প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1091 বার পঠিত
[‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে’র এই সৃনতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর পক্ষ থেকে মুযাফ্ফর বিন মুহসিন ও নূরুল ইসলাম]
তাওহীদের ডাক : আমাদের জানামতে আপনিই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর উপর প্রথম পিএইচ.ডি ডিগ্রীধারী। বিষয়টি নিঃসন্দেহে তখনকার প্রেক্ষাপটে স্পর্শকাতর ছিল। তা সত্ত্বেও এমন একটি বিষয়কে পিএইচ.ডির জন্য বেছে নেয়ার চিন্তা কিভাবে এসেছিল?
আমীরে জামা‘আত : পিএইচ.ডি থিসিসের জন্য ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-কে বেছে নেওয়ার আত্মিক প্রেরণা আমার মধ্যে হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এ আন্দোলনকে যখন থেকে জেনেছি তখন থেকেই বিষয়টি আমার অন্তরে স্থান করে নিয়েছিল। সুপ্ত এ প্রেরণা বাস্তবতার পাদপ্রদীপে আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদানের পর পিএইচ.ডি করার বিষয়বস্ত্ত নির্বাচনের সময়। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ডঃ আব্দুল বারীর একান্ত চাপ ছিল তাঁর চাচাজী মরহূম ‘মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শীর জীবন ও কর্ম’ বিষয়ে কাজ করি। এজন্য তিনি সুপারভাইজর হিসাবে প্রফেসর ডঃ আফতাব আহমাদ রহমানীর নাম প্রস্তাব করেন। তাঁরা উভয়ে ছিলেন জমঈয়তে আহলে হাদীস-এর যথাক্রমে সভাপতি ও সহ-সভাপতি। সে মোতাবেক কাগজ-পত্র তৈরী করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জমা দেইনি। কেননা জীবনীমূলক গবেষণায় আমি আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। বরং আদর্শের উপরে গবেষণা করাই ছিল আমার ইচ্ছা। আর সেজন্যেই আহলেহাদীছ আন্দোলনকে বেছে নিয়েছিলাম এবং নতুনভাবে কাগজ-পত্র প্রস্ত্তত করি। এর উপরে ১৯৭৯ সালেই আমার প্রথম বই বের হয়, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’? আমার একান্ত কামনা ছিল এই যে, এমন একটি বিষয়ে আমি পিএইচ.ডি করব, যেটা হবে নির্ভেজাল সত্যের দিক-নির্দেশক এবং যেটার উপর কাজ করা অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু এসে যায়, তাহ’লে যেন তার নেকীর বিনিময়ে আমি জান্নাত লাভ করতে পারি। এরই মধ্যে কমনওয়েল্থ স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত আহবান করা হ’ল এবং সেজন্য ইউজিসিতে বাছাই পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হ’ল। সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষিকাগণ সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে পিএইচ.ডির জন্য স্কলারশিপের আবেদন করতে পারবেন। আমি দরখাস্ত পাঠালাম। অতঃপর ১৯৮৪ সালে চূড়ান্ত নির্বাচনে আমি ১ম এবং চট্টগ্রামের আবুবকর রফীক ২য় হন। যিনি এখন চট্টগ্রাম বেসরকারী আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি। আমরা উত্তীর্ণ হ’লেও ঐ বছর কাউকে স্কলারশিপ দেওয়া হল না অজানা কোন কারণে। পরের বছর আমার বয়স ৩৫ হয়ে যাওয়ায় আর দরখাস্ত করতে পারিনি। তাই একই বিষয়বস্ত্ত আমি ইউজিসিতে পেশ করি এবং সেখান থেকে বৃত্তি নিয়ে ‘বিমক’ ফেলো হিসাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ’ শিরোনামে থিসিস করি। ১.১.১৯৮৬-তে অফিসিয়ালি কাজ শুরু করলেও প্রকৃত অর্থে কাজ শুরু হয় স্টাডি ট্যুর শেষে মার্চ ’৮৯ থেকে। অতঃপর ১৯৯২-এর ২০শে আগষ্ট অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমার ডিগ্রী অনুমোদন করে।
তখনকার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি স্পর্শকাতর ছিল বলা যায় এই কারণে যে, (১) আহলেহাদীছকে তখন আমভাবে বেদ্বীন, অজ্ঞ ও লা-মাযহাবী বলে গালি দেওয়া হ’ত (২) আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে প্রফেসরদের প্রায় সকলেই ছিলেন মাযহাবপন্থী এবং অনেকে ছিলেন আহলেহাদীছ বিদ্বেষী (৩) সাধারণ শিক্ষকদের কাছেও বিষয়টি ছিল নিতান্ত অনভিপ্রেত এবং অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় (৪) আহলেহাদীছ শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল নিরুৎসাহমূলক। কারণ এটি তাদের মতে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট এবং এর ফলে অন্যদের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাবে। তাছাড়া তাদের অনেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন (৫) ইতিহাসবিদ প্রফেসরগণ এটিকে ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে উদ্ভূত একটি সাময়িক আন্দোলন হিসাবে মনে করতেন এবং সে হিসাবে এর প্রতি যৎসামান্য আগ্রহ বোধ করতেন। অথচ আহলেহাদীছ হিসাবে আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখি যে, আহলেহাদীছ আন্দোলন হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসা একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন। বাকী সবই পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট এবং ভেজাল মিশ্রিত। আর আমার গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সেটা প্রমাণ করা।
আরেকটু গোড়ার দিকে গেলে বলতে হয়, আমার এ আগ্রহের সূত্রপাত হয়েছিল আমার আববার মাধ্যমেই। তিনি ছিলেন দক্ষিণবঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গে আহলেহাদীছ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর লিখিত ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ’ ছোটকালেই আমার হৃদয়ে রেখাপাত করে। বিভিন্ন বাহাছ-মুনাযারায় মাযহাবী আলেম ও পীরদের অযৌক্তিক দলীল, হিংসাত্মক আচরণ ও মিথ্যাচার এবং হাস্যকর যুক্তি-তর্কসমূহের কাহিনী ছোট থেকেই আববার কাছে শুনেছি। অন্যান্যদের মত তিনি গোঁড়া ও সংকীর্ণচেতা ছিলেন না। লাবসা মাযহাবী মাদরাসায় শিক্ষকতা করে এবং মাযহাবী ব্যক্তির বাড়ীতে ২৭ বছর তাদের একান্ত আপনজন হিসাবে জীবন অতিবাহিত করা তাঁর উদারচিত্ততারই পরিচায়ক। অথচ তিনি তখন ছিলেন মাযহাবীদের সাথে বাহাছ-মুনাযারায় আহলেহাদীছ পক্ষের নেতা। তাঁর আক্বীদা ছিল স্বচ্ছ, নিখাদ ও দৃঢ়। একই সাথে তাঁর আচরণ ছিল উদার, মমত্বপূর্ণ ও সমাজদরদী। আমি আমার মাদরাসা শিক্ষা জীবনের প্রথমদিকে কাকডাঙ্গায় ১০ বছর তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে কাটিয়েছি। তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে অত্যন্ত নিকট থেকে তাঁর আচার-আচরণ দেখার ও তা থেকে প্রভাবিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাই আহলেহাদীছকে অন্যদের মত স্রেফ একটি ফের্কা হিসাবে আমি কখনোই মনে করিনি। ফলে ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল আল্লাহ সুযোগ দিলে এ আন্দোলনের গভীরে প্রবেশ করব এবং এর প্রকৃত পরিচয় সমাজের নিকট তুলে ধরব। পিএইচ.ডি করার সুযোগটিকে আমি সেভাবেই গ্রহণ করি এবং একে আমার স্বপ্ন পূরণে আল্লাহর রহমত হিসাবে বরণ করে নেই।
তাওহীদের ডাক : বিষয়টি বেছে নেয়া আপনার জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল বা এর জন্য কোন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি না?
আমীরে জামা‘আত : হ্যা! কাজটি নিঃসন্দেহে ছিল চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মত সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও সুযোগ আল্লাহ আমাকে দান করেছিলেন। বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এনেছেন অলৌকিকভাবে এবং উক্ত বিষয়ে ডিগ্রীটাও হয়েছে নিতান্তই আল্লাহর বিশেষ রহমতে। বরং আরো বলা যায়, শৈশব থেকেই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমি আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া পেয়েছি। সর্বদা আমি আমার লক্ষ্যে দৃঢ় থেকেছি। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে বিরোধীদের শত বিরোধিতা ও বিনাশ সাধনের অপচেষ্টা আমাকে পথচ্যুত করতে পারেনি, আলহামদুলিল্লাহ। কখনো আত্মজীবনী লেখার সুযোগ পেলে সেসব কথা বলা যাবে। তবে আজ কেবল পিএইচ.ডি বিষয়েই বলব।
পিএইচ.ডি করতে গিয়ে আমার ১ম চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যক্তি বনাম আদর্শ। যেটা আগেই বলেছি। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার ছিল যে, এতে আমি স্বয়ং বিমক চেয়ারম্যানের বিরাগভাজনই শুধু হইনি বরং ধারাবাহিক ক্রোধ ও প্রতিশোধের শিকার হই।
২য় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংশ্লিষ্টরা জানেন যে, থিসিসের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি ঘাট পার হতে হয়। (ক) বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি (খ) ফ্যাকাল্টি (গ) এডভ্যান্সড স্টাডিজ কমিটি (ঘ) একাডেমিক কাউন্সিল। এই চারটি কমিটির কোথাও গবেষক নিজে থাকেন না। ফলে ফ্যাকাল্টিতে গিয়ে আমার প্রস্তাব আটকে গেল। প্রশ্ন উঠল, আহলেহাদীছ আবার কি? এর উপরে পিএইচ.ডি কিসের? প্রায় বছরখানেক পড়ে থাকল। ঐখানে সদস্য থাকেন বিভাগীয় সিনিয়র শিক্ষক প্রতিনিধি এবং বাইরের কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি। একবার বাইরের কলেজের জনৈক শিক্ষক বিষয়টি কঠিনভাবে ধরেন এবং আমার বিভাগের প্রতিনিধির সাথে তাঁর তুমুল বিতন্ডার পর শেষ পর্যন্ত বিষয়টি পাস হয়। তিনি বলেছিলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মা কালী’র উপরে একজন মুসলমান পিএইচ.ডি করতে পারেন, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আহলেহাদীছের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন পিএইচ.ডি হবে না? তাঁর একথার সদুত্তর কেউ দিতে পারেননি। ঐ প্রতিনিধিকে আমি আজও চিনি না। অন্য সদস্যদের মুখ থেকে তার এসব বক্তব্য জেনেছি। আল্লাহ তাঁকে ইহকাল ও পরকালে উত্তম জাযা দান করুন। পরবর্তীতে আমার বিরোধী সেই সিনিয়র কলিগকে উত্তম আচরণের মাধ্যমে এমন এক উত্তম প্রতিশোধের সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছিলেন যে, তিনি এখন আমার হিতাকাংখীদের একজন। বরং হানাফী হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীর মৃত্যুর পর জানাযায় উপস্থিত মানুষকে কেবলমাত্র আমার খাতিরে কুলখানির বিদ‘আতী অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেননি এবং পরেও করেননি। যদিও এসব করার জন্য তাঁর উপর শিক্ষকদের যথেষ্ট চাপ ছিল।
