পুণ্যস্রোতের অবগাহনে ক’টি দিন

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 510 বার পঠিত

৯ অগাস্ট ২০১২। ইফতারের তখনও ঘণ্টাখানিক বাকি। ঈদের সংক্ষিপ্ত মার্কেটিং সেরে এসে বাসায় ফিরতেই দেখি আববা ই‘তিকাফে যাওয়ার জন্য হাতের কাজগুলো দ্রুত সেরে নিচ্ছেন। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে উনি নিয়মিত ই‘তিকাফে বসেন। এই রামাযানের শুরুতে আমার মনে একবার উঁকি দিয়েছিল যে, এবার ই‘তিকাফে বসব। তবে নানা কাজের ব্যস্ততায় সে চিন্তা মাথা থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। যদিও একেবারে ভুলিনি, যার প্রমাণ দু’দিন আগে একবার স্মরণ হয়েছিল। তবে কাজের চাপ দেখে ধরেই নিলাম যে এবার আর সম্ভব না। তাই কোন পূর্বপ্রস্ত্ততি ছিল না। কিন্তু আজ আববার শশব্যস্ত প্রস্ত্ততি দেখে দোটানায় পড়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নাম করে চল, কাজগুলো পরেও করা যাবে’। অবশেষে ভাবাভাবি ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, নিয়ত যখন করেছি এবার বসব। আবার কবে এমন সুযোগ আসবে তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। এটাই আমার প্রথমবারের অভিজ্ঞতা। তাই বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে মনে উঁকি দিল টানা দশদিন দিন থাকতে হবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে? পারব তো! আল্লাহ ভরসা।

মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণে সারি বাধা ৭টি হুজরা। উত্তর দিকে আববার পার্শ্বের হুজরাটিই আমার। ১ম রাতে জামা‘আতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায়ের পরই শুয়ে পড়লাম। রাত ৩টা বাজলে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল। ফ্লোরে নিজেকে আবিষ্কার করে ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগল। স্মরণ হল গত রাত থেকে আমি মসজিদের বাসিন্দা। সাহারীর আযান হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে থেকে শূন্য দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছি মসজিদের উঁচু ছাদের দিকে। রাতের আধার চিরে উচ্চস্বরে কেপে কেপে ছড়িয়ে পড়ছে আযানের সমধুর ধ্বনি। খুব মন দিয়ে শুনলাম। অন্তরটা যেন এক অদ্ভূত ভাললাগার অনুভূতিতে ভরপুর হয়ে গেল। আযানের ধ্বনি এতটাই হৃদয়স্পর্শী হতে পারে! প্রতিটি বাক্যের মধ্য দিয়ে যে জীবন্ত আবেদনের অনুরণন ঘটল, তা উপলব্ধির এত নিবিঢ় সুযোগ আগে কখনও পাইনি। এরপর থেকে প্রতিরাতেই নিশুতি রাতের এই আযান শোনার মোহে আমি আগেভাগেই জেগে উঠতাম। শুধু তাই নয় ই‘তিকাফের ১০দিনে আমার নিয়মিত কাজ ছিল প্রতি ওয়াক্তে আযান শোনার জন্য বিশেষ সময় বরাদ্দ রাখা।   

১ম দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে ছালাতুয যোহা আদায় করলাম। যতদূর মনে পড়ে জীবনের প্রথম আমার এই ছালাত আদায়। তারপর টানা যোহর পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত এবং কুরআনের অর্থ ও তাফসীর পড়লাম। যোহরের আযান হলে ফরয-নফলসহ যোহরের ছালাত আদায়, দুপুরে আবার পড়াশোনা, একটু ঘুমিয়ে নেয়া, আবার আছরের ছালাত আদায়, ছালাতের পর ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন ইসলামী বই পড়া, সবাই মিলে ইফতার করে মাগরিব ছালাত আদায়, বাদ মাগরিব আবার পড়াশোনা, তারপর এশা ও তারাবীর ছালাত আদায়, রাতে একসাথে খাওয়া-দাওয়া, খাওয়া শেষে ঘুম না ধরা পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া-এই ছিল আমাদের নিত্যকার কার্যক্রম। বিজোড় রাত্রিগুলোতে রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত, অতঃপর তাহাজ্জুদের আযান হলে ৫ রাক‘আত বিতর ছালাত আদায় করে সাহারী গ্রহণ করতাম। এভাবে সুস্থির ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে চমৎকার ১০টি দিন কেটে গেল চোখের নিমিষেই। কোন ফোন-মোবাইলের জ্বালা-যন্ত্রণা নেই। নেই যান্ত্রিক জীবনের কোন স্পর্শ। কোন পিছুটান নেই। দিন-দুনিয়ার সাথে প্রায় শতভাগ সংযোগবিহিন। যরুরী প্রয়োজনে অগন্তুকদের সাথে কথাবার্তা যদিও বেশ বলতে হয়েছে, তবে তা নিত্যদিনের তুলনায় কিছুই নয়। হুজরার মাঝে শুয়ে শুয়ে কখনও কল্পনায় ভেসে আসত হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূল (ছাঃ)-এর কথা। আল্লাহর নিবিঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পূর্বযুগে এজন্যই হয়ত পুণ্যবান মানুষরা বৈরাগ্যবাদী হয়ে পড়তেন। এমনিতেই নির্জনতা আমার খুবই প্রিয়, তারপর সুশৃংখল ইবাদতে লিপ্ত থেকে একেবারে নিজস্ব জগতের মধ্যে এমন বুদ হয়ে ডুবে থাকার সুযোগ পেয়ে মনটা খুব প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। ২৮ রমযানের দিন। সে রাতে সঊদীআরবে চাঁদ উঠার কথা। কেবলই মনে হচ্ছিল যদি চাঁদটা আজ না উঠত! তারাবীর ছালাত পড়ছি আর ভাবছি হয়ত এটাই এ যাত্রায় শেষ তারাবী। বিষন্ন চিত্তে হুজরায় ফিরতেই জানতে পারলাম আজ সৌদিআরবে চাঁদ উঠে নি। অর্থাৎ আরো একটি দিন বোনাস পাওয়া গেল। একটু পরই কাফী ভাই হুজরায় ঢুকলে সুখবরটা দিলাম। জানতাম খুশী হবে। কিন্তু তার চোখের তারায় অব্যক্ত আনন্দের ঝিলিক যেভাবে চমকাল, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। সত্যিই পূণ্যস্রোতে অবগাহনের এই যে শুচিতা, এ যে প্রখর চুম্বকীয় অনুভূতি তার কোন তুলনা নেই। মনে হল, এ মহাগুপ্তধনের সন্ধান যে একবার পেয়েছে, তার আর পিছু ফেরার কোন অবকাশ থাকে না। জীবনটা যার পান্থজনের সামান্য আশ্রয়স্থল, গন্তব্যের পানে চেয়ে যার নিত্যদিনের অস্থির অপেক্ষা, যাত্রাপথের যে কোন ক্ষুদ্র প্রাপ্তিতেও তার সত্তাজুড়ে বিজয়ের ঔজ্জ্বল্য ঝলমল করবে-এটাই স্বাভাবিক। বুঝতে পারছি এ আকর্ষণের হাতছানিকে উপেক্ষা করা খুব সহজ নয়।

ঈদের চাঁদ উঠার পর বিদায়ের পালা। মসজিদবাসীরা সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দো‘আ চেয়ে মসজিদ ছেড়ে বেরিয়ে এল। বিষন্নতা আর পরিতৃপ্তি মাখা অপরিচিত অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরছি। যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল দীর্ঘ দশদিন আটক থাকতে হবে, আর আজ ফিরে আসার দিন মনে হচ্ছে যেন স্বাধীন জীবন ফেলে আটকা পড়তে যাচ্ছি আবার পরাধীনতার নির্মম শিকলে।      

আহমাদ

নওদাপাড়া, রাজশাহী



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও