গ্রীক তরুণী ও আমেরিকান প্রফেসরের আলোকিত জীবনে ফেরা

রেযওয়ানুল ইসলাম 885 বার পঠিত

[ইউরোপ ও আমেরিকায় এখন ইসলাম গ্রহণের হার অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী। এমনই একজন নবমুসলিম গ্রীক তরুণী জান্না এবং আমেরিকান প্রফেসর জেমস ফ্রাঙ্কেল। ভিন্ন ভিন্ন ভূখন্ডের এই দুই বাসিন্দা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁদের নিজ জবানীতে ইসলামের পথে আসার হৃদয়গ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন। ইংরেজী থেকে নিবন্ধ দু’টি অনুবাদ করেছেন রিযওয়ান হোসেন-নির্বাহী সম্পাদক]

গ্রীক তরুণী জান্না

আমি জান্না। জাতিতে গ্রীক হলেও আমি জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করি এবং সেখানেই একটি অত্যন্ত গোঁড়া ঐতিহ্যবাহী খ্রিষ্টান পরিবারে বেড়ে উঠি। আমার পরিবার নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে, আমরা যেন খ্রিষ্টান ধর্মের কঠোর রীতিনীতি অনুযায়ী বড় হই।

সবসময়ই পরিবারের সবাই আমরা একসাথে ছুটি কাটাতে যেতাম এবং কখনই এ সময়টাতে বিচ্ছিন্ন হতাম না। ফলশ্রুতিতে আমাদের পারিবারিক অবকাশ যাপন সর্বদাই অত্যন্ত আনন্দায়ক হত। প্রথমবার অবকাশযাপনে আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছিলাম এবং সেটা প্রায় ১৩ বছর পূর্বের ঘটনা। তখন আমি ছিলাম ১২-১৩ বছরের এক চঞ্চলা বালিকা। আমরা এক সপ্তাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করলাম এবং প্রায় সমগ্র দেশটিই ভ্রমণ করে বেড়ালাম। এক শুক্রবারের ঘটনা, আমরা তখন মার্কেটে যাচ্ছিলাম হঠাৎ আযানের ধ্বনি (প্রার্থনার জন্য আহবান) ভেসে আসল এবং সকল কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন তাদের চলাচল বন্ধ করে দিল এবং জায়নামাজ নিয়ে প্রার্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। সুবহানাল্লাহ! আমি জানতাম না আযানে কি বলা হচ্ছিল। কিন্তু এটা আমার অন্তরে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটাল, যে পরিবর্তনটা মুছে গেল না বরং স্থায়ী হল। আমি জানার জন্য মুখিয়ে থাকলাম এই শব্দগুলোর অর্থ কী এবং এগুলো আসলে কী বলতে চাচ্ছে।

আমি এমন একজন মানুষ ছিলাম যে কখনই মৃত্যু নিয়ে কোন আলোচনা শুনতে একদমই আগ্রহী ছিল না। যখনই মৃত্যুর প্রসঙ্গ নিয়ে কোন কথা উঠত তখনই আমি সেখান থেকে ভেগে যেতাম আর ভুলেও কখনও কারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতাম না। কিন্তু যেদিন চোখের সামনে চাচাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দেখলাম সেদিন থেকেই আমার চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। অনুভব করলাম যে, জীবনটাকে আমি যেরকম ভাবি তা সেরকম নয়। আমরা অনেক বেশি সময় ও শক্তি অপচয় করছি এমন কিছু অর্জনের জন্য, যা মুহূর্তের মধ্যেই চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। চাচার মৃত্যুর পর আমাকে এমন একটা সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যখন রাতে তিন বার করে জেগে উঠতাম এটা পরীক্ষা করার জন্য যে, তখনও আমার মা-বাবা বেঁচে আছেন কি না।

ইসলাম নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা :

মৃত্যু সম্বন্ধে আমার একটা নিশ্চিত ভয় তৈরি হল। কারণ আপনারা জানেন এটাই হল সবকিছুর শেষ। এই ভয়টাই আমাকে ইসলাম নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করার পথ দেখাল। পূর্বে আমি অন্যান্য ধর্ম নিয়েও পড়াশোনা করেছি কিন্তু সেগুলোর মধ্যে এমন সত্য খুঁজে পাইনি যা আমাকে আশ্বস্ত করতে পারত। ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করার পর আমার সকল প্রশ্নেরই উত্তর পেলাম যা নিজের ধর্মে পাই নি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল যখন আমি নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পড়লাম। আমি শুধু এটা পড়তেই থাকলাম আর পড়তেই থাকলাম। আমার কাছে মনে হল, বিস্ময়কর চারিত্রিক গুণাবলী এবং অন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি এতই মহৎ যে তাঁর তুলনীয় আর কেউ হতেই পারে না। জীবনীটি পড়ার পর ইসলাম সম্পর্কে আগে যা জানতাম তা মন থেকে মুছে ফেলতে বাধ্য হলাম। কারণ পূর্বে যা জেনেছি তা প্রকৃতপক্ষেই ভুল ছিল।

ইসলামই যে একমাত্র সত্য এবং পৃথিবীর আর কোন ধর্মই যে সঠিক নয়, এই বিশ্বাস জন্মাতে একদমই সময় লাগল না। আমার অবচেতন মনের গহীন কোণ থেকে অকপটে বের হয়ে আসল, ‘হ্যাঁ, এটাই তো সঠিক ধর্ম।’ তবে ইসলাম নিয়ে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালেও প্রকাশ্যে তা গ্রহণ করতে আমি ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলাম। আমার অবস্থা এমন ছিল যে, আমি জানি এটাই সত্য, আমার মনপ্রাণ এই যুক্তি ও জীবনদর্শনকে পুরোপুরি গ্রহণ করে নিয়েছে; অথচ আমি ইসলাম গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ আমি জানতাম, আমার বাবা মা, পরিবার কখনোই এটা মেনে নেবে না। এমনকি তারা যদি এই বিষয়ে অল্প কিছুও জানতে পারতেন, তবুও আমার জীবনযাত্রার একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যেত।

ইসলাম গ্রহণ:

জার্মানিতে একদিন নোহা নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয় হল। সে মিসর থেকে এসেছিল। ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সে আমাকে অনেক সাহায্য করল এবং সাহস জোগাল। আমরা পরস্পরকে ভালভাবে জানলাম। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা করলাম। তার কাছে আমি আমার সব জিজ্ঞাসার সুন্দর ব্যাখ্যা পেয়ে নিশ্চিত হলাম যে, আমি প্রকৃত সত্যটাই জেনেছি এবং আমার নিজের ধর্ম সঠিক নয়। নোহার সাথে সাক্ষাতের এক-দেড় মাস পর শিক্ষার্থীদের ডরমিটরিতে (হলের গণরুম) প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করব বলে মনস্থ করলাম। এটা শুধু আমি আর নোহাই জানতাম। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন কিছু মুসলিম শিক্ষার্থী জেনে ফেলল যে, কেউ একজন শান্তির ধর্ম ইসলামে পদার্পণ করছে। কাজেই তারাও সেখানে দল বেঁধে হাজির হল। আলহামদুলিল্লাহ। এভাবে আমি আমার ইসলাম গ্রহণের ২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে গেলাম।

আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি হাযারো মানুষের মধ্য থেকে আমাকে তাঁর মনোনীত একমাত্র দ্বীনে প্রবেশ করালেন। কখনই আমি সেই দিনটির কথা ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না সেই আনন্দঘন ক্ষণটির কথা, যখন আমি নিজেকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পন করলাম।

আমেরিকার তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপকের ইসলাম গ্রহণ

আমি জেমস ফ্র্যাঙ্কেল। আজ আপনাদের শোনাব আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী। তখন সময়টা ২০১০-এর সেপ্টেম্বর মাস। বর্তমানে আমি হাওয়াই এর হনুলুলুতে অবস্থান করছি। গত ২ বছর ধরে এখানে আছি। আমি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একজন অধ্যাপক। কিছু ভাই বহুদিন থেকে অনুরোধ করে আসছেন আমি যেন আমার ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিই। ইনশাআল্লাহ আজ আপনাদের সে গল্পই বলব যা হয়তো অনেকেরই উপকারে আসতে পারে। আল্লাহ সবাইকে হেদায়াত দান করুন।

প্রারম্ভিক বছরগুলো

হাওয়াইতে আসার আগে আমি নিউইয়র্ক সিটিতে বাস করতাম যেখানে ১৯৬৯ সালে আমার জন্ম হয়। আমি বড় হই ম্যানহাটনে। আমাদের পারিবারিক জীবনটা ভীষণ সুখের ছিল। বাবা-মা আমাকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিক্ষা দিয়ে বড় করেননি বটে, কিন্তু তারা আমাকে মৌলিক মূল্যবোধগুলো ঠিকই শিক্ষা দিয়েছিলেন। যদিও আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইহুদী তবুও আমি বড় হই ধর্মহীন এক পরিবেশে, যেখানে ধর্মের চর্চা হত না বললেই চলে। ধর্মের সাথে আমার একমাত্র পরিচয় ঘটে দাদির মাধ্যমে যিনি ছিলেন ধর্মপালনকারী একনিষ্ঠ ইহুদী। তার কাছে থেকে আমি বিভিন্ন বিষয় জানতে পারি। যেমন: বাইবেলের বিভিন্ন গল্প, নবীদের কাহিনী ইত্যাদি। একবার বাবা-মা আমাকে একটা হিব্রু স্কুলে ভর্তি করানোর উদ্যোগে নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি তার যোগ্য ছিলাম না। কারণ আমার বেশি বেশি প্রশ্ন করার অভ্যাস ছিল। সম্ভবত এই অভ্যাসই আমাকে আজ এ অবস্থানে পৌঁছিয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে, একজন অধ্যাপক হিসেবে আজও আমি আমার এ স্বভাব বজায় রেখেছি।

উল্লেখ করার মত আমার আরও একটি অভিজ্ঞতা আছে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমি কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়ি এবং কমিউনিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনে হল এই মূল্যবোধ, এই আদর্শ অভ্রান্ত উপকারী। ঠিক সেই সময় আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল একজন পাকিস্তানী। আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্ধু জুটেছিল আমার। পাকিস্তানী সেই বন্ধুটি একদিন আমাকে পবিত্র কুরআনের একটি কপি হাতে দিয়ে বলল, ‘আশা করি তুমি এটা পড়বে, কারণ আমি চাই না তুমি জাহান্নামবাসী হও।’ সেই সময় জাহান্নাম সম্পর্কে আমার ততটা সচেতনতা ছিল না। কাজেই কুরআনটি শেলফে সাজিয়ে রাখলাম এবং সেখানেই সেটি বহু বছর পড়ে থাকল। কয়েক বছর পর আমার মাথা থেকে কমিউনিজমের ভূত দূর হল, যখন জানলাম যে প্রকৃতপক্ষে কিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিজম চর্চা হচ্ছিল। আমি এই দর্শন ত্যাগ করলাম। এটা ঘটল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করার পর। যাইহোক, ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু ভাবুক প্রকৃতির ছিলাম এবং সব সময় জীবনের আসল অর্থ নিয়ে ভাবতাম। এমনকি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন থেকেই আমার মনে উদয় হত কিছু মৌলিক জিজ্ঞাসা। যেমন: কেন আমরা আজ এ পৃথিবীতে? আমাদের ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায় এবং কেনই বা এত কষ্ট পাচ্ছি? তারপর একদিন বড় হলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম এবং পড়াশোনায় নিজেকে নিবদ্ধ করলাম।

আচ্ছা, আমার দাদির কথা স্মরণ আছে কি যার কথা পূর্বে একবার বলেছিলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে আমি তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে। একদিন হঠাৎ চাচাত ভাইয়ের ফোন পেয়ে চমকে উঠলাম যখন জানতে পারলাম যে দাদি, চাচা-চাচী ওয়াশিংটনে বেড়াতে এসেছেন। সেদিন রাতে তাদের সাথে খেলাম। বেশিরভাগ সময় দাদির সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করে কাটল। তাকে জানালাম যে, আমি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফার নিতে যাচ্ছি। তিনি আমার পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর যখন আমরা গাড়ির দিকে হাঁটছিলাম, তখন দাদি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। বললাম, ‘দাদিমা ঠিক আছেন তো?; তিনি বললেন, ‘আমায় নিয়ে ভেবো না ভাই, নিজের চিন্তা কর।’ তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললাম, ‘আশা করছি, নিউইয়র্কে ফিরে শিগগিরই আপনার সাথে দেখা করতে পারব।’ তিনি শুধু বললেন, ‘ঈশ্বর ইচ্ছা করলে।’

দাদির মৃত্যু

পরদিন ভোরে আবার চাচাত ভাইয়ের ফোন পেলাম। সে বলল, ‘দাদি মারা গেছেন।’ ভাবলাম মজা করছে। ‘সত্যি? কি আবোল-তাবোল বকছ?’ সে বিস্তারিত জানাল যে, ঘুমের মধ্যে দাদির হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। বার বার তার শেষ বাক্যটা কানে বাজতে লাগল- ‘ঈশ্বর ইচ্ছা করলে।’ খুবই বিস্মিত হলাম কেন দাদির সাথে এমন অপ্রত্যাশিত শেষ সাক্ষাৎ হল যিনি ছিলেন ধর্মের সাথে আমার সংযোগের একমাত্র মাধ্যম। নিউইয়র্কে উপস্থিত হলাম দাদির     অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে, যা ছিল একটি গতানুগতিক ইহুদী     অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। সেখানে র‌্যাবাই (ইহুদী ধর্মযাজক) দাদির অতি উচ্চ প্রশংসা করে বললেন, ‘সারাহ ছিলেন এক দূর্লভ সম্পদ যাকে ঈশ্বর ফিরিয়ে নিয়েছেন।’ পরে সেই রাবাই যখন দাদার বাড়িতে এলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেউ মারা গেলে কেন বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। তিনি বললেন, ‘এগুলো নিয়ে ভাবার দরকার নেই কারণ এগুলো শুধুই প্রথা মাত্র।’ তাকে শুধালাম, ‘ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কি করে দাদি সম্পর্কে এত ভাল কথা বললেন? আপনি তো তাকে চিনতেনই না। আপনি বললেন যে ঈশ্বর তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন তাহলে তিনি এখন কোথায়? আরও ব্যাপার হচ্ছে, আমার গন্তব্য কোথায়? আর আপনারই বা কোথায়? এবং আরও অনেক প্রশ্ন। এখনও স্পষ্ট চোখে ভাসে, রাবাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার একটু তাড়া আছে।’ তার এই পলায়ন আমাকে যে কতটা রাগান্বিত করেছিল তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না।

সত্যের সন্ধানে

প্রতিজ্ঞা করলাম দাদির স্মৃতির সম্মানার্থে ঐ প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার চেষ্টা করব। তখন আমার বয়স ছিল ১৮ কি ১৯ বছর। বেশ কয়েকটি ইহুদী সংস্থার দারস্থ হলাম প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে। কিন্তু কেউই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। আমাকে বলা হল ‘ঈশ্বর হলেন একমাত্র ইহুদীদের ঈশ্বর, অন্য কারও নন।’ আমার মাথায় একটি যুক্তি খেলে গেল পৃথিবীতে তো মাত্র ২ কোটি লোক ইহুদী, কিন্তু আরও শত শত কোটি লোক আছে, তাদেরকেও তো ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন তাই না?

তারপর শুরু হল অধ্যায়ন। বাইবেল পড়া যখন শুরু করি তখন আমি শিক্ষানবীশ হিসেবে ইংল্যান্ডে ছিলাম। সেখানে কিন্তু ইভানজিক্যাল খ্রিষ্টানদের (যারা বিশ্বাস করে ‘যিশু ঈশ্বর’, শুধু এই বিশ্বাসেই মুক্তি মেলে) সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। বাইবেল পড়ে যীশু খ্রিষ্টের প্রতি আমার গভীর ভালবাসা ও সম্মান তৈরী হল। কিন্তু তারা চাচ্ছিল আরও একধাপ এগিয়ে আমি যেন যিশুকে ঈশ্বর, রক্ষাকর্তা হিসেবে গ্রহণ করি যা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বড়জোর তিনি আমার কাছে ছিলেন একজন মহান ব্যক্তিতব এবং আদর্শ শিক্ষক। আমি তাদের দাবী অগ্রাহ্য করলাম। বাইবেল ছাড়াও অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করলাম। যেমন-বৌদ্ধ ধর্মের মত প্রাচ্য দর্শন; বিভিন্ন পাশ্চাত্য দর্শন, যেমন- গ্রীক, রোমান এবং ঐতিহাসিক দর্শন ইত্যাদি। দুঃখের বিষয় কোনটাতেই আমার সেই নিগূঢ় প্রশ্নগুলোর সমাধান পেলাম না।