৩. ১৯৮৪ সালে ইউজিসি’তে কমনওয়েল্থ স্কলারশিপের জন্য বাছাই পরীক্ষা। ইন্টারভিউ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে বিমক চেয়ারম্যানের কক্ষে ডাক পড়ল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বললেন, তুমি চাচাজী মরহূমের উপরে গবেষণা শিরোনাম ঠিক রেখে ইন্টারভিউ দাও। তাতে তোমার উত্তীর্ণ হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র উপরে করলে উত্তীর্ণ হ’তে পারবে না। কারণ ইন্টারভিউ বোর্ডের ৯ জন সদস্যের মধ্যে আমি বাদে বাকী সবাই হানাফী এবং তার মধ্যে দু’জন বামপন্থী। কাফী ছাহেবকে সাহিত্যিক ও রাজনীতিক হিসাবে এবং আমার চাচাজী হিসাবে সবাই জানেন। অতএব সহজেই পাস হয়ে যাবে। আমার পরামর্শ হ’ল, আগে ডিগ্রীটা করে নাও, পরে আহলেহাদীছ আন্দোলনের উপর গবেষণা কর’। আমি বললাম, স্যার! ছাত্রজীবন থেকেই এ আন্দোলনকে ঘিরে আমার স্বপ্ন। আমি এ আন্দোলনের উপরেই কাজ করতে চাই। ইন্টারভিউতে উত্তীর্ণ হওয়া না হওয়াটা আল্লাহর ইচ্ছা’। আমার এ জওয়াবে তিনি আদৌ খুশী হননি।
যথাসময়ে ইন্টারভিউ শুরু হ’ল। তিন-চার মিনিটে সবাই বেরিয়ে আসছে। এক সময় আমার ডাক পড়ল। সালাম দিয়ে ঢুকলাম। সুসজ্জিত কক্ষ। সদস্যদের বাইরে একজন আছেন বৃটিশ কাউন্সিলের প্রতিনিধি। তিনি পরীক্ষার্থীর ইংরেজী জ্ঞান পরখ করেন। পুরা ইন্টারভিউটা হয় ইংরেজী ভাষায়। আমি আমার গবেষণা শিরোনাম বললাম। সবাই যেন চমকে উঠলেন। কেননা বিষয়টি এযাবত কেউ পিএইচ.ডির জন্য নির্বাচন করেনি। তবে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর সাবেক ডিজি ও চবি-র প্রফেসর ডঃ মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান প্রথমেই বিষয়টি পসন্দ করে মতপ্রকাশ করলেন। এবার শুরু হ’ল প্রশ্নোত্তরের পালা। ঢাবি-র প্রোভিসি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ মাহফূযুল্লাহ বললেন, Mr. Ghalib! Explain your movement. আমি ইংরেজীতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতিগুলি সাবলীল ভঙ্গিতে বলে গেলাম। অতঃপর ডঃ মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান প্রশ্ন করলেন, What is the differance between tareeqah-i. Muhammadia mavement and Ahle hadeeth movement? সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দিলাম। অতঃপর ঢাবি-র প্রফেসর ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, Is there any publication on the movement by you? আমি yes বলেই ফাইল থেকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বই বের করে প্রত্যেক সদস্যের হাতে এক কপি করে দিলাম। বৃটিশ কাউন্সিলের প্রতিনিধি আমাকে বললেন, Why do you wish to go to London for study on Ahle hadeeth, rather the mejority Ahlehadeeth People lives in Indian Sub-continent and in the Middle East? (আপনি কেন লন্ডন যেতে চান? অথচ অধিকাংশ আহলেহাদীছ জনগণ ভারত উপমহাদেশে ও মধ্যপ্রাচ্যে বসাবস করে?) জবাবে বললাম, আমি কখনোই লন্ডন যাব না, যদি আপনাদের বিখ্যাত লাইব্রেরীটি ঢাকায় এনে দিতে পারেন। জবাব শুনে সবাই হেসে উঠলেন। অতঃপর অনুমতি পেয়ে সবার সপ্রশংস দৃষ্টির মধ্যে ২৭ মিনিট পরে বেরিয়ে এলাম। পরীক্ষার্থীরা সব ঘিরে ধরল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন- এত দেরী কেন হ’ল? বিকালে ফলাফল প্রকাশিত হ’ল। আমার নাম প্রথমে, অতঃপর আবুবকর রফীক। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে চলে এলাম। গেইট পার হবার সময় বোর্ডের সদস্য প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গাড়ী থেকে নেমে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, Mr. Ghalib! you know I am also an Ahle hadeeth.
৪. বিমক ফেলোশীপ-এর নিয়ম ছিল প্রতিবছর কাজের অগ্রগতি বিবেচনায় বৃত্তি নবায়ন হওয়া। কিন্তু তিন বছর পর চাহিদা অনুযায়ী উন্নতি দেখাতে ব্যর্থ হ’লে বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়। বিমক-এর আইনী খড়গ আমার উপর চাপানো হবে-তা বুঝলাম তখনই যখন বারবার মৌখিক ও লিখিত আবেদন করেও বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পেলাম না। ১৯৮৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তিন বছর পূর্ণ হবে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকায় একদিন কথায় কথায় আমার একান্ত সুহৃদ আব্দুল মতীন সালাফীকে বিষয়টা বললাম। শুনে উনি চমকে উঠে বললেন, আপনি এতটা সরল মানুষ তাতো বুঝতে পারিনি। এটাইতো আপনাকে ডুবানোর সুযোগ। আইনী কারণে ব্যর্থ হ’লে আপনার বিরুদ্ধে বলা সহজ হবে যে, নিজ অযোগ্যতার কারণে আপনি পিএইচ.ডি করতে পারেননি। আমি আপনার যাতায়াত খরচের ব্যবস্থা করছি। আপনি প্রস্ত্তত হন।’ তার ব্যাখ্যা শুনে আমি হতবাক হ’লাম। তবে ইতিপূর্বে একাধিকবার ধোঁকা খেয়েছি বলে তেমন বিস্মিত হইনি। অতঃপর যাবতীয় প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে ২১.১২.১৯৮৮ইং তারিখে আমি করাচীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এটাই ছিল আমার প্রথম বিদেশ সফর। সত্যি কথা বলতে কি, আল্লাহ পাকের মহান ইচ্ছায় ঐসময় আব্দুল মতীন সালাফী যদি ভূমিকা না নিতেন, তাহলে আমার স্বপ্নসাধ পূর্ণ হ’ত কি-না সন্দেহ। আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন- আমীন!
হাঁ, তাকেও ‘যুবসংঘ’কে সমর্থন করার অপরাধে (?) মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এরশাদ সরকারের মাধ্যমে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে ২.৭.১৯৮৯ইং তারিখে মাত্র ৩ ঘণ্টার নোটিশে স্বদেশে (ভারতে) পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন তার বিদায়ের দৃশ্য ছিল অতীব করুণ। কোনক্রমেই বুঝতে পারছিলাম না কেন এটা ঘটল। পরে আসল ঘটনা জানতে পেরে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এত বড় পদে আসীন ব্যক্তির দ্বারা এত নীচু ও অমানবিক কাজ সংঘটিত হতে পারে তা ছিল আমাদের ভাবনার বাইরে। এ ঘটনার পিছনে তাঁর এই ষড়যন্ত্রের বাস্তব সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী সরদার আমজাদ হোসেন (রাজশাহী)। যা তিনি সেসময় মাওলানা মুসলিম, মাহমূদ আলম ও আমার সামনে প্রচন্ড উষ্মার সাথে বর্ণনা করেছিলেন।
৫. বই-পত্র এখনকার মত সহজলভ্য ছিল না। তাই প্রথম তিন বছর বলতে গেলে আমি তেমন কোন কাজ করতে পারিনি তথ্য-উপাত্ত অভাবে। মূল বিষয়বস্ত্ততে প্রবেশ করলাম বিদেশ থেকে সংগৃহীত কিতাব-পত্র ও অন্যান্য উপাদানসমূহ পাওয়ার পর। ইতিমধ্যে আমি একবার যাত্রাবাড়ী মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়াহর লাইব্রেরীতে বসে কিছুদিন পড়াশুনা করতে চেয়েছিলাম। কারণ লাইব্রেরীটি ছিল আমার হাতে গোছানো এবং সেখানে রক্ষিত পুরানো কিতাব সমূহের অনেকগুলি আমার গবেষণায় কাজে লাগত। কিন্তু অনুমতি মিলেনি। পরে শেষবারের মত একদিন আমি ঢাবি-র আরবী বিভাগ থেকে ইউজিসিতে ফোন করে সরাসরি বিমক চেয়ারম্যানের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলাম। কিন্তু খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে তিনি এড়িয়ে গেলেন। এ সময় আমার সাথে ছিলেন যাত্রাবাড়ীর শিক্ষক বেলাল হোসায়েন রহমানী (গোদাগাড়ী)। পরে জেনেছি তাঁদের