বস্ত্তনিষ্ঠ ইতিহাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ
আব্দুল্লাহ মাহমুদ
গ্রন্থের লেখক :
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। প্রকাশক : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৫৪। মূল্য : ৫৫০ টাকা। ১ম প্রকাশ : মার্চ ২০১৫। শেষ (৩য়)
সংস্করণ : ফেব্রুয়ারী ২০১৬।
ভূমিকাঃ- উর্দূ কবি হালী বলেন,
‘হেরা থেকে নেমে জাতির কাছে এলেন
এবং একটি পরশমণির টুকরা সাথে নিয়ে এলেন’
(মুসাদ্দাসে হালী ১৩ পৃ.)।
বিশ^বাসীর জন্য রহমত হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ঘোর তমসাচ্ছন্ন পৌত্তলিক আরবের বুকে প্রেরিত হন। তরুণ বয়সে তাঁর আদর্শবাদী নীতির ফলে সকলের নিকট তিনি ভূয়সী প্রশংসিত হন। নবুঅতপ্রাপ্তির মাধ্যমে প্রভুর পক্ষ হতে প্রকৃত মানবীয় শিক্ষা অর্জনের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর ভোগবাদী মানুষকে সঠিক পথ বাতলে দেবার জন্যে এলাহীবাণী কুরআন প্রাপ্ত হন। রাসূল (ছাঃ) সে মোতাবেক তাওহীদের দাওয়াত দিলে কাঙ্গাল ও মযলুম জনতার মধ্যে এক নতুনত্বের শিহরণ জেগে ওঠে। তারা যেন এ চিরন্তন আহবানের মধ্যে অধিকার ফিরে পাওয়ার আভা পাচ্ছিল। মহাজন কর্তৃক নিগৃহীত হবার নিয়তিই ছিল যে কৃতদাসের, সে যেন নিজেকে সার্বভৌম ভাবতে লাগল। কিন্তু বস্ত্তবাদী সমাজপতিরা পার্থিব স্বার্থ কুপোকাত হবে ভেবে তাওহীদের চিরঞ্জীব আহবানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বধ করতে না পারলেও দেশান্তর করে ছাড়ে। মদীনায় গিয়ে ইসলামের সুষ্ঠু দাওয়াত প্রচারে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ছোট-বড় ৯০টি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়। এভাবে সমস্ত বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে।
সার সংক্ষেপঃ গ্রন্থটির প্রারম্ভে রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাবস্থল আরব জাতি, আরবের অবস্থান এবং মক্কার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। আরবরা তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। রাসূল (ছাঃ) ছিলেন ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত আদনান-এর সম্প্রদায়ভুক্ত। ত্রিকোণ সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী আরব উপদ্বীপটি সকল নবী-রাসূলদের আগমনস্থল হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হ’ল, এখানকার অধিবাসীরা ব্যবসায় অভ্যস্ত থাকায় বণিকদের মাধ্যমে সারা বিশে^ তাওহীদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ত। পৃথিবীর নাভিস্থল খ্যাত মক্কার সামাজিক অবস্থা এককথায় might is Right ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিচালিত হত। সমাজে পুঁজিবাদী নিখাদ অর্থব্যবস্থা চালু থাকার ফলে এক শ্রেণীর মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হলেও সিংহভাগ মানুষের নিত্যসঙ্গী ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। তবে তাদের সততা, আমানতদারিতা, মেহমানদারীসহ স্মৃতিশক্তি এতই তীক্ষ্ম ছিল যে, একবার কোন কিছু শুনলে হুবহু মুখস্ত বলে দিতে পারত। হয়তোবা এসব সদগুণাবলীর কারণে বিশ^নবীকে আল্লাহপাক এই এলাকায় প্রেরণ করেন। যাতে তারা তাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছকে অবিকৃত রাখতে পারে। আরবের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ আলেম আমর বিন লুহাই বিদ’আতে হাসানাহর দোহাই দিয়ে সর্বপ্রথম শাম থেকে ‘হোবল’ মূর্তি চড়া দামে খরিদ করে এনে মক্কায় স্থাপন করে। অতঃপর ক্রমেই সারা মক্কায় ভাস্কর্য পূজার সয়লাব শুরু হয়ে যায়।
