ফিলিস্তীনে ইহুদীবাদের জন্ম ও তাদের দাবীর যথার্থতা
লিলবর আল-বারাদী
ড. মুহাম্মাদ আতাউর রহমান 947 বার পঠিত
ইতিহাসের পাতায় স্বাধীন বসনিয়া
১৯৯২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী বসনিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। সে মোতাবেক বসনিয়া ১৯৯২ সালের ১ মার্চ সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। নববই দশকের শুরুতে নিজস্ব স্টাইলে সমাজতান্ত্রিক দেশ যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র স্বাধীন ছয়টি দেশে বিভক্ত হয়। এগুলো হলো-সার্বিয়া, ভজভোদিনা, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজেগোভিনা এবং মন্টেনিগ্রো। আর মেসিডোনিয়া ও কসভো ছিল স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে সার্বিয়া। সার্বরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল যুগোশ্লাভিয়ায়। তাদের হাতে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা। রাজধানী বেলগ্রেড থেকে সার্বরা নিয়ন্ত্রণ করত গোটা যুগোশ্লাভিয়া। বর্তমানে সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো একত্রে থাকলেও একে একে স্বাধীন হয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া, মেসেডনিয়া, হার্জেগোভিনা ও বসনিয়া। বসনিয়ার পশ্চিমে এবং উত্তরে ক্রোয়েশিয়া, পূর্বে সার্বিয়া এবং দক্ষিণে মন্টেনিগ্রো। বসনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪৯% মুসলমান, ৩১% সার্ব, ১৮.৫% ক্রোট এবং ১.৫% অন্যান্য। মুসলমানরা কমিউনিস্ট শাসিত শাসনামলে বিভিন্নভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক দিক দিয়ে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়ার ফলে কমিউনিজমের পতনের সাথে সাথে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু মুসলিম প্রধান বসনিয়ার স্বাধীনতার পর নতুন এ দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পরিচিত বসনিয় নামে। দেশটির অপর দুই সংখ্যালঘু জাতি সার্ব ও বসনিয় ক্রোট। ক্রোটরা পার্শ্ববর্তী দেশ ক্রোয়েশিয়ার সাথে এবং সার্বরা সার্বিয়ার সাথে বসনিয়াকে একীভূত করার দাবি তোলে। সার্বিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ও বসনিয় ক্রোটদের বিতাড়িত করার ঘোষণা দেয় সার্ব জাতীয়তাবাদী সমর্থকরা। সার্বরা বসনিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। তারা সার্বিয়ার মদদে বসনিয় মুসলমানদের চরম বিরোধিতা শুরু করে। এমনকি সার্বরা সেখানে একটা পার্লামেন্ট খাড়া করে পাল্টা সার্ব রিপাবলিকান ঘোষণা করে। এই রিপাবলিকানকে সার্বিয়ার সাথে অঙ্গীভূত করার লক্ষ্যে বসনিয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। গড়ে তোলে ৮০ হাজার সদস্যের এক শক্তিশালী সার্ব সেনাবাহিনী। আর এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। সার্বিয়া সরকার এই বাহিনীকে বিমান, কামান, ট্যাংক, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ দিয়ে প্রকাশ্যে সহায়তা করে। আর এসব সমরাস্ত্র দিয়ে সার্বরা বসনিয়ায় মুসলিম নিধনে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হামলে পড়ে। সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বুকে সবচেয়ে কলংকিত অধ্যায়। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সার্ব মনস্তাত্ত্বিক ডাক্তার রাদাভান কারাদজিচ। বসনিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে সার্বদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। জেনারেল রাতকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে সার্বসেনারা একটির পর একটি শহর দখল ও বসনিয়া থেকে সার্ব ছাড়া মুসলিম ও ক্রোটদের বিতাড়িত করার কাজ শুরু করে।
যুদ্ধের কবলে বসনিয়া
