অধিকাংশ সমাচার (২য় কিস্তি)
লিলবর আল-বারাদী
এস.এম. রিয়াজুল ইসলাম 1487 বার পঠিত
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না পশ্চিমা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের, যার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন গনিতবিদ এবং এথেন্সে পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আরেক গ্রীক দার্শনিক প্লেটো। এই প্লেটোর ছাত্র ছিল আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের শিক্ষক এরিষ্টোটল। তাহলে? সক্রেটিসই বিশ্ব ইতিহাস পরিবর্তনে রেখে গেছেন অসাধারণ প্রভাব। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ভালো ছাত্র হিসাবে কখনই তুলে ধরতে পারেননি নিজেকে। এই সব অতি পরিচিত ব্যক্তি ছাড়াও আরো অনেক অসাধারণ মানুষ এসেছেন পৃথিবীতে যারা কিনা এই আধুনিক বিশ্ব গড়ার পিছনে রেখেছেন বিস্ময়কর সব অবদান, অথচ তাদেরও ছিল না কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। চলুন তাহলে দেরি না করে তাদের উপর একটু চোখ বুলিয়ে নিই।
মাইকেল ফ্যারাডে (১৭৯১-১৮৬৭)
বই বাঁধাইকারী থেকে বিজ্ঞান উৎপাদনের যন্ত্র
আপনি নিশ্চয় বিদ্যুৎ-চালিত বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, নিশ্চয় ম্যাগনেটিসম বা চৌম্বকত্বের উপরও কিছু জানেন, নিশ্চয় জৈব যৌগ বেনজিনের নাম শুনেছেন বা এর উপর শ্রেণীকক্ষে লেখাপড়া করেছেন। তাহলে আসুন আমরা জনাব ফ্যারাডেকে বিশেষভাবে সম্মান জানাই। কারণ, এই সব তাঁরই আবিষ্কার! মাইকেল ফ্যারাডে প্রকৃতপক্ষেই একজন প্রতিভা এবং বিশ্ব-ইতিহাসের প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের একজন। অথচ, এই অসাধারণ কর্মদক্ষতার মানুষটির প্রথাগত কোন শিক্ষাই ছিল না! শিল্পনগরী লন্ডনের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম এই ফ্যারাডের, আর তাই পয়সা দিয়ে বিদ্যালয়ের পাঠ নেওয়া হয়নি তার কখনই। পরিবর্তে ১৪ বছর বয়সে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ নেন স্থানীয় একটি বই বাঁধাইয়ের দোকানে। সেখানে তিনি বছর সাতেক কাজও করেন। এই কাজ করার সময় যে সমস্ত বই তিনি পেতেন সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিতে ভুলতেন না। কোন কোন বই তার কাছে এতো ভালো লেগে যেত যে সেগুলোতে রীতিমতো ডুবে যেতেন। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বইগুলো তার কাছে দিনে দিনে প্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো। এরই ধারাবাহিকতায় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে সে সময়ের লন্ডনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হামফ্রি ড্যাভির কাছে যান এবং হামফ্রি ড্যাভির ল্যাব সহকারী হিসাবে কাজ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সত্যি কথা, একজন ফ্যারাডের কোন ধরণের বিজ্ঞান চর্চার অভিজ্ঞতা ছিল না, অথচ তিনি সে সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানীর ল্যাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন। যাই হোক, তিনি পরের বছর কাজ পেয়েছিলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি করেন বৈদ্যুতিক মোটর, বৈদ্যূতিক জেনারেটর, বুনসেন বার্ণার, ইলেকট্রোলাইসিস, ইলেকট্রোপ্লাটিং। তিনিই আবিষ্কার করেন বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় আবেশ, বেনজিন। চৌম্বকক্ষেত্রের কাঠামো কেমন হবে সেটাও তিনি দেখান, ধাতব ন্যানো-কণাও (মনে করা হয় ন্যানো সায়েন্সের জন্ম তার মাধ্যমেই) তারই আবিষ্কার। এছাড়াও আরো জটিল জিনিষ তিনি আবিষ্কার করেছেন, বলা যায় তিনি ছিলেন বিজ্ঞান উৎপাদনের যন্ত্র!
