রোহিঙ্গাদের পর মিয়ানমার সামরিক জান্তার কবলে এবার কারা?

শামসুল আলম 1484 বার পঠিত

ভূমিকা  :

‘কথায় বলে,  অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’

এই লাইন দু’টির মূল ভাব হল, যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ করল আর যদি অন্য মানুষ তা দেখে চুপ থাকে কিংবা সমর্থন করে তাহলে উভয়ই সমান অপরাধী। এর ফলাফল সকলকে ভোগ করতে হয়। এরই বাস্তব প্রমাণ সম্প্রতি আমাদের পার্শবর্তী দেশ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক এবার সে দেশেরই জনগণের উপর হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের লোমহর্ষক চিত্র, যারা সকলে মিলে একসময় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই সময়ের প্রধান নরখাদক সিনিয়র জেনারেল হ্লাইং সেনা শাসনের মাধ্যমে সে দেশেরই এবার নিজ ঘরের সুসন্তানকে (?) বন্দী রেখে সাধারণ জনগণের উপর হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে দেশছাড়া করছে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। এবার সে দেশের বেŠদ্ধ সম্প্রদায়সহ বিরোধী সাধারণ জনগণ আশ্রয় নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড ও ভারতে।

নোবেল বিজয়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী অং সান সুচি যে আন্তর্জাতিক আদালত হেগে (নেদারল্যান্ড) কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে সকলের সম্মুখে বলেছিলেন তার দেশের সরকার ও  সেনা প্রধানসহ কোন সামরিক সদস্য গণহত্যা কিংবা রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা নির্যাতনের সাথে জড়িত নয়। অথচ সেই সুচির দলের নিরঙ্কুশ বিজয় শেষে ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক ঘন্টা পূর্বে ফেব্রুয়ারী ২০২১ তারিখে নির্বাচনে কারচুপির দোহাই দিয়ে সে দেশের সামরিক জেনারেলরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বন্দী করেছে হাযার হাযার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিরোধীমত পন্থীদের। শতশত নর-নারী হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সে দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের খুশী করার জন্য ও রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য যে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা হল, শেষমেষ সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভোটে পাশ করেও সুচী ক্ষমতার মুখ তো দূরের কথা আমানবিকভাবে এখন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর, ভাগ্যের কেমন নির্মম পরিহাস, যেই জেনারেলদের পক্ষে সুচি মিথ্যা সাফাই গেয়েছিলেন সেই জেনারেলরাই তাকে আবার কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।

কেন এমনটা হল মিয়ানমারে। অতীত ইতিহাস কী বলে, একটি গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘাড়ে অবস্থানরত ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের ভবিষ্যত কী, আর মিয়ানমারের ভবিষ্যতও বা কী হতে যাচ্ছে? মিয়ানমারের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির চুলচেরা বিশ্লেষণ নিম্নে উপস্থাপিত হ’ল।