গ্রন্থটির ১ম ভাগে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম, বংশ ও শৈশব থেকে নবুঅতপ্রাপ্তি পর্যন্ত মাক্কী জীবনের বেদনাদায়ক ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। মুহাম্মাদ (ছাঃ) কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। আজন্ম ইয়াতীম মুহাম্মাদ ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। অনাথ মুহাম্মাদ এবার এলেন ৮০ বছরের প্রবীণ দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ছত্রছায়ায়। কিন্তু দু’বছর না যেতেই পিতামহ পরপারে পাড়ি জমান। ফলে পিতৃব্য আবু তালিব আমৃত্যু ভাতিজার একান্ত অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন। শৈশব থেকে যুলুম ও অন্যায়ের হিংস্রতা স্বচক্ষে দেখতে দেখতে তরুণ মুহাম্মাদের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠে। যুবক বয়সে তিনি জনকল্যাণমূলক ৪ দফা দাবী উত্থাপন করলে সকলের নিকট তা গৃহীত হয়। কুরায়েশগণ এটিকে ‘হিলফুল ফুযূল’ নামে আখ্যায়িত করেন। এটির সফল কার্যক্রমের ফলে সমগ্র মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে এবং মুহাম্মাদের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ‘আল-আমিন’ তথা পরম বিশ্বস্ত মুহাম্মাদ ৪০ বছর বয়সে উপনীত হ’লে আল্লাহর নিকট হতে এলাহীগ্রন্থ কুরআন প্রাপ্ত হন। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সর্বপ্রথম তাওহীদের জ্ঞানার্জনের অনুশাসন দেয়ার পর শিরকী জাহেলিয়াতে আবর্জনাময় ভূষণ ঝেড়ে সমাজ বিপ্লবের অপরিসীম দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। পুরো সমাজ যেখানে বস্ত্তবাদিতায় নিমগ্ন, এমন বৈরী পরিবেশে সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাইতো উর্দূ কবি বলেন,
‘বায়ু প্রবাহ ফিরানো কঠিন
স্রোতকে উল্টানো কঠিন,
কিন্তু অতটা কঠিন নয়, যতটা কঠিন
একটি পথভ্রষ্ট জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে আনা’।
মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বাগ্রে আপনজনদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম পর্বতচূড়ার এ প্রদীপ্ত আহবান মযলুম জনতার মধ্যে এক নতুন কম্পন জাগিয়ে তুলে। অধিকার বঞ্চিত মানবতা যেন এই অমর আহবানে সাড়া দেওয়ার মধ্যে ন্যায্য পাওনা ফিরে পাওয়ার আগাম বার্তা পাচ্ছিল। অপরদিকে ভাতিজার হৃদয় নিংড়ানো আহবান চাচা আবু লাহাব বরদাশত করতে পারেনি। সমাজনেতারাও ধর্মীয় নেতৃত্ব ও দুনিয়াবী স্বার্থের অপমৃত্যু দেখতে পেয়ে বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) কারো পরোয়া না করে বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে ভিন দেশীদের নিকট ব্যাপকহারে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু আবু লাহাবের পরিচালিত গীবতকারী জোটদল তার পিছু ছাড়েনি।
মোড়লদের সমস্ত আপোষ ও লোভনীয় প্রস্তাব অকৃতকার্য হওয়ায় তারা তাওহীদের অবিনশ^র আহবানকে গলা টিপে চিরবিদায় করে দেবার জন্য মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীদের উপর লোমহর্ষক নির্যাতন শুরু করে। ৫ম নববী বর্ষে উৎপীড়ন চরম আকার ধারণ করলে রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের পরিত্রাণের উপায় হিসাবে হাবশায় হিজরতের অনুমতি দেন। এদিকে হিজরতের খবর জানতে পেরে নেতারা সীমান্তে প্রহরা জোরদার করতে লাগল এবং তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য হাবশায় গিয়ে বৃথা অপচেষ্টা করে লাঞ্চিত হয়ে ফিরে আসে। কারণ বিদেশের মাটিতে যুলুমের খবর পৌঁছে গেলে সেখানে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে নরপিশাচ নেতারা গোত্রনেতা আবু তালিবকে হাত করতে চেষ্টা কম করেনি। অনন্যোপায় হয়ে তারা বনু হাশেম ও মুত্তালিবের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কট জারী করে, যা তিন বছর স্থায়ী হয়। বয়কটকালীন অতিশয় কষ্টক্লিষ্ট সহ্যের কিছুদিন পর সামাজিক ঢালস্বরূপ চাচা এবং পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনের নির্ভরকেন্দ্র স্ত্রী খাদীজা পরপর ইহলোক ত্যাগ করেন। চাচার মৃত্যুকালে ভাতিজার করুণ আকুতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং শয়তানের শিখন্ডি গোত্রনেতাদের প্ররোচনা বিজয়ী হয়।
শক্র পরিবেষ্টিত ও আশ্রয়হীন মযলুম নবী প্রৌঢ়ত্বের এই ৫০ বছর বয়সে পদব্রজে সাহায্যকারী সন্ধানের নিমিত্তে তায়েফ গমন করলেও উৎপীড়িত হয়ে ফিরে এসে দ্বিগুন উৎসাহে দাওয়াত দিতে থাকেন। কুচক্রীদের দ্বারা দিনে অপদস্ত হবার ভয়ে রাত্রিতে দাওয়াত প্রদানকালীন আক্বাবাহর বায়’আতের ফলে হিজরতের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইয়াছরেবীরা নিজেদের সাপে-নেউলে দূরত্ব ভুলে মক্কার নির্যাতিত মুসলমানদের আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। এদিকে কুরায়েশ নেতারা হিজরতে বাধা দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা সত্ত্বেও মুসলমানরা দ্বীন ও প্রাণ রক্ষার্থে মাতৃভূমি বিসর্জন দেয়।
গ্রন্থটির ২য় ভাগে মদীনার পারিপাশি^র্ক অবস্থা ও সংগঠিত যুদ্ধসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। মদীনায় সর্বমোট ৪টি দল গড়ে উঠেছিল। ১. আউস ও খাযরাজ গোত্র ২. ইহুদীদের ৩টি গোত্র ৩. নাছারা ও ৪. ইবনে উবাইয়ের গুপ্ত দল। ১ম হিজরী সনেই মযলুম মুসলমানদের দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে জিহাদের অনুমতি দেয়া হয়। এরপর থেকেই রাসূল (ছাঃ) সীমান্তে টহল অভিযান প্রেরণ করতে থাকেন। অতঃপর ২য় হিজরীতে ‘বদর’ প্রান্তরে তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মোকাবেলা সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধে মুসলিমদের ঈর্ষণীয় বিজয়ের ফলে তাদের ঈমানী শক্তি ও হিম্মত দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কুরায়েশরা মদীনার ধূর্ত মুনাফিক ও ইহুদীদের সাথে গোপন সংস্রব করে রাসূল (ছাঃ)-কে সেখান থেকে অপসারিত করার জন্য চূড়ান্ত অপচেষ্টা করতে থাকে। একাজে তারা যাতে স্বার্থক হতে না পারে সেজন্য রাসূল (ছাঃ) পার্শ^বর্তী বিভিন্ন গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত মদীনা চার্টার বা ‘মদীনা সনদ’ হিসাবে মানবতার সামনে পেশ করা হয়।
নবগঠিত মদীনা রাষ্ট্রের ক্রমোন্নতি দেখে হিংসায় জর্জরিত ইহুদীরা ৫ম হিজরীতে বেদুঈন গোত্রগুলোসহ কুরায়েশদেরকে পুনরায় উস্কানী দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১০০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী গড়ে মদীনার উপর আপতিত হয়। এদিকে রাসূল (ছাঃ) দক্ষ গুপ্তচরের মাধ্যমে অবগত হয়ে মদীনার প্রতিরক্ষার জন্য তিনদিকে বেষ্টিত পাহাড়ের বিপরীতে উত্তর পাশে^র্ দৈর্ঘ্যে ৫০০০ হাত পরীখা খনন করেন বলে একে ‘খন্দকের যুদ্ধ’ বলা হয়। মদীনার বিরুদ্ধে সমগ্র আরব সম্প্রদায়ের এই সর্ববৃহৎ হামলায় মাসাধিককাল অবরোধ শেষে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমরা বিজয়ী হয়।
৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূল (ছাঃ) ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাথীসহ মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। মক্কার অদূরবর্তী ‘হোদায়বিয়া’ নামক স্থানে কুরায়েশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হ’লে বিস্তর সমঝোতার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদী ৪ দফা বিশিষ্ট শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবাজ কুরায়েশদের মধ্যে যুদ্ধ নির্বাপিত হ’লে বিভিন্ন গোত্র এবং শক্তিধর সম্রাটদের নিকটে রাসূল (ছাঃ) পত্রের মাধ্যমে দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন।
সন্ধির দু‘বছর না যেতেই মিথ্যার পূজারী কুরায়েশদের হাতে চুক্তি লঙ্ঘিত হয়। যার ফলে কোনরূপ প্রতিদ্বনিদ্বতা ছাড়াই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয় ত্বরান্বিত হয়, যা মুশরিক নেতাদের দর্প চূর্ণ করে আরব উপদ্বীপ থেকে চিরকালের জন্য শিরক নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এদিকে রোমকরা মুতার যুদ্ধের গ্লানিকর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য মদীনায় হামলার দুঃসাহস দেখালে রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে সৈন্যসামন্তসহ রোম সীমান্তে যাত্রা করলে তারা আতংকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। এতে সারা আরবে মদীনার ইসলামী খেলাফত অপ্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হয়। সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর রাসূল (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায়ের আশংকা করলে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জে সকলকে হৃদয়র্স্পশী ভাষায় বিদায়ী নছীহত দেন। সেখানে ইসলাম পূর্ণতা পাওয়ার মাত্র ৮১ দিন পর ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।
গ্রন্থটির ৩য় ভাগে নবী পরিবার, নবী পত্নণীগণের মর্যাদা, রাসূল (ছাঃ)-এর শারিরীক গঠন, তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং একাধিক বিবাহের পর্যালোচনা করা হয়েছে। এভাগে কুরআন ও হাদীছ জীবন্ত মু‘জেযা হওয়ার ২৬টি চাক্ষুষ প্রমাণও উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রন্থে বর্ণিত মর্মস্পর্শী কিছু ঘটনা :-
১. হাবশার মুহাজিরগণ মদীনায় গমনের প্রাক্কালে সম্রাট নাজাশী তাদের সাথে সংসার বিরাগী ৭০ জন রাহেব প্রতিনিধিদল মদীনায় প্রেরণ করেন। রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে সূরা ইয়াছিন পাঠ করে শুনান। তখন অবিরল ধারায় তাদের দু’চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। তারা বলে ওঠেন ইনজীলের সাথে কুরআনের কি অদ্ভুত মিল! অতঃপর তারা সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম গ্রহণ করেন।
২. কুরায়েশদের কর্তৃক বনু হাশেম ও মুত্তালিবের সাথে বয়কট চলাকালীন উভয় গোত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিদারুণ কষ্টের সম্মুখীন হয়। সঞ্চিত খাদ্যশস্য ফুরিয়ে গেলে তারা গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হয়। ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুদের ক্রন্দনধ্বনি গিরি সংকটের বাইরের লোকেরা শুনতে পেত। মক্কার ব্যবসায়ীরাও জিনিসপত্রের চড়া দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, যা ক্রয় করা কারো পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। এদিকে রাতের বেলা সকলে শুয়ে যাওয়ার পর আবু তালিব দুশ্চিন্তায় রাসূল (ছাঃ)-কে বিশ^স্ত আপনজনদের সাথে বিছানা বদল করাতেন। যাতে কেউ তাকে অপহরণ করে নিয়ে না যেতে পারে।
৩. ছুহায়েব রূমী হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কিছুদূর যেতেই মুশরিকরা তাকে ঘিরে ফেলে। তখন সওয়ারী থেকে নেমে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তোমরা জানো আমার তীর সাধারণত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আমার তূনে একটি তীর বাকী থাকতেও তোমরা আমার কাছে ভিড়তে পারবে না। তীর শেষ হয়ে গেলে তলোয়ার চালাব। অতএব তোমরা যদি দুনিয়াবী স্বার্থ চাও, তবে মক্কায় রক্ষিত বিপুল ধন-সম্পদের সন্ধান বলে দিচ্ছি, তোমরা সেগুলো নিয়ে নাও এবং আমার পথ ছাড়। তখন তারা পথ ছেড়ে দিল। মদীনায় পৌঁছে এই ঘটনা বর্ণনা করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে প্রশংসা করে বলেন, ‘হে আবু ইয়াহইয়া! তোমার ব্যবসা লাভজনক হয়েছে’।