সারা জীবনেও কারো কাছ থেকে ফ্যারাডে কিছু শিখেন নাই। একাধারে দিয়ে গেছেন আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতাকে। রেখে গেছেন অসংখ্য অবদান। যেমনটি আগেই বলেছি ড্যাভি ছিলে সে সময়ের বিশ্ব সেরা বিজ্ঞানী যিনি কিনা শুরুতে ফ্যারাডের চাকুরিই দিতে চাননি। সেই ড্যাভিকে জিজ্ঞাসা করে হয়েছিল বিজ্ঞানে আপনার সেরা আবিষ্কার কোনটি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘মাইকেল ফ্যারাডে’!
উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮-১৮২২)
সুরকার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী
উইলিয়াম হার্শেল ১৭৩৮ সালে জার্মানীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি মিশে ছিলেন মিউজিকের সাথে। বাজাতেন সেলো, সানাই, অর্গান, হার্পসিকর্ড আর সেই সাথে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন বিশ্বমানের এক মিউজিশিয়ান হিসাবে। অসংখ্য সঙ্গীত-কাজের মধ্যে ছিল ২৪টি সিম্পফোনি, করেছেন অনেক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং প্রচুর চার্চ-সঙ্গীত। সঙ্গীতের উপর কাজ করতে গিয়ে তিনি গণিত এবং লেন্সের উপরও আগ্রহ খুঁজে পান। একসময় ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নেভিল মাসকেলাইনের সাথে পরিচিত হওয়ার পর তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর ইন্টারেস্ট আরো জোরদার হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে অজানা জিনিষ খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছাটা তার অনেক বেশি বেশি হয়ে আসলেও তার কোনো টেলিস্কোপ ছিল না! সমাধান হিসাবে নিজেই একটা টেলিস্কোপ তৈরির বাসনা নিজের মনে নিয়ে আসেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাই তার ছিল না।
যাই হোক, তিনি টেলিস্কোপের জন্য আয়না এবং লেন্সটাকে সুন্দর করে তৈরি করার জন্য সেগুলো দিনে ১৬ ঘন্টা করে পোলিশ করতে লাগলেন। টেলিস্কোপ তৈরি হলে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রদের দেখতে শুরু করলেন। এবং আকাশে বিচরণ করতে থাকেন অবাধে, তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন হরেক রকমের গ্রহ, নক্ষত্র। কয়েক বছর পরে হঠাৎ তিনি মজার এক জিনিষ দেখতে পান। যেটি ঠিক নক্ষত্রও নয় আবার কোন ধূমকেতুও নয়। তার এই পর্যবেক্ষণটি তিনি রাশিয়ান এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নিকট পাঠান। এর মধ্য দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন আমাদের সৌরজগতের একটি গ্রহ, ইউরেনাস! নিজেকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন একজন স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে। ইউরেনাস আবিষ্কার করে থেমে থাকেননি হার্শেল। একাধারে তিনি আবিষ্কার করেছেন ইউরেনাসের ২টি মূখ্য চাঁদও যাদের নাম টিটানিয়া এবং অবেরণ। আবিষ্কার করেছেন শনি গ্রহের ২টি চাঁদ। তিনিই আবিষ্কার করেছেন ইনফ্রারেড বিকিরণ। সাগর প্রাণী কোরালের বিশেষ ধরণের বৈশিষ্ট্য বের করতে তিনি আবিষ্কার করেন এক ধরণের মাইক্রোস্কোপ। এভাবে মিউজিশিয়ান হিসাবে জীবনের অর্ধেক পার করে এসে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও হার্শেল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে।
নিভাস রামানুজন (১৮৮৭-১৯২০)
জন্ম থেকেই গণিতবীদ
অসাধারণ গণিত প্রতিভার অধিকার ছিলেন দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রামানুজন। অথচ তেমন কোন শিক্ষা ছাড়াই তিনি আবিষ্কার করেছেন মজার মজার সব গণিত। বয়স যখন ১০ তাঁর বাবা-মা ছেলের গণিত প্রতিভা আঁচ করতে পেরে তাকে একটি এ্যাডভান্সড ত্রিকোনমিতির বই কিনে দেন। কিন্ত রামানুজন দেখলো এখান থেকে তেমন কিছু শিখার নেই তার। কারণ ওগুলো ছিল খুবই সহজ। তাই নিজেই তৈরি করতে লাগলেন গণিতের বাস্তবধর্মী সব থিওরি। বয়স হলে তিনি কলেজে ভর্তি হন কিন্তু পরীক্ষায় পাস করলেন না। কারণ, একসাথে ইতিহাস, বায়োলজি এবং অন্য সব বিষয়ে ফোকাস করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে, অবসর সময়ে তিনি আবিষ্কার করতে লাগলেন সংখ্যাতত্তের নানা সুত্র!
