মাহে রামাযান : মুছে যাক যাবতীয় গ্লানি
মুযাফফর বিন মুহসিন
মুযাফফর বিন মুহসিন 1339 বার পঠিত
‘বাংলাদেশ
আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কর্মীদের সর্বোচ্চ স্তর ও মান হ’ল ‘কেন্দ্রীয়
কাউন্সিল সদস্য’। সংগঠনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাউন্সিল সদস্যগণ অগ্রগতির
পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন।
যুগ যুগ ধরে কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন আহলেহাদীছগণ। অহি-র বিধানের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় তারাই সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অকুতোভয়ে। বদর-ওহোদ-খন্দকের ধারাবাহিকতায় ইসলাম ও দেশের মর্যাদা রক্ষায় তারা প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন ক্লান্তিহীন চেতনায়। উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তার জ্বলন্ত সাক্ষী। কিন্তু পরবর্তীতে এই ঐতিহাসিক সম্মান ও ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হ’তে শুরু করেছিল এবং আহলেহাদীছ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল এভাবে যে, রাফউল ইয়াদায়েন করা, বুকের উপর হাত বাঁধা ও সরবে আমীন বলাই তাদের কাজ। অন্যদের কারো ধারণা ইসলাম কেবল ভুয়া ফযীলতের কিতাবের মধ্যে বন্দী, কারো বিশ্বাস খানকা-মাযার ও ওরসের মাঝেই ইসলাম সীমাবদ্ধ। কেউ দ্বীন কায়েমের নামে মাযহাবী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কেউ সময় ব্যয় করছে মানবরচিত মিথ্যা দর্শনের পিছনে। কেউবা পাশ্চাত্যের সৃষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিধর্মীয় মতবাদের মধ্যে জনকল্যাণের স্বপ্ন দেখছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিল এই সব বাতিল মতবাদীদের লোভনীয় শিকার। আহলেহাদীছ ছাত্র ও তরুণরাও এ সবের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
এমতপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে ময়দানে আবির্ভূত হ’লেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মহানগরীর ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে ১৯৭৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী গড়ে তুললেন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’। শুরু হ’ল যাত্রা। আহলেহাদীছ নওজোয়ানদের এই সংগঠন হয়ে দাঁড়াল জান্নাত পাগল মানুষের মুক্তির দিশারী, মহাসত্যের যাত্রাপথের আলোর মশাল। কিন্তু বিদ‘আতীদের জন্য হল চরম আতঙ্ক। ত্রাস হয়ে উঠল জাহেলী মতবাদের ধ্বজাধারীদের জন্য। আহলেহাদীছের পরিচয় দিয়ে যারা আহলেহাদীছ সমাজকে অন্যের বশংবদ লেজুড়ে পরিণত করেছিল, তাদের জন্য হয়ে উঠল এক মরণজ্বালা।
শিরক, বিদ‘আত ও নব্য জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনের শুভ সূচনা করার কারণে যুবসংঘের সামনে এসেছে হাযারো বাধা। পথ ছিল কন্টকাকীর্ণ। গীবত-তোহমত, গালি-গালাজ, হিংসা-বিদ্বেষ, যুলুম-অত্যাচার, লোমহর্ষক নির্যাতন, অফিস ভাংচুর, বসত বাড়ীতে আগুন লাগানো, সম্পদ লুণ্ঠন থেকে শুরু করে এমন কোন জঘন্য কর্ম নেই যা তাদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হয়নি। অবশেষে মিথ্যা মামলা ও কারাগারের লৌহ কপাট।
এরপরও এই অদম্য তাওহীদী কাফেলা তার নিজস্ব নীতি-আদর্শ থেকে একচুল বিচ্যুত হয়নি। সংগ্রামী চেতনায় এগিয়ে চলেছে সম্মুখে। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় কবর পূজারীদের ইট-পাথরকে তোয়াক্কা করেনি, ১৯৮০ থেকে অব্যাহত গীবত-তোহমত-হিংসা ও চোখরাঙ্গানীর দিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি, মাওলানা আব্দুল মতীন সালাফীকে হারানোর ব্যথায় ভেঙ্গে পড়েনি, ১৯৮৯-এর ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি, ২০০১ সালে কপটদের বিভ্রান্তির কবলে পড়েনি, ২০০৫-এর সরকারী জেল-যুলুম ও নির্যাতনকে পরওয়া করেনি, ২০০৬-সালে নোংরা দলবাজিকে পাত্তা দেয়নি, ২০০৯ সালে আপতিত বাধাকে তোয়াক্কা করেনি। যাবতীয় বাধা ডিঙ্গিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। যাবতীয় যড়যন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলেছে; গুঁড়িয়ে দিয়েছে শিরক-বিদ‘আত ও জাহেলিয়াতে ভিত। ফালিল্লাহিল হামদ।
এভাবেই পেরিয়ে গেল ৩৩টি বছর। এরই মাঝে অনেক কর্মী ও কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য চির বিদায় নিয়েছেন। অনেক নতুন ভাই সামনে এসেছেন। ঈমানের পরীক্ষায় ছিটকে পড়েছেন। ৩৩ বছরের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে যদি ১৯৭৮ সালের দিকে পিছন ফিরে তাকাই, তবে বিশ্বাসই হবে না যে, সেদিনের ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ আজ এক পূর্ণ-পরিণত জাতীয় সংগঠন। ১৯৮১ সালের ৭ই জুনে সৃষ্টি হয়েছে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ মহিলা সংস্থা, ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু হয়েছে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বইয়ের, ১৯৮০ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায় ঐতিহাসিক সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন, ১৯৮৬-এর ২১-২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলন। সেখান থেকে এসেছে- ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ ও ‘তিনটি মতবাদ’ বই, ১৯৮৯-এর ৫ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সমাজকল্যাণ সংস্থা ‘তাওহীদ ট্রাস্ট’, ১৯৯১ সালে রাজশাহী মহানগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আহলেহাদীছদের সর্ববৃহৎ কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’, ১৯৯২-এর ১৫ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’, ১৯৯৪ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুরববী সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘সোনামণি’, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে আহলেহাদীছ আন্দোলনের তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ জ্ঞানসাগর ডক্টরেট থিসিস- ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’, ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা পত্রিকা মাসিক আত-তাহরীক, ১৯৯৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে আহলেহাদীছদের প্রথম ফাতাওয়া বোর্ড ‘দারুল ইফতা’, একই সালে প্রকাশিত হয় সর্বাধিক তত্ত্ব ও তথ্যবহুল ছালাত শিক্ষার বিশুদ্ধ বই ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আহলেহাদীছদের প্রথম মহিলা মাদরাসা, ২০১০ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় গবেষণা বিভাগ। সময়ের বাঁকে বাঁকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এভাবেই গড়ে উঠেছে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। ফালিল্লাহিল হামদ।
প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বয়ে স্মৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন’১১। এ সম্মেলন সংগঠনের অগ্রযাত্রার পথে অবদান রাখতে পারে আক্বাবায়ে কুবরার শপথের মত। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবিস্মরণীয় ত্যাগের বিনিময়ে ইসলাম মদীনা থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব হল- আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অভ্রান্ত সত্যকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে হাতে-দাঁতে অাঁকড়ে ধরা। ক্ষুদ্র বিষয়কে ক্ষুদ্র ভেবে বৃহত্তর বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া। যাবতীয় কার্যবিধি আল্লাহর দিকে সোপর্দ করা এবং তাঁরই কাছে উত্তম প্রতিদান প্রার্থনা করা।
আজ যারা প্রবীণ তাদের দায়িত্ব শেষ হয়নি। আমরা তাঁদেরকে আগামী দিনের তরুণ ছাত্র ও যুবকদেরদের উৎসাহ দেওয়ার আহবান জানাব। যেমনভাবে ওয়ারাক্বা বিন নওফেল বৃদ্ধ বয়সে রাসূল (ছাঃ)-কে উৎসাহ দিয়েছিলেন: ‘হায় আক্ষেপ! আমি যদি সেদিন থাকতাম! আফসোস! যেদিন তোমার জাতি তোমাকে বের করে দিবে সেদিন যদি আমি জীবিত থাকতাম! বিস্মিতচিত্তে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, আমাকে কি তারা বহিষ্কার করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই! তুমি যা নিয়ে এসেছ তা নিয়ে ইতিপূর্বে যিনিই এসেছেন তার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি যদি সেদিন বেঁচে থাকি তাহলে আমি সর্বশক্তি দিয়ে তোমাকে সাহায্য করব’।
নবীনদের জন্য স্মরণ করিয়ে দেব আমাদের ‘কর্মপদ্ধতি’ বইয়ের দু’টি লাইন- ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্যগণ হবেন ছাহাবায়ে কেরামের বাস্তব জীবনের প্রতিমূর্তি। আল্লাহর ভয়ে তারা যেমন থাকবেন সদা সন্ত্রস্ত, তেমনি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন ও বেহেশতের অতুলনীয় পুরস্কার লাভের আশায় থাকবেন সদা কর্মচঞ্চল’। আল্লাহ আমাদেরকে ছাহাবায়ে কেরামের প্রকৃত উত্তরসূরীদের অন্তর্ভুক্ত করুন! যারা আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় হয়ে গেছেন তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাঊস নছীব করুন! সেই সাথে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন ২০১১-কে আল্লাহ কবুল করুন- আমীন!!