মিয়ানমারের পিছনের কথা

মিয়ানমার দক্ষিণ এশিয়ার ৯টি দেশের একটি। ১৯৪৮ সালের ৪ই জানুয়ারী বৃটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে নতুন রাষ্ট্রীয় নাম হয় ‘ইউনিয়ন অব মায়ানমার’। এর পূবে ১৯৪৫ সালে জার্মান-জাপানের পক্ষ হয়ে ইংল্যান্ড আমেরিকার মিত্র শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বৃটেনের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে ১৯শে এপ্রিল ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ২৬১২২৭ বর্গ মাইল আয়তনের সবুজ ফসল আর পাহাড়-পর্বতে ঘেরা, নানা খনিজ সম্পদে ভরা সাধারণ মানুষের এই দেশটি বেড়ে উঠেছে সেনা সমর্থিত রাজনীতির শাসন কাঠামোতে। বৃটিশ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যুষিত দেশটিতে সে সময় হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান সকলে মিলে এক সাথে সংগ্রাম করেছিল। সে সময়ে বর্তমানের অংসান সুচির পিতা মিয়ানমারের জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা জেনারেল অং সান-এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনেক মুসলিম নেতা পরবর্তীতে মায়ানমার তথা বার্মার (পূর্বনাম) মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। ৮৯%বৌদ্ধ, ৪% খৃষ্টান, ৪% মুসলমানের এই দেশটিতে সব ধর্মের মধ্যে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। তার গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক দলীল হ’ল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও মুসলিম আরাকান সাম্রাজ্য, যার অধীনে ছিল বাংলাদেশের অনুপম সৌন্দর্যের পর্যটন এলাকা কক্সবাজারও। সরেযমীনে দেখা যায় এখনও কক্সবাজার ও আরাকানী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় একই। ইতিহাস বলে রাসূল (ছাঃ)-এর আমলে রাহমী নামক আরাকানী শাসকের নিকট এক কলস আদা হাদিয়া দেন। সে সময় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছাহাবীগণ এখানে এসেছিলেন। এরপর আরব বণিকগণ দাওয়াতের উদ্দেশ্যে এসে চট্টলা (বর্তমান চট্রগ্রাম) সমুদ্র বন্দরে নৌকা, জাহায ভীড়ান। অত্র এলাকায় ইসলামের সুমহান দাওয়াতের পাশাপাশি তারা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। তখন থেকে তারা বার্মার আরাকান রাজ্যসহ সারা ভারত উপমহাদেশে ইসলামের সুমহান দাওয়াতের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে।

৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে এবং ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে ১২০৪ সালে বাংলা জয়ের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক ইসলামের দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ জাতিগত বৈষম্য ও পরস্পর যুলুমের শিকারে পতিত সাধারণ মানুষ দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়। এজন্য দেখা যায় স্থানীয় শাসকগনের শাসন কাঠামো দুর্বল হয়ে মুসলিম শাসনের অগ্রযাত্রা চলতে থাকে। চার খলীফার আমলে ইসলামের প্রচার-প্রসারের পর মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক উপমহাদেশ শাসন চলতে থাকে। সে সময়ে আরাকান রাজ্যসহ উপমহাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমানরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন। অতঃপর দাঈগণ হিন্দু-বেŠদ্ধ ছেলে-মেয়েদের ইসলামে দীক্ষিত করে বিয়ে-শাদী করে বসবাস করতে থাকেন। রোহিঙ্গা মুসলিম তাদেরই উত্তরসূরী।

