মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1677 বার পঠিত

[মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ (৬৫) কুমিল্লা যেলার একজন কৃতী আলেম ও সংগঠক। শিক্ষকতার সুবাদে তিনি যেমন বহু ছাত্র তৈরী করেছেন, তেমনি সাংগঠনিক জীবনে অসংখ্য মানুষের দীক্ষাগুরু হয়েছেন। জীবনের শুরুকাল থেকেই একজন সচেতন, মুখলিছ ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি সমাজের সমস্যাগুলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ফলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ডাক পাওয়ার পর আর দেরী করেননি। দৃঢ় প্রত্যয়ে হাতে তুলে নিয়েছেন সমাজ সংস্কারের মহান দায়িত্ব। বলিষ্ঠ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিজ যেলায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের ঝান্ডাকে উচ্চকিত করেছেন বহুদূর সীমানায়। বৃহত্তর কুমিল্লাসহ দেশে-বিদেশে তাঁর রয়েছে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী। সংগ্রামী এই মানুষটির কর্মময় জীবন সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক- নির্বাহী সম্পাদক]   

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : আমার জন্ম ১৯৫৬ সালে, কুমিল্লা যেলার বুড়িচং উপযেলার জগৎপুর গ্রামে। আমার পিতা মাওলানা আব্দুল হামীদ। দাদা মুন্সী আব্দুল জববার এবং পরদাদা আরব মিয়াঁ। পরদাদা আরব মিয়াঁ ছাহেবের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ কেন্দ্রিক মাদরাসায় পড়াশুনা শেষে আমার আববা দিল্লীতে যান। দিল্লীতে পড়াশুনা শেষ করে এসে তিনি গ্রামের মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে অসুস্থতার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন এবং জগৎপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের আমৃত্যু ইমাম ও খতীব ছিলেন। আমার পরদাদা আরব মিয়াঁ অত্র এলাকার সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। এজন্য তাকে মিয়াঁ ছাহেব বলা হ’ত। তিনি প্রথম জীবনে হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে আহলেহাদীছ হন। আমীরে জামা‘আতের থিসিসে (পৃঃ ৪২১) উল্লেখিত গাযী মাওলানা আশেকুল্লাহর (ধানীখোলা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ) মেয়ের সাথে আমার পরদাদা আরব মিয়াঁর দ্বিতীয় পুত্র আফতাবুদ্দীন মুন্সীর বিবাহ হয়। ফলে বংশ পরম্পরায় ছোট থেকেই আমি দ্বীনী এবং ইলমী পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ

তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : জগৎপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর কুরআন হিফয শুরু করি। পরবর্তীতে হিফয অসম্পূর্ণ রেখে জগৎপুর ফাযিল মদ্দ্রাসায় ভর্তি হই। এখানে ফাযিল পর্যন্ত লেখাপড়া করি। মাঝখানে আলিম পরীক্ষার পর আমার উস্তায মাওলানা আব্দুল হাকীম আমাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পার্শ্ববর্তী কাসেমুল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি করান। কিন্তু সেখানে আহলেহাদীছ তরীকায় আমল করা যায়না বিধায় ঈদুল আযহার পঁচিশ দিন পূর্বে বাড়ি চলে আসি। ঈদের পর আমার আববা আমাকে ঢাকা নাযিরাবাজার মাদ্রাসাতুল হাদীছে ভর্তি করান। সেখানে আরবী সাহিত্য, হাদীছ, তাফসীর, বালাগাত প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করি। এর পাশাপাশি আমার উস্তায অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ-এর কাছে মাক্বামাতে হারীরী অধ্যয়ন করি। তাছাড়া ১৯৭৯ সালে কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাযিল এবং ১৯৮১ সালে মুরাদনগর সোনাকান্দী মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করি।

তাওহীদের ডাক : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোন উল্লেখযোগ্য স্মৃতি আপনার মনে আছে কি?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : ১৯৭১ সালের স্মৃতি আমার ভালেভাবেই মনে আছে। আমাদের গ্রাম পূর্ব থেকেই আহলেহাদীছ হওয়ায় শত্রুতাবশত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ময়নামতি সেনানিবাসে আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়। সেকারণে ৫ই মে ১৯৭১ সালে প্রায় ৫/৭ শো হানাদার বাহিনী আমাদের গ্রামের দিকে রওনা দেয়। গ্রামের ৪ কি.মি. পশ্চিমে মালাপাড়ায় তারা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বাধার শিকার হয়। ফলে তারা সেখানে নির্মমভাবে অনেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। অতঃপর আমাদের গ্রামে আসে। তাদের আগমনের খবর পেয়ে আববার সাথে বাড়ির দক্ষিণ পাশে আসি। এত অস্ত্র-শস্ত্র আর এমন সেনাবাহিনী আগে কখনো দেখিনি। আমাদের বাড়িতে তখন অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। আববার সাথে উর্দূতে তাদের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা তল্লাশি শুরু করে। তল্লাশি শেষে আমার মাথায় ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের সাথে নিয়ে যায়।

কিছুদূর যাওয়ার পর বললাম, যিয়াদা তাকলীফ হো রাহী হ্যায়। এটা শুনে তারা আমাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু ৫ মিনিট পর ফিরে এসে আববার দিকে অস্ত্র তাক করে বলতে লাগল তোমার ছেলে কোথায়? তোমার ছেলে (আমার বড় ভাই) মুক্তিফৌজ। আববার নির্দেশে এই ভয়ংকর মুহূর্তে আমরা কেবল দো‘আ ইউনুস পড়ছিলাম। আববা তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। ইতিমধ্যে তারা আমাদের পাশের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের মোল্লা বাড়িতে যখন আগুন দিবে, তখন হুইসেল বেজে ওঠায় তারা আগুন না লাগিয়ে চলে যায়।

তাওহীদের ডাক : আপনার পেশাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : ১৯৭৭ সালে আমি শিক্ষক হিসাবে আমার গ্রামের জগৎপুর মাদ্রাসায় যোগদান করি। সেসময় উক্ত মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল আমার উস্তায মাওলানা আব্দুল হাকীম এর সাথে গ্রামবাসীর ঝামেলা চলছিল। এহেন মুহূর্তে মাদ্রাসায় থাকা না থাকা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি আমার সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। তিনি এটাও জানালেন যে, তিনি যদি মাদ্রাসায় না থাকেন তাহলে তাকে নতুন একটা মাদ্রাসা করতে হবে। তখন আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম যে, ১৯৭৪ সালে বন্যার সময় আপনার সাথে কোরপাই কাকিয়ারচরে মাওলানা আহসানুল্লাহ ছাহেবের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার ছাত্র শাহজাহান, শরাফাত আলী ও এরশাদুল্লাহকে সাথে নিয়ে কোরপাই বাজারের দিকে ঘুরতে যাই। বিশ্বরোডের পাশে ঐ আহলেহাদীছ এলাকাটা খুবই উর্বর এবং উপযোগী। সেখানে একটি মাদ্রাসা হলে সুন্দর হত। আমার পরামর্শ শুনে তিনি জগৎপুর মাদ্রাসা থেকে রিজাইন দিয়ে কোরপাই চলে যান এবং সেখানে এক সাথে প্রথম শ্রেণী থেকে ফাযিল পর্যন্ত মাদ্রাসা চালু করেন। এই মাদ্রাসার শুরু থেকে সরকারী মঞ্জুরী লাভ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আমাকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। উস্তায এবং মাদ্রাসাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে সেখানে হেড মাওলানা পদে শিক্ষকতাও করতে হয়েছে।

আরেকটা ঘটনা বলি, আমাদের প্রচেষ্টায় যখন বৃহত্তর কুমিল্লায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ছড়িয়ে পড়ে, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেলার বাঞ্ছারামপুর উপযেলার রাধানগর-কালিকাপুর গ্রামে আমরা একটা মাদরাসার জায়গা পরিদর্শনে যাই। মাওলানা আব্দুল মতীন সালাফী, মাওলানা মুছলেহুদ্দীনসহ আমরা কয়েকজন সেখানে গিয়েছিলাম। রাতের অন্ধকারে নৌকা যোগে আমরা জায়গাটি পরিদর্শন করি। কেননা সেখানে তখন হাঁটুর উপর পানি ছিল। পরবর্তীতে সেখানে আমাদের উদ্যোগে দাখিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি বর্তমানে আমাদের কর্মী ও দায়িত্বশীলদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে আলহামদুলিল্লাহ কুমিল্লায় আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। যেগুলি চলছে, ইনশাআল্লাহ চলবে।

সর্বশেষ জগৎপুর ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা থেকেই ৪৩ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে ২০২০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী অবসর গ্রহণ করি।

তাওহীদের ডাক : সংগঠনে কবে ও কিভাবে যোগদান করলেন?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি প্রথমে তাবলীগ জামাতের সাথে যুক্ত হই। আমরা আহলেহাদীছ ছিলাম। আমার আববা আলেম ছিলেন। তাই তাদের কিতাবাদি পড়ে ও বক্তব্য শুনে বুঝতে পারি সেখানে শিরক-বিদ‘আতের ছড়াছড়ি। এজন্য শীঘ্রই তাবলীগ জামাত ছেড়ে দেই। অতঃপর আহলেহাদীছদের কোন যুব সংগঠন না থাকায় তৎকালীন প্রচলিত ইসলামী ছাত্র সংগঠনে যোগদান করি। ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে ঐ সংগঠনের উচ্চতর দায়িত্বশীল পর্যায়ে চলে যাই। তবে যখনই তাদের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল বিরোধী কোনো কার্যকলাপ দেখতাম, তখন তা নোট করে নিতাম। এরপর যখন তাদের মুরববী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসি, তখন বুঝতে পারি এদের মধ্যে যথেষ্ট মাযহাবী গোঁড়ামি রয়েছে এবং এরা জাহেলিয়াতের সাথে আঁতাত করে চলছে। কুমিল্লা বার লাইব্রেরীতে তাদের কেন্দ্রীয় নেতার সাথে মতবিনিময় সভা চলছিল। ঐ সভায় কেন্দ্রীয় নেতাকে প্রশ্ন করলাম, ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে যদি দেশে ইসলাম কায়েম হয়, তাহলে সেখানে কি কুরআন-হাদীছ ভিত্তিক ইসলাম চলবে (আমি তখনও ছহীহ হাদীছ পরিভাষার সাথে পরিচিত ছিলাম না)? তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন দেশে যে মাযহাবের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ সে মাযহাব অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। তাদের মাযহাব প্রীতি, আহলেহাদীছ বিদ্বেষ এবং জাহেলিয়াতের সাথে আঁতাতের বিষয়গুলি বুঝতে পেরে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলাম। 

তখন বৃহত্তর পরিসরে আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ভাবতাম আহলেহাদীছ মাসলাক কতিপয় আমল ও মাসআলা-মাসায়েলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাজনৈতিক দিকটা আমাকে অন্য সংগঠনের মাধ্যমেই চালাতে হবে। অতঃপর ১৯৮৪ সালে ঢাকার যাত্রাবাড়ীস্থ মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ার মসজিদে ২১শে মে থেকে জমঈয়তের ১৫দিন ব্যাপী ইমাম প্রশিক্ষণ হয়। সেখানে কুমিল্লা যেলা থেকে আমাকে এবং মাওলানা অলিউল্লাহকে মনোনীত করা হয়। সেখানে আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব আহলেহাদীছ আন্দোলন বিষয়ে কয়েকটা প্রশিক্ষণ দেন। যার নোট এখনো আমার কাছে আছে। প্রশিক্ষণে ওনার বক্তব্য শুনে আমি স্বস্তি ফিরে পাই। আমার কাছে আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে পার্থক্যও বুঝে আসে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি আর প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনে জড়িত হব না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। অতঃপর আমীরে জামা‘আতের সাথে কথা বলে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করি। পরে একই সালের ৮.৮.১৯৮৪ ইং তারিখে অনুমোদিত ‘কর্মী’ হই। আমীরে জামাআ‘তের স্বাক্ষরিত উক্ত ‘কর্মী অনুমোদন ফরম’ আজও আমার কাছে অতি সযতনে সংরক্ষিত আছে। কেন্দ্রেও কপিটি সংরক্ষিত আছে। 

তাওহীদের ডাক : আপনার দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং কিছু স্মৃতিচারণ যদি করতেন?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : আমি যখন প্রচলিত ইসলামী আন্দোলন করেছি তখনও পরিস্থিতি প্রতিকূলে ছিল। নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেছি। কর্মীদেরকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি। এরপর যখন আহলেহাদীছ আন্দোলনে আসি এবং কুমিল্লাতে সর্বপ্রথম ‘যুবসংঘে’র কাজ শুরু করি, তখনও প্রতিকূল পরিস্থিতি ছিল। দাওয়াতী কাজ শুরুর পর আমার সঙ্গী-সাথীরাই বলতে লাগল, আমি এতদিন ঐ সংগঠনের কথা বলেছি, এখন কেন অন্য সংগঠন করতে বলছি। ইঞ্জিনিয়ার রুস্তম আলীর বাসায় উক্ত সংগঠনের উপযেলা দায়িত্বশীলদের মিটিং ডাকলাম। অতঃপর বক্তৃতা দিয়ে বললাম, আমি যেহেতু আল্লাহর জন্য কাজ করব, সেহেতু আমার এক ফোঁটা রক্ত এবং আমার একটা পয়সাও আল্লাহর রাস্তা ছাড়া অন্য রাস্তায় ব্যয় হৌক, এটা আমি চাইনা। প্রচলিত ইসলামী সংগঠনের আদর্শিক ভিত্তির দুর্বলতা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের সামনে তুলে ধরলাম। তারাও বিষয়গুলো বুঝতে পারে। সংগঠনের দায়িত্বশীলদের সামনে বললাম, আমি আজ থেকে আর এই সংগঠন করতে পারব না।

তখন ইঞ্জিনিয়ার রুস্তম আলী, মৌলবী শামসুল হক, মাওলানা সাঈদুর রহমান, মাওলানা আব্দুল জলীল প্রমুখও আমার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন এবং আহলেহাদীছ ‘যুবসংঘে’র সাথে কাজ করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন আহলেহাদীছ যুবকরা বিভিন্ন মাযহাবী এবং অনৈসলামিক সংগঠনে জড়িত ছিল। গোটা যেলাতে আমরা যুবকদের পিছনে শ্রম দেই। আলহামদুলিল্লাহ সেই পরিশ্রমের বরকত আল্লাহ দিয়েছেন। যেলাব্যাপী আমরা সংগঠন করতে পেরেছি। সাংগঠনিক কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি যে, এর জন্য বেশ কিছু বিষয় থাকা যরূরী- (১) আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে হবে। (২) আন্দোলনের প্রতি নিখাদ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকতে হবে। (৩) এই আন্দোলনকে পরকালীন নাজাতের অসীলা মনে করে কাজ করতে হবে। তবেই ময়দানে টিকে থাকা যাবে।

কর্মীরা কিছুদিন পর পর ঝিমিয়ে যায়। অধৈর্য না হয়ে তাদের পিছনে শ্রম দেই। তারা আবার চাঙ্গা হয়। এ আন্দোলন করতে গিয়ে ঘরে-বাইরে হামলার শিকার হয়েছি। সকল স্মৃতি তো বলা সম্ভব নয়। তবে দু’টি ঘটনা বলি-

(১) ১৯৮৭ সালে দাউদকান্দির মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে কামারকান্দিতে সাংগঠনিক প্রোগ্রামে যাই। সেখানে মাহফিলও ছিল। অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ ছিলেন সভাপতি। বক্তা হিসাবে ছিলেন আমার শ্বশুর মাওলানা আব্দুর রায্যাক, আমি আর আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল। আমি বক্তব্য দিয়ে মসজিদে চলে আসি। এমন সময় মাযহাবীরা মাহফিলে চতুর্দিক থেকে হামলা শুরু করে। এক পর্যায়ে আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল একটা ছড়ি হাতে নিয়ে দৌড়ে মঞ্চে চলে যান এবং শ্লেলাগান দেওয়া শুরু করেন। শ্লোগান অবস্থায় মারামারি বন্ধ থাকে। শ্লোগান শেষ হলে আবার মারামারি শুরু হয়। এভাবে রাত প্রায় ১-টা বেজে যায়। আর এদিকে শত্রুরা মসজিদে আমাদের ঘেরাও করে রাখে। ওরা চর এলাকার ডাকাত স্বভাবের মানুষ। আমাদেরকে বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলবে বলে হুমকি দিচ্ছিল। এই কঠিন অবস্থায়ও ওরা আমাদেরকে কিছু করতে পারেনি। পরিশেষে ‘যুবসংঘে’র কর্মী আর স্থানীয় আহলেহাদীছদের প্রতিরোধে তারা চলে যায়। তারপর নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাহফিল শেষ হয় এবং ফজর পর্যন্ত প্রোগ্রাম চলে।

পরদিন ওদের সাথে বাহাছ হবার কথা। অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ এবং শ্বশুর মাওলানা আব্দুর রায্যাক ছাহেব আমাকে এবং আমানুল্লাহ মাদানীকে বাহাছ করার দায়িত্ব দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। বাহাছের জন্য আমরা প্রস্ত্তত ছিলাম, কিন্তু প্রতিপক্ষের আলেমদের কাউকে আর বাহাছের জন্য পাওয়া যায়নি। অতঃপর সেখানে সালিশী বৈঠক হয় এবং মাযহাবীরা আমাদের কাছে ক্ষমা চায়।

(২) ১৯৯১ সালে দেবিদ্বার থানার ফুলতলীতে যেলা ‘যুবসংঘে’র প্রশিক্ষণ  প্রোগ্রাম চলছিল। ফুলতলী আহলেহাদীছ জামে মসজিদে আমরা এশার ছালাত আদায় করি এবং বুঝতে পারি যে, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে। আমরা তা অাঁচ করতে পেরে চলে যাই আব্দুল হাকীম চেয়ারম্যানের বাড়িতে। চেয়ারম্যানের ছেলে মু‘আয্যাম হোসেন ছিল আমাদের দায়িত্বশীল। জমঈয়ত নামধারী কিছু লোক রাস্তায় আমাদের উপর হামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা একে কিছু মনে করিনি। কর্মীদের রাতভর সতর্ক প্রহরার মধ্যে আমাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন সকালে বাইরে থেকে কিছু লোক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করলে তারই ভাইয়ের সাথে তার ঝামেলা বেঁধে যায়। কারণ ঐ লোকের ভাই ছিল আমাদের ‘কর্মী’। এ ঘটনার পর গ্রামের সরদাররা আসতে শুরু করে। আব্দুল মতীন নামক একজন আমাকে চিনতে পারে। তখন সে বলেই ফেলে, আমরা তো ভাবছিলাম আজকে এখানে খুনাখুনি হবে। যাক আপনি যেহেতু পরিচিত, আশা করি আর কিছু হবে না। তখন আমি বললাম, হ্যাঁ! কেউ খুন হয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্যই তো আপনি এসেছেন। তখন সে লজ্জা পেয়ে যায়। আমাদের প্রোগ্রাম জুম‘আ পর্যন্ত চলবে। কিন্তু তারা আমাদেরকে আহলেহাদীছ মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করতে নিষেধ করল। বলল আমরা যেন হানাফী মসজিদে গিয়ে ছালাত পড়ি। আমরা বললাম তাহ’লে আমরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে জুম‘আর ছালাত পড়ব। তখন তারা লোকলজ্জার ভয়ে বলল, ঠিক আছে আপনারা জুম‘আর ছালাত পড়তে পারেন। তবে আপনাদের কেউ খুৎবা দিতে পারবেন না। আমরা তাদের প্রস্তাবে রাযী হলাম।