প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। মনের দুঃখে কুয়েতে ও রিয়াদে পত্র লিখলাম। দু’জায়গা থেকেই কিতাব আসল যথাক্রমে ৬১৯ ও ১২১ কেজি করে। কিন্তু ঠিকানায় ওঁরা প্রযত্নে ওঁনার নাম দিয়েছে। ফলে বিমানের Way-bill ওঁনার ঠিকানায় চলে যায়। পরে কিতাব আনার সময় ওঁনার প্রশ্নের জওয়াবে বললাম, স্যার! দেশে যখন কেউ সাহায্য করেনি, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে বিদেশে পত্র লিখেছিলাম। আল্লাহ রহম করেছেন। এরপরে তিনি চুপ ছিলেন। অবশ্য রিয়াদের কিতাবগুলি সরাসরি রাবি-তে এসেছিল। মানুষ পথ বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তা খুলে দিলেন এমনভাবে, যা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। ফালিল্লা-হিল হামদ।
৬. পিএইচ.ডির মধ্যম পর্যায়ে তখন আমি দারুণ ব্যস্ত। ওদিকে স্ত্রী তার তিন ছেলেমেয়ে সামলিয়ে চরম ব্যস্ততার মধ্যে এম.এ. পরীক্ষা দিচ্ছে। আর মাত্র ২টি পরীক্ষা বাকী। এ সময় আবার খড়গ চাপল উপর মহলের। হঠাৎ একদিন রাত ১০-টার দিকে দরজায় করাঘাত। পরিচিত কণ্ঠ শুনে দরজা খুললাম। দেখি পরিচিত লোকটির সাথে এক অপরিচিত ব্যক্তি। তারা ঘরে ঢুকল টলতে টলতে। জীবনে মদের গন্ধ কেমন জানিনা। কুরআন-হাদীছে ভরা ঘর মদের দুর্গন্ধে ভরে গেল। জড়িয়ে জড়িয়ে সে বলল, ‘চাচা আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছে, আপনি আমাকে দু’লাখ টাকা দেন, এখানে কেউ আপনার বিরুদ্ধে টু শব্দ করতে পারবে না। নইলে আপনাকে এখান থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে চলে যেতে হবে’। বললাম, ‘কেন যেতে হবে আমাকে? তাছাড়া মাসের শেষ। এখন কোথাও খালি বাসা পাওয়া যাবে না। গেলে আগামী মাসের ১ তারিখে যাব। কিন্তু সে কোন কথা শুনতে রাজী নয়। বললাম, বেশ। আমি যাব। দু’লাখ টাকা নয়, সাধুর মোড়ের লোকদের দু’ফোটা বিদায়ী অশ্রু তার চাইতে আমার নিকটে অধিক মূল্যবান।’ যাতে আমি ৭ দিনের মধ্যে অবশ্যই যাই, সেজন্য ২দিন পরে সে তার দলবল আমার উপর পুনরায় হামলা করে স্থানীয় হোমিও ডাক্তারখানার মধ্যে। সেদিন এলাকার মুরববী আফসার আলীর নিঃস্বার্থ সহযোগিতার কথা আমি সর্বদা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দিন। অতঃপর পরের সপ্তাহেই রাজশাহী সাধুর মোড়ের বাসা ত্যাগ করে হড়গ্রামে এক বাসায় উঠতে হল। হিংসার আগুন যে কত তীব্র হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
৭. স্নেহাস্পদ ছাত্রকর্মী আযীযুর রহমানের (নাচোল) চেষ্টায় হড়গ্রামে একটা খালি বাসার সন্ধান পাওয়া গেল। ২০শে ডিসেম্বর ১৯৯০ আমরা হড়গ্রামের নতুন বাসায় এলাম। সবাই অপরিচিত। স্থানীয় আহলেহাদীছ মসজিদে খুৎবা দিলাম। মসজিদ কমিটির জনৈক প্রভাবশালী সদস্য বললেন, এই মসজিদে আজই প্রথম আহলেহাদীছ-এর সত্যিকারের খুৎবা শুনলাম। এযাবত কেউ ‘আহলেহাদীছ’ নামটিও এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেনি’। সেদিন জয়পুরহাট যেলা যুবসংঘের সভাপতি ‘মাহফূয’ মসজিদে উপস্থিত ছিল। উল্লেখ্য যে, আশপাশের বহু হানাফী মুছল্লী এখানে ছালাত আদায় করেন। খতীব আহলেহাদীছ হলেও জামায়াতপন্থী লোক হওয়ায় তাদের খুৎবা হ’ত সর্বদা সকলকে খুশী করা ও ভোটমুখী। ফলে কুরআন-হাদীছের প্রকৃত বিষয়গুলি মুছল্লীরা জানতে পারত না। আমি সাধুর মোড়ের অভ্যাসমতে প্রতি মঙ্গলবার বাদ আছর মসজিদে সাপ্তাহিক তাফসীরের ঘোষণা দিলাম। শুরু হ’ল দাওয়াতী কাজের প্রসার। শিক্ষিত ভাইদের আগমন বাড়তে লাগল। কিছুদিনের মধ্যেই ৬ জন ভাই ‘আহলেহাদীছ’ হলেন। কিন্তু এটাই অবশেষে কাল হ’ল।
যিনি আমাকে এখানে আনার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন, সেই অতি ভক্ত মাওলানাই রুষ্ট হলেন। কেননা উনি নিজেকে এলাকার ‘পীর’ বলতেন। মসজিদে আমার অনুরাগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকায় তিনি অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। ফলে তাঁর লোকদের ইশারায় স্থানীয় কিছু মূর্খ ব্যক্তি বাজারে ৪দিন আমাকে অপমান করল। এদিকে ঢাকা থেকে এসে মাননীয় নেতা শুধু আমার কারণেই দলবল নিয়ে এলেন একদিন আছরের সময় পূর্ব ঘোষণা দিয়ে। তিনি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে অনেক কিছু বললেন এবং আশ্বাস দিয়ে গেলেন বিদেশী অনুদানে মসজিদ পুনর্নির্মাণ করে দেবেন (যদিও আজও তা হয়নি)। আশ্বাস পেলেন মসজিদ কমিটির দুই নেতা তাদের ছেলেদের চাকুরীর। ফল হল দ্রুত। উনি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই মসজিদ কমিটির সেই দুই নেতা এসে আমার হানাফী বাড়ীওয়ালাকে বলে গেলেন যেন আমি ২৮শে জানুয়ারী ১৯৯২-এর মধ্যে হড়গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। বছরের ব্যবধানে আবার সপরিবারে বাসা ছাড়ার হুমকি আমাকে চরম বেকায়দায় ফেলে দিল। অন্যদিকে ৩১.১২.৯১ইং তারিখের মধ্যে থিসিস জমা দেওয়ার চূড়ান্ত মেয়াদ শেষ হবে, তা নিয়েও দারুণ টেনশনে আছি। যাহোক আল্লাহর অশেষ রহমতে পরে হানাফী নেতারাই আমাকে সাহায্য করেন। ফলে সে যাত্রায় রক্ষা পাই। কিন্তু ঐ আহলেহাদীছ মসজিদে আমার যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল। ফলে পরবর্তী কয়েকবছর আমাকে স্থানীয় হানাফী মসজিদেই ছালাত আদায় করতে হয়েছে। অতঃপর ১৯৯৬ সালের ২৬শে এপ্রিল আমি সপরিবারে নওদাপাড়ার বর্তমান বাসায় চলে আসি।
৮. আমার সুপারভাইজর একজন কট্টর মুক্বাল্লিদ হানাফী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পাকিস্তানী উস্তাদ প্রফেসর এইচ. দানীর উপদেশ মোতাবেক ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর উপর পিএইচ.ডি গবেষণার ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। তাছাড়া গবেষণাকর্মে তিনি আমার উপর খুবই আস্থাশীল ও সন্তুষ্ট ছিলেন। তাই সবদিকে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তাঁর উপর নানাবিধ চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে উনি থিসিস অনুমোদন না করেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। থিসিস জমা দেবার পূর্বে পরীক্ষকমন্ডলী গঠনের সময় সুপারভাইজর ছাহেবকে অনুরোধ করেছিলাম যেন কোন আহলেহাদীছ প্রফেসর আমার পরীক্ষক না থাকেন। তিনি আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য হানাফী ও পীরপন্থী প্রফেসরদের হাত দিয়েই সর্বসম্মতিক্রমে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর উপর কৃত এই ডক্টরেট থিসিস পাস হয়ে যায় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তা অনুমোদন করে। ফালিল্লা-হিল হামদ।
তাই বলতে পারি, প্রচন্ড মানসিক নির্যাতন এবং কঠিন বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়েও এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে গবেষণাকর্ম সফলভাবে শেষ করতে পারার পিছনে যেমন দেশ ও বিদেশের উদারপন্থী বিদ্বানদের সহযোগিতা রয়েছে, তেমনি এর বিরোধিতায় সবরকমের বাধা সৃষ্টি করেছেন কতিপয় আহলেহাদীছ নেতা, আলেম ও তাঁদের অজ্ঞ অনুসারীগণ। আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন!
আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়, ১৯৯০ সালের ২২শে নভেম্বর। থিসিসের হস্তলিখিত ৭৫০ পৃষ্ঠার গোটা পান্ডুলিপি নিয়ে চট্টগ্রামে ১২ দিন অবস্থান করে মূল্যায়ন কমিটির সদস্য প্রফেসর মুঈনুদ্দীন আহমাদ খানকে দেখানোর পর আমি রাজশাহী ফিরছি। এবারে টাইপে দেব। সঙ্গী ছিলেন আব্দুছ ছামাদ সালাফী। ঢাকা থেকে কোচটি লালপুর-বাঘা হয়ে আসছে। হঠাৎ রাত ২-২০ মিনিটে ঈশ্বরদী-লালপুরের মধ্যবর্তী এক আখক্ষেতের কাছে যাত্রীবেশী ডাকাতেরা ছুরি বের করে ডাকাতি শুরু করল। কয়েকজন রক্তাক্ত হল। একটু পর যার যা আছে সব নিয়ে ওরা নেমে পড়ল। আমার ও সালাফী ছাহেবের ব্যাগ দু’টিও তারা নিল। সব নেয়া শেষ করে আখক্ষেতের পাশে মালামাল জমা করছিল। এবার গাড়ী ছাড়বার উপক্রম। এ সময় সীট থেকে উঠে ডাকাত সর্দারটাকে ডেকে বললাম, ‘ঐ কালো ব্রীফকেসটা আমার। ওটা ফেরৎ দাও। ওতে কিছু নেই কাগজ-পত্র ছাড়া।’ সে বিনা বাক্য ব্যয়ে নেমে গিয়ে প্রথমে সালাফী ছাহেবের ব্যাগটা আনল। বললাম, আরেকটা আছে। ইশারায় দেখিয়ে দিলাম। চাঁদনী রাত। সব দেখা যাচ্ছিল। সে আবার নেমে গিয়ে আমার ব্রীফকেসটা এনে দিল। তারপর গাড়ী ছাড়ল। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে বসে পড়লাম।
ব্যাপারটা ছিল এই যে, সর্দারটি বাসে আমার সীটের অনতিদূরে বসেছিল। রাস্তায় কয়েকবার ওকে সিগারেট খেতে নিষেধ করায় সে আমার প্রতি দুর্বল ছিল। তাছাড়া আমাদের মাথায় টুপী ছিল এবং যাত্রীরা যাতে কেউ সিগারেট না খায় ও ড্রাইভার যাতে ক্যাসেট না বাজায় সেজন্য আমার উপদেশমূলক কথায় সে হয়ত প্রভাবিত হয়েছিল। ফলে ওর সাথীরা ব্রীফকেস নিয়ে গেলেও সে নিজ হাতে তা ফিরিয়ে দিয়ে যায়। সেদিনই মনে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যে আমার এই সাধনা আল্লাহ কবুল করেছেন। নইলে ডাকাতের হাত থেকে অলৌকিকভাবে এ পান্ডুলিপি ফেরৎ আসতো না..فلله الحمد والمنة।