এক সময় নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের দেখা মিলত। সংশয়বাদীদের মত আমিও তাদের সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে ভালবাসতাম। একদিন টাইম স্কয়ারের এক কোণায় সাদা টুপি, জুববা পরিহিত লম্বা-কালো দাড়িওয়ালা কিছু মানুষকে দেখলাম। সম্ভবত তারা আফ্রিকান বা আফ্রিকান-আমেরিকান ছিল। তাদের দেখতে বাইবেলের নূহ বা ইব্রাহীম (আঃ)-এর মত লাগছিল। জানতে চাইলাম তারা কে এবং কোন ধর্ম প্রচার করছে। সরাসরি উত্তর না দিয়ে তারা বললেন যে, বোধহয় আমি শুনে খুশি হতে পারব না।

আমি বললাম, ‘কেন নয়?’ তারা বলল, ‘কারণ আপনি একটা শয়তান’, বললাম, ‘কি বললেন, আমি শয়তান?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ সব শেতাঙ্গরাই শয়তান।’ তখন তাদের পাল্টা আক্রমণ করে বসলাম, ‘যদি শয়তানই হই তবে কেন ঈশ্বর সম্বন্ধে আমার এত আগ্রহ?’ তাদের ব্যাখ্যা, ‘এমনকি শয়তানও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে’। তাদের চেপে ধরলাম কোথা থেকে তারা এ কথা জেনেছে অর্থাৎ আমাকে শয়তান বলার উৎসটা কি? তারা বাইবেলের ‘বুক অব ড্যানিয়েলে’র কথা বললেন। আমি বললাম, ‘না, না। বাইবেল নয়। আপনারা কোন বই পড়েন? আপনারা কি কুরআন পড়েন না?’ তারা আমাকে সূরা কাহাফের কিছু আয়াত পড়তে দিলেন।

কুরআন অধ্যয়ন

বাসায় এসেই শেলফ থেকে সেই কুরআনটি বের করলাম যেটি আমার পাকিস্তানী বন্ধু মনসুর দিয়েছিল। কুরআন পড়তে শুরু করলাম বিশেষ করে সেই আয়াতগুলো পড়লাম যেগুলো পড়তে তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলোতে কোন চিহ্নই পেলাম না যেখানে বলা আছে যে আমি বা সব শেতাঙ্গরাই শয়তান। কিন্তু যেহেতু পড়া শুরু করেছি তাই বইটি পড়তে থাকলাম যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন থেকে যখনই অবসর পেতাম তখনই শুধু কুরআন পড়তাম। বাস্তবিকই কুরআন আমাকে অভিভূত করল যা অন্য কোন গ্রন্থ করতে পারেনি। বাইবেলে কুরআনের মত প্রত্যক্ষ কোন নির্দেশনা নেই অপরপক্ষে কুরআনে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে অত্যন্ত সরাসরি এবং  আন্তরিকভাবে। কুরআন আমাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিল। কুরআন পড়ার সময় মাঝে মাঝে অনুভব করতাম আমার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কেন এমনটা হত তা বুঝতাম না। কখনও কখনও ঘাড়ের লোম খাঁড়া হয়ে যেত। কখন, কোথায় এমনটা ঘটত তা ব্যাখ্যা করতে পারব না কিন্তু এটা বুঝতে পারতাম মে, আমি ঈশ্বরের কালাম পাঠ করছি।

১৯৯০ সনের জানুয়ারী মাসের ঘটনা, একদিন স্কুলের বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একজন আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি ঈশ্বরে আদৌ বিশ্বাস কর?’ আসলে সে জানত যে স্কুলে আমি কমিউনিস্ট ছিলাম। তাই এ জিজ্ঞাসা। আমি স্পষ্ট ভাবে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি।’ সে বলল, ‘সত্যি? কোন ঈশ্বর?’ দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যক্ত করলাম। ‘ঈশ্বরতো মাত্র একজন।’ তারা জানতে চাইল, ‘তুমি এটা কিভাবে জানলে?’ আমি অকপটে স্বীকার করলাম, ‘মহাগ্রন্থ আল কুরআন পড়ে জেনেছি,’ তাদের মধ্যকার একজন যে কিনা মুসলিম ছিল সে বলল ‘যেহেতু তুমি কুরআন পড়েছে সুতরাং তুমি অবশ্যই বিশ্বাস কর যে এটা আল্লাহর বাণী এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বার্তাবাহক,’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তো তাই-ই মনে করি।’

সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, আমাকে ব্যাপারটা ভালভাবে বুঝতে দাও। তুমি বিশ্বাস কর যে ঈশ্বর মাত্র একজনই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর রাসূল?’ আমি বললাম, ‘তুমি যদি এভাবে ভাবতে চাও তবে তাই।’

সে আমাকে অবাক করে বলল, ‘তাহলে তুমি তো একজন মুসলিম,’ আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি বললে! আমি মুসলিম? মুসলিম তো তুমি, কারণ তুমি পাকিস্তানী, আমি তো কেবল এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করি।’ সে ব্যাখ্যা করল, ‘না তুমিও মুসলিম কারণ তুমি বিশ্বাস কর যে আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসুল। হ্যাঁ, তুমি অবশ্যই একজন মুসলিম।’ আমি প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম।

এক আত্মগোপনকারী মুসলিম

পরে বেশ কয়েকদিন ঘটনাটা নিয়ে ভাবলাম এবং মনসূরের সাথে যোগাযোগ করলাম যে আমাকে পবিত্র কুরআনটি দিয়েছিল। সে তখন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত এবং একটি মুসলিম ছাত্র সংস্থার সাথে জড়িত ছিল। তাকে কিছু বই পাঠাতে বললাম যাতে করে ইসলামের পরিচয় এবং একজন মুসলিমের জীবন-যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারি। সে কিছু বই পাঠাল। বিশেষ করে, ১টা বই (Islam in Focus) আমাকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং পাঁচটি খুঁটি সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা দিল। বইটি থেকে জানলাম, কিভাবে ওযু করতে হয়, কিভাবে ছালাত আদায় করতে হয় এবং কিভাবে কালেমা শাহাদাৎ পাঠ করতে হয়। আমি ইবাদাত করা শুরু করলাম। তখন বাবা-মার সাথে থাকতাম বলে ঘরের দরজা দিয়ে আমাকে ছালাত আদায় করতে হত। কাজেই আপনারা আমাকে আত্মগোপনকারী মুসলিম বলতেই পারেন। এমনকি প্রথমবার যখন ছিয়াম পালন করি তখন সম্পূর্ণ গোপনেই তা করতে হয়েছিল। খেয়াল রাখতাম কখন সূর্য উদিত হয় এবং কখন অস্ত যায়। আর সে অনুযায়ী সেহরী ও ইফতারী খেতাম। এভাবে নও মুসলিম হিসেবে ৬ বা ৮ মাস সম্পূর্ণ একাকী ইবাদাত করেছি যখন একমাত্র কুরআন ছিল আমার পথ নির্দেশ। এক সময় পরিবারকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানালাম। একদিন রাতে খেতে খেতে বললাম, ‘আমি কুরআন পড়েছি।’ বাবা-মা বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা সেটা জানি। আমরা তোমাকে সেটা সব জায়গায় বহন করতে দেখি।’ বললাম, ‘আমি সত্যি সত্যিই এতে বিশ্বাস করি এবং সে বিশ্বাসের দাবি অনুযায়ী আমি কুরআনের শিক্ষা অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মনে হয় আমি তাতে মুসলিম হয়ে গেছি।’

পরিবারের প্রতিক্রিয়া

মার প্রতিক্রিয়া ছিল খুব কঠোর। তিনি কাঁদলেন এবং বাবার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের ভুল ছিল কোথায়, কিভাবে এমনটা ঘটল?’ বাবার প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা শান্ত। সম্ভবত তিনি ভাবলেন। ‘ঠিক আছে, আমার ছেলে তো ১৩ বছর বয়সে কমিউনিস্ট হয়েছিল, ১৬ বছর বয়সে চুল ছোট করা বাউন্ডুলে। সে বিভিন্ন অবস্থা পাড়ি দিয়ে এসেছে। হয়তো এটাও তেমনই একটা।’ কিন্তু না, আমি জানি, আমার বর্তমান অবস্থাটা কখনই পরিবর্তন হবে না। আল্লাহর কাছে এটাই আমার একমাত্র কামনা। কারণ অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে অবশেষে আমি চূড়ান্ত সত্য, সঠিক পথ এবং এক কালজয়ী সুন্দর আদর্শের সন্ধান পেয়েছি। তাই কায়মনোবাক্যে সর্বদা প্রার্থনা করি আমি যেন আর কখনই সে অন্ধকারে ফিরে না যাই। আমীন!

রেযওয়ানুল ইসলাম

লেখক : ৩য় সেমিস্টার, ইংরেজী বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ক্যাম্পাস



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও