স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ত্রাণ বিতরণের কিছু স্মৃতি
ইহসান ইলাহী যহীর
[এক]
১৯৯২ সাল। দিন, তারিখ মনে নেই। রাজশাহীতে পড়তে যেতে হবে। কী দারুণ অনুভূতি! কিন্তু সেই ছোট্ট আমি একা একা যশোরেই তো যেতে পারি না, রাজশাহী যাবো কীভাবে! বলা হলো, যশোরের মণিরামপুর থানার মুজগুন্নী গ্রামের আরো দু’জন ভাইও পড়তে যাবে, তাদের সাথে যেতে হবে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। তারা হলেন আতাউর রহমান ও সাইফুয্যামান। তারা বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও তাদেরও তখন এতদূর সফরের মত সক্ষমতা তৈরি হয়নি। সেজন্য আমাদের ৩ জনকে রাজশাহী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন ঐ গ্রামেরই সন্তান শ্রদ্ধেয় আব্দুল আহাদ সাহেব। যশোর রেলস্টেশনে পৌঁছার পর বুঝলাম, ভ্রমণটা রেলভ্রমণ হতে যাচ্ছে। রেলভ্রমণ! ভাবা যায়! সে এক অন্যরকম অনুভূতি। অবশ্য এর আগে একবার রেল ভ্রমণ করেছিলাম বলে একটু একটু মনে পড়ে, কিন্তু তখন অনুভূতি প্রকাশের মত বয়স হয়নি। টিকেট কাটা হয়ে গেল। অপেক্ষা ট্রেন আসার।
হঠাৎ হুইসেল বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি, মহানন্দা এক্সপ্রেস হাজির। অমনি চেপে পড়লাম ট্রেনে। ঝিকঝিক ঝিকঝিক ট্রেন চলল রাজশাহী পানে। গোধূলি বিকেলের পর নেমে এল রাতের অন্ধকার। ট্রেনেই দেখা হয়ে গেল আরো কয়েকজন ভাইয়ের সাথে, তারাও নাকি একই প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাবে। বাড়ি সাতক্ষীরায়। পরিচয়ও হয়ে গেলো ভাইদের সাথে। তারা হল, শেখ আব্দুছ ছামাদ, যিয়াউর রহমান, নূরুল্লাহ ও আখতারুয্যামান। আমাদের রাজশাহী পৌঁছতে রাত গভীর হল। রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে রিকশা যোগে রাণীবাজার নিয়ে যাওয়া হল আমাদেরকে। তখন বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল রাণীবাজার মাদরাসা মার্কেটে। অনেক ডাকাডাকির পরও আমরা কাউকে ঘুম থেকে জাগাতে সক্ষম হলাম না। ফলে সেখানে রাত্রিযাপন আর করা হল না। পুনরায় ফিরে আসলাম রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে। সেই স্টেশন কিন্তু বর্তমান স্টেশন নয়; বরং সেটা ছিল পুরানো স্টেশন।
যাহোক স্টেশনের চেয়ারে বসেই রাত পার হল আমাদের। পরের দিন খুব ভোরে আমরা রওয়ানা দিলাম নওদাপাড়াস্থ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে। এই ছিল আব্দুছ ছামাদের সাথে আমার প্রথম স্মৃতি। এরপর থেকে এক যুগ ধরে একসাথে থাকা। একসাথে পড়াশোনা করা।
[দুই]
১৯৯৬/১৯৯৭ সাল হবে হয়তোবা। তখন আমরা ‘আমীনুন নাহু’ বইটি পড়ছি বা পড়ে ফেলেছি। সেখানেاسم صوت এ بَخْ، نَخْ শব্দদ্বয় আমরা পড়েছিলাম, যার উভয়টির বা শেষেরটি অর্থের ব্যাপারে আমরা জেনেছিলাম যে, এটি উট বসানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। একদিন আমি, শায়খ আব্দুছ ছামাদ সালাফী উস্তাদজীর বড় ছেলে আব্দুল আহাদ ও আব্দুছ ছামাদ বেড়াতে গিয়েছিলাম রাজশাহী চিড়িয়াখানায়। সাথে আর কেউ ছিল কিনা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। যাহোক চিড়িয়াখানায় ঘুরতে ঘুরতে আমরা উটের কাছে গেলাম। উট দেখেই আমি বলে উঠলাম, بَخْ، نَخْ। কিন্তু উট তার নিজ গতিতেই রয়ে গেল। না বসল, আর না নড়াচড়া করল। ওরা বলল, আব্দুল আলীম! কি ব্যাপার! উট বসল না কেন? আমি বললাম, উটটা এ্যারাবিয়ান উট না তো, তাই আরবী বোঝে না আর কি। এই যে হাসি শুরু হলো, হাসি যেন আর থামেই না। হাসিতে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা।
আব্দুছ ছামাদ প্রায়ই ঘটনাটা বলতো। আমাকেও একাধিক দিন বলেছে, আব্দুল আলীম! তোমার কি চিড়িয়াখানার সেই মজার ঘটনাটা মনে পড়ে?
আব্দুছ ছামাদ! তুমি চলে গেছো। এরকম বহু স্মৃতি রেখে গেছো। তোমাকে একজন ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম। তোমাকে সব সময় আমানতদার ও ইনছাফদার দেখেছি। মহান আল্লাহ তোমাকে পরপারে সুখে রাখুন এবং দুনিয়ায় তোমার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে ধৈর্যধারণের তাওফীক দিন। আমীন!
আব্দুছ ছামাদের নির্ধারিত আয়ু শেষ হয়ে গেছে, সে তার রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে। আজ-কাল-পরশু আমাদেরকেও একদিন যেতে হবে। সেই দিনটার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা যেন জান্নাতে আবার মুলাকাত করতে পারি-মহান রবের কাছে এই প্রার্থনা।
আব্দুছ ছামাদ ভাইয়ের স্মৃতিকথা
-ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
রাজশাহী, নওদাপাড়াতে আমরা আসি ১৯৯৬ সালের মে মাসে। তখন আমি খুব ছোট। নওদাপাড়া মাদরাসায় এসে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে এসে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও দিনগুলো বেশ ভালই কাটত। কেননা এখানে অনেক খেলার সাথী পেয়েছিলাম। বিশেষ করে মারকাযের বেশকিছু ছাত্র ছায়ার মত সঙ্গী ছিল, যাদের মধ্যে দু’জন ছিল সাতক্ষীরার আব্দুছ ছামাদ ভাই এবং যিয়াউর রহমান। আগে থেকে পরিচয় না থাকলেও যেহেতু একই গ্রামের মানুষ, তাই তাদের সাথে ভাবটা বেশ গাড়ই হয়ে গেল। আব্দুছ ছামাদ ভাই আমাদের এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন আর যিয়া এক ক্লাস জুনিয়র। প্রতিদিন বিকালে খেলাধূলার সময় মাঠে তাদের সাথে দেখা হত। তবে খেলাধূলায় ততটা পারদর্শী না হওয়ায় আব্দুছ ছামাদ ভাই সাধারণত দর্শকদের সারিতেই থাকতেন। ফলে তাকে গল্পগগুজবের সময়ই বেশী পেতাম। তখনই লক্ষ্য করতাম তিনি কথাবার্তায় বেশ স্পষ্টবাদী এবং বয়স কম হলেও যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সৎসাহসী। ক্লাসে, খেলাধূলার মাঠে কিংবা যে কোন বৈঠকে হক কথা বলাকে তিনি যেন কর্তব্য মনে করতেন। ফলে অনেক সময় তার কথাবার্তা বেশ কড়া ও ঠোঁটকাটা প্রতিক্রিয়া মনে হত। আবার সাধারণতঃ দেখা যায়, যারা মুখের উপর উচিৎ কথা বলতে পছন্দ করেন, রাগ তাদের নিত্য স্বভাব। আব্দুছ ছামাদ ভাইও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু এই রাগী স্বভাবের মধ্যে তিনি যে বৈশিষ্ট্যটা ধরে রেখেছিলেন সেটা হ’ল তার মুখ ভরা হাসি।
দেখা হলেই একটা অন্তরখোলা হাসি দিয়ে কথা শুরু করতেন। রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে দাখিল পরীক্ষার পর আলিমের ক্লাস শুরু হলে আমরা ভাগ্যচক্রে এক ক্লাসের ছাত্র হয়ে গেলাম। সেই থেকে দাওরায়ে হাদীছ পর্যন্ত আমরা দীর্ঘ কয়েক বছর একই সাথে ক্লাস করেছি। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বিভাগের ছাত্র হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সাংগঠনিক কোন কাজে আমাদের প্রায়ই একত্রিত হওয়া হত। তার সাথে সেসব হারানো দিনের হাজারো স্মৃতি জমে আছে। আলাদাভাবে কোন স্মৃতিটা উল্লেখ করব?
আব্দুছ ছামাদ ভাইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিল তার সততা এবং দায়িত্বশীলতা। দায়িত্ব সহজে নিতে চাইতেন না, কিন্তু একবার নিলে পূর্ণ সততার সাথে তা পালন করাকে নিজের জন্য অপরিহার্য করে নিতেন। সেটা সংগঠনের ক্ষেত্রে হোক কিংবা অন্য কোন ক্ষেত্রে। তার এই দায়িত্বশীল আচরণ সবার কাছে সুপরিজ্ঞাত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে পেশাগত জীবনে তিনি নওদাপাড়া মাদরাসায় শিক্ষক ও বোর্ডিং সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। বলা বাহুল্য, যে কোন হোস্টেলে বোর্ডিং সুপার তথা খাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটা প্রায় থ্যাংকলেস একটা জব। খুব কম ব্যক্তিকেই পাওয়া যাবে যিনি এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাহবা পেয়ে থাকেন। হয় ছাত্র কিংবা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অসন্তোষ তাকে সহ্য করতেই হয়। কিন্তু আব্দুছ ছামাদ ভাই সেদিক থেকে নিজগুণেই আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। প্রশ্নাতীত সততার কারণে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি যেমন ছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক, তেমনি ছাত্ররাও ছিল তার প্রতি সন্তুষ্ট। সেজন্য পক্ষ-প্রতিপক্ষ নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি একটা গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রাজশাহী থেকে সাতক্ষীরা বাঁকাল মাদরাসায় ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার পর বাঁকাল মাদরাসার যে কোন সংবাদ পেতে বিশ্বস্ত সূত্র হিসাবে তাঁকেই ফোন দিতাম। গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হয় খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যই। এরমধ্যেই তিনি সংবাদ পেলে বাসায় চলে আসতেন। গ্রামের নতুন প্রজন্মের ছেলেদের মধ্যে তিনি ছিলেন খুৎবা দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন। তাই গ্রামের আদর্শবান ছেলে হিসাবে সবাই তাকে একনামে চিনত। অসুস্থ হওয়ার পর আশাবাদী ছিলাম খুব দ্রতই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু ব্লাড ক্যান্সার চুড়ান্ত পর্যায়ে ধরা পড়ার পর সেই আশা ফিঁকে হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে তাঁর সাথে একবারই কথা হয়েছিল, যখন তিনি ঢাকা ইবনে সীনা হাসপাতালে ছিলেন। বলছিলেন, এখানে চিকিৎসা ভাল হচ্ছে না। অন্য কোথায় নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। করোনার কারণে দেশের হাসপাতালগুলোতে চলছে অচলবস্থা। পিজি বা ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার শত চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তার শারীরিক অবস্থাও অবশ্য মুভমেন্টের উপযুক্ত ছিল না। প্লাটিলেটের ঘাটতির কারণে শরীরের রক্তপ্রবাহ কোনভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ২৭ই মে’২১ রাত সাড়ে এগোরোটায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ এল। পরিণতি জানাই ছিল। তবুও অবিশ্বাসী মন মেনে নিতে চাইল না। তরতাজা মানুষটা এভাবে এত অল্প বয়সেই চলে যাবেন! বুকটা ধক করে উঠে। শরীর অসাড় হয়ে আসে। শূন্য দেয়ালে তাকিয়ে থাকি আর মনের স্ক্রীণে একের পর এক ভেসে উঠতে থাকে আব্দুছ ছামাদ ভাইয়ের জীবন্ত দিনের অজস্র স্মৃতি।
পরদিন দুপুরে সাতক্ষীরায় তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করতে গেলাম। বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যে তাঁর সাড়ে চার বছর বয়সী ইয়াতীম সন্তানটি কারো কোলে চড়ে এগিয়ে এল। তার দিকে তাকিয়ে বেদনায় চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু জমা হয়। কাকতালীয়ভাবে আব্দুছ ছামাদ ভাইয়ের পিতাও তাকে প্রায় একই বয়সে ইয়াতীম করে চিরবিদায় নেন। সেই ব্লাড ক্যান্সার রোগেই। আল্লাহ তাঁর ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস নছীব করুন। তাঁর সন্তানকে পিতার পদাংক অনুসরণ করে মানুষের মত মানুষ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
আব্দুল আলীম বিন কাওছার মাদানী