মসজিদে নববীর ইতিহাস
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 472 বার পঠিত
-ড. এ এস এম আযীযুল্লাভারতবর্ষে ইসলাম আগমনের সূচনা হয় রাসূল (ছা.)-এর জীবদ্দশাতেই। অতঃপর খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ও তৎপরবর্তী পর্যায়ে আরব বণিক, ছাহাবায়ে কেরাম এবং ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে তা নানাভাবে বিকশিত হয়ে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক নানা পট পরিবর্তনের ফলে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে বহুমুখী বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। এই বিভ্রান্ত আক্বীদা ও আমলই সময়ের ব্যবধানে ভারতবর্ষের অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত মুসলমানের অন্তরে প্রকৃত ধর্মের স্থান দখল করে নেয়। ফলশ্রুতিতে এদেশের জনগণের মধ্যে কেউ মাযহাবপন্থী, কেউ পীরপন্থী, কেউ কবরপন্থী, কেউ শিরক ও বিদ‘আতপন্থী, আবার কেউ কেউ শী‘আ বা কাদিয়ানীপন্থী হয়েও নিজেকে স্বগর্বে মুসলমান পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নানা প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেও নগণ্য কিছু আলেম হক্ব বিমুখ বিভ্রান্ত নিরীহ মুসলমানের মাঝে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। যুগে যুগে এঁরাই ‘আহলেহাদীছ’ নামে অভিহিত হয়ে এসেছেন, আজও হচ্ছেন। জেনে রাখা ভাল আহলেহাদীছ কোন সম্প্রদায়ের নাম নয়। যিনি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ ও নিঃশর্ত অনুসারী কেবল তিনিই কেবল এই নামে নিজেকে অভিহিত করতে পারেন। আর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন সেটিই মূলতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলন।
ভারতবর্ষে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এ আন্দোলন এদেশে মূলতঃ একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসাবে পরিচিত হলেও সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের অবদান অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৬৪-১৮৪০) ও তাঁর শিষ্যদের দ্বারা গঠিত ফরায়েযী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এদেশে বৃটিশ রাজত্বকে তিনি এবং তাঁর সাথীরা ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং ইংরেজ শাসনাধীন এদেশকে তিনি ‘দারুল হার্ব’ বলে মনে করতেন। যার ফলে তাঁর আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারিত হয় এদেশ থেকে বৃটিশ বিতাড়নের মাধ্যমে ‘দারুল হারব’কে ‘দারুল ইসলামে’ পরিণত করা। যা ছিল বৃটিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ। অতঃপর বারাসাতের সৈয়দ নেছার আলী ওরফে তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১)-এর বাঁশের কেল্লার কথা বলা যেতে পারে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিতুমীর আপোষহীন ভূমিকা সর্বজনবিদিত। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহ্হাব পরিচালিত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে, যা এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’ বলে টিটকারী করে থাকে। এ আন্দোলনও ধর্মীয় সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনিভাবে বৃটিশ বিরোধী সর্বাত্মক আন্দোলনের ফলেই ভারতবর্ষ একপর্যায় বিদেশী দখলদারদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে।
বৃটিশ বেণিয়ারা এদেশ থেকে চলে গেল ঠিকই, কিন্তু রেখে গেল এমন কিছু নিয়ম-কানুন ও সংস্কৃতি, যার দ্বারা এদেশের আপামর জনসাধারণ আজও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে এদেশীয় নরপতিদের দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বৃটিশরা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে আমূল পরিবর্তন এনেছিল, যা ছিল ভূতপূর্ব ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলে এক শ্রেণীর প্রগতিবাদী ধর্মবিমুখ তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ সহজেই সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আনীত ঐ পদ্ধতিকে সাদরে বরণ করে নেয় এবং এর বিপরীত তথা দীর্ঘদিনের পুরাতন ব্যবস্থাকে কখনো পরোক্ষভাবে আবার কখনো প্রত্যক্ষভাবে এড়িয়ে যায় বা বিরোধিতা করে থাকে। যে কারণে ঐ সব মুসলমানের সন্তানদের চিন্তা-চেতনা থেকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অপর দিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অল্প শিক্ষিত আলেমদের নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের কারণে অধিকাংশ মুসলমানের কেউ মাযহাব পন্থী, কেউ পীর বা তরীক্বা পন্থী পরিচয়ে আপোষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি ছালাত-ছিয়ামের মত নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে এবাদত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বৃটিশের রেখে যাওয়া নিয়মের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে এদেশের নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কার্যতঃ ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মুসলমানদের মধ্যে এই সেক্যুলার ও পপুলার গোষ্ঠী দু’টি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে আপন আপন অবস্থানে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এরই মাঝে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সেক্যুলার বা পপুলার কোন পন্থার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে নিরপেক্ষভাবে অনুসরণ করে এসেছে। এঁরাই হল প্রকৃত পক্ষে আহলেহাদীছ এবং এঁদের পরিচালিত আন্দোলনই প্রকৃত আহলেহাদীছ আন্দোলন।
ভারতবর্ষে স্বতন্ত্র পরিচয়ে আহলেহাদীছরা সর্বপ্রথম সাংগঠনিক পরিচয় বহন করে ১৮৯৫ সাল থেকে। উক্ত সংগঠনের নাম ছিল ‘জামাআতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আপোষহীন সংগ্রামী সিপাহসালার মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব দেহলভী (১৮৬৬-১৯৩৩)। অতঃপর বিশিষ্ট মুনাযের ও প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, শামসুল হক্ব আযীমাবাদী, আব্দুর রহমান মুবারকপুরীসহ বেশ কিছু দুঃসাহসী আলেমের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে একটি বড় ধরনের আহলেহাদীছ ‘কনফারেন্স’-এর ব্যবস্থা করা হয়। উক্ত কনফারেন্সে উপস্থিত সুধীবৃন্দ ও ওলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে ‘অল-ইন্ডিয়া আহলে হাদীছ কনফারেন্স’ নামে একটি সর্বভারতীয় আহলেহাদীছ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার প্রথম সভাপতি ছিলেন হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী (১৮৪৪-১৯১৯)। এর ঠিক ৪০ বছরের মাথায় মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী (রহ.) (১৯০০-১৯৬০) প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদিস’ নামে একটি সংগঠন। এ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন মাওলানা আব্দুল্লাহেল বাকী (রহ.), মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৮৮-১৯৫৮), মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), মাওলানা আববাস আলী (১৮৫৯-১৯৩২), আবুল মনসুর আহমাদ প্রমুখ আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দ। যদিও তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এই ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদিস’ই কালের পরিক্রমায় ভৌগলিক পট পরিবর্তনের ফলে ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিস’ নাম ধারণ করে।
যতদিন মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী (রহ.) জমঈয়তে আহলে হাদিসের দায়িত্বে ছিলেন, কার্যতঃ ততদিন পর্যন্ত জমঈয়ত মূল আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে তার সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালিত করেছিল। এরপর থেকে যত দিন অতিবাহিত হয়েছে, জমঈয়ত তার মূল আদর্শ থেকে তত দূরে সরে গিয়েছে। মূল সংগঠনের এই করুণ অবস্থায় কিছু মুরববী পুরাতন মোহাববতে জমঈতের সঙ্গে চোখ-কান বুঁজে থাকলেও তরুণ সমাজ ঐ মরা নদী নিয়ে কোন অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারলো না। ফলে তারা দিন দিন আপন ঘর ছেড়ে পরের ঘরে গিয়ে নিজের মেধা, সময়, শ্রম এমনকি অবলীলাক্রমে জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে শুরু করে। এমত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বিশেষ করে আহলেহাদীছ ঘরের মেধাবী সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি যুব সংগঠন, যার নাম ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’। সাথে সাথে সারা বাংলাদেশে বিশেষ করে আহলেহাদীছ সমাজে অন্য রকম একটা সাড়া পড়ে গেল। দু’দিন আগেও যে পিতা তার সন্তানকে ছালাত আদায়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেও মসজিদমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আজ ‘যুবসংঘে’র ছেলেদের সংস্পর্শে এসে সে শুধু নিজেই ছালাত আদায়ের জন্য মসজিদে যাচ্ছে না, অন্যকেও নিয়মিত ছালাত আদায়ের পাশাপাশি সকল প্রকার শির্ক ও বিদ‘আত থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণের দাওয়াত দিচ্ছে। যে আহলেহাদীছ ঘরের সন্তান দু’দিন আগেও নেশা করে, সিনেমা দেখে, অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপ করে সময় অতিবাহিত করতো, সেই আহলেহাদীছ ঘরের সন্তান আজ দেশের প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আতী আমলের বিরুদ্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রচলিত ইসলাম বিরোধী নীতি ও কর্মের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হয়ে উঠল। এমনিভাবে দিনে দিনে পথভোলা আহলেহাদীছ ঘরের বিচ্ছিন্ন সন্তানেরা সঠিক পথের দিশা পেয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে প্রস্ত্তত হয়ে গেছে। এ অবস্থানে পৌঁছতে এ সংগঠনকে পার হতে হয়েছে বহু চড়াই-উৎরাই। তবু বাংলার বুকে এ সংগঠন তার হক্ব প্রসারের আন্দোলনকে কখনই স্তিমিত হতে দেয়নি। ফালিল্লাহিল হামদ।
আহলেহাদীছ যুবসংঘের আছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। রয়েছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নির্ধারিত পাঁচটি মূলনীতি এবং যুগোপযোগী চারদফা কর্মসূচী। এছাড়াও সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আছে চারটি কর্মীদের স্তর এবং চারটি সাংগঠনিক স্তর। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজও পর্যন্ত আহলেহাদীছ যুবসংঘ তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, মূলনীতি এবং কর্মসূচীর উপর অবিচল আস্থা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
আহলেহাদীছ যুবসংঘের কর্মীদের চারটি স্তরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের সদস্যকেই বলা হয় ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য’। একজন যুবককে সংগঠনের ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য’ মানে উন্নীত হতে গেলে, তাকে নৈতিক, ঈমানী, জ্ঞান ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়। ইচ্ছা করলেই সংগঠনের যেকোন সদস্য ঐ মানে উন্নীত হতে পারে না। এক কথায় এটি সংগঠনের কর্মীদের সর্বোচ্চ মান। ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অত্র সংগঠন বহু যুবককে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় উক্ত মানে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে।
যেহেতু সংগঠনটি বয়সভিত্তিক ক্যাডারে বিভক্ত হয়ে পরিচালিত হচ্ছে, সেহেতু বয়স বৃদ্ধির কারণে সাংগঠনিক বাধ্যবাধকতায় অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইকে অত্র সংগঠনের গন্ডি থেকে ঊর্ধ্বতন সংগঠনে প্রবেশ করতে হয়েছে। যাঁদের অনেকেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মূল সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আজও পর্যন্ত দ্বীনের কাজে সম্পৃক্ত রেখে নিজেদেরকে হক্বের পথে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। আবার অনেকের সে সৌভাগ্য হয়নি। কারণ ইতোমধ্যে এ সংগঠনটির উপর দিয়ে নানা রকম ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে। সে কারণে অনেকে দুর্বল ঈমানের পরিচয় দিয়ে, অনেকে জাগতিক প্রলোভনে পড়ে, অনেকে নেতৃত্বের প্রতি অযথা অভিমান করে, আবার অনেকে সংগঠনের মূল নীতি-আদর্শ পরিবর্তনের অযৌক্তিক দাবী তুলে সংগঠন থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। আবার অনেকেই চিরতরে ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর দরবারে পাড়ি জমিয়েছেন। তারপরও আহলেহাদীছ যুবসংঘ তার প্রতিষ্ঠিত নীতি-আদর্শের উপরে দৃঢ় থেকে কাঙ্খিত গতিতে না হলেও মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে ২০০৫ সালে একটি কুচক্রী মহল রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর সওয়ার হয়ে বাংলার বুক থেকে এই ক্ষুদ্র জামা‘আতটিকে চিরতরে মিটিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে জান্নাতকামী কিছু নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর পাহাড়সম সুদৃঢ় ঈমানী মনোবল, হক্বপন্থী জনসাধারণের প্রাণখোলা দোয়া, সর্বোপরি মহান আল্লাহর খাস রহমতে আহলেহাদীছ আন্দোলন আজও বাংলার মাটিতে সগৌরবে মাথা উঁচু করে পূর্বের তুলনায় আরও দুর্বার গতিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি যদি সংগঠনটি তার নীতি-আদর্শের উপর টিকে থাকে, তবে মহান আল্লাহ সামনে-পেছনের, ডাইনে-বায়ের সকল প্রকার চক্রান্তকে নস্যাৎ করে হক্বের এ আন্দোলনকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখবেন ইনশাআল্লাহ।
গঠনতান্ত্রিক নিয়মে যে সকল তরুণ ভাইয়েরা অত্র সংগঠনের সর্বোচ্চ মানের কর্মী হিসাবে চলমান দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাঁদের নিয়ে প্রতি বছরই সংগঠনের বিশেষ প্রয়োজনে এক বা একাধিক ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন’ হয়ে থাকে। যেখানে পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট এজেন্ডার উপরে আলোচনা, পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেই কাউন্সিল সম্মেলনের কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ থাকে। আবার প্রতি সেশনে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল, কর্মী ও সুধীবৃন্দের সমন্বয়ে ‘দ্বি-বার্ষিক কর্মী সম্মেলন’ একটি বড় আঙ্গিকে উন্মুক্ত আলোচনা হয়ে থাকে। যেখান পুরাতনদের মধ্যে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইয়েরা মূল সংগঠনের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন, শুধু তাঁরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন।
কিন্তু চলতি সেশনের দায়িত্বশীলবৃন্দ এবার একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনের আয়োজন করেছে। যেখানে সকল পুরাতন ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য’ ভাইদের দাওয়াত করার মাধ্যমে নতুন-পুরাতন সহযোদ্ধাদের এক অসাধারণ মেলবন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান ইতিপূর্বে কখনও আয়োজিত হয়নি বলে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র জন্য এটি এক ঐতিহাসিক সম্মেলন হিসাবে পরিগণিত হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ।
এই আয়োজন আমাদেরকে যেন এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে যাচ্ছে যে, সময়ের ব্যবধানে আমরা যেখানেই যাই না কেন, যত দূরেই থাকি না কেন আমাদেরকে আবার একদিন ফিরতেই হবে সেখানে যেখান থেকে আমাদের উত্থান ঘটেছিল। আমরা সকলেই এমন একটি আন্দোলনের সহযোদ্ধা ছিলাম এবং রয়েছি, যে আন্দোলন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ আন্দোলন। যে আন্দোলনের একমাত্র ঠিকানা জান্নাতুল ফেরদাউস ইনশাআল্লাহ। অতএব এ আন্দোলন থেকে জীবনের কোন একটি অসতর্ক মুহূর্তেও বিচ্যুত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এত কিছুর মাঝেও আমাদেরকে যে কঠোর বাস্তবতা ব্যথাতুর করে তোলে তা হল আমাদের কিছু ভাইয়ের পদস্খলন। সেক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নিকটে এই প্রার্থনা করি, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকল ভাইকে সকল প্রকার শয়তানী কুমন্ত্রনার ঊর্ধ্বে উঠে আহলেহাদীছ আন্দোলনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার তাওফীক দাও’। প্রসঙ্গতঃ ইতোমধ্যে আমাদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে কাঁদা ছুড়াছুড়ি করে এমন কিছু বিভেদাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যা কখনই বাঞ্ছনীয় ছিল না। এরকম অনাকাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে যত কারণ বা যুক্তিই থাকুক না কেন এই মুহূর্তে অন্যকে দোষারোপ না করে বলব, এখন আবার সময় এসেছে- নিজেদের পারস্পরিক স্বার্থদ্বন্দ্ব পরিহার করে হক্বের এই আন্দোলনকে সম্মুখপানে এগিয়ে নেওয়ার, সত্য ও ন্যায়ের বিজয়বার্তা ঘোষণার জন্য আবার সেই পতাকা হাতে তুলে নেয়ার। আল্লাহর রজ্জুকে মযবুত হস্তে ধারণ করে বাতিলের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নতুন অভিযাত্রার। যে সুযোগ ও সৌভাগ্য চাইলেই আল্লাহ সবার ভাগ্যে নছীব করেন না। তার জন্য আল্লাহর একান্ত রহমতের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!
পরিশেষে আমি নিশ্চিত যে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ তার সুনির্দিষ্ট নীতি-আদর্শের আলোকে শির্ক ও বিদআত অধ্যুষিত এই বাংলার জমিনে অহির যে দাওয়াতী নিশান বহন করে চলেছে, সে দাওয়াত যে বিশুদ্ধ দাওয়াত তাতে আমাদের কারোরই দ্বিমত নেই। তাই এ সম্মেলন থেকে আমাদের বুকভরা প্রত্যাশা, এই বিশুদ্ধ দাওয়াতের প্রতি আমাদের যে এক স্থায়ী ভালবাসা রয়েছে, নবীণ-প্রবীণের এ মিলনমেলার মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হোক। আর সত্যি বলতে কি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তথা আমাদের যৌবনকাল যে সংগঠনের নিবিঢ় ছায়াতলে প্রতিপালিত হয়েছে সে সংগঠনের প্রতি আমাদের ভালবাসার টান বাস্তবিকঅর্থে কোনদিন ম্লান হতে পারে না। তাই আসুন, জাগতিক সকল ভেদাভেদ ভুলে আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর এই দীপ্ত আলোকশিখাকে বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আর এই প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিল করি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সে তাওফীক দিন-আমীন\
লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।