোষ্টী ও সুচিকে চটাতে চায় না। আরাকান ও রাখাইন অঞ্চল প্রায় চৌদ্দ হাযার বর্গকিলোমিটারের ভূখন্ড, যেখানে রয়েছে প্রায় দুই হাযার কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর সমুদ্রতট এবং গ্রেট কোকোসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয় বর্তমানে বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মূলতঃ এই অঞ্চল ঘিরেই চীন-ভারত-মার্কিনের মধ্যে টানাপড়া চলছে বহু দিন থেকে। চীনের কাছে রাখাইন অঞ্চল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের তেল গ্যাস ও সমান্তরাল রেললাইনের কাজ চলছে, তার পূর্ব টার্মিনাল রাখাইন তটে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন মিয়ানমারকে মাথায় তুলে ধরার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের উপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রায় তিন দশকের পুরানো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে মিয়ানমার সরকারকে অর্থনৈতিক লগ্নির আশ্বাস দিচ্ছে। সেই শক্তিগুলো মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যায়িত না করে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ এখনও দেখা যায়নি। প্রায় বিশ লক্ষ থেকে ৯ লক্ষ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা আজ রাষ্ট্রহীন বা স্টেটলেস। এমন একটি অসহায় এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিমজ্জমান এই হতভাগ্য রোহিঙ্গা মুসলমানরা। অথচ এদের জন্য পশ্চিমারা কিছু করেনি। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ঠিকই মধ্যপ্রাচ্যে চলছে রেজিম চেঞ্জের মহড়া। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রহীন ইহুদীদের জন্য পশ্চিমারা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তীনিদের বুকের উপর অন্যায়ভাবে ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়েছে। তাদের সংখ্যা তখন ৫ লাখেরও কম ছিল। অথচ প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আজ নিজ স্থায়ী আবাসভূমিতে ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে ভাসমান। তাদের একমাত্র অপরাধ এটাই যে, তারা মুসলমান।
বাংলাদেশের অবস্থান :
বাস্তবতা যে কত নিষ্ঠুর তার এক মর্মন্তুদ প্রমাণ উপস্থাপন করল বাংলাদেশ। অসহায় আশ্রয়প্রার্থী মানুষকে আশ্রয় দেয়া মানবধর্ম। অন্যদিকে মুসলিম হিসাবে আক্রান্ত মুসলিমদের সাহায্য করাও ছিল ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশ তথাকথিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর যে পাশবিক আচরণ প্রদর্শন করল, তা সারাবিশ্বের বিবেকবান মানুষের অন্তরকে পুড়িয়ে দিয়েছে। উৎপীড়ন, নিগ্রহ থেকে বাঁচার তাগিদে যখন নিরন্ন, অসহায় শত শত রোহিঙ্গা উত্তাল সমুদ্র নাফ নদী পাড়ি দিয়ে তাদের প্রতিবেশী মুসলমান ভাইদের নিকট আশ্রয়ের জন্য আসছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ‘পররাষ্ট্রনীতি’র দোহাই দিয়ে বিজিবি তাদের ঐ অবস্থায় ফেরত যেতে বাধ্য করছে। সে দৃশ্য যে কত মর্মান্তিক ছিল তা পত্রিকায় পাতায় উঠে এসে আমাদের বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছে। উত্তাল সমুদ্রে নৌকায় দাঁড়িয়ে করজোড়ে বিজিবির কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করছে এক রোহিঙ্গা পরিবারকর্তা, পিছনে পরিবারের নারী ও শিশুরা নির্বিকার-অবসন্নভাবে তাকিয়ে রয়েছে। হাতটি এমনভাবে উঠানো তাতে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গারা একই সাথে আল্লাহ এবং তার বান্দাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন। সাহায্য চাচ্ছেন মযলুম হিসেবে। উত্তাল সমুদ্রে রোহিঙ্গাদের এই অসহায় সাহায্য প্রার্থনার দৃশ্য পুরো মানবজাতিকে করেছে শোকার্ত। রোহিঙ্গা নামের জাতিগোষ্ঠী যখন আরাকানে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করে বাঁচার সন্ধানে ছুটছে, মৃত্যুকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড দূর থেকে দেখে তারা পালিয়ে আসতে চেয়েছিল এদেশের মাটিতে দীর্ঘ সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে। আর সে সময় তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল, না হয় নৌকা সমুদ্রের গহীনে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। কি নিষ্ঠুর, নির্মম ও ভয়ঙ্কর মৃত্যু! তারপরও আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তথাকথিত পররাষ্ট্রনীতির শ্বেতপত্র দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছি। ঠেলে দিচ্ছি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। নিয়মের দোহাই দিয়ে তাদের হাইকোর্ট দেখিয়ে বলছি, ‘আমরা তোমাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য নই। কেননা ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে আমরা স্বাক্ষর করিনি। আমরা এমনিতে জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। আবার অতিরিক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে কেন আমাদের ঝামেলা সৃষ্টি করব।’ বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব এমন যেন আমরাই অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের মালিক। আল্লাহর পরিবর্তে আমরাই মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যোগাই। ফলে আজকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের চোখে উটকো ঝামেলা, মিয়ানমারের কাছে বহিরাগত বাঙালী। মিয়ানমারে তারা ঘৃণিত, বাংলাদেশে তারা পরিত্যক্ত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কুম্ভীরাশ্রু ফেলে বাংলাদেশ সরকার যে মানবাধিকার লঙ্গনের নতুন অধ্যায় সূচনা করল, তার পরিণাম আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। বিশ্বসভায়ও আমরা একটি নীচুমনা জাতি হিসাবে প্রতীয়মান হলাম। জানিনা এ দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মানবতার চেয়ে যদি জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বড় হয়, তবে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার সময় সে স্বার্থ কোথায় ছিল? সীমান্তে যে নির্বিচারে মানবহত্যা চলছে প্রতিনিয়ত, এর বিরুদ্ধে কেন আমাদের তথাকথিত পররাষ্ট্রনীতি এত নীরব?
ইতিহাসের দায়
মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করলেন যে, যদি তোমরা (আমার নে‘আমতের) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তাহ’লে তোমাদেরকে অবশ্যই বৃদ্ধি করে দিব, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠোর (ইবরাহীম ১৪/৭)।
ইতিহাসের দায় বলে একটি কথা মানবসমাজে খুব চালু আছে। সময়ের প্রয়োজনে প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইতিহাসের দায় মেটাতে হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গারা আজ আমাদের আশ্রয়প্রার্থী। অথচ ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় এই আরাকানী মুসলমানরা বাঙ্গালীদেরকে সাহায্য করে আসছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আলাওল আরাকান রাজসভার রাজকবি ছিলেন। এখানে বসেই তিনি মালিক মুহাম্মাদ জায়সীর পদুমাবৎ অবলম্বনে পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার গবেষকরা সবাই একমত যে, আরাকানেই বাংলা ভাষার নবউৎক©র্ষর সূচনা হয়েছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালে শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে যখন ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ শুরু হল, বড় পুত্র দারা সপরিবারে এই বাংলায় আশ্রয় নিতে এসেছিলেন কিন্তু বাংলায় তার আশ্রয় না হওয়ায় আরাকানে চলে যান। তৎকালীন মগরাজা দারার কন্যাকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্যে প্রস্তাব দিলে দারার সাথে মগ রাজার বিরোধ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে এই রোহিঙ্গা মুসলমানরাই এই মুসলমান রাজকন্যার সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও তারা সফল হননি। কিন্তু তাদের সাহস, সহমর্মিতা ও মুসলমান হিসেবে আত্মমর্যাদা ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে। শুধু তাই নয় সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে আমাদের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা আরাকানী মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। এই অঞ্চলের জনজীবনে আরাকানী ডাকাতদের অত্যাচারের মূর্তিমান আতঙ্ক এখনো শরীরে কাপন ধরায়। বাংলার নবাব শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ ঊমেদ খান সেই সময়ে আরাকানী রোহিঙ্গা মুসলমানদের কূটনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতায় আরাকানী জলদস্যুদের সম্পূর্ণভাবে দমন করেছিলেন।
মানবিক প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্তত ইতিহাসের দায় মেটাতেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়া আমাদের কতটুকু যথার্থ হয়েছে তা ভাবা দরকার ছিল। উদ্বাস্ত্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই? ১৯৭১ সালে যখন গণহত্যা শুরু হয় তখন প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে উদ্বাস্ত্ত হয়েছিল। ফিলিস্তীনীরা লেবাননে, আফগানরা ইরানে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশীরা যখন পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখন ঐ রাজ্যগুলো এমনিতেই নিজের সমস্যা নিয়ে পেরেশান ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন নকশালদের উৎপাতে ব্যতিব্যস্ত ছিল। অর্থনৈতিকভাবেও পেছনে ছিল। তখন যদি পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের কপাট বন্ধ করে রাখত তাহলে আমাদের মরণ ছাড়া কি অন্য কোন পথ ছিল? বিধর্মী রাষ্ট্র হয়েও পশ্চিমবঙ্গ সেদিন আমাদের কেবল আশ্রয়ই দেয়নি, বরং বাঁচার জন্য ডাল-ভাতও খেতে দিয়েছিল।
শেষকথা
পরিশেষে বলতে চাই যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যেই একটি আত্মার টান থাকে। কিন্তু আজকের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক মমত্ববোধের চরম অভাব। রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব আমাদের সব দুর্দশার মূল কারণ। অথচ মুসলমানগণ এককালে এমন ছিলনা। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে একজন মুসলমান নাগরিক বিপদগ্রস্ত হ’লে মুসলমান রাজা বাদশাহ তাকে উদ্ধার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, ঝাঁপিয়ে পড়তেন। স্পেনের মুসলমানরা যখন বিপদগ্রস্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী মরক্কোর বাদশাহ ইউসুফ বিন তাশফীনের সাহায্য চাইলেন, তখন তিনি মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য সে দেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। একইভাবে ষষ্ঠ শতাব্দীতে শ্রীলংকায় বসবাসরত একটি মুসলমান পরিবার সমুদ্রপথে যাত্রাকালে সিন্দুর দেবল বন্দরে সিন্দুরাজ দাহিরের সৈন্যদের দ্বারা লাঞ্চিত হন এবং কারারুদ্ধ হন। সেই কারাগারের অভ্যন্তর থেকে এক কিশোরী মেয়ে ইরাকের উমাইয়া শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে সাহায্য চেয়ে পত্র লেখেন। হাজ্জাজ সিন্ধু রাজার কাছে জবাব চান এবং জবাব সম্মানজনক না হওয়ায় তিনি কালবিলম্ব না করে সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানে পাঠান। পরবর্তী ইতিহাস তো সবার জানা।
ইতিহাসের আলোকে দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমরা কি সেই মুসলমান জাতি? আমাদের কাছে যারা সাহায্য চাচ্ছে তারা কি মুসলমান নয়? নির্যাতিত আরাকানী মুসলমানদের এই বিপদ মুহূর্তে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্বই সর্বাধিক। এমতাবস্থায় আমরা যদি তাদের সাহায্য করি তাহলে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। বিশ্বসভায়ও আমাদের মর্যাদা বাড়বে বৈ কমবে না। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা পূর্বতিমুরের মত স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার অধিকারী। আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশন অনুযায়ী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যদি আন্তরিকতার সাথে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে ও নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেয় তাহলে নিশ্চয়ই জাতিসংঘের পক্ষে বিষয়টি উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ১৯৬০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানী গর্ভণর যাকির হোসায়েন, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মজিবুর রহমান এবং ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের দৃঢ় ভূমিকায় ভীত হয়ে অত্যাচারী বর্মী রাজারা রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত্তদেরকে ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের বাড়ীঘরে সম্মানজনক পুনর্বাসনে বাধ্য হয়েছিল। আজ আমাদের সরকারও তেমনি শক্ত ভূমিকা নিলে মিয়ানমার সরকার প্রমাদ গুণতে বাধ্য হবে।
তাই আমরা বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হিসাবে অবিলম্বে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে শক্ত হাতে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছি। এর মাধ্যমে যে ক্ষমাহীন অপরাধ আমরা করেছি, তার কিছুটা হলেও হয়ত লাঘব হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আর এই নিবন্ধটি যে সকল যুবক ভাই ও বোনেরা পাঠ করলেন তাদের প্রতিও আমাদের আহবান, আসুন! এই মর্মান্তিক ও দুঃসহ ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। নিশ্চয়ই আমাদের আগামীর যুবসমাজ বর্তমানের এই কাপুরুষ নেতৃবৃন্দের মত নতজানু হয়ে থাকবে না। মানবতা দিয়ে, ন্যায়-সুশাসন দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের অধীনে এক ঐক্যবদ্ধ মানবজাতি আমরা গড়ে তুলব- এই হোক আগামী প্রজন্মের বজ্রকঠিন শপথ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
লেখক : সহ-পরিচালক, সোনামণি, রাজশাহী মহানগরী
২য় বর্ষ ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।