ইতিপূর্বে পাশ্ববর্তী দেবীদ্বার থানার ভৈষেরকুট গ্রামে মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানীর আগমনে জমঈয়তের সম্মেলন হয়। সেখানে আমাদের দু’জন কর্মী ফয়যুল ইসলাম ও মুহাম্মাদ শরীফ ‘যুবসংঘ’ করার অপরাধে (?) প্রহৃত হয়। পরের দিন চেয়ারম্যান আব্দুল বারী পুনরায় লোকজন নিয়ে তাদের উপর চড়াও হন ও তাদেরকে কঠিনভাবে যখম করেন। ফয়যুল ইসলাম এখন সিলেট সেনগ্রাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল এবং সিলেট যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি। ভৈষেরকুটের আরেক কর্মী জসীমুদ্দীনকে দাড়ি রাখার অপরাধে তার বাপ-মা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং এস.এস.সি পরীক্ষার ফরম ফিলআপের টাকা বন্ধ করেন। এধরণের বহু নির্যাতন ভোগ করেছে আমাদের কর্মীরা। সবার ইতিহাস এখানে বলা সম্ভব না। 

আমাদের কর্মীদের আনুগত্য ছিল, ধৈর্য ছিল। তারা আমাদের নির্দেশনা মেনে চলে। যার কারণে আমরা পরাজিত হইনি। ফলে যারা এক সময় আমাদের সাথে রূঢ় আচরণ করেছিলেন, অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ ছাহেবের পা ভাঙ্গার হুমকি দিয়েছিলেন, আমাদের উত্তম আচরণে তারাই এখন আমাদের সাথী ভাই। সেই গ্রামের মসজিদ, মাদরাসা, বাৎসরিক ওয়ায মাহফিল কোনকিছুই এখন পূর্ণতা পায় না আমাদের ছাড়া। সাংগঠনিক জীবনে এমন অনেক অভিজ্ঞতা আছে, যেগুলি আমরা কাজে লাগিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা দৈনন্দিন বেড়েই চলেছে।

তাওহীদের ডাক : আপনি যখন দাওয়াতী কাজ শুরু করেন, তখনকার অবস্থা কেমন ছিল?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : ১৯৮৪ সালে যাত্রাবাড়ির ইমাম প্রশিক্ষণে গিয়ে ‘যুবসংঘে’র সদস্য হয়ে বাড়ি ফিরি। তারপর আমি প্রথমে বৃহত্তর কুমিল্লায় আহলেহাদীছ অঞ্চল সমূহের একটি তালিকা তৈরী করি। সেই টার্গেটে কাজ শুরু করায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। চিহ্নিত কয়েকটি মাসআলা-মাসায়েল ও আমল ছাড়া তৎকালীন আহলেহাদীছ সমাজ নাম সর্বস্ব বৈ কিছুই ছিল না। আহলেহাদীছ যুবকরা তখন বিভিন্ন মাযহাবী ও বিজাতীয় সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল। তখন দাওয়াতী কাজে তথাকথিত এসব ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট বাধা প্রাপ্ত হই। তবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ হ’ল নদীর উজান স্রোতের মতো। যতই বাধাপ্রাপ্ত হয়, ততই তা যোরদার হয়। আমাদের প্রচেষ্টার বাস্তব ফল হিসাবে ১৯৮৫ সালের ২৬ ও ২৭শে নভেম্বর রামপুরে প্রথম যেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন। সেদিন আমাকে আহবায়ক ও মাওলানা শরাফত আলীকে যুগ্ম-আহবায়ক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট যেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার নেতৃত্বে সমাজ সংস্কার এবং জনকল্যাণমূলক কিছু কাজের উদাহরণ যদি উল্লেখ করতেন!

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : আমি প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালের পর থেকে সাংগঠনিকভাবে সমাজে পুঞ্জীভূত বিভিন্ন শিরক ও বিদ‘আত উৎখাতে ব্রতী হই। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা রহম করেছেন। যার ফলে বিভিন্ন জায়গায় যেসব কাজ আমার দ্বারা আল্লাহ করিয়ে নিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- (১) পীর-ফকীরের আস্তানা উৎখাত করেছি। (২) ওরস ও বিদ‘আতী যিকিরের হালকা বন্ধ করেছি। (৩) শবেবরাত ও শবে মে‘রাজের নামে চালু বিদ‘আতসমূহ বন্ধ করেছি। (৪) শবীনা খতম (৫) কুরআন খতম (৬) দল বেঁধে কবর যিয়ারত (৭) মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিন দিনা, চার দিনা, চল্লিশা নামক যিয়াফত বন্ধ করেছি। (৮) খতমে ইউনুস। (৯) মদ, জুয়া ও যাত্রার আসরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। যেমন কোরপাই বাজারের পশ্চিম পার্শেব মাযার উৎখাত করা হয়েছে। জগৎপুরে কবরের উপর আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালিয়ে আখড়া বানানোর চেষ্টা করা হলে জনসম্মুখে নিজ হাতে কোদাল দিয়ে তা সমান করে দেই। (১০) পহেলা বৈশাখে জুয়াড়িদের বিপক্ষে বুড়িচং বাজারে মিছিল করা এবং আমাদের গ্রামের কেউ যাতে মেলায় যেতে না পারে সেজন্য কর্মীদের নিয়ে রাতভর গ্রামের সীমানা পাহারা দিয়েছি। সমাজ থেকে শিরক-বিদ‘আত ও বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ উৎখাতে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! এসব কাজে বৃহদাংশেই সফল হয়েছি। তাছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজে বৃহত্তর কুমিল্লা যেলায় সাংগঠনিকভাবে তাওহীদ ট্রাস্টের মাধ্যমে ২০-এর অধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছি। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ট্রাস্টের অর্থায়নে মাদরাসা স্থাপন, ওযূখানা নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ (১৯৮৮ সালের বন্যায় মুরাদনগর উপযেলায় গিয়েও ত্রাণ বিতরণ করেছি), দরিদ্র ও রুগ্ন ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য নগদ অর্থ প্রদান, ইফতার ও কুরবানী বিতরণ, গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কাজ করতে পেরেছি। এখনো বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আমরা মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে যাচ্ছি। সর্বশেষ গতবছর লকডাউনে কর্মীদের নিয়ে যেলা ব্যাপী বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। এভাবেই সাংগঠনিক জীবনের দীর্ঘ ৩৭ বছর পার করেছি। ফালিল্লাহিল হাম্দ!

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতির কথা যদি বলতেন!

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : সাংগঠনিক জীবনে তাঁর সাথে আমার উল্লেখযোগ্য অনেক স্মৃতি রয়েছে। তবে সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি হ’ল ২০১১ সালের ১৩ ও ১৪ই জানুয়ারী। ১৩ই জানুয়ারী বৃহস্পতিবার কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে যেলা সম্মেলন শেষে পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে অসুস্থ নেতৃবৃন্দকে দেখতে যাওয়া এবং মৃতদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করাসহ সর্বমোট ১৫টি সাংগঠনিক সফরের অসাধারণ ঘটনা। সবশেষে তাঁকে নিয়ে আমাদের নিজ গ্রাম জগৎপুরে আসি। আমীরে জামা‘আতের আগমনের খবর শুনে সংগঠনের নেতা-কর্মী ও আহলেহাদীছ জনতার মিছিলে মিছিলে বুড়িচং বাযার এলাকা আলোড়িত হয়। তিনি আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর গ্রামের লোকদের দাবীক্রমে আগে থেকে আয়োজিত এক ওয়ায মাহফিলে অঘোষিতভাবে যোগদান করেন। আমীরে জামা‘আতকে এক নযর দেখা এবং তাঁর কথা শোনার জন্য সেদিন উৎসুক জনতার যে ঢল নেমেছিল, সে স্মৃতি ভোলার মত নয়। দিনব্যাপী সফর শেষে গভীর রাতে তিনি কুমিল্লা শহরে ফিরে আসেন। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৯শে নভেম্বর যেদিন তিনি আল-মারকাযুল ইসলামী শাসনগাছা কমপ্লেক্স উদ্বোধনের জন্য এসেছিলেন। এভাবে তিনি যখনই কুমিললা সফর করেন, জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। আমীন!

তাওহীদের ডাক :  আপনি অনেক বাহাছ-মুনাযারা করেছেন বলে শুনেছি। এবিষয়ে দুএকটি ঘটনা বলবেন কি?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : কারো সাথে বাহাছ করা আমাদের দাওয়াতী নীতি ছিল না। তবে অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় বাহাছ করতে বাধ্য হয়েছি। আলিম পরীক্ষা দিতে বি-বাড়িয়া শহরের মাদরাসা কেন্দ্রে যাই। সেখানে ওযূ করতে গিয়ে হানাফী মাযহাবের ছাত্রদের সাথে আমাদের বাদানুবাদ হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আড়াইবাড়ি কামিল মাদরাসার তৎকালীন উপাধ্যক্ষ মাওলানা সাঈদুর রহমান। যিনি পরে ঢাকা তা‘মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিছ হিসাবে যোগদান করেন। তিনি আমাদের উভয়পক্ষের মধ্যে ন্যায্য মীমাংসা করে দেন। তারপরও সেখানকার সিলেটী ছাত্ররা  আমাকে ও আমার সাথী হাফেয আব্দুল্লাহকে বাহাছের জন্য মসজিদের ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সাথে বাহাছ হয় এবং তারা পরাজিত হয়। ফলে তাদের দলের কয়েকজন আমাদের সাথে যোগদান করে। পরবর্তীতে অনেকদিন তাদের সাথে আমার পত্র যোগাযোগ ছিল। এ ঘটনার পর মাওলানা সাঈদুর রহমান দীর্ঘ গবেষণার পর আহলেহাদীছ হয়ে যান। তিন বছর পূর্বে তিনি রাজশাহী তাবলীগী ইজতেমায় বক্তব্য দেওয়ার সময় এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন।

১৯৮০-এর দশকে একবার ঢাকা শহরে কিছুদিন ছিলাম। সেখানে তুলাগাঁও নিবাসী ক্বারী আব্দুল মতীন আমাকে বখশীবাজার কাদিয়ানী মসজিদে নিয়ে যান। কাদিয়ানী এক আলেমের সাথে সেখানে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। বিতর্কের এক পর্যায়ে ‘ওফাতে ঈসা’ নামে একটা বই তারা আমাকে দেয়। আমি তখন তাদের বই দিয়ে তাদেরকে ঘায়েল করা শুরু করি। ফলে তারা আমতা আমতা করে স্থান ত্যাগ করে।

একবার নিজ গ্রামে মাহতাব ফকীরের সাথে বাহাছ হয়। সে পরাজিত হলে গ্রামের লোকেরা মিছিল নিয়ে গিয়ে তার খানক্বা ভেঙ্গে দেয়। তাছাড়া নিজ গ্রামে কালা ফকীর ও তোতা মিয়াঁ ফকীরদের সাথে বাহাছ করি। গ্রামে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে মাদরাসার আলেমদের সাথে বাহাছ করি। তারা পরাজয় বরণ করলে ১৯৭৭-এর পর গ্রামে আর কখনো শবেবরাত হয়নি। ধামতী আলিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীছ মাওলানা ফযলুল করীম ছাহেবের সাথে তাক্বলীদে শাখছী বিষয়ে তার মাদরাসাতেই বাহাছ করেছি। তাছাড়া জোরে আমীন, রাফঊল ইয়াদায়েন ইত্যাদি বিষয়ে উস্তায আব্দুল মতীন সালাফীর সাথী হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাহাছ করেছি।

সর্বশেষ ৫ই ডিসেম্বর ২০২০ ইং তারিখে কুমিল্লা শহরের  কোতোয়ালী থানায় আমাদের নতুন আহলেহাদীছ ভাইদের পক্ষ হয়ে মাযহাবীদের সাথে বাহাছের দায়িত্ব পালন করি। আলহামদুলিল্লাহ প্রত্যেক বাহাছেই আল্লাহ বিজয় দান করেন। ফালিল্লাহিল হামাদ!

তাওহীদের ডাক : আপনার নিজের কোন লেখনী আছে কি-না?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : সাংগঠনিক ব্যস্ততা ও শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের চাপে লেখার তেমন সুযোগ হয়নি। তবে ‘ফরয ছালাতের পর পঠিতব্য দো‘আ ও যিকির’ নামে একটি পোস্টার ছাপিয়ে বিতরণ করি। এক সময় মাসিক ‘সালাফী’ পত্রিকার দরসে হাদীছ কলামে নিয়মিত লিখতাম। এক দরসে ফরয ছালাতের শেষে সম্মিলিত দো‘আ বিষয়ে মাওলানা আলীমুদ্দীন নদীয়াভী ছাহেবের বই থেকে রেফারেন্স দেওয়ায় সাপ্তাহিক আরাফাত পত্রিকায় বিশাল প্রতিবাদ ছাপা হয়, যার কপি আজও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া ‘সাহারী ও উহার আযান’ নামে একটি বই পুস্তিকাকারে প্রকাশ করি। ‘জুমআ‘র আযান একটি না দু’টি’ শীর্ষক আরেকটি বই অপ্রকাশিত রয়েছে।

তাওহীদের ডাক : সাংগঠনিক জীবনে আপনার অনেক সাথী মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার অনেকে সংগঠন ছেড়ে চলে গেছে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কি?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : হ্যাঁ, আমার সাংগঠনিক জীবনের বেশ কিছু সাথী ও কর্মী দূরে সরে গেছে। ইখলাছের সাথে আমি নিজে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং অন্যদের দ্বারাও যোগাযোগ করে কারণ জানতে চেয়েছি। তাদের কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাইনি। যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের জন্য দো‘আ করি আল্লাহ যেন তাদের ক্ষমা করেন। আর যারা দুনিয়াবী স্বার্থে চলে গেছে তাদের জন্যও দো‘আ করি, আল্লাহ যেন তাদেরকে সংশোধনের তাওফীক দেন। আমীন!

তাওহীদের ডাক : আপনি তো এখন কুমিল্লা শহরে অবস্থিত আল-মারকাযুল ইসলামী কমপ্লেক্সের সভাপতি। সংক্ষেপে যদি এই মারকায প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে বলতেন!

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : আমাদের মুরববী আলেমগণ কুমিল্লা শহরে আহলেহাদীছ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। একথাটি শ্রদ্ধেয় পিতা ও অন্য আলেমগণের মুখে শুনেছি। পরবর্তীতে আমি নিজে কুমিল্লা শহরে মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যেলার মুরববী ও নেতৃবৃন্দের নিকট আবেদন করে ব্যর্থ হই। অবশেষে ‘আন্দোলন’-এর যেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বুড়িচং আগমন করেন। তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য কুমিল্লা আসার পথে উনি বললেন, ছফিউল্লাহ! কুমিল্লা শহরে একটা মারকায করার জন্য মাটি দেখ। আমি গাড়িতে বসা অবস্থায় দূর থেকে বাসস্ট্যান্ডের পাশে শাসনগাছা এলাকায় মাটি দেখালাম, যা তখন পানিতে ডুবেছিল। উনি বললেন, এখানেই দেখ; এখন ডুবে আছে, পরে জেগে উঠবে। অতঃপর তিনি সেখানে মাটি ক্রয়ের জন্য ‘আন্দোলন’-এর সাবেক নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ-এর নিকট তিন লক্ষ টাকা প্রদান করেন। যা দিয়ে ১৪ শতক মাটি কেনা হয়। এজন্য তিনি আমাকে ও মাওলানা মুছলেহুদ্দীনকে দিয়ে ৫ সদস্যের একটা কমিটি করে দেন। অতঃপর সেখানে মারকায স্থাপনের জন্য তাওহীদ ট্রাস্টের অর্থায়নে ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৮ সালে মসজিদ ও মাদরাসার গৃহ নির্মাণ শেষে উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে আমাদের প্রচেষ্টায় সঊদী আরব শাখা ‘আন্দোলনে’র সুধী জনাব আবুল হাশেমের মাধ্যমে মসজিদ ও মাদরাসার জন্য আরো অর্থ সহযোগিতা পাই। যা দিয়ে মারকাযের নতুন তিন তলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমীরে জামা‘আত এসে ২০১৯ সালের ২৯শে নভেম্বর শুক্রবার যার উদ্বোধন করেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ!

তাওহীদের ডাক : আপনার সাংগঠনিক জীবনে সহযোগী হিসাবে কাকে সবচেয়ে বেশী কাছে পেয়েছেন?

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : আমার সাংগঠনিক জীবনে নিঃস্বার্থ ও বিশ্বস্ত সাথী হিসাবে সবসময় কাছে পেয়েছি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ কুমিল্লা যেলার বর্তমান সহ-সভাপতি মাওলানা মুছলেহুদ্দীনকে। আল্লাহ তাকে নেক হায়াত দান করুন। আমীন!

তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাকের পাঠক এবং আহলেহাদীছ ‘যুবসংঘে’র কর্মীদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু উপদেশ থাকলে বলুন।

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকাটি মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের প্রতিষ্ঠিত একটি দাওয়াতী মুখপত্র। তাওহীদের ডাক খাঁটি দ্বীন শিক্ষার পাশাপাশি যুবকদের জন্য সাহিত্যচর্চাসহ বহুমুখী জ্ঞান লাভের পথ উন্মোচন করে দেয়। তাই পাঠকবৃন্দকে নিয়মিত তাওহীদের ডাক পাঠের আহবান জানাচ্ছি। ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র বন্ধুদের বলছি, আপনারা সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থেকে পরকালীন মুক্তির জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করুন। এখানেই রয়েছে যুবসমাজের মুক্তির দিক- নির্দেশনা। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন- আমীন!

তাওহীদের ডাক : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ : তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।



বিষয়সমূহ: সাক্ষাৎকার
আরও