বসনিয়ার যুদ্ধকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ পরবর্তীকালীন সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ। কম্যুনিস্ট শাসিত সাবেক যুগোশ্লাভিয়া থেকে ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার দু’ বছরের মাথায় এই যুদ্ধ শুরু হয়। যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট স্লবোদান মিলোসেভিচ গোটা বলকান অঞ্চল জুড়ে সার্ব জাতির আধিপত্য কায়েমের স্বপ্ন দেখতেন। এ লক্ষ্যে বসনিয়ার রাজধানী সারাজেভো অবরোধ করে সার্ব বাহিনী মুসলমান হত্যায় মেতে উঠে। এই যুদ্ধে উগ্র সার্ব ও ক্রোয়েশিয়া বাহিনী নির্মমতার যে উদাহরণ তৈরি করেছিল বিশ্ব ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বসনিয়ায় যুদ্ধচলাকালে একটি ‘ত্রয়ীশক্তি’ ইউরোপের বুকে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। এরা হলেন তৎকালীন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লাবোদান মিলোসেভিচ, বসনিয়ায় যুদ্ধরত স্ব-ঘোষিত সার্ব প্রেসিডেন্ট রাদাভান কারাদজিচ এবং তার সেনাপ্রধান জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। এই কুখ্যাত ‘ট্রয়কা’ ইউরোপের বুকে এক বিভীষিকাময় জাতিগত নির্মূল অভিযানে নেমেছিলেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের ইহুদী নিধনপর্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই তিনজনের লক্ষ্য ছিল বলকান এলাকাকে ‘মুসলমান মুক্ত কর’ এই এলাকা থেকে ওদের বিতাড়িত কর, প্রয়োজনে নির্মূল কর। মুসলিম নারীদের ধর্ষণ কর, ওদের গর্ভে বেশি বেশি করে সার্ব সন্তানের জন্ম দাও’-উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে এমন সব উদ্ভট, হটকারী, বিকৃত সব দর্শনে বিশাসী ছিলেন এই ‘ট্রয়কা’। এই বিশ্বাস নিয়েই জেনারেল ম্লাদিচ বলকান এলাকায় সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা-যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধে একতরফাভাবে বসনিয়ার লাখ লাখ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং বিশ লাখ নিরীহ মানুষ শরণার্থী হয়। সার্বসেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার বসনিয় নারী ও কিশোরী। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ক্রোয়েট বাহিনী বসনিয়ার আমিচি নামে একটি গ্রামে হামলা চালায়। বেছে বেছে ১১৬ জন মুসলিম পুরুষকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। সার্বরা মুসলমানদেরকে নিধনের জন্য ব্যাপকহারে আক্রমণ চালাতে থাকে। তারা লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার মুসলিম নারীদের ওপর মানবতাবিরোধী জঘন্য নির্যাতন চালায়। ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে সার্ব বাহিনী বসনিয়ার ৭৫% ভূমি দখল করে নেয়। ক্রোটদের দখলে চলে যায় ২০% ভূমি। রাজধানী সারাজেভোসহ মাত্র ৫% ভূমি মুসলমানদের দখলে থাকে। সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া বাহিনীর নির্মমতা মুসলমানদের সইতে হয়েছে টানা সাড়ে তিনটি বছর। তবে এই যুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে ‘সেব্রেনিসা গণহত্যা’ বা ‘জাতিগত শুদ্ধি’ অভিযানই ছিল সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়াবহ। এই গণহত্যাকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সেব্রেনিসা গণহত্যা
জাতিসংঘ বসনিয়া যুদ্ধ চলাকালে ১৯৯৩ সালে সেব্রেনিসা শহরটি ‘নিরাপদ’ শহর হিসেবে ঘোষণা করায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার আতংকিত মুসলমান জীবন রক্ষার জন্য সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। সার্বদের হামলার আশঙ্কা অাঁচ করতে পেরে সেখানকার মুসলমানরা ঐ শহর ও নিজেদের রক্ষার জন্য সশস্ত্র হতে চেয়েছিল কিন্তু জাতিসংঘের ডাচ শান্তিরক্ষীরা তাদের ঐ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাতকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী সেব্রেনিসায় অভিযান চালায়। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই সার্ব সেনারা বেলগ্রেডের তৎকালীন সরকারের সমর্থনে সেব্রেনিসা শহরটি দখল করে নেয়। রাতকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে দু’ হাজার সশস্ত্র সার্ব জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষিত সেব্রেনিসা শহরটিকে ঘিরে ফেলে। সেব্রেনিসা শহরে উপস্থিত হয়ে জেনারেল রাতকো স্লাদিচ দম্ভ করে বলেন, ‘আজ ১১ জুলাই, ১৯৯৫। আমরা সার্বিয়ার সেব্রেনিসায় আছি। মহান ছুটির দিনের পূর্বক্ষণেই আমরা সার্বিয় জাতিকে এই শহর উপহার দিচ্ছি। তুর্কীদের বিরুদ্ধে উত্থানকে স্মরণ করছি। সময় এসে গেছে মুসলিমদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেবার......’। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর পূর্বে ১১ জুলাই মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বক্ষণে কথাগুলো বলেছিল বসনিয়ার গণহত্যার নায়ক জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। এ সময় শহরটির নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মোতায়েন জাতিসংঘের ডাচ সেনারা নীরবে ঐ গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে। সার্ব বাহিনী সেখানে জাতিসংঘের ডাচ শান্তিরক্ষীদের সামনেই ৮ হাজার ৩৭২ জন বসনীয় পুরুষ ও যুবক মুসলমানকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। তারা সেখানকার প্রত্যেক কর্মক্ষম মুসলমান কিশোর ও যুবককে ট্রাকে করে তুলে নিয়ে পরে ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিছু লাশ গণকবর দেওয়া হয়। বাকিগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়। মানবতার বিরুদ্ধে এই জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয় বিশ্বাসঘাতক জাতিসংঘের নাকের ডগায়। মুসলমানদের প্রথমে শান্তির নামে ধোঁকাবাজি করে নিরস্ত্র করা হয় এবং তারপর তাদের উপর বর্বর সার্বিয় খ্রিস্টানদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। সার্ব বাহিনীর এই জঘন্যতম কর্মকান্ড আমাদেরকে ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল স্পেনের গ্রানাডায় ঘটে যাওয়া সেই লোমহর্ষক ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলার নির্দেশে মুসলমানদের শেষ আশ্রয়স্থল গ্রানাডার পবিত্র মসজিদে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার মুসলমান নারী, শিশুকে জীবন্ত দগ্ধীভূত করে হত্যা করা হয়। মুসলমানগণ যখন চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত তখন প্রতারক ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করে, ‘মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেওয়া হবে’। দুর্ভিক্ষতাড়িত গ্র্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও নিষ্পাপ বাচ্চাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খ্রিস্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে। শহরে প্রবেশ করে খ্রিস্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভিতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর একযোগে ঐতিহাসিক গ্রানাডা শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা। লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধীভূত হয়ে প্রাণ হারায় পবিত্র মসজিদের মধ্যে। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় গ্রানাডার আকাশ বাতাস যখন ভারী ও শোকাতুর, তখন ইসাবেলা ক্রুর হাসি হেসে বলতে থাকে, ‘হায় এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাসে কেউ বিশ্বাস করে’? রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও তাঁর স্ত্রী ইসাবেলার চক্রান্তে ইউরোপের একমাত্র সমৃদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র স্পেনের রাজধানী গ্রানাডায় ৭ লক্ষ মুসলিম নর-নারীকে সীমাহীন প্রতারণার মাধ্যমে মসজিদে ভরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। আটশ’ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইসলামী শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর এ বিয়োগান্ত ঘটনাকে স্মরণ করে খ্রিস্টান জগৎ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে ‘April fool’ মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসব হিসাবে। ঠিক একইভাবে ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই বলকান অঞ্চলকে মুসলিম শূন্য করার দীর্ঘমেয়াদী অপতৎপরতার অংশ হিসেবে ‘নিরাপদ’ শহরে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরীহ মুসলমানদের উপর চালানো হয় সেব্রেনিসা গণহত্যা।
বসনিয়ায় কত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে, কত সম্পদ ধ্বংস হয়েছে তা পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। তবে বিভিন্ন সূত্রে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা সভ্যতার কলংক ছাড়া আর কিছু নয়। লাখ লাখ নারী-শিশু নিহত হওয়া ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে চারশ বছরের পুরনো দু’টি মসজিদসহ আটশ’ মসজিদ। ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়েছে প্রায় ৬০ হাজার নারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিচালিত নাজী বাহিনীর বীভৎস নারী নির্যাতনের পর এ ধরনের ঘটনা বিরল। মানবতার খাতিরেই সার্ব বাহিনীর এই দানবীয় তান্ডব বন্ধ করা মনুষ্যত্বের দাবি ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিশ্ব মোড়লদের কার্যত নির্বিকারে সার্ব বাহিনী মরিয়া হয়ে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটে যায় সেব্রেনিসা গণহত্যা। রচিত হয় ইতিহাসের ন্যক্কারজনক কালো অধ্যায়।
স্বজন হারানো বসনিয়ার মুসলমানরা প্রতিবছর ১১ জুলাই স্মরণ করে থাকে। সেব্রেনিসার মাঠগুলোতে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত গণকবর। স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে এখনও সেব্রেনিসার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। তারা বলেন, আমরা কিভাবে ভুলব সেখানকার গাছে গাছে ঝুলন্ত মুসলমানদের মৃতদেহগুলোর কথা, আমাদের স্মৃতিতে দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে হাজার হাজার মুসলমান মহিলার অপমানের কাহিনী, আমরা এখনও ভুলিনি সেই অসহায় ভাইদের যাদের পশুর মত জবাই করা হয়েছিল...... ষোল বছর আগে সেব্রেনিসায় সার্ব বাহিনী যে ৮১০০ মুসলমানকে হত্যা করেছিল, বসনিয়ায় সেই গণহত্যার বার্ষিকীতে প্রত্যক্ষদর্শীরা এ কথাগুলো বলেন। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের অনেককেই দাফন করা হয় সেব্রেনিসার ‘পটচারি’ গোরস্থানে। আবার অনেকের লাশ যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছিল। হত্যাকান্ডের শিকারদের দাফন করা এখনও শেষ হয়নি, কারণ এখনও গণকবর পাওয়া যাচ্ছে। ২০১০ সালে শনাক্ত করা আরও ৭৭৫টি মৃতদেহ সম্প্রতি পটচারের গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা
আক্রমণকারী সার্বিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা জাতিসংঘের কার্যকারিতার প্রতি সন্দিহান করে তোলে দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষকে। বসনিয়া ৭০ ভাগ এলাকা জবরদখল করে যারা জাতিসংঘের প্রতি বৃ্দ্ধাংগুলি প্রদর্শন করে জাতিসংঘ তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বসনিয়ার সংখ্যাগুরু অধিবাসীদের জন্য ছয়টি শহরকে নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করে। শহরগুলো হলো-সারাজেভো, তুজলা, জেপা, গোরাজদে, বিহাক এবং সেব্রেনিসা। কিন্তু জাতিসংঘ ঘোষিত এই নিরাপদ শহরগুলোতেও সার্ব এবং ক্রোট বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠে।