দারিদ্রতা কখনই তার পিছু ছাড়লো না। তবে তার নিজের আবিষ্কারের উপর ছিল অনেক আত্মবিশ্বাস। তাই তার নিজের তৈরি গণিতগুলো ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষার করার জন্য পাঠাতে লাগলেন ইন্ডিয়া এবং ইংল্যান্ডের বড় বড় সব গনিতবেত্তাদের নিকট। বেশিরভাগ সময় ঐসব অংকগুলোকে কেবল হক্স বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। আবার অনেকেই একটা ছোঁকরা আর কি তৈরি করবে এই ভাবনা থেকেই না পড়েই রায় দিয়েছেন, এসব কিছু না। আবার অনেকেই একেবারেই বুঝেন নি যে, রামানুজন তাঁর গণিতে আসলে কি বলতে চেয়েছেন। অনেকেই দেখেছেন রামানুজনের দেওয়া কিছু থিওরি আগে থেকেই কেউ হয়তো করে দিয়ে গেছেন।
যাই হোক, রামানুজনের দেওয়া থিওরি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সটির প্রফেসর হার্ডি দেখলেন এবং বুঝলেন রামানুজন গণিতের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। অধ্যাপক হার্ডি রামানুজনকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আহবান করলেন। কিন্ত রামানুজন বিদেশের মাটিতে যেতে রাজি হলেন না। তবে সাদা চামড়ার একজন প্রফেসর রামানুজনকে সম্মান দেখানোর ফলে, ভারতীয় গণিতবেত্তাদের নিজেদের অবস্থান বুঝতে আর দেরি হলো না। তারাও রামানুজনকে যথাযথ সম্মান দিলেন; উপমহাদেশে যা প্রায়ই ঘটে আর কি! পরবর্তীতে অনেক বুঝানোর পরে রামানুজন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। গণিতের এই যাদুকরের থিওরি ব্যবহৃত হয় স্ট্রীং থিওরিতে, ক্রিস্টালোগ্রাফিতে, তথ্যের নিরপত্তা প্রদানে। লনডাও-রামানুজন ধ্রুবক, থিটা ফাংশন, মক থিটা ফাংশন, রামানুজন মৌলিক, রামনুজনের যোগ, রামানুজনের মাষ্টার থিওরি, রামানুজন-সোল্ডার ধ্রবক, রোজার-রামানুজন আইডেনটিটি আরো কত কত সব থিওরি। রামানুজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এই যে বিরাট গণিত প্রতিভা এসবের রহস্য কি? উত্তরে বলেছিলেন আমি কিছু জানি না, সপ্নে বিদ্যাদেবি আমাকে যে সব বলে দিয়ে যায়, আমি ঘুম থেকে উঠে সে সব লিখে রাখি। যেভাবেই যা ঘটুক না কেন রামানুজন যে গণিতের অসাধারণ এক প্রতিভা ছিলেন এতে কারো সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র। প্রফেসর হার্ডি রামানুজনের গণিত প্রতিভাকে নিউটন এবং আর্কিমিডসের সংগে তুলনা করেছিলেন। গণিতের এই যাদুকর মাত্র ৩২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, নতুবা বিশ্ববাসী হয়তো অনেক কিছুই পেত।
ম্যারি এ্যানিং (১৭৯৯-১৮৪৭)
ঝিনুক কুডানী থেকে জীবাশ্মবিজ্ঞানী
‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমুল্য রতন’। সেরকমই রতন আমাদেরকে এনে দিয়েছিলেন সাগর তীরে ঝিনুক কুড়িয়ে বেড়ানো ব্রিটিশ নারী ম্যারি এ্যানিং। চার্চের রবিবারের পাঠ ছাড়া তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। কিন্তু পরিশ্রম করে, জীবনের ঝুকি নিয়ে সাগরের জোয়ার-ভাটাকে জয় করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শামুক-ঝিনুকের ব্যবসা। সময়ের সাথে কিছুটা পরিচিতিও পেয়েছিলেন এতে। অবশ্য অনেকেই সমালোচনা করতেও ছাড়েনি; ম্যারি এ্যানিংকে কটাক্ষ করতো এই ঝিনুক বিক্রি নিয়ে। তবে, এসবে তাঁর কিছু আসে যায়নি, তিনি এগিয়ে গেছেন তার নিজের পরিকল্পনা নিয়ে। জীবাশ্ম সংগ্রহ করে গেছেন আপন মনে।
অবশেষে তার পুরষ্কার পান তিনি। একটি সুন্দর দিনে, তার ভাই তাদের বাড়ির নিকটে একটি খাঁডা বাঁধে মাথার খুলি সাদৃশ্য কিছু দেখতে পায়। ছোট ভাই এ্যানিংকে তা জানালেন। এ্যানিং সময় নিয়ে ওটা খুঁড়ে তোলেন এবং খুলি সাদৃশ্য জিনিষের মধ্যে থেকে পুরো একটি কুমিরের কংকাল উদ্ধার করেন। কিন্তু ওটা আসলে কুমির ছিল না, ছিল ডাইনোসার! পরবর্তিতে যার নাম দেয়া হয় ইচথিওসাইরাস। তিনি আরো খুঁজে পান প্লেসিওসাইরাস, টারোডেকটাইলাস, স্কোয়ালোরাহা। তাঁর আবিষ্কারসমূহ উনিশ শতকের ইতিহাসের দর্শনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে যখন অধিকাংশ মানুষ ধরে নিয়েছিল ডাইনোসারের অস্তিত্ব শুধুই কল্পনা। তাই আধুনিক ভূতত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এই ম্যারি এ্যানিংকে চিহ্নিত করা হলেও বাড়িয়ে বলা হবে না মোটেও। ১৮৪৭ সালের ৯ মার্চ বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেয়া এই নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যান।
হেডি লামার (১৯১৩-২০০০)
শিল্পী থেকে টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার
তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়াতে জন্ম নেওয়া এক মার্কিন অভিনেত্রী। ছোট বেলা থেকে মিউজিকের উপর বিশেষ আকর্ষণ ছিল তার। সেটার ধারাবাহিকতায় ২৮ বছর বয়সে স্বয়ংক্রিয় পিয়ানোতে কিভাবে গোপনীয় প্রোগ্রাম সেট করা যায় তার উপর নিজের তৈরি বিশেষ কৌশল আবিষ্কার করে বসেন। আসলে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন টেলিকমিউনিকেশনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কলাকৌশল ‘ফ্রিকোয়েন্সি-হপিং স্প্রেড-স্পেকট্রাম টেকনোলজি’। অথচ এসব বিষয়ে বিন্দুমাত্র নলেজ তার ছিল না কখনই। তার সেই আবিষ্কার আজকের যুগের ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ, সিওএফডিএম, সিডিএমএ প্রভৃতি তারহীন প্রযুক্তির ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা যায়।
গ্রেগর মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪)
সন্ন্যাসী থেকে আধুনিক জীনতত্বের জনক
জীনতত্ব? এটা মানুষের অস্বাভাবিক রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার হতে পারে, শরীরের মেদবৃদ্ধির জন্য এটাকে দায়ী করা যায়, কুমিরের শরীর আর শিম্পাঞ্জীর মাথার সমন্বয়ে একটি কাল্পনিক এবং বিষ্ময়কর প্রাণী তৈরিতেও ব্যবহার হতে পারে এই জীনতত্ব। সুতরাং আমাদের মনে হতে পারে এটা হয়তো কিছু সুপার-সায়েন্টিস্টস বা অধিবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। প্রিয় পাঠক, আপনি নিশ্চয় এমনটি ভাবেননি, কারণ পোষ্টের শিরোনামটি তাহলে মিথ্যা হয়ে যাবে। যে লোকটি এই আধুনিক বিজ্ঞানের জনক তার জীবন-বৃত্তান্তে এসবের ধারের কাছে কিছু ছিল না। এমনকি তিনি গবেষণাগারের সাদা কোর্ট পরা কোন ভদ্রলোকও নন। এমনকি তার এমন কোন পোষাকও ছিল না। তিনি হলেন জাত সন্ন্যাসী গ্রেগর মেন্ডেল। ১৮২২ সালে চেক রিপাবলিকে জন্ম নেওয়া মেন্ডেল পয়সার অভাবে কলেজের গন্ডি পৌঁছাতে পারেননি। তাই ভেবে চিন্তে অবশেষে বার্ণের অগাস্টিন সন্ন্যাসী আশ্রমে যোগ দেন এবং সেখানে তিনি বাগান পরিচর্যা করতে শুরু করেন। এই বাগান পরিচর্যা করতে করতে তিনি মোটর গাছের চারার কিছু মজার জিনিস পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বুঝলেন যে কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন গাছের রং, আকার, ইত্যাদি আসল মোটর গাছ থেকে চারা মোটর গাছে চালিত হচ্ছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে আরো কয়েকটা পরীক্ষা করলেন এবং একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নিয়মমাফিক কাজ করেন তিনিও ঠিক তেমনই করতে লাগলেন। আর এভাবেই ঘটনাক্রমে তিনি হাটতে লাগলেন আধুনিক জীনতত্ব আবিষ্কারের পথে।
টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
পত্রিকার হকার থেকে বিশ্ব সেরা উদ্ভাবক
মাত্র তিন মাস স্কুলে গিয়েছলেন টমাস আলভা এডিসন। স্কুল শিক্ষক তাঁকে প্রায় স্থূলবুদ্ধির এক বালক বলে অভিহিত করতো। শেষমেস স্কুল ছেড়ে দেন এডিসন। একটি অসুখের কারণে তিনি এসময় প্রায় বধিরও হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বাডীতে মায়ের উৎসাহে কিছু পড়াশোনা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব কৌতুহলী এডিসন বাবার ব্যবসাতে মন্দা আসার কারণে ট্রেনে চকলেট আর পত্রিকা বিক্রি করতে লাগলেন। একদিন চলন্ত ট্রেনের আঘাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ৩ বছর বয়সের জিমি মেকেঞ্জিকে। জিমির বাবা ছিলেন রেলওয়ের একজন স্টেশন মাষ্টার। নিজের মেয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে এডিসনকে টেলিগ্রাফ অপারেটর পদে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। এই চাকুরির সাথে নিজের অবসর সময় বই পড়ে এবং গবেষণা পরীক্ষা করে কাটাতেন। একসময় গবেষণার প্রতি তিনি এতটাই কৌতুহলী হয়ে ওঠেন যে রাতেও নিজের অফিসে কাজ করতে থাকেন। একরাতে লেড-এসিড ব্যাটারি নিয়ে কাজ করার সময় মেঝেতে কিছু সালফিউরিক এসিড পড়ে গেল এবং ওটা অফিসের বসের ডেস্কের নিচ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়লো। পরদিন সকালে এডিসনকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। এডিসনের এই দূর্দিনে এগিয়ে আসলেন তাঁরই অফিসের এক ইঞ্জিনিয়ার, ফ্রাংকলিন লিওনার্ড পোপ এবং নিজ বাড়ীর বেসমেন্টে এডিসনের থাকার এবং কাজ করার জায়গা করে দেন।
কিছুদিনের মধ্যেই এডিসন আবিষ্কার করেন উন্নতমানের টেলিগ্রাফ যন্ত্র! এরপর শুধু এগিয়ে যান তিনি। আর বিশ্বকে দেন নব নব আবিষ্কার। উদ্ভাবন করেন ফনোগ্রাফ, মূভি ক্যামেরা, ব্যবহারিক বৈদ্যুতিক বাতি। একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিদ্যুৎ তৈরি করে সেটা বাড়ী-ঘরে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, ফ্যাক্টরিতে বিতরণ করা যেতে পারে এমন ধারণা তিনিই প্রথম প্রবর্তন এবং বাস্তবায়ন করেন। ১৮৮২ সালে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে তাঁর তৈরি বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম পাবলিক পাওয়ার স্টেশন। তিনি আরো আবিষ্কার করেছেন স্টক টিকার (টেলিগ্রাফ ব্যবহার করে শেয়ারবাজারের তথ্য প্রদান), যান্ত্রিক ভোট রেকর্ডার, গাড়ির জন্য ব্যাটারি, রেকর্ডেড মিউজিক আরো অনেক কিছু! এসব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এডিসন বিশ্বকে নিয়ে গেছেন সভ্যতার পাহাড়ে।
আমি নিশ্চিত যে খুঁজতে থাকলে এই তালিকা আরো লম্বা হতে থাকবে। প্রিয় পাঠক, একজন বাচ্চাকে স্কুলে দিতে হবে এটা যেমন ঠিক সাথে সাথে তার নিজস্বতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রত্যেক মানুষকে বিশেষ প্রতিভা দিয়ে পাঠিয়েছেন। এই প্রতিভাকে বিকশিত হতে দিতে হবে সাবলীলভাবে। তাই ছোট্ট শিশুর উপর পাহাড়সম লেখাপড়া, দায়িত্ব, প্রতিযোগিতার বোঝা চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না কোনভাবেই। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় শিখানোর পাশাপাশি একজন শিশুকে তার মতো করে বেড়ে উঠতে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তার প্রকৃত প্রতিভাটাকে কাজ লাগানো সম্ভব নয় কি?
লেখক : সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়