একজন আদর্শবান ব্যক্তির গুণাবলী (৫ম কিস্তি)
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম
মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন নে‘মতরাজি দিয়ে ধন্য করেছেন। বরকত হ’ল মহান আল্লাহর নিকট থেকে অতিরিক্ত প্রাপ্তির একটি বিষয়। মানুষ দুনিয়াতে হয় বরকত লাভে ধন্য হয়, নতুবা বরকতশূন্যভাবে জীবনযাপন করে। নিম্নে আমরা বরকত কি এবং কিভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত লাভ করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
বরকত কি?
الْبَرَكَةُ শব্দটির অর্থ হ’ল النماء والزيادة অতিরিক্ত, প্রাচুর্যতা। অন্তরের মধ্যে প্রবল লোভ, তীব্র লালসা, স্বার্থপরায়ণতা, অতৃপ্ত থাকা, অতিরিক্ত আত্মম্ভরিতা, অত্যধিক মতলবী হওয়া, বিদ্বেষ ও অমঙ্গল, দরিদ্র্যতা বা দীনতা, উদ্বেগ ও অস্বস্তিকর অবস্থা এবং অশান্ত মনোভাব বিরাজ করার বিপরীতে অধিকতর কল্যাণ ও মঙ্গল অর্থাৎ সুস্বাস্থ্য, সুখ, সুস্থতা, তৃপ্তি এবং মনের মধ্যে নিরাপত্তা, আরাম ও প্রশান্তি অনুভব করা এবং সর্বপ্রকার ভয় ও উদ্বেগ হ’তে নিরাপত্তার উপলব্ধির নাম হ’ল বরকত।
এটি এমন একটি এলাহী কল্যাণ, যা বান্দার উপর নাযিল করা হয়। বরকত হ’ল মহান আল্লাহর এমন গোপন সেনাবাহিনী, যা মানুষের অলক্ষ্যেই তার জীবনে পরিলক্ষিত হয়। পাপী হৃদয় কখনো বরকতের এই অনুপম স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না। কেবল ‘কালবুন সালীম’ বা নিষ্কুষ আত্মা এর যথাযথ প্রাপ্তির হকদার।
আল্লাহ সব বরকতের উৎস : তাওহীদী বিশ্বাসই একক সত্ত্বা মহান আল্লাহর সব বরকতের উৎসস্থল। সেখান থেকেই বান্দাদের প্রতি বরকতের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। তিনি যাকে ইচ্ছা বরকত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তা থেকে বঞ্চিত করেন। সব বরকত ও কল্যাণের অধিকারী মহান আল্লাহ বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সকল রাজত্ব এবং তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (মুলক ৬৭/১)।
বরকতময় জীবনের প্রার্থনা : বরকত বান্দার জন্য চাওয়ার ও পাওয়ার বিষয়। কেবল সম্পদের প্রাচুর্য, সন্তান-সন্ততির আধিক্য ও দীর্ঘ জীবন লাভ মুমিনের কাছে ‘বরকত’ নয়, যদি তা উপকারী ও কল্যাণকর না হয়। মুমিনের কাছে বরকতময় জীবন অবশ্যই কাম্য। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কাছে বরকত লাভের দো‘আ করতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَيْنَا أَيُّوبُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا فَخَرَّ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ ، فَجَعَلَ أَيُّوبُ يَحْتَثِى فِى ثَوْبِهِ، فَنَادَاهُ رَبُّهُ يَا أَيُّوبُ، أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتُكَ عَمَّا تَرَى قَالَ بَلَى وَعِزَّتِكَ وَلَكِنْ لاَ غِنَى بِى عَنْ بَرَكَتِكَ ‘একদিন আইয়ূব (আঃ) কাপড় খুলে গোসল করছিলেন। তখন তাঁর ওপর সোনার পঙ্গপাল এসে পড়ছিল এবং তা কুড়িয়ে কাপড়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর প্রতিপালক তাঁকে ডেকে বললেন, তুমি যা দেখেছ আমি কি তা থেকে তোমাকে অমুখাপেক্ষী করিনি। তিনি বললেন, আপনার সম্মানের কসম! অবশ্যই করেছেন। কিন্তু আপনার বরকত থেকে আমি অমুখাপেক্ষী নই’।[1] এ জন্য রাসূল (ছাঃ) সম্পদ বৃদ্ধির দো‘আ না করে প্রাপ্ত সম্পদের কল্যাণ ও সুফল বৃদ্ধির দো‘আ করতেন। রাসূল (ছাঃ)-এর শিখানো দো‘আ কুনূতের মধ্যে বরকতের স্বরূপ স্পষ্টরুপে ফুটে উঠেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি যাদেরকে সুপথ দেখিয়েছ, আমাকে তাদের মধ্যে গণ্য করে সুপথ দেখাও। যাদেরকে তুমি মাফ করেছ, আমাকে তাদের মধ্যে গণ্য করে মাফ করে দাও। তুমি যাদের অভিভাবক হয়েছ, তাদের মধ্যে গণ্য করে আমার অভিভাবক হয়ে যাও।وَبَارِكْ لِى فِيمَا أَعْطَيْتَ ‘তুমি আমাকে যা দান করেছ, তাতে বরকত দাও’। তুমি যে মন্দ ফায়ছালা করে রেখেছ, তার অনিষ্ট হ’তে আমাকে বাঁচাও। কেননা তুমি সিদ্ধান্ত দিয়ে থাক, তোমার বিরুদ্ধে কেউ সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তুমি যার সাথে বন্ধুত্ব রাখ, সে কোনদিন অপমানিত হয় না। আর তুমি যার সাথে দুশমনী কর, সে কোনদিন সম্মানিত হ’তে পারে না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি বরকতময় ও সর্বোচ্চ মর্যাদাবান’।[2]
রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, وَإِنَّ هَذَا الْمَالَ حُلْوَةٌ، مَنْ أَخَذَهُ بِحَقِّهِ وَوَضَعَهُ فِى حَقِّهِ، فَنِعْمَ الْمَعُونَةُ هُوَ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِغَيْرِ حَقِّهِ، كَانَ الَّذِى يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ. ‘এ পৃথিবীর ধনদৌলত সুমিষ্ট। যে ব্যক্তি তা সৎভাবে গ্রহণ করবে এবং সৎভাবে ব্যয় করবে, তা তার জন্য খুবই উপকারী (বরকতময়) হবে। আর যে তা অন্যায়ভাবে গ্রহণ করবে, সে ঐ ব্যক্তির মত যে খেতে থাকে কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না’।[3]
মুমিন জীবনে বরকত : মহান আল্লাহ বলেন, قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا-وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا- ‘শিশুটি (ঈসা আঃ) বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আর তিনি আমাকে বরকতমন্ডিত করেছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন এবং তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ছালাতের ও যাকাতের যতদিন আমি বেঁচে থাকি’ (মারইয়াম ১৯/৩১)। দুনিয়াতে সকল নবী-রাসূলই বরকতময় জীবনের আদর্শ পুরুষ। অতএব মুমিন-মুসলমান তাদের অনুসৃত পথে চলতে পারলেই বরবকতময় সুখী জীবন লাভ করতে পারবে অন্যথায় নয়। মুমিন জীবনে বরকত প্রাপ্তির প্রকৃতি নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।
সময় ও সুস্থতায় বরকত : মহান আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের উপরে সবচেয়ে বড় নে‘মত হ’ল অবসর সময় ও সুস্থতা। দেহ-মন সুস্থ না থাকলে দুনিয়ার অন্য সকল নে‘মত ও বরকত অকেজো হয়ে পড়ে। সকল ইবাদতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন মানুষ অবসর ও সুস্থতা নিয়ে আফসোস করতে থাকে। পুনরায় সেগুলো ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু সে ফুরছত আর কয়জনের জীবনেই বা মিলে।
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো অবসর সময়। মানুষের জীবনটাই সময়ের সাথে বাধা। একটা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে। সময়ের মধ্যেও মহান আল্লাহ বরকতের বারিধারা বর্ষণ করেন। যেমন একজন ব্যক্তির দশ ঘন্টা ঘুমিয়েও তার ক্লান্তি দূর হয় না, অলসতা বোধ করে। অথচ তার পাশেই আরেকজন ভাই পাঁচ ঘন্টা ঘুমিয়েও পূর্ণ তৃপ্তি অনুভব করে। সকালে সে ঘুম থেকে তরতাজা শরীর ও মন নিয়ে শয্যা ত্যাগ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ ‘এমন দু’টি নে‘মত আছে, যে দু’টোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর’।[4]
রূযীতে বরকত : মানুষের জীবনধারণের অন্যতম মাধ্যম মহান আল্লাহর বন্টনকৃত রূযী। এই রূযীও অনেক সময় বরকতশূন্য হয়ে পড়ে বান্দার পাপের কারণে। সমাজের অনেক বিত্তশালী, ধনী, বড় চাকুরীজীবীকে দেখা যায় তার নুন আনতে পান্না ফুরানোর দশা। কিন্তু পাশেই জীর্ণশীর্ণ পর্ণ কুটিরে বসবাসরত অনেক দিনে আনে দিন খাওয়া মানুষের সন্ধান মিলবে যাদের স্বল্প কামাই কিন্তু বরকতময় সুখী জীবন। দিন চলে যায়। কিন্তু কারো নিকটে হাত পাততে হয় না। আর বিত্তশালীর ঘাড়ে ঋণের বোঝা। এত কামাই তবুও তার সংসারে অভাব দূর হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِى أَمْلأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ وَإِلاَّ تَفْعَلْ مَلأْتُ يَدَيْكَ شُغْلاً وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ. ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর, আমি তোমার অন্তরকে ঐশ্বর্যে পূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। আর তুমি তা না করলে আমি তোমার দুই হাত কর্মব্যস্ততায় পরিপূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব-অনটন দূর করবো না’।[5]
ইলমে বরকত : ইলম বা জ্ঞানে বরকতের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। উপকারী ইলমের অধিকারী আলেমদের কাছে জাতি সর্বদা উপকৃত হয়। কিন্তু রিয়া বা লৌকিকতা, সুখ্যাতি প্রাপ্তির দোষে দুষ্ট বরকতহীন আলেমের জন্য কিয়ামতের মাঠে তার বিদ্যা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। একজন মুসলিম আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকতপ্রাপ্ত হলে সে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করবে। ইলম তথা শিক্ষা ও ঈমানের মাধ্যমে প্রাণবন্ত অন্তর লাভ করবে।
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-এর ঘরে ছিলেন। রাতে আমি তাঁর জন্য ওযূর পানি তৈরী করে রাখলাম। মায়মূনা (রাঃ) তাঁকে বললেন, এটা আব্দুল্লাহ ইবন আববাস রেখেছে। তিনি দো‘আ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করো’।[6] আল্লাহ তাঁর এ দো‘আ কবুল করেছিলেন পরবর্তীতে সত্যিই রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আর প্রতিফলন আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রাঃ)-এর মধ্যে বিশ্ববাসী দেখেছে।
