তোমাদের ধর্ম মিথ্যা!
ড. নূরুল ইসলাম
সকাল
সাড়ে সাতটার দিকে আববা বেরিয়ে গেলেন। নাতি-নাতনিকে দেখতে যাবেন। আমার
ভাগ্নীটা বেশ চঞ্চল হয়েছে। সবাইকে সারাদিন ব্যস্ত রাখে। কল করলেই বলে, নানু
তুমি কবে আসবে? তুমি এখন কী করছ? ইত্যাদি ইত্যাদি। আববা আবার নানান
ঝামেলার মানুষ। কোথাও যেয়ে বেশিক্ষণ থাকেন না। আববা চেয়েছিলেন সকাল সকাল
যেয়ে যোহরের আগেই ফিরে আসবেন। সেজন্যে খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের
হলেন। ফিরেও এলেন যোহরের আগে, তবে লাশ হয়ে।
আনুমানিক সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আববার এ্যাক্সিডেন্ট হয়। পেছন থেকে আসা ট্রলির ধাক্কায় সাইকেল আরোহী আববা গুরুতর আহত হন। উপযেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার পর যেলা হাসপাতালে নেয়ার পথে আনুমানিক পৌনে ১০টার সময় আববা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এ্যাক্সিডেন্টের পর আববাকে যখন প্রথম দেখি তখন তিনি এ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সেই আটপৌরে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবীতে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। কোনোরকমে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। এর তিন-চার মিনিট পর আববা মারা গেলেন।
ভালো মানুষ বাড়ি থেকে বের হলেন। হঠাৎ খবর এল এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এরপর তার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তিনি মারা গেলেন। একটা মানুষ এত সহজে মরে যায়!
ছোটবেলায় আববার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এরপর যত বড় হয়েছি, সময় যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি করেছে। শেষবার যখন তাকে জড়িয়ে ধরি, তখন তিনি লাশ হয়ে হাসপাতালের ট্রলিতে শুয়ে ছিলেন। যখন ঈষদুষ্ণ অশ্রুধারা তাকে সিক্ত করছিল, ততক্ষণে তিনি দূষিত দুনিয়ার মিছে মায়া কাটিয়ে ফেলেছেন। জানি এপারের কৃত্রিম ভালোবাসা ওপারে পৌঁছায় না। তবুও মনে হয় যদি আববাকে শেষ বারের মত কোনোকিছু বলার সুযোগ পেতাম, তাহ’লে বলতাম, আববা আপনাকে ভালোবাসি।
আমি জানি না, তবে অনেকে বলছিল গোসল করানোর পর নাকি আববার চেহারা থেকে এক ধরনের আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। জানি না কারণ যতবার আববার সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে।
দু’কলম পড়ালেখা শিখে আববাকে বোকা, সাধাসিধে আর সহজ-সরল ভাবতে শুরু করেছিলাম। প্রায়ই বলতাম, মানুষ কি আর এত বোকা আছে আববা! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় কেউ! উপযাচক হয়ে অন্যের উপকার করার কোনো মানে হয় না! ইত্যাদি ইত্যাদি। বোকা আববা মৃত্যুর পর মানুষের যে দো‘আ আর ভালোবাসা পেলেন তা দেখে রীতিমতো বুঝে গিয়েছি তার মতো বোকা হ’তে পারলে মানবজনম সার্থক।
সেই পুরনো সাইকেল, টেপ দিয়ে পেঁচানো মোবাইল ফোন, বুক পকেটে থাকা কলম, নোটবুক, নোটবুকে থাকা টাকা, চশমার খাপ, এমনকি মেয়ের বাড়ির জন্য কেনা আম, মিঠাই, খিচুড়ি- সবই ফিরে এল। ফিরলেন না শুধু আববা।
যখন একা একা থাকি, প্রায়ই একটা অনুভূতি ঘিরে ধরে। সব আছে, সব আছে, সব আছে; শুধু আববা নেই। নেই নেই নেই। ‘আববা আর কখনো আসবেন না’ ভাবতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের প্রচুর সান্ত্বনা বাণীতে ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছি মৃত্যু জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু নয়। মৃত্যু জীবনেরই অংশবিশেষ। জীবনকে পূর্ণরূপে উপভোগ করতে হ’লে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। মৃত্যুকে বাদ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করা সম্ভব নয়।
খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি জীবনের শেষ মুহূর্তে আববা কী কষ্টটাই না পেয়েছেন। রক্তাক্ত দেহ পড়ে ছিল রাস্তায়। অন্তিম মুহূর্তে কোনো আপনজনকে কাছে পেলেন না। এসব ভাবলে মনটা ভারী হয়ে আসে।
‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তোমরা পূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে ব্যক্তি সফলকাম হবে। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন প্রতারণার বস্ত্ত ছাড়া কিছুই নয় (আলে ইমরান ৩/১৮৫)।
উপরের আয়াত মনে পড়ার পর থেকে ওসব মন খারাপ করা চিন্তা ছাপিয়ে নতুন চিন্তা জায়গা করে নিয়েছে। খেল তামাশার দুনিয়া থেকে আববা কীভাবে বিদায় নিলেন সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে আববা ক্বিয়ামতের দিন যেন সফল হন।
‘যারা ঈমানদার এবং যাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী, আমরা তাদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে মিলিয়ে দেব। আর আমরা তাদের কর্মফল দানে আদৌ কমতি করব না। বস্ত্ততঃ প্রত্যেক ব্যক্তি স্ব স্ব কৃতকর্মের নিকট দায়বদ্ধ’ (তূর ৫২/২১)।
এই আয়াত মনের মধ্যে আশা আর সাহস যোগাচ্ছে। আববার সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ তো আছে! সুযোগটা কাজে লাগাতে পারব তো? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!
[গত ৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১০-টায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কুষ্টিয়া-পূর্ব সাংগঠনিক যেলার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য জনাব মাষ্টার হাশিমুদ্দীন সরকার (৬৫) কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন)। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ১ কন্যা ও ২ পুত্র রেখে যান। ঐদিন বাদ আছর নিজ গ্রাম কুমারখালীর নন্দলালপুর আহলেহাদীছ ঈদগাহ ময়দানে তার জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র, নওদাপাড়া মারকাযের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র অর্থ সম্পাদক হাফেয আসাদুল্লাহ আল-গালিব।
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।