ড. ফযলে ইলাহী যহীর সকাশে
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 985 বার পঠিত
এক.
‘বাবা, তুমি কেমন আছ?’ ‘অশীতিপর বৃদ্ধ লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তার সারা শরীর ঘামে ভেজা। পাতলা মলিন পাঞ্জাবির বাইরে দিয়ে ভেতরের জীর্ণ শরীরটা দেখা যাচ্ছে। মাথার সাদা চুলগুলো রুক্ষ, এলোমেলো। মুখমন্ডলে ক্লান্তির ছাপ। চোখ দু’টো কোটরের ভেতরে ঢোকানো।
আমি চুপ করে রইলাম। বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ তার মাঝে অস্থিরতার সঞ্চার হল। ডান হাত দিয়ে আমার শরীরটা তিনি স্পর্শ করতে চাইলেন। কিন্তু তারপরই হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমি মন দিয়া চা বেচতাছি। তুমি আইবা কইছিলা, কবে আইবা?’ আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। অনুশোচনা গ্রাস করল আমাকে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি চোখের কোণটা ভেজা। বিছানা ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম।
দুই.
সময়টা ২০০৩ সালের মাঝামাঝি। আমি তখন সবে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি। হোস্টেলেই থাকতাম। পড়ালেখার পাশাপাশি দু’একটা টিউশনি করাতাম।
শুক্রবার ছিল সেদিন। দুপুরে খাবার পর বের হলাম স্টুডেন্টের বাসার উদ্দেশ্যে। গন্তব্য, বখশিবাজার মোড় থেকে রাজারবাগ। দুপুরের কাঠফাটা রোদে দরদর করে ঘামছি আমি। রাস্তায় কোন খালি রিক্সা নেই। দু’একটা যাও এলো, রাজারবাগের দিকে যাবে না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। দেরী করে গেলে স্টুডেন্টের মা কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বেন না। যেন মাসে দুইটা হাযার টাকা দিয়ে আমাকে কিনে নিয়েছেন। তারপরেও ছাড়ি না টিউশনিটা। মনকে সান্ত্বনা দেই, মাঝে মাঝে একটু খারাপ কথা না হয় শুনলামই। তারপরেও তো মাসে হাযার দু’য়েক টাকা আসছে।
এদিক ওদিক তাকালাম। একটাও খালি রিক্সা নেই। হঠাৎ ‘স্যার, কই যাইবেন?’ পিছন থেকে হঠাৎ ক্ষীণ একটা ডাক শুনে আমি চমকে উঠলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, অশীতিপর সাদা শশ্রুমন্ডিত এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার ময়লা একটা পাঞ্জাবি আর ছেড়া লুঙ্গি। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বৃদ্ধ অনেকটা জোর করেই তার রিক্সায় আমাকে নিয়ে উঠালো। তারপর তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্যাডেল মেরে অনেক কষ্টে রিক্সাটাকে অল্প খানিকটা নিয়ে গেল। বেশি দূর টানতে পারলনা। কিছুটা দূরে গিয়ে এক সময় রিক্সাটা থেমে গেল।
আমি নামলাম রিক্সা থেকে। বৃদ্ধ লোকটিও নামল। অপরাধীর মতো সে মাথা নিচু করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, তার ডান হাতের তর্জনী ময়লা একটা কাপড় দিয়ে পেঁচানো। কেটে গিয়েছে মনে হয়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মুরুববী, আপনার শরীরের অবস্থা তো ভাল না, আপনি রিক্সা চালাইতেছেন ক্যান?’ বৃদ্ধ লোকটি বিব্রত ভঙ্গিতে আরও জড়সড় হয়ে দাঁড়াল, যেন এত কঠিন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন সে জীবনেও হয়নি। তারপর বলল, ‘বাবা, রিক্সা না চালাইলে আমারে আর আমার বউরে খাওয়াইবো কেডা?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্যান, আপনার ছেলে মেয়ে নাই?’ বৃদ্ধ বললো, ‘বাবা, আমার বয়স আশি পার হইছে। দুইটা বেটা আমার। বিয়া দিছি ওগোরে। হ্যার পর বউ নিয়া আলাদা থাকে। আমার আর আমার বউরে খাওন দেয় না হ্যারা, খোঁজ-খবরও লয় না। না খাইয়া মারা যাওনের থেইকা রিশকা চালাইয়া যদি কিছু টেকা পাই...’। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলেন বৃদ্ধ, গলা ধরে এলো তার।’ ‘সারাদিনে কত টাকা কামাইছেন আজকে?’ জিজ্ঞেস করলাম তাকে। তিনি বললেন, ‘দুপুর বারোটা থেইকা আধা বেলার লাইগা রিক্সাডা নিছি। মহাজনরে চল্লিশ টেকা দেওন লাগবো সন্ধ্যার সময়। কিন্তু কেউ আমার রিশকায় উঠেনা বাবা। চালাইবার পারিনা তো, তাই...। এই পর্যন্ত বিশ টেকা কামাইছি। রিক্সার চাক্কা ফুটা হইছিল, সাত টেকা খরচা হইছে সারাইতে। পকেটে অহন বাকী তের টেকা আছে।’
রিক্সাটা সাইডে চাপিয়ে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটাতে তিনি বসলেন আমার সাথে। ড্রামের ভেতর থেকে গেলাসে করে পানি নিয়ে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম অবহেলিত অশীতিপর এক বৃদ্ধ মানুষের পানি খাওয়ার দৃশ্য। তারপর তিনি দোকানের পলিথিনে ঝুলতে থাকা সস্তা দামের বন রুটির দিকে তাকালেন। পরক্ষণে চোখ ফিরিয়ে নিতেই আমার সাথে চোখাচোখি হল। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘আপনি পেট ভরে খান, নিশ্চিন্ত মনে খান, কোন টাকা আপনাকে দিতে হবেনা।’
তার খাওয়া শেষ হলো। কোমরে পেঁচানো ময়লা গামছাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘চলেন, রওনা হই।’ আমি বললাম, ‘না, একটু কাজ আছে আমার।’ তারপর তাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে হোস্টেলে ফিরে এলাম। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই মানুষটিকে একলা ছেড়ে দেয়া যাবেনা। কোন ভাবেই না। কিছু একটা করতে হবে তার জন্যে। পকেটে ছিল চারশো টাকার কিছু বেশি। বন্ধু সুকান্তকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ওর থেকে ধার নিলাম পাঁচশ টাকা। এই নয়শ টাকা নিয়ে আবার এলাম সেই বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার কাছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মুরুবিব, আপনেরে যদি আমি চা-এর ফ্লাস্ক কিনা দেই, আপনে ঘুইরা ঘুইরা চা-বিস্কুট বেচতে পারবেন?’ তিনি প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে জানালেন, পারবেন।
এরপর তার রিক্সাটা হোস্টেলের ভেতরে একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে তাকে নিয়ে গেলাম নিউমার্কেটে। দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে অনেক দেখে শুনে একটা চা বিক্রির ফ্লাস্ক কিনলাম। তারপর চায়ের পাতা আর কাপ, বিস্কুট। আমি খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, বৃদ্ধ মানুষটি হঠাৎ করেই যেন আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলেন। উত্তেজনায় তার হাত এখন আগের থেকে অনেক বেশি কাঁপছে। চায়ের ফ্লাস্ক কেনার সময় আমি প্রথমে একটা পছন্দ করলাম। কিন্তু তিনি বললেন, ‘তাড়াহুড়া কইরোনা বাবা, দাম দিয়া একটা জিনিস কিনুম, দেইখা শুইনা কিনি, কি কও?’
কেনাকাটা শেষ করে আমরা আবার ফিরে এলাম হোস্টেলে, যেখানে তার রিক্সাটা রেখে গিয়েছিলাম। এরপর একটা রিক্সাসহ রিক্সাওয়ালা এবং আরেকজন শুধু রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া করলাম তাকে আর তার নিজের রিক্সাটিকে তার বাসা পর্যন্ত পৌছে দেবার জন্যে। বিদায় নেবার সময় তিনি বললেন, ‘বাবা, তুমি আইজকা যে কাজটা করলা, আমি সারাজীবন মনে রাখুম। গেন্ডারিয়া রেল ইশটিশনের পাশে বস্তিতে আমি থাকি। ওইহানে গেলেই আমারে পাইবা। আর অহনে তো আমি ইশটিশনেই চা বেচুম। কবে আইবা তুমি?’
‘আসুম মুরুবিব, একটু সময় পাইলেই চইলা আসুম’।-আশ্বস্ত করলাম তাকে। ‘আইসা আপনেরে একটা দোকান কইরা দিমু’।-কথাটা বললাম মন থেকেই।
এরপর অনেক দিন পার হয়ে গেলো। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়লাম। চাকুরীতে ঢুকলাম। জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে ভুলেই গেলাম সেই অশীতিপর বৃদ্ধের কথা।
তিন.
২০১০ সাল। অফিসের কাজে গেন্ডারিয়া যেতে হল। রেল ষ্টেশনের কাছের বস্তিতে যখন গেলাম, হঠাৎ মনে পড়ল সাত বছর আগের সেই বৃদ্ধ লোকটির কথা। কৌতূহলবশতঃ খোঁজ নিলাম। প্রথমে কেউ কিছুই বলতে পারলনা। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারলাম, বছর দু’য়েক আগে এক চা বিক্রেতা বৃদ্ধ লোক চা বিক্রি করতে গিয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গিয়েছেন।
খবরটা শুনে আমি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলাম। ২০০৩ সালের সেই দিন আমি তার নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই, ঐ মানুষটাই যে এই মানুষ, এটা প্রমাণ করাটা কষ্টকর হলেও মনে মনে বললাম, তাকে আমার একটা দোকান করে দেবার কথা ছিল, সেটা করে দিতে পারলাম না। আমি দোষী। বিধাতা, ক্ষমা করো আমাকে।
এখন মাঝে মাঝেই ঐ স্বপ্নটা দেখি। একজন অশীতিপর বৃদ্ধ লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাবা, তুমি কেমন আছ?’ আমি চুপ করে থাকি। তিনি তার হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করেন, তারপর ইতস্তত করে বলেন, ‘আমি মন দিয়া চা বেচতাছি। তুমি আইবা কইছিলা, কবে আইবা?
হাসান ফেরদাউস
বালিয়াপুকুর, রাজশাহী