বরকতময় ইলমের অধিকারী ব্যক্তির একমাত্র লক্ষ্য থাকবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। তার ইলম যদি দুনিয়াবী লোভের রং-তামাশার স্রোতে ভেসে যায়, তাহলে নিজে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তার বিদ্যা কোন কাজে আসবে না। একটি আয়াত বা হাদীছ জানা থাকলেও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। রিয়া ও সুম‘আর মত ভাইরাসে যদি কোন আলেম আক্রান্ত হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার ইহকালও শেষ এবং পরকালও শেষ। বরকতশূন্য কষ্টকর জীবন তাকে আলিঙ্গন করবে।
বাড়িতে বরকত : নিজের বাড়িও বরকত নাযিলের একটি অন্যতম জায়গা। প্রতিটি বাড়িতে বরকতের ফেরেশতা অথবা শয়তান বসবাস করে। মহান আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, وَقُلْ رَبِّ أَنْزِلْنِي مُنْزَلًا مُبَارَكًا وَأَنْتَ خَيْرُ الْمُنْزِلِينَ ‘আরও বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে কল্যাণকরভাবে অবতরণ করাও। আর তুমিই শ্রেষ্ট অবতারণকারী’ (মুমিনূন ২৩/২৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاَثَةٌ وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاَثَةٌ مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ وَالْمَسْكَنُ الصَّالِحُ وَالْمَرْكَبُ الصَّالِحُ وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ الْمَرْأَةُ السُّوءُ وَالْمَسْكَنُ السُّوءُ وَالْمَرْكَبُ السُّوءُ. ‘বনী আদমের সৌভাগ্য রয়েছে তিনটি জিনিসে-পার দ্বীনদার সহধর্মিণী, ভাল (বরকতময়) বাড়ি ও ভাল যানবাহন এবং দুর্ভাগ্য রয়েছে তিনটি জিনিসে- অসৎ সঙ্গিনী, খারাপ (বরকতহীন) বাড়ি এবং যানবাহন’।[7]
বরকত লাভের উপায়সমূহ
১. তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি : তাকওয়ার ছায়াতলেই সকল কল্যাণ, সৌভাগ্য ও বরকতের বসবাস। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে তাকে যথাযথ ভয় করলে তিনি বান্দার প্রতি বরকত বা কল্যাণ দান করেন। আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মরো না (আলে ইমরান ৩/১০২)। মহান আরো বলেন, وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের দরজা খুলে দিতাম। কিন্তু তা না করে তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকমের দরুণ’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করবেন’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)।
যখনই একজন মানুষ সব হারাম থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করে এবং সব বিষয়ে বেশী বেশী আল্লাহকে ভয় করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা ওই বান্দার জন্য আসমান ও যমীনের সব বরকতের দুয়ার খুলে দেন।
২. তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা : আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখাকে তাওয়াক্কুল বলে। এর দ্বারাও জীবনের পেরেশানী দূর হয়। কাজে-কর্মে বরকত লাভ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার আদেশ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন’ (তালাক্ব ৬৫/৩)। হাদীছে কুদসীতে এসেছে, يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِى بِى، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِى، فَإِنْ ذَكَرَنِى فِى نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِى نَفْسِى، وَإِنْ ذَكَرَنِى فِى مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِى مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِى يَمْشِى أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً. আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি সেই রূপই, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে আমিও তাকে নিজে স্বরণ করি। আর যদি সে লোক-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তবে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’হাত অগ্রসর হই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দৌঁড়ে অগ্রসর হই। [8] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا. ‘যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহর ওপর ভরসা করতে, তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাদের পাখির মতো রিজিক দান করতেন। ভোরবেলা পাখিরা খালি পেটে (বাসা থেকে) বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলা উদর পূর্তি করে (বাসায়) ফিরে আসে’।[9]
মুমিন যত বেশী আল্লাহর ওপর ভরসা করবে তত বেশী সে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি আস্থা, নির্ভরতা বা ভরসা যত বেশী কমবে, সে তত বেশী অপমাণিত ও লাঞ্ছিত হবে।
বিপদে অনেকেই আল্লাহর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় আল্লাহ সম্পর্কে নানান মন্তব্যও করে বসেন। না তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মহান আল্লাহ সকল বরকতের উৎসস্থল। তিনি যদি কোন বান্দার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান, তাহলে সে বান্দার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অতএব তাকদীরের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাসকে দৃঢ় রেখে মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করতে পারলে সে মুমিনের জীবন বরকতময় হয়ে উঠবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
৩. জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপন : এই ফিৎনা-ফাসাদপূর্ণ দুনিয়ায় আল্লাহর রহমত-বরকত পেতে জামা‘আতবদ্ধ তথা সাংগঠনিক জীবনযাপনের বিকল্প নেই। জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য স্বীয় উম্মতকে রাসূল (ছাঃ) যোর তাকীদ দিয়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الاِثْنَيْنِ أَبْعَدُ مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ مَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَذَلِكَ الْمُؤْمِنُ. ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হতে সাবধান থেকো। কেননা, শয়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দু’জন হতে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচাইতে উত্তম জায়গার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে। যার সৎআমল তাকে আনন্দিত করে এবং বদআমল কষ্ট দেয় সেই হলো প্রকৃত ঈমানদার’।[10]
হাদীছে এসেছে, حَدَّثَنِي وَحْشِيُّ بْنُ حَرْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ أَصْحَابَ النَّبِيِّ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا نَأْكُلُ وَلَا نَشْبَعُ، قَالَ: فَلَعَلَّكُمْ تَفْتَرِقُونَ؟ قَالُوا نَعَمْ، قَالَ فَاجْتَمِعُوا عَلَى طَعَامِكُمْ، وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ يُبَارَكْ لَكُمْ فِيهِ» قَالَ أَبُو دَاوُدَ إِذَا كُنْتَ فِي وَلِيمَةٍ فَوُضِعَ الْعَشَاءُ فَلَا تَأْكُلْ حَتَّى يَأْذَنَ لَكَ صَاحِبُ الدَّارِ» ‘ওয়াহশী ইবনু হারব থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত, একদা নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা খাবার খাই, কিন্তু পরিতৃপ্ত হতে পারি না। তিনি বললেন, হয় তো তোমরা বিচ্ছিন্নভাবে খাও। তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা একত্রে আহার করো এবং খাদ্য গ্রহণের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করো, তাহলে তোমাদের খাদ্যে বরকত দেয়া হবে। ইমাম আবু দাঊদ (রহঃ) বলেন, যদি তোমাকে কোথাও দাওয়াত করা হয় এবং খাবার সামনে রাখা হয় তাহলে বাড়ির কর্তা অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত খাওয়া শুরু করবে না’।[11] রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, يَدُ اللَّهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ ‘জামা‘আত বা সংগঠনের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে’।[12] অর্থাৎ জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপনের মধ্যেই আল্লাহর বরকত নিহিত। কেননা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন হ’ল আযাবের এবং জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপন হ’ল রহমতের।
জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপনের শিক্ষা রাসূল (ছাঃ) ইসলাম আসার পূর্বেই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। যখন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়নি তার পূর্বেই মাযলূম মানবতার বৃহত্তর কল্যাণের কথা মাথায় রেখে তিনি ‘হিলফুল ফুযূল’ সংগঠন কায়েম করেছিলেন। তিনি এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমাজ সংস্কারের মত মহান দায়িত্ব পালন করতে গেলে একাকী কখনো সম্ভব নয়। তা না হ’লে বাতিল খুব সহজেই ঘাড় মটকাবে। বাতিলের চাপিয়ে দেওয়া সর্বগ্রাসী বিপদ থেকে মহান আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও বরকতের খুবই প্রয়োজন। আর তা অর্জিত হ’তে পারে মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপনের মাধ্যমেই। মা খাদীজা (আঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যে তা সহজেই অনুমেয়। মা খাদীজা (আঃ) বলেন, كَلاَّ وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتَكْسِبُ الْمَعْدُومَ، وَتَقْرِى الضَّيْفَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ. ‘আল্লাহর কসম, কখনই নয়। আল্লাহ্ আপনাকে কখনও লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায়-দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথে থাকা দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন’।[13]
৪. কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো : কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো খুবই যরূরী। কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন এবং কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়ার মাধ্যমে বরকত অর্জিত হয়। যে যত বেশী কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াবে তার জন্য তত বেশী বরকত নেমে আসবে।
যে ঘরে কুরআন তেলাওয়াত হবে, কুরআনের চর্চা হবে, কুরআনের ওপর আমল করা হবে, সে ঘরেই নেমে আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত ও কল্যাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘আর এই কিতাব (কুরআন) আমরা নাযিল করেছি যা বরকতমন্ডিত। সুতরাং এটির (আদেশ সমূহ) অনুসরণ কর এবং (নিষেধ সমূহে) ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হতে পার’ (আনা‘আম ৬/১৫৫)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করি, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও রহমত স্বরূপ। কিন্তু পাপীদের জন্য তা কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৮২)।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠে রহমত ও বরকতের কথা পবিত্র সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে সূরা কাহাফ পাঠ করার ফলে এক ছাহাবীর বাড়িতে মেঘমালা সদৃশ বরকত নাযিল হয়েছিল যা আমাদের সকলেরই জানা। হাদীছে এসেছে, قَالَ بَيْنَمَا رَجُلٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَقْرَأُ، وَفَرَسٌ لَهُ مَرْبُوطٌ فِى الدَّارِ، فَجَعَلَ يَنْفِرُ، فَخَرَجَ الرَّجُلُ فَنَظَرَ فَلَمْ يَرَ شَيْئًا، وَجَعَلَ يَنْفِرُ، فَلَمَّا أَصْبَحَ ذَكَرَ ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ تِلْكَ السَّكِينَةُ تَنَزَّلَتْ بِالْقُرْآنِ. নবী করীম (ছাঃ)-এর জনকৈ ছাহাবী কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তাঁর একটি ঘোড়া ঘরে বাঁধা ছিল। হঠাৎ তা পালাতে লাগলো। সে ব্যক্তি বেরিয়ে এসে দৃষ্টিপাত করলেন। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। ঘোড়াটি পালিয়েই যাচ্ছিল। যখন ভোর হলো তখন তিনি ঘটনাটি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে ব্যক্ত করলে তিনি বললেন, এ হলো সেই সাকীনা বা প্রশান্তি, যা কুরআন তিলাওয়াত করার সময় অবতীর্ণ হয়ে থাকে’।[14]
যারা কুরআনুল কারীমের অনুসরণ করবেন, তাদের জন্য এ কিতাব হবে বরকতের কারণ। আর যারা এ থেকে দূরে সরে যাবে, তা হবে তাদের জন্য অমঙ্গলের কারণ।
৫. প্রতিটি কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা : শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শক্র। মহান আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি নে‘মত-বরকতে অংশগ্রহণ করে তাতে ভাগ বসাতে চায় এবং তা নষ্ট করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় এবং সবার অলক্ষ্যে তা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালায়। কিন্তু অনেক সময় আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না। এজন্য রাসূল (ছাঃ)-এর রক্ষাকবচ হিসাবে আমাদের মহান আল্লাহর নামের কালিমা ‘বিসমিল্লাহ’ শিখিয়েছেন। যখন কোন খাবার খায় আর যদি বিসমিল্লাহ বলে, তবে শয়তান ওই খাবারে অংশ নিতে পারে না। যেটুকু খাবার আছে তা (পরিমাণে কম হলেও) তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। অনুরূপভাবে কেউ যদি ঘরে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে তখনও শয়তান তার সঙ্গে বাসায় ঢুকতে পারে না। এভাবে বান্দা যখন সব কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে, তখন শয়তান সব কিছু থেকে মাহরূম হয়। আর আল্লাহ তা‘আলা সব কাজেই বরকত দান করেন।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ لاَ مَبِيتَ لَكُمْ وَلاَ عَشَاءَ. وَإِذَا دَخَلَ فَلَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ. وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ. ‘যখন কোন লোক তার গৃহে প্রবেশ করে এবং প্রবেশকালে ও আহারকালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, তখন শয়তান তার সাথীদের বলে, তোমাদের (এখানে) রাত্রি যাপনও নেই, খাওয়াও নেই। আর যখন সে প্রবেশ করে কিন্তু প্রবেশকালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তখন শয়তান বলে, তোমরা রাত্রিবাসের (থাকার) জায়গা পেয়ে গেলে। আর যখন সে আহারের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তখন সে বলে, তোমাদের রাত্রি যাপন ও রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হল’।[15] বরকতের জন্য যদি কেউ খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায়। তাহলে ইসলাম সে বিষয়ে প্রতিষেধক স্বরূপ ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখেরাহু’ বলতে শিখিয়েছেন। এ বিষয়ে একটি মজাদার হাদীছ এসেছে, إِنَّ رَجُلًا كَانَ يَأْكُلُ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْظُرُ فَلَمْ يُسَمِّ اللَّهَ حَتَّى كَانَ فِي آخِرِ طَعَامِهِ فَقَالَ بِسْمِ اللَّهِ أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا زَالَ الشَّيْطَانُ يَأْكُلُ مَعَهُ حَتَّى سَمَّى فَمَا بَقِيَ فِي بَطْنِهِ شَيْءٌ إِلَّا قَاءَهُ ‘রাসূল (ছাঃ) দেখল, একদিন জনৈক ব্যক্তি ‘বিসমিল্লাহ’ না পড়েই খাওয়া শুরু করল, অবশেষে তার খাওয়া যখন প্রায় শেষ এমতাবস্থায় সে ‘বিসমিল্লাহি আওওয়ালাহূ ওয়া আ-খিরাহূ’ (খাবারের প্রথমে এবং শেষে আল্লাহর নামে) বলল। তার অবস্থা দেখে নবী করীম (ছাঃ) অতঃপর বললেন, এতক্ষণ পর্যন্ত শয়তান ঐ লোকটির সঙ্গে খাচ্ছিল। আর যখনই সে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করল, তখনই শয়তান তার পেটের মধ্যে যা কিছু ছিল, তা উগরে করে দিল’।[16] অপর হাদীছে এসেছে, عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ البَرَكَةُ تَنْزِلُ وَسَطَ الطَّعَامِ، فَكُلُوا مِنْ حَافَتَيْهِ، وَلَا تَأْكُلُوا مِنْ وَسَطِهِ ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, খাদ্যের মাঝখানে বরকত নাযিল হয়। অতএব তোমরা এর কিনারা হতে খাওয়া আরম্ভ কর, মাঝখান হতে খেও না’।[17]
৬. সকাল সকাল প্রতিটি কাজ শুরু করা : সকালের বরকতময় সময়ে ছোট বা বড় যে কোন কাজ দিয়ে আমাদের দিনটা শুরু হওয়া উচিৎ। তাহলে প্রতিটি কাজই আমাদের ফলপ্রসূ হবে। কথায় আছে, ‘সকালের হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া’। অথচ সকালে ঘুমানো আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন সকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত নাযিল হয়, তখন আমরা ঘুমে বিভোর থাকি। আর এজন্য একটি জাতি অর্থব ও পঙ্গু হয়ে যাওয়ার জন্য এই একটি মাত্র বাজে অভ্যাসই যথেষ্ট। অথচ সুন্নাত হচ্ছে ফজরের পর না ঘুমিয়ে যিকর-আযকারে সময় ব্যয় করা। কেননা রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেছেন, اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরু (সকাল) বরকতময় করুন।’ র্বণনাকারী বলেন, ‘এ জন্যই রাসূল (ছাঃ) কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। আর ছাখার (রাঃ) ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনিও তাঁর ব্যবসায়িক কার্যক্রম ভোরবেলা শুরু করতেন। এতে তাঁর ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয় এবং তিনি সীমাহীন প্রাচুর্য লাভ করেন’।[18]
সালাফরা ফজরের পর ঘুমানোকে মাকরূহ মনে করতেন। উরওয়া (রহঃ) বলেন, إِنِّي لَأَسْمَعُ بِالرَّجُلِ يَتَصَبَّحُ فَأَزْهَدُ فِيهِ ‘আমি যখন কারো সর্ম্পকে শুনি যে সে ভোরবেলা ঘুমায়, তখন তার প্রতি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি’।[19]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর এক সন্তানকে ভোরবেলা ঘুমাতে দেখে বলেছিলেন, أتنام في الساعة التي تُقسَّم فيها الأرزاق؟ ‘উঠ! তুমি কি এমন সময়ে ঘুমিয়ে আছ, যখন রিযিক বণ্টন করা হয়? [20]
৭. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা : আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণ নেমে আসে। আত্মীয়-স্বজন তথা মা-বাবা, ভাই বোন তথা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। অথচ বর্তমান সমাজে এর বিপরীতটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আত্মীয়দের কেউ খারাপ আচরণ করলেও তাদের সঙ্গে নিজ থেকে সুসম্পর্ক রাখা মুমিনের কর্তব্য। হাদীছে এসেছে, أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِى قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِى وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَىَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَىَّ. فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلاَ يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ. ‘এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্বন্ধ রক্ষা করি; কিন্তু তারা আমার সাথে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সঙ্গে সহনশীল ব্যবহার করি আর তারা আমার সঙ্গে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, তুমি যা বললে, যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয় তাহলে তুমি যেন তাদের উপর গরম ছাই নিক্ষেপ করছ। সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফিরিশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এই অবস্থায় বহাল থাকবে’।[21] সুতরাং মুমিনের কর্তব্য হবে, সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য করা। সাহায্য করতে না পারলে তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। আর এর মাধ্যমে নেমে আসবে বরকত ও কল্যাণ। আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখলে আল্লাহ তা‘আলা জীবনে ও রিযিকে অফুরন্ত বরকত দান করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি পসন্দ করে যে তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তার মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে’।[22]
৮. বেচাকেনায় সততা : সৎভাবে ব্যবসা করা ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত। যারা ব্যবসায় সততা বজায় রাখে, মহান আল্লাহ তাদের বরকত দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের এখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা)। যদি তারা সত্য বলে এবং অবস্থা ব্যক্ত করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে; আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়’।[23]
৯. সালাম দেওয়া : সালাম মহান আল্লাহর একটি ছিফাতী নাম, যার অর্থ হ’ল মনে প্রশান্তিদাতা। সকল শান্তি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। দুনিয়ায় সবকিছুই মানুষ করে একটু সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই সুখ-শান্তি আজকে কোথায়? কবি বলেন, সুখ সুখ বলে তুমি কেন কর হা-হুতাশ, সুখ তো পাবে না কোথা বৃথা সুখের আশ’।
মুসলমানরা পরস্পরে সাক্ষাৎ হ’লে সালাম তথা শান্তির দো‘আ করবে অর্থাৎ সালাম করবে। তাতেই মহান আল্লাহর বরকত, রহমত ও সুখ-শান্তি বান্দা অনুভব করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দেব, যার উপর আমল করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। (তা হলো) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে’।[24]
১০. দান করা : বেশী বেশী দান ও সাহায্য-সহযোগিতায় বরকত নেমে আসে। দানের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বিপদ-মুছীবত দূর করে দেন। বান্দার উপর বেশী বেশী বরকত নাযিল করেন। সে কারণেই সব কাজে বরকত লাভে বেশী বেশী দান করা উচিৎ। হাদীছে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন, قَالَ اللَّهُ أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ أُنْفِقْ عَلَيْكَআল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি খরচ করো, আমিও তোমার জন্য খরচ করব’।[25]
আসলে বান্দা উপর মহান আল্লাহ কিভাবে খরচ করবেন? মূলতঃ এর তাৎপর্য হলো বান্দার রুযীতে বহুগুণে বরকত বাড়িয়ে দিয়ে তা পুষিয়ে দেওয়া হবে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে দান করার কিছু যদি না থাকে তবে একটি খেজুরের অংশ দিয়ে হলেও দান করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে বলেছেন।
প্রত্যেক সকালে দানশীল বা কৃপণ নির্ধারণ করার জন্য ফেরেশতাদের মহান আল্লাহ যমীনে নামিয়ে দেন। তারা দানশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির দো‘আ করে এবং কৃপণের ধ্বংস কামনা করে। তাই প্রত্যহ সকালবেলা দান দিয়ে শুরু হৌক আমাদের পথচলা।
১১. বেশী বেশী ইসতেগফার করা : জীবনে বরকত লাভের অন্যতম আমল হ’ল বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর কোনো হিসাব বা সংখ্যা বা সময় নির্ধারণ করে করা যাবে না। বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই ইসতেগফার করতে হবে। অন্তত এটুকু বলা উচিৎ- اَسْتَغْفِرُاللهু اَسْتَغْفِرُالله। রাসূল (ছাঃ) দিনেরাতে একশরও অধিকবার মহান আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। মহান আল্লাহ বলেন, فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا - يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا - وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا ‘অতঃপর বলেছি, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ৭১/১০-১২)
কেননা বান্দার পাপের জন্য বরকত নষ্ট হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নেকীর কাজে আয়ু বাড়ে, দো‘আই ভাগ্য প্রতিহত করে, বান্দার পাপের কারণে জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়’।[26] তাই সবসময় ইসতেগফার পড়ার মাধ্যমে দুনিয়ার বরকত ও কল্যাণ লাভ করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
