পরহেযগারিতা (শেষ কিস্তি)

মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান 774 বার পঠিত

পর্ব ১ । পর্ব ২

গ্রহণযোগ্য দ্বীনদারী :

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, الْوَرَعُ الْمَشْرُوعُ هُوَ الْوَرَعُ عَمَّا قَدْ تُخَافُ عَاقِبَتُهُ وَهُوَمَا يُعْلَمُ تَحْرِيمُهُ وَمَا يَشُكُّ فِي تَحْرِيمِهِ وَلَيْسَ فِي تَرْكِهِ مَفْسَدَةٌ أَعْظَمُ مِنْ فِعْلِهِ ‘শরী‘আত সম্মত দ্বীনদারী হ’ল, যেসব কাজের পরিণতি আশঙ্কাজনক তা থেকে বিরত থাকা। আর আশঙ্কাজনক কাজগুলো হ’ল, যে কাজ হারাম হওয়ার বিষয়ে জানা গেছে অথবা যে কাজ হালাল কি হারাম সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া যেসব কাজ করা থেকে ছেড়ে দেয়াতে তেমন কোন ক্ষতি নেই, সেগুলোও আশঙ্কাজনক কাজ’।[1] পূর্বে আমরা এ ধরনের তাক্বওয়া বা দ্বীনদারীর একাধিক দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি।

অগ্রহণযোগ্য দ্বীনদারীঃ এটি কয়েকটি ধাপে বিভক্ত। আর তা হল-

(ক) দ্বীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা :

কতিপয় লোক রয়েছে যারা দ্বীনদারী অবলম্বনে সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে এবং তারা ইসলামী শরী‘আতের মূল উদ্দেশ্য হতে বের হয়ে আসে। এটি নিতান্তই বাড়াবাড়ি ও খারাপ কাজ। কেননা সবকিছুর একটি সীমা রয়েছে। যখন কোন ব্যক্তি সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন সে তার সকল উদ্দেশ্য হতে বের হয়ে যায় এবং লক্ষচ্যুত হয়। সুতরাং কোন মানুষের জন্য দ্বীনদারী অবলম্বনে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।

মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে মানুষ যেসব বাড়াবাড়ি করে তার উদাহরণ। যেমন- যখন হারাম মাল হালালের সাথে মিশে, তখন হারাম মালকে হালাল থেকে আলাদা করতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি ১০০ দিনারের মালিক হয় তার অর্ধেক হালাল আর বাকী অর্ধেক হারাম। অর্থাৎ সে অর্ধেক সম্পদের দায় থেকে পরিত্রাণ পেল। কিন্তু এ ব্যক্তি সম্পর্কে কেউ কেউ বলে যে, নির্ধারিত হারাম অর্ধেক থেকে দায়মুক্তি দ্বারা সে কোন উপকৃত হতে পারবে না। এটিই হ’ল, বাড়াবাড়ি, যা তাক্বওয়ার সীমা থেকে এক ধাপ আগে বাড়িয়ে বাড়তি তাক্বওয়া অবলম্বন করা হয়, যার কোন ভিত্তি শরী‘আতে নেই।

যখন হালাল মাল হারামের সাথে মিশে তার বিধান কি হবে? এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কোন কোন আলেম তা থেকে গ্রহণ করাকে হারাম বলেছেন। কিন্তু যদি হারামের পরিমাণ একেবারে সামান্য হয়ে থাকে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। এ বিষয়টি ইমাম আহমাদ (রহঃ) পরিস্কার করেছেন, يَنْبَغِيْ أَنْ يَّتَجَنَّبَهُ إِلَّا أَنْ يَكُوْنَ شَيْئًا يَسِيْرًا أَوْ شَيْئًا لَا يَعْرِفُ ‘এ ধরনের মাল থেকে বিরত থাকা উচিত। কিন্তু যদি তা সামান্য বস্ত্ত হয় বা উল্লেখযোগ্য কোন বস্ত্ত না হয়ে থাকে, তাতে কোন অসুবিধা নেই’।[2]

আবার কোন কোন সালাফ বা আলেম বলেন, যদি জানা যায় যে, তার মালের মধ্যে হারাম মাল রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে জানে না, কোনটুকু হালাল আর কোনটুকু হারাম; তাহ’লে তার জন্য তা হতে খাওয়ার অনুমতি রয়েছে। ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, لَا بَأسَ أَن يَؤْكُلَ مِنْهُ مَا لَمْ يَعْرِفْ أَنَّهُ حَرَامٌ بِعَيْنِهِ ‘এ ধরনের সম্পদ হতে খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জানতে পারবে যে, নির্দিষ্ট এ সম্পদটি হারাম’।[3]

আবার কোন কোন আলেম কোন প্রকার ব্যাখ্যা ছাড়াই এ ধরনের সম্পদ থেকে দ্বীনদারী অবলম্বন করার কথা বলেন। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন,لَا يُعْجِبُنِيْ ذَلِكَ وَتَرْكُهُ أعْجَبُ إِلَيّ ‘এ ধরনের সম্পদ ভক্ষণ করা আমার নিকট পসন্দনীয় নয়। আর ছেড়ে দেয়া আমার মতে অধিক প্রিয়’।[4]

তবে যখন যে পরিমাণ হারাম মাল তার মধ্যে প্রবেশ করছে, তা বের করে দেয়া হয় এবং অবশিষ্ট মালকে ব্যবহার বা কাজে লাগানো হয়, তখন তা হ’তে ভক্ষণ করা জায়েয।

ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেন, إِنْ كَانَ الْمَالُ كَثِيْرًا أَخْرَجَ مِنْهُ قَدْرُ الْحَرَامِ وَتَصَرَّفَ فِي الْبَاقِيْ ‘যদি অধিক সম্পদ থেকে কিছু হারাম সম্পদ বের করা হয়। তাহলে অবশিষ্ট সম্পদ ব্যবহার করাতে কোন অসুবিধা নেই’।[5]

এ অবস্থার মধ্যে নির্ধারিত হারাম মালকে বের করে আনার পর তা থেকে বেঁচে থাকা বা সে মালকে কোন প্রকার কাজে লাগানো উচিত নয়। কেউ যদি একে তাক্বওয়া মনে করে তবে সে ভুল করবে।

অনেক সময় দেখা যায় কোন কোন মানুষ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে সন্দেহ হয়। কিন্তু এ ধরনের সন্দেহের উপর ভিত্তি করে তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা বা তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা কোনক্রমেই উচিত নয়। যেমন তুমি কোন একজন মুসলিম ভাইয়ের ঘরে প্রবেশ করলে যার অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জান না। তারপর যখন তোমার সামনে সে খাবার উপস্থিত করল। তখন তুমি বলবে, তুমি যে টাকা দিয়ে বাজার করছ, সে টাকা কোথায় পেয়েছ? এ ধরনের জিজ্ঞাসা কোন ক্রমেই বৈধ নয়।

এ ধরনের প্রশ্ন কি তাক্বওয়া হতে পারে? এ ধরনের প্রশ্ন করা কোন ক্রমেই তাক্বওয়ার মানদন্ডে পড়ে না। বরং এ ধরনের প্রশ্নের মধ্যে একজন মুসলিমকে কষ্ট দেয়া ও তাকে লজ্জা দেয়া হয়। কেননা এ ধরনের প্রশ্ন করা হ’ল, তাকে অপবাদ দেয়া হয়। কোন মুসলিমকে কোন প্রকার দলীল প্রমাণ বা আলামত ব্যতীত অপবাদ দেয়া এবং তাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ। আর এ হ’ল, একজন মুসলিমের প্রতি খারাপ ধারণা করা এবং একজন মুসলিমের জন্য আর অপর মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।

(খ) কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা :

এখানে কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া কোন ক্রমেই উচিত নয়। এগুলোকে তাক্বওয়া বলা চলে না; বরং এগুলোকে কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা বলা হয়। এ বিষয়ে উদাহরণ গিয়ে আল্লামা ইবনু হাজার (রহঃ) ফাৎহুল বারীতে উল্লেখ করেন, وَرَع الْمُوَسْوَسِينَ كَمَنْ يَمْتَنِعُ مِنْ أَكْل الصَّيْدِ خَشْيَةَ أَنْ يَكُون الصَّيْدُ كَانَ لِإِنْسَانٍ ثُمَّ أَفْلَتَ مِنْهُ ، وَكَمَنَ يَتْرُكُ شِرَاءَ مَا يَحْتَاجُ إِلَيْهِ مِنْ مَجْهُولٍ لَا يَدْرِي أَمَالُهُ حَلَالٌ أَمْ حَرَامٌ وَلَيْسَتْ هُنَاكَ عَلَامَةٌ تَدُلُّ عَلَى الثَّانِي ، ‘কোন কোন লোক এমন রয়েছে তারা শিকার করা পাখি খায় না। তারা আশঙ্কা করে, শিকারটি কোন মানুষের ছিল। তারপর সে তার মালিকের নিকট থেকে পালিয়ে গেছে। তাই সে চিন্তা করে, মালিকের অনুমতি ব্যতীত তা হতে খাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তার প্রয়োজনীয় বস্ত্ত কোন অপরিচিত লোক থেকে ক্রয় করে তা খায় না। তার যুক্তি হল, তা কি হালাল না হারাম তা সে জানে না। অথচ এখানে এমন কোন প্রমাণ নেই বা একথা প্রমাণ করে যে, বস্ত্তটি হারাম। কোন প্রকার দলীল প্রমাণ ব্যতীত কোন কিছু খাওয়া বা গ্রহণ করা হতে বিরত থাকা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ শরী‘আতের মূলনীতি হ’ল, প্রতিটি বস্ত্তর আসল প্রকৃতি হ’ল হালাল হওয়া, যদি হারাম হওয়ার কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়। আর যদি হারাম হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তখন তাকে হারাম বলা যাবে। অন্যথায় তাকে হারাম বলাও হারাম’।[6]

ওয়াসওয়াসার আরেকটি দৃষ্টান্ত :

আল্লামা যিরাকশী (রহঃ) বলেন, لَوْ حَلَفَ لَا يَلْبَسُ غَزْلَ زَوْجَتِهِ فَبَاعَتْ غَزْلَهَا وَوَهَبَةْ الثَّمَنَ لَمْ يَكْرَهُ أَكَلُهُ فَاِنَّ تَرْكَهُ فَلَيْسَ بِوَرْعٍ بَلْ وَسَوَاسَ ‘যদি কোন ব্যক্তি কসম করে বলে, সে তার স্ত্রীর কাপড় পরিধান করবে না। এরপর স্ত্রী তার কাপড়টি বিক্রি করে দিল এবং বিক্রয় মূল্যটি তার স্বামীকে দান করল, তখন তার জন্য তা খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা, তার কাপড় ব্যবহার করা ছেড়ে দেয়া কোন দ্বীনদারীর অংশ নয়, বরং তা হ’ল ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা’।[7]

বিশেষ পরহেযগারিতা :

কিছু কিছু বিষয়ে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী রয়েছে, যেগুলো শুধু বিশেষ লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; সবার ক্ষেত্রে নয়। অর্থাৎ এ ধরনের পরহেযগারিতাকে খাছ পরহেযগারিতা বলা হয়। আল্লামা ইবনু রজব (রহঃ) বলেন, وَهَاهُنَا أَمْرٌ يَنْبَغِيْ التَّفَطَّنُ لَهُ وَهُوَ أَنَّ التَّدْقِيْقَ فِي التَّوَقُّفِ عَنِ الشُّبْهَاتِ إِنَّمَا يُصْلِحُ لِمَنْ اسْتَقَامَتْ أَحْوَالُهُ كُلُّهَا وَتَشَابَهَتْ أَعْمَالُهُ فِي التَّقْوَى وَالْوَرْعِ فَأَمَّا مَنْ يَقَعَ فِي اِنْتِهَاكَ الْمُحَرِّمَاتِ الظَّاهِرَةِ ثُمَّ يُرِيْدُ أَنْ يَتَوَرَّعَ عَنْ شَيْءٍ مِنْ دَقَائِقِ الشُّبُهَةِ فَإِنَّهُ لَا يَحْتَمِلُ لَهُ ذَلِكَ بَلْ يَنْكِرُ عَلَيْهِ ‘এখানে একটি বিষয় রয়েছে, যে বিষয়ে সতর্ক হওয়া একান্ত যরূরী। আর তা হ’ল, সন্দেহযুক্ত বস্ত্ত থেকে বিরত থাকা তার জন্য মানায়, যার সকল অবস্থা স্থির এবং তার আমলসমূহ তাক্বওয়া বা দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে একটি অপরটির পরিপূরক। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে হারামে লিপ্ত হয়, তারপর সে সন্দেহযুক্ত বস্ত্ত হতে দ্বীনদারী অবলম্বন করে; তার জন্য এ ধরনের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা মানায় না। তার ক্ষেত্রে এ ধরনের দ্বীনদারী বা পরহেযগারিতা কোন ক্রমেই প্রযোজ্য নয়। বরং তাকে এ ধরনের পরহেযগারিতা অবলম্বন থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়’।[8] যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-কে ইরাকের এক অধিবাসী ব্যাঙের পেশাবের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বলেন, তারা আমাকে ব্যাঙের পেশাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে, অথচ তারা হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করেছে। আর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنْ الدُّنْيَا ‘দুনিয়াতে তারা উভয়ে আমার দুই বাহু’।[9]

ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে একজন লোক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, يَشْتَرِيْ بَقْلًا وَيَشْتَرِطُ الْخَوْصَةُ يَعْنِي الَّتِي تُرْبَطُ بِهَا حَزَمَةَ الْبَقْلِ فَقَالَ أَحْمَدُ إِيْشَ هَذِهِ الْمَسَائِلٰ؟! قِيْلَ لَهُ إِنَّ ِبْرَاهِيْمَ بْنِ أَبِيْ نُعٰيْمِ يَفْعَلُ ذَلِكَ فَقَالَ أَحْمَدُ إِنَّ كَانَ إِبْرَاهِيْمَ بْنِ أَبِيْ نُعَيْمِ فَنَعَمْ هَذَا يَشْبَهُ ذَاكَ ‘সে সবজি কেনার সময় শর্ত দিয়ে বলল, আমি তোমার থেকে সবজি এ শর্তে ক্রয় করতে পারি, যদি তুমি আমাকে একটি দড়ি দাও যার দ্বারা আমি আমার সবজিগুলো বেঁধে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি। ইমাম আহমাদ (রহঃ) তার কথা শুনে বলল, এ ধরনের কাজ কে করে? তখন তাকে জানানো হল, ইবরাহীম ইবনে আবু নু‘আইম এ ধরনের কাজ করে থাকে। তখন তিনি বললেন, যদি ইবরাহীম ইবনে আবু নু‘আইম এ ধরনের কাজ করে থাকে তবে তা বৈধ। কেননা, দড়িটি সবজির সাথে সম্পৃক্ত।[10]

সারকথা : কিছু কিছু বিষয় রয়েছে এত সূক্ষ্ম, যা থেকে বেঁচে থাকা কারো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বরং যারা এসব থেকে বেঁচে থাকতে চায়, তারা যদি ফাসেক বা সুযোগসন্ধানী লোক হয়, তাদেরকে তা হতে বিরত রাখতে হবে এবং তাদের প্রতিহত করতে হবে।

পরিশিষ্ট :

একজন মানুষের জন্য দ্বীনদারী বা পরহেযগারিতা ছেড়ে দেয়ার মধ্যে তার দ্বীন ও দুনিয়ার অনেক ক্ষতি নিহিত। সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, أَيُّمَا عَبْدٌ لَمْ يَتَوَرَّعْ وَلَمْ يَسْتَعْمَلِ الْوَرْعَ فِي عَمَلِهِ اِنْتَشَرَتْ جَوَارِحَهُ فِي الْمَعَاصِي وَصَارَ قَلْبُهُ بِيَدِ الشَّيْطَانِ وَمُلْكِهِ ‘যখন কোন বান্দা পরহেযগারিতা অবলম্বন করে না এবং আমল করার ক্ষেত্রে সে পরহেযগারিতাকে কাজে লাগায় না। তখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো গুনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর ধীরে ধীরে তার অন্তর শয়তানের হাতে বা কব্জায় চলে যায়। তখন তার থেকে বের হয়ে আসা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে’।[11]

অনেক সময় দেখা যায়, একজন মানুষ তাক্বওয়া বা দ্বীনদারী অবলম্বন না করার কারণে তার আমলসমূহ বিনষ্ট বা বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ তার আমল কোন কাজে আসে না। ইয়াস ইবনু মু‘আবিয়া (রহঃ) বলেন, যে কাজ পরহেযগারিতা-দ্বীনদারী বা তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়, তা অবশ্যই অনর্থক।[12] বরং পরহেযগারিতা বা তাক্বওয়া ছেড়ে দেয়া উম্মতে মুসলিমাকে ধ্বংস করে দেয়। আর পরহেযগারিতা বা তাক্বওয়া ছেড়ে দেয়া মুসলিম উম্মাহর ভাল কাজগুলোকে সমূলে উৎখাতের কারণ হয়। সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, تَظْهَرُ فِي النَّاسِ أَشْيَاءَ يَنْزَعُ مِنْهُمُ الْخُشُوْعَ بِتَرْكِهِمُ الْوَرْعَ ‘পরহেযগারিতা ছেড়ে দেয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রকাশ পাবে, যা মানুষের বিনয়কে মানুষ থেকে তুলে নিবে’।[13]

পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী জোর করে সাব্যস্ত করার বিষয় নয় যে, একজন ব্যক্তি জোর করে বা দাবি করে পরহেযগার হতে পারবে। বরং তা অর্জন করার জন্য আমল করতে হবে এবং সাধনা বা গবেষণা করতে হবে।

যারা হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হতে বিরত থাকে না এবং হালাল হারাম বেঁচে চলে না, তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার ভালবাসা দাবি করা মিথ্যা বৈ আর কিছুই নয়। হাতেম (রহঃ) বলেন, مَنْ ادعَى حُبَّ اللهِ بِغَيْرِ وَرْعٍ عَنْ مُحَارِمِهِ فَهُوْ كَذَّابٌ ‘যে ব্যক্তি হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হতে বিরত থাকে না, অথচ আল্লাহকে ভালোবাসার দাবী করে, সে অবশ্যই মিথ্যুক’।[14]

একজন মুসলিমের জন্য আবশ্যক হ’ল, তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য যেন হয়, দ্বীনের বিষয়ে তাকওয়া অবলম্বন করা। আল্লাহ তা‘আলার ভয়কে কাজে লাগানো এবং আল্লাহ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধ থেকে সব সময় সতর্ক থাকা।

وَوَاظِبْ عَلَى التَّقْوَى وَكَنْ مُتَوَرِّعاً + صَبُوراً عَلَى البَلْوَى وَبِالدِّينِ كُنْ شَهْمَا ‘তুমি সব সময় আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং তুমি পরহেযগার হও। বিপদে তুমি ধৈর্যশীল থাক এবং দ্বীনের বিষয়ে তুমি বিচক্ষণ হও’।[15]

উপসংহারঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে মুত্তাক্বী বানিয়ে দাও অথবা আমাদেরকে সকল কাজে হেদায়াত দান কর। আর তাক্বওয়া বৃদ্ধি করে দাও এবং জান্নাতকে আমাদের গন্তব্যস্থল বানাও। আর আমাদেরকে তুমি এমন শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক্ব দান কর, যা তোমাকে খুশী করে। আর তুমি আমাদেরকে এমন পরহেযগারিতা দান কর, যা আমাদেরকে তোমার নাফরমানির মাঝে দেয়াল হিসাবে বিবেচিত হয়। আর তুমি আমাদেরকে এমন চরিত্র দান কর, যা দ্বারা আমরা মানুষের মাঝে আদর্শ হতে পারি। আর আমাদেরকে তুমি এমন জ্ঞান দান কর, যদ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হেদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের পথপ্রদর্শক বানাও। আপনি আমাদের পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত করবে না। আর আপনি আমাদের সকলের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। আর সকল প্রশংসা তার জন্য যার অপার অনুগ্রহে যাবতীয় সৎআমলসমূহ পরিপূর্ণতা লাভ করে। আল্লাহুম্মা আমীন, ইয়া রাবিবল আলামীন।

মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান

লেখক : শিক্ষক, ইক্বরা ইসলামিয়া মডেল মাদরাসা, বি-বাড়িয়া


[1]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ১০/৫১১-৫১২, সংক্ষেপিত।

[2]. জামেঊল উলুম ওয়াল হিকাম ১/৭০ পৃঃ

[3]. প্রাগুক্ত

[4]. প্রাগুক্ত

[5]. প্রাগুক্ত

[6]. ফাৎহুল বারী ৪/২৯৫ পৃঃ

[7]. আল-মানছুর ফিল ক্বাওয়ায়ে‘দ ২/২৩০ পৃঃ

[8]. জামেঊল উলুম ওয়াল হিকাম ১/১১১ পৃঃ।

[9]. বুখারী হা/৫৯৯৪; জামেঊল উলুম ওয়াল হিকাম ১/১১১ পৃঃ।

[10]. জামেঊল উলুম ওয়াল হিকাম ১/১১১ পৃঃ

[11]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫ পৃঃ।

[12]. তাহযীবুল কামাল ৩/৪১৩ পৃঃ।

[13]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৬ পৃঃ।

[14]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/৭৫ পৃঃ।।

[15]. নুশরাতি আত-তা‘রীফ ৮৫ পৃঃ।



বিষয়সমূহ: আমল
আরও