আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রাথমিক ইতিহাস
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 1050 বার পঠিত
দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন
৭- মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান (প্রতিষ্ঠাকালঃ ২৪শে জুলাই ১৯৪৮) : ভারত বিভাগের পর লাহোরের সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছের গোড়াপত্তন হয়। লাহোর সরকারী কলেজের আরবী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল কাউয়ূমের উদ্যোগে আয়োজিত প্রায় দুইশত আলেম ও নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত উক্ত জমঈয়তের প্রথম ছদর বা সভাপতি নির্বাচিত হন খ্যাতনামা আলিম ও রাজনীতিক মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ গযনবী (১৩১২-৮৩/১৮৯৫-১৯৬৩) বিন আব্দুল জাববার বিন আব্দুল্লাহ গযনবী (১২৩০-৯৮ হিঃ) ও সম্পাদক হন অধ্যাপক আবদুল কাইয়ূম। মাওলানা গযনবীর বাড়ী সংলগ্ন মাদরাসা ‘দারুল উলূম তাক্বভিয়াতুল ইসলাম’ -এর দু’টি কামরা জমঈয়ত অফিসের জন্য বরাদ্দ করা হয়।[1] তাঁর পরে ‘আমীর’ হন বিখ্যাত আলিম মাওলানা ইসমাঈল সালাফী (গুজরানওয়ালা)। ১৯৬৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ‘আমীর’ হন শায়খুল হাদীছ মাওলানা মুহাম্মাদ গোন্দলবী। ১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে বর্তমান আমীর হলেন মিয়াঁ ফযলে হক। কেন্দ্রীয় অফিস ১০৬, রাভী রোড়, লাহোর। ১৯৪৮ সালে ব্যাপকভিত্তিক মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ কায়েম হবার পূর্বে ১৯১৩ সালে এডভোকেট মৌলবী আযীমুল্লাহ ও মৌলবী সুলতান আহমদের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ‘আনজুমানে আহলেহাদীছ লাহোর’ কায়েম হয়। প্রথমজন ছিলেন ‘ছদর’ ও দ্বিতীয়জন ‘নাযেম’। যিনি অধ্যাপক আবদুল কাইয়ূমের নানা ছিলেন। পরে ১৯৩৪ সালে ইনি সভাপতি ও আবদুল কাইয়ূম ছাহেব সম্পাদক হন[2] যিনি উক্ত পদেই সম্ভবতঃ আমৃত্য বহাল ছিলেন। সাপ্তাহিক ‘আহলেহদীছ লাহোর’ এই জমঈয়তের মুখপত্র।
৮ - জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান (প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৮১)
রাজনৈতিক বিষয়ে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে আল্লামা ইহসান ইলাহী যাহীর (১৯৪০-১৯৮৭ খৃঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ ১৯৮১ সালে গুজরানওয়ালাতে এক বিরাট সম্মেলনের মাধ্যমে পৃথক ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ’ গঠন করেন।[3] প্রথম ‘আমীর’ হন শায়খুল হাদীছ মাওলানা আবদুল্লাহ ও নায়েম হন শায়খ মুহাম্মাদ হুসাইন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে আল্লামা ইহসান ইলাহী সম্পাদক পদ গ্রহণে বাধ্য হন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে আহলেহাদীছ আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। বহু প্রতিশ্রুতিশীল আলেম ও তরুণ তাঁর প্রতি আস্থাবান ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি নিজে পাকিস্তানের সমকালীন সময়ের সেরা বাগ্মী ছিলেন। পনেরো/ষোলখানা মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা ও খ্যাতনামা আলিম ও রাজনীতিক ছিলেন। তাঁর স্পষ্টবাদিতা ও ক্ষুরদার লেখনীর কারণে বিষেশ করে শী‘আ, কাদিয়ানী ও ব্রেলভীগণ সন্ত্রস্ত ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক মহল আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই নওজোয়ান সিপাহসালারকে ভীতির চোখে দেখতেন। ফলে হিংসুকদের চক্রান্তে ১৯৮৭ সালের ২৩শে মার্চ সোমবার লাহোরের কেল্লা লছমনসিং ময়দানে বোমার সাহায্যে তাঁকে হত্যা করা হয়। সাথে সাথে নিহত হন আরও আটজন সেরা আহেলহাদীছ আলিম ও নেতৃবৃন্দ। যখম হন শতাধিক ব্যক্তি।