১২. দো‘আ করা : দো‘আ সকল বরকত ও কল্যাণ হাছিলের এক অনন্য মাধ্যম। বান্দা সর্বদা দো‘আ করার মাধ্যমে বরকত লাভের জন্য তার জিহবাটা সবসময় ভিজিয়ে রাখবে। দো‘আর বিষয়টি পুরো জীবন তথা সাংসারিক, পারিবারিকসহ পার্থিব জীবনের চলায়-বলায় সর্বত্র প্রয়োজন হয়। অনেকেই দো‘আ করতে অভ্যস্ত নয়। আবার কেউ দো‘আ করতে করতে হতাশ হয়ে পড়ে। দো‘আ এমনটা একটি বিষয় যার ফলাফল ইহকালে অথবা মহান আল্লাহ নিজ হাতে দো‘আকারীকে দান করবেন। শুধু নিজে দো‘আ করা নয় বরং অন্য দ্বীনদার-পরহেযগার মানুষের নিকট থেকে বরকতের দো‘আ চেয়ে নিতে হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, সুলাইম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনু বুসর (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার পিতার ঘরে এলে তিনি তাঁর সামনে খাদ্য পরিবেশন করলেন। তিনি ‘হাইস’ নামক খাবারের কথা উল্লেখ করলে তা তাঁর কাছে নিয়ে আসা হ’ল। অতঃপর তিনি শরবত আনলেন এবং নবী (ছাঃ) তা পান করলেন। তারপর ডান দিক হ’তে পরিবেশন করা হলো। তিনি খেজুর খেলেন এবং বিচিগুলো তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলের পেটের ওপর রাখলেন। যখন তিনি বিদায় নিতে উঠলেন, আমার পিতাও দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর জন্তুযানের লাগাম ধরে বলেন, আল্লাহর কাছে আমার জন্য দো‘আ করুন। তিনি দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! তাদের দেওয়া রিযিকে বরকত দিন, তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন’।[27]
১৩. ইস্তিখারা করা : ইস্তিখারা বলা হয় ছালাত ও দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে কোনো বিষয়ের কল্যাণ চাওয়া। এর মাধ্যমেও বরকত অর্জিত হয়। জীবনের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইস্তিখারার মাধ্যমে মহান আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া প্রতিটি মানুষের উচিৎ। কেননা যেকোন বিষয়ের ভালমন্দের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ। তার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত তালাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। তাতে মা‘বূদ ও বান্দার মাঝে এক অনন্য সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যা বান্দার জন্য পুরোটা কল্যাণকর। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ সালামি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ছাহাবাদের সব কাজে এভাবে ইস্তিখারার শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি তাদের কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন’।[28]
উপসংহার : মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বান্দার জন্য সর্বত্র বরকত ছিটিয়ে রেখেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর শিখানো প্রতিটি কথাকর্মই বরকতে পরিপূর্ণ। সকল মুমিনকে রাসূল (ছাঃ)-এর বাতলিয়ে দেওয়া বরকতময় পথ-মতকে অগ্রাধিকার ও সৎ আমল-আখলাকের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের চেষ্টা চালাতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/২৭৯; মিশকাত হা/৫৭০৭।
[2]. আবুদাউদ হা/১৪২৫; মিশকাত হা/১২৭৩।
[3]. বুখারী হা/৬৪২৭; মিশকাত হা/৫১৬২।
[4]. বুখারী হা/৬৪১২; মিশকাত হা/৫১৫৫।
[5]. তিরমিযী হা/২৪৬৬; মিশকাত হা/৫১৭২।
[6]. আহমাদ হা/৩০৩৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫৮৯।
[7]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/২৬৪০।
[8]. বুখারী হা/৭৪০৫; মিশকাত হা/২২৬৫।
[9]. তিরমিযী হা/২৩৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৪১৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৯।
[10]. তিরমিযী হা/২১৬৫; মুসতাদরাকে হাকেম হা/৩৮৭।
[11]. আবুদাউদ হা/৩৭৬৪।
[12]. তিরিমিযী হা/২১৬৬।
[13]. বুখারী হা/৩; মিশকাত হা/৫৮৪১।
[14]. বুখারী হা/৪৮৩৯; মিশকাত হা/২১১৭।
[15]. মুসলিম হা/২০১৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৮৭; মিশকাত হা/৪১৬১।
[16]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/৭০৮৯।
[17]. তিরমিযী হা/১৮০৫; মিশকাত হা/৪২১১।
[18]. তিরমিযী হা/২৬০৬; মিশকাত হা/৩৯০৮।
[19]. মুছান্নাফ ইবন আবী শায়বাহ ৫/২২২ পৃঃ।
[20]. যাদুল মা‘আদ ৪/২৪১ পৃঃ।
[21]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯২৪।
[22]. বুখারী হা/২০৬৭; মিশকাত হা/৪৯১৮।
[23]. বুখারী হা/২০৭৯; মিশকাত হা/২৮০২।
[24]. আবুদাউদ হা/৫১৯৩; মিশকাত হা/৪৬৩১।
[25]. বুখারী হা/৫৩৫২; মিশকাত হা/১৮৬২।
[26]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/১৮১৪; ইবনে মাজাহ হা/৪০২২; মিশকাত হা/৪৯২৫।
[27]. আবুদাউদ হা/৩৭২৯।
[28]. বুখারী হা/৭৩৯০; মিশকাত হা/১৩২৩।