মানবাধিকারের কথিত ধ্বজাধারী ইউরোপীয় সরকারসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীরবতা ও প্রকৃত অর্থে তাদের সহযোগিতার ফলে সার্বরা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষিত ‘নিরাপদ’ ঐ শহরটি দখল করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের মোতায়েন করা হয়েছিল ঐ শহরে। সেখানে মোতায়েন জাতিসংঘের সেনারা ছিল হল্যান্ডের নাগরিক। নীল টুপি পরা হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা সার্বদের হামলা ঠেকানোর জন্য হল্যান্ড সরকারের বা ন্যাটোর সহায়তা চাইতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে সেব্রেনিসা শহরটির নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে বর্ণবাদী সার্বদের হাতে ছেড়ে দেয়। হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা ঐ সময় মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্য বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রধান সার্বদের হাতে ঐ শহর দখলকে ‘যৌক্তিক পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ঐ কর্নেল ও তার অধীনস্থ সেনারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে ব্যাপক অভ্যর্থনা পান এবং তাদের পুরস্কারও দেওয়া হয়।
সেব্রেনিসা গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন ঐ গণহত্যা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য দায়ী ডাচ শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নিলেও হেগের আন্তর্জাতিক আদালত তা গ্রহণ করেনি। বসনিয়ার গণহত্যা শেষে সেখানকার জাতিগত শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সেব্রেনিসায় গণহত্যা ঠেকানোর ব্যাপারে হল্যান্ড সরকার ও জাতিসংঘের অবহেলার কথা স্বীকার করা হয়েছে।
সেব্রেনিসা গণহত্যার জন্য কেবল তৎকালীন হল্যান্ড সরকার ও জাতিসংঘ দায়ী ছিল না, মানবাধিকারের রক্ষক হওয়ার দাবিদার পাশ্চাত্যের প্রতিটি সরকার ও সংস্থা দায়ী। কারণ জেনে শুনেও গণহত্যার হুমকির সম্মুখীন নিরস্ত্র মুসলমানদের রক্ষার জন্য তারা বিন্দুমাত্র চেষ্টা চালায়নি, বরং উগ্র সার্বদেরকে গণহত্যা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। এই জন্যই হয়তো ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ বসনিয়ার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই আরোপের পেছনে কাজ করে রাশিয়া ও বৃটেনের সার্বদের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা। জাতিসংঘ কর্তৃক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বসনিয়ার মুসলিম সরকার বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে পারেনি। অপরদিকে যুদ্ধরত সার্ব বাহিনী পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাষ্ট্র সার্বিয়া থেকে অবাধে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র পায় এবং সেই অস্ত্র দিয়েই মুসলিম সৈন্যদেরকে প্রতিহত করে। অন্যদিকে ক্রোটরা অস্ত্র পায় পার্শ্ববর্তী ক্রোয়েশিয়া থেকে। সার্ব বাহিনী যখন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জি হয়ে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও সম্পদ বিনষ্ট পরিস্থিতি ভয়াবহরূপ ধারণ করে, ঠিক তখনই নিরাপত্তা পরিষদ বসনিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করা হয। কিন্তু বাস্তবে সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনীর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন বসনিয়ায় সার্বদের আগ্রাসন ও গণহত্যা ঠেকানোর জন্য কোন উদ্যোগ নেননি। বসনিয় মুসলমানদের রক্ষা করা ‘মার্কিন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট’ নয় বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। মার্কিন ইউ-টু গোয়েন্দা বিমানগুলো গণহত্যার ঘটনা দেখতে পেয়েও নীরব থেকেছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের সাবেক প্রধান ক্লারা ডেল পন্টির মুখপাত্র ফ্লোরেন্স হার্টম্যান ‘শান্তি ও শাস্তি’ শীর্ষক বইয়ে বসনিয়ার ট্রাজেডির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মার্কিনীরা বলকানে রহস্যজনক ও জটিল খেলা খেলে হেগের আদালতে মুসলমানদের হত্যাকারী সম্পর্কে ভুল তথ্য দিত এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ, র সাথে এ আদালতের দীর্ঘদিনের সহযোগিতার সম্পর্ক নিস্ফল হয়েছে।’ ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার সাবেক উপ-প্রধান উইলিয়াম এশটুবনার বলেছেন, ‘সেব্রেনিসার গণহত্যার নায়ক সার্ব জঙ্গী বা আধা সামরিক বাহিনীর প্রধান রাতকে ম্লাদিচের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা সত্ত্বেও বলকানের এই কসাই বসনিয়ায় মার্কিন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মুক্ত মানুষের মত বসবাস করত।’ তথাকথিত সভ্য ইউরোপের বুকে মানবতার বিরুদ্ধে এত বড় অপরাধ পাশ্চাত্যকে কলংকিত করেছে।
ডেটন চুক্তি ও যুদ্ধের সমাপ্তি
সেব্রেনিসা গণহত্যার পর টনক নড়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। তড়িঘড়ি দখলদার বাহিনীর উপর বিমান হামলা শুরু করে ন্যাটো। এরপরই পিছু হটতে শুরু করে দখলদার সার্বিয়রা। ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্যারিসে ‘ডেটন চুক্তি'তে সই করে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সার্বরা। দেশ ছেড়ে পালান বসনিয়ার কুখ্যাত সার্ব নেতা স্লাদোভান কারাদিচ। তখনই সার্ব কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য যুগোশ্লাভিয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে জাতিসংঘ। গণহত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ৪৬ সার্বনেতাকে অভিযু্ক্ত করেন এ আদালত। অভিযুক্ত নেতাদের মধ্যে এ যাবৎ সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লাদোভান মিলোসেভিস, স্ব-ঘোষিত বসনিয়ার সার্ব প্রেসিডেন্ট রাদাভান কারাদজিচ এবং সর্বশেষ গ্রেফতার হন সার্ব সেনাপ্রধান জেনারেল রাতকো স্লাদিচ।
আদালতে বলকানের কসাই
বসনিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হয়। এ লক্ষ্যে ১১ জন বিচারক শপথ করে আনুষ্ঠানিকভাবে। একজন প্রসিকিউটর ও আন্তর্জাতিক বিচারকদের একটি প্যানেলের সমন্বয়ে গঠিত এই আদালত নেদারল্যান্ডের দ্যা হেগ শহরে অবস্থান করে কাজ চালাবে। কিন্তু ‘বলকানের কসাই’ খ্যাত স্লোবোদান মিলোসেভিস সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন আরেক কসাই রাতকো ম্ললাদিচ। ২০০১ সালে মিলোসেভিসকে গ্রেফতার করে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৬ সালে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। ১৯৯৬ সালে আত্মগোপনে চলে যান সেব্রেনিসা গণহত্যার মোস্ট ওয়ান্টেড যুদ্ধাপরাধী রাতকো ম্লাদিচ । বসনিয়ার কসাই হিসেবে খ্যাত এই সাবেক সেনাপ্রধান দীর্ঘ ১৬ বছর আত্মগোপনে থাকার পর সম্প্রতি সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সার্বিয়াতেই পালিয়ে ছিলেন বলকানের তিন কসাই খ্যাতদের অন্যতম ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধী ৬৯ বছর বয়সী এই সার্ব জেনারেল রাতকো স্লাদিচ। রুমানিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা লাজারেভো গ্রাম থেকে ২৬ মে ২০১১ ভোরে স্লাদিচকে গ্রেফতার করে সার্ব নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রামটি বেলগ্রেড থেকে ৫০ মাইল উত্তরে। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থাকতেন তিনি। যদিও সার্বিয়া আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে এতদিন স্লাদিচের গ্রেফতারের জন্য লোক দেখানো ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু দেখা গেল জেনারেল ম্লাদিচ তাদেরই আশ্রয়ে এতদিন নিরাপদ জীবনযাপন করে এসেছেন। ২০০৮ সালে স্ব-ঘোষিত বসনিয় সার্ব প্রেসিডেন্ট যুদ্ধাপরাধী রাদোভান কারাদজিচ গ্রেফতার হওয়ার পর ম্লাদিচ বসনিয় যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। গ্রেফতারের পর সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস তাদিচ ঘটা করে সংবাদ মাধ্যমে জানালেন, ‘স্লাদিচকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সার্বিয়ার দায়মুক্ত হল। সমাপ্তি ঘটল দুঃখজনক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের’। ন্যাটোর প্রধান আন্ডারস রাসমুসেন গ্রেফতারের ঘটনায় প্রশংসা করে বলেছেন, ‘অবশেষে ন্যায় বিচারের সুযোগ এসেছে’। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল মন্তব্য করেছে, ‘১৫ বছরের বেশি সময় লেগে গেলেও যারা ভুক্তভোগী তাদের জন্য ন্যায় বিচারের আশা তৈরি হল। জেনারেল স্লাদিচ ছাড়া বাকি আসামীরা হলেন সার্বিয়ার সাবেক জেনারেল ভূজাদিন পোপোভিচ, ড্রাগো নিকোলিচ, লজুবিসা বেয়ারা, ভিনকো পান্ডুরেভিচ, রাদিভোজে মিলেটিচ, মিলান ভেরো এবং পুলিশ কর্মকর্তা লজুবমির বোরোভকানিন।
আদালতে ম্লাদিচের রিরুদ্ধে ওঠা ১৫টি অভিযোগের সবই হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত গণহত্যা দু’টি হল যুদ্ধ শুরুর দিকে প্রিজেদোর এলাকায় একটি নিরাপদ ক্যাম্পে দেড় হাজার মুসলমানকে হত্যা করা এবং ভয়াবহ সেব্রেনিসা গণহত্যা। এই গণহত্যার প্রধান আসামী রাতকো ম্লাদিচ আদালতে উচ্ছৃংখল ও হঠকারী আচরণ করেছেন। বিশেষ আদালতের ১৫ বছরের ইতিহাসে আর কখনও এমন নাটকীয় ঘটনা দৃশ্যমান হয়নি। বলকানের কসাই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন। বিচারক যখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনাচ্ছিলেন তখন ম্লাদিচ চিৎকার করে বলেন, ‘না, না আমি আমার উকিল ছাড়া এসব শুনব না’। এরপর ম্লাদিচ কান থেকে হেডফোন সরিয়ে নেন এবং এভাবে এটি বুঝিয়ে দেন যে, বিচার কার্যক্রমের ধারা বিবরণী অনুবাদ শোনার কোন ইচ্ছে তার নেই। যে ব্যক্তি একটি জাতিকে দ্বিখন্ডিত করেছে, গণহত্যা, জোর খাটিয়ে বহিষ্কার, ত্রাস সৃষ্টি, অপহরণ ও অমানবিক তৎপরতার মত নানা অপরাধের হোতা, এই কসাই কিভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড়িয়ে এমন হঠকারী আচরণ করল তা আমাদের বোধগম্য নয়। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এ প্রত্যাশাই বিশ্বের শান্তিকামী জনতার।
উপসংহার
সেব্রেনিসা গণহত্যা বসনিয়া গণহত্যাগুলোর একটি অংশ মাত্র। সাবেক যুগোশ্লোভিয়া ভেঙ্গে অনেক দেশই স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া ও ম্যাসিডোনিয়ার বিপরীতে কেবল বসনিয়াতেই মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই বসনিয়া পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী নীতির শিকার হয়। পাশ্চাত্য ইউরোপের বুকে একটি মুসলিম দেশের আবির্ভাব সহ্য করতে মোটেই প্রস্ত্তত ছিল না। তাইতো, সেব্রেনিসা ‘নিরাপদ’ শহরটিকে যখন রাতকো স্লাদিচের নেতৃত্বে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হয় তখন সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের ডাচ সেনারা নীরবে গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে। আসলে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধ তদন্ত আদালত সত্যিই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও বসনিয়ার গণহত্যার মূল হোতাদের শাস্তি দিতে চায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যদি এই আদালত ন্যায়বিচার চায় তাহলে ইউরোপের যেসব সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের অবহেলা বা নিষ্ক্রিয়তার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐ ভয়াবহ গণহত্যার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তাদেরকেও শাস্তি দিতে হবে। কারণ তারাও ছিল ঐ মহা অপরাধের সহযোগী বা শরীক। ইউরোপ ও মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায় ডেটনচুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার যু্দ্ধ শেষ হলেও এখনও সেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্য ও নতুন নতুন ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।
ড. মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, বারিধারা ক্যাম্পাস, ঢাকা