[4] তাঁর ইন্তেকালের পরে প্রফেসর সাজেদ মীর সম্পাদক হন। ৫০, লোয়ারমাল রোডে প্রশস্ত জমির উপরে এই জমঈয়তের সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা সজ্জিত বিরাট অফিস অবস্থিত। মাসিক তরজমানুল হাদীছ, সাপ্তাহিক আল-ইসলাম, ‘মুমতায ডাইজেষ্ট’ সাময়িকী এই জমঈয়তের নিয়মিত পত্রিকা হিসাবে চালু আছে।
৯ - জামা‘আতে আহলেহাদীছ পাকিস্তান (প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩১ খৃঃ) : খ্যাতনামা আলিম মাওলানা আবদুল্লাহ রৌপড়ী (১৩০৩-১৩৮৪/১৮৮৪-১৯৬৪) ‘জামাআতে আহলেহাদীছ পাঞ্জাব’ নামে ১৯৩১ সালে প্রথম এই সংগঠন কায়েম করেন। বর্তমানে লাহোরের চকদালগেরাঁ ‘মসজিদে কুদ্সে’ এই জামা‘আতের কেন্দ্রীয় দফতর অবস্থিত। সাপ্তাহিক ‘তানযীমে আহলেহাদীছ’ এই জামা‘আতের মুখপত্র। মাওলানা আবদুল কাদের রৌপড়ী বর্তমানে ‘আমীর’।
১০ - জামা‘আতে মুজাহেদীন পাকিস্তান : আমীরুল মুজাহিদীন সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী (১২০১-১২৪৬/১৭৮৬-১৮৩১) ও আল্লামা ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১) -এর জিহাদী আদর্শের অনুসারী হওয়ার দাবীদার এই জামা‘আতের পাকিস্তান শাখার বর্তমান আমীর গাযী আবদুল করীম এবং নায়েবে আমীর করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মাদ যাফরুল্লাহ। করাচী ব্লক-৬ গুলশান ইকবালে এই জামা‘আতের কেন্দ্রীয় মাদরাসা জামে‘আ আবুবকর আল-ইসলামিয়াহ এবং কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী অবস্থিত- যা আধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত। দা‘ওয়াত ও তাবলীগের আধুনিক ব্যবস্থাপনাসহ কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি খুবই সুন্দর ও উন্নতমানের। গ্রন্থপ্রকাশ, মুবাল্লিগ-প্রশিক্ষণ ও তাবলীগের মাধ্যমেই এঁরা আহলেহাদীছ আন্দোলন করে থাকেন। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তাঁরা সমর্থন করেন না। এই জামা‘আতের নিজস্ব মুখপত্র নেই।[5] ভারতের পাটনা ছাদিকপুরের মূল কেন্দ্র কিংবা বাংলাদেশে এই জামা‘আতের কোন তৎপরতা নযরে না পড়লেও করাচীতে এই জামা‘আতের দৃষ্টান্তমূলক তৎপরতা রয়েছে।
[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পি এইচ.ডি থিসিস) শীর্ষক গ্রন্থ পৃঃ ৩৭৯-৩৮১]
[1]. সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’ (লাহোরঃ শীশমহল রোড়, ‘মাওলানা মুহাম্মাদ হানাফী নাদ্ভী’ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা) ৪০ বর্ষ ৫২ সংখ্যা, ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৮৮, পৃঃ ৩১৮।
[2]. প্রাগুক্ত পত্রিকা পৃঃ ৯৭।
[3]. মাসিক ‘তারজুমানুল হাদীছ’ ২১ বর্ষ ৩-৪র্থ সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল ১৯৮৮, পৃঃ ৩১৮।
[4]. প্রাগুক্ত পত্রিকা পৃঃ ১৬-২৪।
[5]. তথ্যঃ ইয়াহ্ইয়া আযীয,, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, জামা‘আতে মুজাহিদীন পাকিস্তান।-তারিখ ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৮৮।