অতঃপর ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে তাদের শোষন-নিপীড়ন অব্যাহত থাকলেও দেশীয় স্বাতন্ত্র্যবাদ নীতিতে পাশাপাশি একত্রে সহমর্মিতা নিয়ে তারা ভালভাবেই বসবাস করতে থাকে। বড় রকমের কোন জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মারামারি-কাটাকাটি তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। অতঃপর ১৯৪৮ সালে বার্মা বৃটিশদের থেকে স্বাধীন হয় এবং একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের সামরিক শাখা, সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনী যারা বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তারাই আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর উনের নেতৃত্বে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৯শে অক্টোবর ১৯৫৮ সালে ক্ষমতাসীন এ্যান্টি ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগ (AFPL)-এ ভাঙন দেখা দিলে জেনারেল নে উইন তৎকালীন সরকারকে সরিয়ে দিয়ে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬০ সালে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পরে উনের নেতৃত্বে আবারও বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালে আবার সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে দেশটিতে নতুন সংবিধান চালু হয়। এভাবে সেনারা দেশ চালাতে থাকে। ১৯৮৮ সালে অং সান সুচির নেতৃত্বে গঠন করা হয় ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমাক্রেসী (NLD)। ২৭শে মে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচনে NLD ৪৯২টি আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক মিলিশিয়া ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (USDA)  প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৮ সালে সামরিক জান্তা নতুন সংবিধান অনুমোদন করে তাদের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করেন। ৮ই জুন ২০২১ সালে (USDA) ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেল্পমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন পার্টি (USDP) নাম ধারণ করেন। এ দলটিই সেনাবাহিনীর পোষা দল হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৫ই আগষ্ট ২০০৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেদেশের জ্বালানী তেলের উপর ভতুর্কি তুলে নিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয় যা উষ্টাটাবেকা বা জাফরান বিপ্লব (Saffron Revulation) নামে পরিচিত। ৭ই নভেম্বর ২০১০ কথিত সাধারণ নির্বাচনে সেনা সমর্থিত (USDP) বিজয় দাবী করে। ততদিন অংসান সুচির নেতৃত্বে দেশে আবার রাজনৈতিক সুষম ক্ষেত্র তৈরী হয়। এ প্রেক্ষাপটে ১লা এপ্রিল ২০১২ সালে আইন সভার নির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টি আসনে সুচির (NLD) প্রার্থীরা জয়লাভ করে এবং বহিঃর্বিশ্বের চাপে ৮ই নভেম্বর ২০১৫ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে সুচির দল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে বিজয় লাভ করে। এখানে সেনারাও তাদের কতৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করে। আর এই সুযোগে ২৫শে আগষ্ট ২০১৭ সালে তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসী হামলার দোহাই দিয়ে নিরীহ মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ চালিয়ে তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। ৮ই নভেম্বর ২০২০ সালে দেশটিতে আইনসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত আসন ছাড়া ৪৯৮টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসলে জয় লাভ করে ক্ষমতাসীন (NLD) এবং সেনা সমর্থিত (USDP) পায় মাত্র ৩৩ আসন। কিন্তু সেনারা পরাজয় স্বীকার করেনি। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন। ২৯শে জানুয়ারী ২০২১ সালে সেনাবাহিনীর এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে নির্বাচন কমিশন তাদের অন্যায্য দাবী খারিজ করে দেন।

আবার সামরিক শাসনের কবলে মিয়ানমার

২০১৫ সালে দেশের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের মাধ্যমে সামরিক শাসকের পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। সাধারণ জনগনের মৌলিক অধিকারগুলো অন্ধকার হতে আলোর পথ দেখাবে ভাবা হয়েছিল। এর পরপরই সুচির সর্মথক এবং সাধারণ জনগণ এর প্রতিবাদে মাঠে নামলে সেনাবাহিনী শক্ত হাতে দমনাভিযান শুরু করে। শতশত বার্মিজকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার মানুষ পাশ^র্বর্তী দেশ থাইল্যান্ড ও ভারতে আশ্রয় নেয়। রাজনৈতিক ভাষ্যমতে ধারণা করা হয় ৩রা জুলাই ২০২১ মিয়ানমারের বর্তমান সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হবে। নিয়মানুসারে তাকে অবসরে যেতে হবে। দীর্ঘ বছর পর তার সে দেশের প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন ছিল। গত ৮ই নভেম্বর ২০২০ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সেনা শাসকেরা তাদের সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (USAP) ব্যাপক ভরাডুবির ফলে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালের সংবিধানানুসারে সেনাদের মধ্য থেকে শতকরা ২৫ ভাগ সংসদ সদস্য রাখা হয়। হিসাবানুযায়ী সেনাদের জন্য মোট সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৬৬টি। মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এর বাইরে আরো ১৬৭টি আসনের দরকার ছিল। কিন্তু সংরক্ষিত  আসনের বাইরে দলটি মাত্র ৩৩ আসন পায়। অপরদিকে সংরক্ষিত আসন ছাড়া সুচির NLD ৪৯৮টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসনে জয় পায়। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে মর্মে নির্বাচন কমিশনের ওপর অভিযোগ তোলে। এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। সেনা শাসকেরা দেখিয়ে দিল শুধু মুসলিম রোহিঙ্গা নয় ক্ষমতা দখলের জন্য নিজের ঘরের মানুষ কিংবা স্বজাতিকেও গ্রেফতার, হত্যা, নির্যাতন ও দেশত্যাগে তারা বাধ্য করতে পারে। অতঃপর ২রা ফেব্রুয়ারী ২০২১ তারিখে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ১১ সদস্য বিশিষ্ট (STATE ADMINISTRATION COUNCIL) সংক্ষেপে (SAC) গঠন করে বহাল তবিয়তে অবৈধ পন্থায় মিয়ানমারে একচ্ছত্র অধিকার প্রয়োগ করে স্বৈরচারী সামরিক সেনা শাসন পুনরায় চালু করে।

দীর্ঘ ৫০ বছরের সেনাশাসন ও রাজনীতি

মিয়ানমার এমন একটি বিচিত্র দেশ যেখানে দীর্ঘ ৫০ বছরাধিকাল থেকে সেনাশাসন চলে আসছে। পৃথিবীতে এমন শাসন আর দেখা যায় না যে একটি দেশ সামরিক বাহিনী দ্বারা সার্বিকভাবে পরিচালিত হতে পারে। প্রকৃতঅর্থে তাদের প্রধান দায়িত্ব-কর্তব্য দেশের প্রতিরক্ষা এবং বিদেশী শক্তি থেকে দেশ রক্ষা করা। বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে সোনবাহিনী সে শপথ নিয়েই তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু না, উল্টা শপথ ভেঙ্গে দায়িত্বের প্রতি অবমাননার কারণে এখন তারা জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে। যাইহোক ১৯৪৫ সালে মিয়ানমারে যে সামরিক বাহিনী গঠিত হয় তার নাম ছিল তাতমাতো (Tatmadaw)। এর তিনটি শাখা ছিল সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, যারা বৃটিশদের বিরুদ্ধে জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল। তাকেই সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দেখা হয়। দেশটির স্বাধীনতার ৬ মাস আগে ১৯শে জুলাই ১৯৪৭ সালে তিনি প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন। এরপর ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর উনের নেতৃত্বে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। আর ১লা ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ সাল থেকে জেনারেল নে উইন ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার। ২৯শে অক্টোবর ১৯৫৮ সালে ক্ষমতাসীন এ্যান্টি ফ্যাসিস্ট পিপসস ফ্রিডম লীগ (AFPFL)-এ ভাঙন দেখা দিলে জেনারেল নে উইন তৎকালীন সরকারকে সরিয়ে দিলে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬০ সালে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২রা মার্চ ১৯৬২ সালে নে উইন বার্মা সোশালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (BSPP) প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে একক সরকার হিসাবে ঘোষণা দেন। এর জন্য ১৯৭৪ সালে নে উইন নতুন সংবিধান কার্যকর করেন। ৯ই নভেম্বর ১৯৮১ সালে জেনারেল নে উইন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সান ইউয়ের কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ২৩শে জুলাই ১৯৮৮ সালে দেশের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ও দুর্নীতি-অনিয়ম ও কতৃর্ত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে উক্ত পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। সামরিক শাসক জেনারেল থান সুয়ে ৩০শে মার্চ ২০১১ সালে পদত্যাগ করেন। এভাবে মিয়ানমারে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরাধিকাল সামরিক জেনারেলরা জবরদস্তিমূলক দেশ চালায়। আবার এর পুণরাবৃত্তি ঘটে ১লা ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে সামরিক শাসক দ্বারা প্রণীত সংবিধানানুযায়ী দেশটির পার্লামেন্ট সেনাবাহিনী কোটায় ২৫% সংসদ সদস্য রাখা হয়। শুধু তাই নয় দেশ পরিচালনা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়সহ সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয় ছিল সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেহেতু পার্লামেন্ট এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, সেহেতু যে কোন মৌলিক আইন পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন পড়ে সামরিক আইন প্রণেতাদের। এভাবে মিয়ানমারে র্দীঘদিনের সামরিক শাসনের মাধ্যমে তারা যেমন গণমানুষের অধিকার সহ ধর্মীয় ও মানবিক সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তেমনি তার ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা গং তাদের কথিত অহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে নিয়ে মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে জাতিগত হত্যা-নিধন, দেশ বিতাড়নের কারণে বিশ^ মানবতার ইতিহাসে কালো অধ্যায় রচনা করে গেছে।

বর্তমান সেনাপ্রধান মিন হ্লাইংয়ের উত্থান

মিয়ানমারের স্বৈরাচারী সেনাপ্রধান মিন হ্লাইং-এর নাম বিশ^ব্যাপী যেমন পরিচিত, তেমনি সমালোচিত, নিন্দিত ও ধিকৃত। কারণ তিনিই রোহিঙ্গা মুসলিম গোষ্ঠীকে বর্বর হত্যা নিধনের জন্য মূল পরিচালনাকারী এবং তার সহযোগী ছিলেন কথিত নোবেল বিজয়ী স্টেট কাউন্সিলর অংসান সুচি এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। রক্তখেকো এই সেনাপ্রধানসহ আরো কয়েক জন সামরিক নেতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ আদালত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই উচ্চাভিলাষী সামরিক নেতা ৩রা জুলাই ১৯৫৬ সালে মিয়ানমারের তাভয়ে (বর্তমান দাউই) জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে ইয়াঙ্গুন বিশ^বিদ্যালয় থেকে আইনে পাশ করেন। তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমীতে যোগ দেন। ৩০শে মার্চ ২০১১ সালে তিনি সেনাপ্রধান হন। ২০১৬ সালে তিনি পুণরায় ৫ বছরের জন্য ক্ষমতা বাড়িয়ে নেন। এই সেনাপ্রধানের আমলে অর্থাৎ ২০১৭ সালেই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা নিযার্তন নতুন মাত্রা পায়। ফলে ২০১৯ সালে এই নেতাসহ ৩ জন সামরিক নেতার বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আদালতে জাতিগত হত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং বিভিন্ন দেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তিনিই আবার ১লা ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে অবৈধভাবে সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে এবং নির্বাচিত নেতা অং সান সুচিকে গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল করেন।

সুচির উত্থান-পতন

বৃটেন থেকে মিয়ানমারকে স্বাধীন করার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে হলেন অং সান সুচি। তিনি ১৯শে জুন ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য বৃটেনে যান। পড়ালেখা শেষ করে সেখানে বেশকিছু দিন কাটানোর পর ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরেন। তিনি দেশের মানুষের পক্ষে অধিকার আদায়ের জন্য সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। এজন্য ১৯৮৯-২০১০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ১৫ বছর যাবৎ গৃহবন্দি ছিলেন। গৃহবন্দি থাকাকালে তিনি ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ৮ই নভেম্বর ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুচির দল NLD নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। তবে স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশী নাগরিক হওয়ায় সেনা সমর্থিত সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সরকারের স্টেট উপদেষ্টা থাকাকালে ২০১৭ সালে রাখাইনে দেশের রোহিঙ্গা মুসলিমের উপর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করার সময়ে সুচি উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সেনাদের সমর্থন দেন। ফলে তিনি বহির্বিশে^ ব্যাপক সমালোচিত, ধিকৃত ও নিন্দিত হন। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদেরকে বাঁচানোর লক্ষ্যে সাফাই মিথ্যা সাক্ষ্য দেন যে তার দেশের সরকার ও সেনারা কোন রোহিঙ্গা গণহত্যার সাথে জড়িত নয়। আজ সে মিথ্যা সাক্ষ্যের জের পাচ্ছেন সুচি। তাকে নির্মমভাবে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করার পাশাপাশি তার দলের লোকজনকে গ্রেফতার, হত্যা ও নির্যাতন অতঃপর দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবেই ইতিহাসের নির্মম পালাবদলের সাক্ষী হতে হচ্ছে তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে।

মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত

মিয়ানমারে বিগত কয়েক মাসে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ হত্যা করা হয়েছে। নানা রকম নির্যাতনসহ প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, সুচি সহ তাঁর হাযার হাযার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কয়েক হাযার মানুষ সেনা অত্যাচারের কারণে থাইল্যান্ড ও ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবাদকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরও গুলি চালিয়ে হত্যা, নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সামরিক জান্তার সরকার পতনের জন্য ও সুচির মুক্তির জন্য দেশটির রাজধানী নেইপিদো, ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় ও বড় বড় শহরসহ সারাদেশে উত্তাল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। যা সেনাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব ডামাডোলের মধ্যে পার্শ্ববর্তী চীন, রাশিয়া এবং ভারতের রহসাবৃত ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বৃটিশ ওপেন সোর্স প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সামরিকজান্তা বিরোধীদের দমনের জন্য চীনের তৈরী চালকবিহীন আকাশযান (ইউএভি) ড্রোন ব্যবহার করছে। রাশিয়ার তৈরী ডিজিটাল নজরদারির সিস্টেম, যন্ত্রপাতি এবং মডেলের ফাইটার জেট দিয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, বিরোধীমত দমনে ব্যবহৃত ভেহিক্যালগুলোর মালিক চীন। এই চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতনে ও সমর্থন জুগিয়েছিল যাতে বিশ^ব্যাপী নিন্দার ঝড় তুলেছিল। এমনকি তারা গত ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৯ জাতিসংঘে উত্থাপিত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনতেও বাধা দিয়েছিল। চীন তার দেশে উইঘুর মুসলিমদের উপরও একই কায়দায় নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছে। এগুলো সকলের ভাবনার ব্যাপার। কিন্তু তাদের  এসব অন্যায় সহযোগিতা কোন সভ্য মানুষের কাছে কাম্য নয়। তবে এজন্য মিয়ানমারে চীনের তৈরী শিল্প কলকারখানার উপর আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে ভারত চুপচাপ বসে সামরিক জান্তাকে তার স্বার্থে মৌন সমর্থন দিয়ে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যাইহোক এই মুহূর্তে সুচি ও তার দলের বুঝা উচিত মুসলিম রোহিঙ্গাদের হত্যা ও বিতাড়নকে সমর্থন করা তাদের জন্য আদৌ ঠিক হয়নি। মিয়ানমারে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে এখনই তাদের উচিৎ হবে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সকল জাতি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ডাক দেয়া, যাতে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে। সামরিক শাসনের জাতাকল থেকে মিয়ানমার স্থায়ীভাবে মুক্তি পায়। তবে সুচি ও তার দল কি সেই সৎসাহস রাখে?   

মুসলিম রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত

মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে শরণার্থী শিবিরে লাখ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গাদের অমানবিকভাবে সে দেশের নরপশু সেনাদের নযরদারিতে কোন রকম বেঁচে আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসাবে অবস্থান করছে। গত ২০-২২শে ডিসেম্বর ২০১৬ এবং ২য় বারে ১-৪ জানুয়ারী ২০১৭ মোট ১সপ্তাহ কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির যেমন: রামু, টেকনাফ, উখিয়া এবং কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং পার্বত্য চট্রগ্রামে রামু, নাইক্ষংছড়ির প্রায় ১৫০-২০০ ফুট উঁচু পাহাড়-পর্বতে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতে সবকিছু বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছিল সেই সময়। প্রায় শত শরণার্থীর সাক্ষাতকারে জানা গিয়েছিল তাদের দেশ মিয়ানমারে সেনা ও বেŠদ্ধ ভিক্ষুদের সীমাহীন অত্যাচারের নির্মম কাহিনীর কথা। ওদের ভাষায় কাফিররা তাদের সব শেষ করে দিয়েছে ও তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ ফেলে রেখে আসতে বাধ্য করেছে। আমরা স্বামী কিংবা স্ত্রী অথবা কন্যা সন্তানদের মৃত লাশ অথবা হারানো অবস্থায় রেখে পালিয়ে এসেছি। আমরা দেশত্যাগের সময় কয়েকদিন পায়ে হেটে অথবা নাফ নদী পার হয়ে কয়েকদিন না খেয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। কারও কারও ৫ থেকে ৫০ হাযার টাকাও দিতে হয়েছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী ও তাদের দালালদের হাতে। হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে মারা সহ তাদের উপর নির্মম নির্যাতনের কাহিনী শুনতে শুনতে আমাদের চোখের পানি চলে আসে। গা শিহরিত হয়ে উঠে। সভ্যতার এই যুগে মানুষ এত বর্বর, নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে! যেন ফেরাউনী শাসনকেও হার মানিয়ে যায়। সবমিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এরমধ্যে শেখ হাসিনা সরকার ভাষানটেকে কয়েক হাযার শরণার্থীকে পুর্নবাসন করেছে। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার পরিচয় দিয়ে প্রশংসা পেয়েছে। তবে সরকারকে আরও উদ্যোগী হয়ে এবং আন্তর্জাতিক মহলে দৌড়-ঝাপ করে তাদেরকে নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওআইসি, আরবলীগ, আসিয়ানসহ বিশ্বসম্প্রদায়কে সচেতন করতে হবে। এদের প্রামাণ্য চিত্র বিশ^সম্প্রদায়ের নিকট প্রচার করতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে দোষীদের প্রকাশ্যে বিচার ও গ্রেফতার করার জন্য সভা-সমাবেশ করতে হবে। যাতে এই বিপন্ন জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পায় এবং অতি দ্রুত নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক আদালতের ভূমিকা

ধন্যবাদ দিতে হয় আফ্রিকার ছোট একটি দেশ গাম্বিয়ার সরকারকে যারা অত্যন্ত সময়োপোযোগী ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নেদারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মামলার কার্যক্রমকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়। মিয়ানমার সরকারকে গণহত্যার দায়ে আদালত ২০ জানুয়ারী ২০২০ এক অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন ICJ -এর প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুল কোয়াই আহমদ ইউসুফ। তাতে চার দফা নির্দেশনা দেয়া হয় মিয়ানমারকে। সর্বসম্মতিক্রমে এই আদেশে বলা হয়-

(ক) গণহত্যা সনদ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের হত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে।

(খ) সেনাবাহিনী বা অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংগঠন ষড়যন্ত্র বা উস্কানী দিতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

(গ) গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্য প্রমাণ রক্ষা করতে হবে।

(ঘ) চার মাসের মধ্যে আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে তা আদালতকে জানাতে হবে।

নিঃসন্দেহে এ আদেশ রোহিঙ্গা সহ সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা। এখন সুচি সহ মিয়ানমারের মুক্তিকামী জনগণের উচিৎ হবে তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে এসে সামরিক জান্তাকে প্রতিরোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের এই আদেশ দ্রুত পালনের জন্য সহযোগিতা করা। কারণ তাদের বুঝা উচিত ঘরে বিষধর সাপ পুষে কখনও নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবা যায় না। জীবন বাজি রেখে হলেও জনগণের এ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাদেরকে থাকতে হবে। তবে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে, নতুবা নয়।

উপসংহার

পরিশেষে নিপীড়িত মুসলিম রোহিঙ্গাদের বুঝা দরকার যে, তারা যেখানেই থাকুক তাদের সকলকে শিক্ষা-দিক্ষা ও দ্বীনী জ্ঞানার্জনে রত থাকতে হবে। সুষ্ঠু ও দ্বীনী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। কারো কোন উস্কানীতে কান না দিয়ে  ধৈর্যের সাথে মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য ও করুণা প্রার্থনা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সুচির সরকার বিগত দিনগুলোতে রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্যাতন-নিপীড়নের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, তা যেন ফেরআঊনী দুঃশাসনকেও হার মানিয়েছে। যদি তাওহীদপন্থী মযলুম জনতা মহান অভিভাবক আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলার উপর পূর্ণ ভরসা ও ছবর করতে পারে, তবে বিশ্ববাসী আরো একবার ফেরআঊনী ধ্বংসলীলার ইতিহাস নিজ চোখে দেখে যেতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আমরা সেইদিনের অপেক্ষায়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য মযলুম জনতাকে আল্লাহ সঠিক পথের দিশা দিন এবং তাদের হিফাযত করুন-আমীন!

শামসুল আলম

লেখক : সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া, রাজশাহী



বিষয়সমূহ: সাময়িক প্রসঙ্গ
আরও