৪. মুতার যুদ্ধে খ্রিষ্টান রোমকদের ২ লক্ষ ফৌজের বিরুদ্ধে মুসলিমদের মাত্র ৩ হাজার সৈন্য প্রেরিত হয়। পরামর্শ সভায় আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহার তেজস্বিনী ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলিমরা রোমকদের মুখোমুখি হয়। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে সেনাপতি যায়েদ বিন হারেছাহ বর্শার আঘাতে শহীদ হলে জা‘ফর বিন আবু তালিব যুদ্ধের ঝান্ডা উত্তোলন করেন। এসময় তার ঘোড়া ‘শাক্বরা’ নিহত হলে মাটিতে দাড়িয়ে যুদ্ধাবস্থায় তার ডান হাত কর্তিত হলে বাম হাতে নিশান অাঁকড়ে ধরেন। অতঃপর বাম হাতের ছেদন ঘটলে বগলে ধ্বজা চেপে ধরেন। এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলে ইবনু রাওয়াহা পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি শহীদ হয়ে গেলে খালেদ বিন অলীদ সেনাপতি নিযুক্ত হন। মুসলিম বাহিনীর সীসাঢালা ঐক্য, অপূর্ব বীরতব এবং সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্যে খালেদের হাতে বিজয় পদচুম্বন করে।
৫. প্রতিনিধি দলসমূহ আগমনের বছরে একদিন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের নিকট একদল লোক আসবে, যারা ইসলামের ব্যাপারে তোমাদের চাইতেও নম্র হৃদয়’। অতঃপর ইয়ামনের আশ‘আরী গোত্রের ৭০০ লোক মুসলমান হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন পাঠ করতে করতে, কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে বলতে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। তারা মদীনায় প্রবেশের সময় খুশীতে কবিতা পাঠ করতে থাকেন, ‘কালকে আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে মিলিত হব। মুহাম্মাদ ও তার দলের সাথে’। রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেন, ‘তোমাদের নিকট ইয়ামন বাসীরা এসে গেছে। এদের অন্তর বড়ই কোমল, হৃদয় খুবই নরম’। ওমর ও আববাস (রাঃ) এই দৃশ্য দেখে কাঁদতে থাকেন।
প্রতিক্রিয়া :
রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীর উপরে আমার সর্বপ্রথম পাঠ এই গ্রন্থটি। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ যে দ্বীনের পথে কতটা সংগ্রামী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কতটা সিদ্ধহস্ত এবং সমাজে নিজেদের প্রভুত্ব ভন্ডুল হবার আশংকায় সমাজনেতারা যে কতটা নির্দয় হতে পারে গ্রন্থটি পড়ার পূর্বে কখনো বুঝিনি। ৮৫৪ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট পুস্তকটির আকৃতি দেখে প্রথমে তা পড়ার হিম্মত হয়ে উঠেনি। কিন্তু আগ্রহভরে বিভিন্ন যুদ্ধের কাহিনী, নবী জীবনের শেষ অধ্যায়, রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের কষ্টকর হিজরত এবং তাদের উপর অকথ্য নির্যাতনের বিবৃতি পড়ে বইটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত গ্রন্থটি পুরোপুরি পাঁচবার পড়ে ফেলি। গ্রন্থটি পড়ে যে কোন পাষাণ হৃদয় ধারণকারী ব্যক্তিরও অক্ষি কোণে অশ্রু ঘনীভূত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। আমরা শেষ নবীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার দাবীদার হয়ে তার পরিচয় ও জীবন প্রবাহ জানব না, এটা হতেই পারে না। এজন্য এই গ্রন্থটি অপরিহার্যভাবে অধ্যয়ন করতে আমি সকলকে পরামর্শ দিব।
শেষকথা
মদীনার দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক রাসূল (ছাঃ)-এর উদারনৈতিক দাওয়াত ভাষা ও অঞ্চলগত রেখা অতিক্রম করে কিভাবে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী অখন্ড ইসলামী জাতীয়তা গড়ে তুলেছিল, তার প্রতিবিম্ব হচ্ছে সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থটি। এমনকি এটি রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের হকের পথে দৃঢ়চিত্ত সংগ্রামী চেতনা এবং গরীব-দুখীদের রক্ষণস্থলের প্রতিচ্ছবিও প্রদান করে। গ্রন্থটি বাস্তবিকই খুব চমকপ্রদ। মাননীয় লেখককে মহান আল্লাহ তা‘আলা উত্তম জাযা দান করুন-আমীন!
লেখক : ছানাবিয়া ১ম বর্ষ, আল মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী